বিপন্ন মানবতাঃ দেশে বিদেশে
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২২ জুন, ২০১৯, ১১:৪০:২৯ রাত
হোমলেস শেল্টার বা গৃহহীনদের আশ্রয়। শব্দটা পরিচিত অনেকের কাছেই, কিন্তু এর বিষয়ে বিস্তারিত জানা আছে অল্প কিছু লোকের। ঘটনা খুলে বলি!
ধরা যাক তার নাম মাইকেল, মাইক বলে ডাকে সবাই। নিম্নবিত্তদের পাড়ায় জন্ম, বন্ধুরাও তেমনি। তাদের পাল্লায় পড়েই ১৮ বছরে পা দেয়ার আগেই এলকোহলে আসক্ত হয় সে। পয়সার অভাব তীব্র হয়, আবারও তাদের বুদ্ধিতেই একটা কর্নার স্টোরে ঢুকে পয়সা দাবী করে সে। তার বিশালবপু দেখে ভয়েই টাকা দিয়ে দেয় ক্যাশিয়ার, কিন্তু এরপর ফোনে বলে দেয় পুলিশকে। তার আকৃতির কারনেই সহজে ধরা পরে সে। ডাকাতি সিরিয়াস ক্রাইম। জুভেনাইল তথা অপ্রাপ্তবয়স্কদের কারাগারে ঠাই হয় তার। একবার জেল খেটে বের হয়ে এলে রেকর্ড খারাপ হয়ে যায়, বার বার ঢুকতেই থাকে। হাইস্কুল শেষ হয়নি, রেকর্ডের কারনে চাকুরী বাকুরিও হয়নি, ট্রাকের ড্রাইভার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছে, কন্সট্রাকশনে কিছুদিন! স্রোতের শেওলার মত এদিক সেদিক ভেসে বেড়িয়ে এখানে জায়গা পেয়েছে।
এখানে বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বেশী; কেবল দুয়েকজন আছে মাইকের মত। কিছু বয়স্কা মহিলাও থাকে এখানে। বাড়ি ঘর নেই, কোন আত্মীয়জন ও নেই তাদের, আর স্বাধীন জীবন যাপন করার মত কর্মক্ষমতা বা মানসিক দৃঢ়তাও নেই হয়তো। অথবা মানসিক অসুস্থতা! কারন যাই হোক – এটাই আশ্রয় এখন।
ঈদের দিন। বছরের দুই ঈদে গির্জার শেল্টারে আশ্রিতদের এক বেলা খাবার দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ক’বছর হল ! গির্জা কর্তৃপক্ষ আমাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে! ওদের পশ্চিমা খাবারের তুলনায় ঈদের দিনে প্রস্তুত আমাদের বিশেষ খাবার- তারা খুব আগ্রহ নিয়ে খায়। ক্ষুধার্ত মানুষকে আগ্রহ নিয়ে খেতে দেখলে আমাদেরও ভাল লাগে।
বুফে স্টাইল। টেবিলে খাবার সাজানো থাকবে । তবে সময় বাঁচাতে, খাবার তুলে দেয়া হবে তাদের প্লেটে, খাওয়ার আগে সবাইকে লাইনে দাঁড়াতে বলল- শেল্টারের কেয়ার টেকার। তাদের খাবার দাবারের দেখাশুনা এই লোকের দায়িত্বে। খাবার এর আগে প্রার্থনা গির্জার নিয়মের মধ্যেই, তবে এখানে চালু নেই মনে হয়। এদের শৃঙ্খলায় রাখা খুব সহজ কাজও নয়।
ওয়াজ কুরফিল কিতাবি মারিয়ামা ইযিন তাবাযাত মিন আহলিহা মাকানান শারকিয়া- And mention, [O Muhammad], in the Book [the story of] Mary, when she withdrew from her family to a place toward the east.
১৫-১৬ বছরের তরুণ। হাফিজ- ফায়েজ । বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ক্যানাডিয়ান। তার সুললিত কন্ঠ ধ্বনিত হচ্ছে- সেন্টক্লিয়ার এভিনিউ এর গির্জার বড় একটা কক্ষে। কুরআন তিলাওয়াত এদের কাছে কেমন আবেদন রাখে তা লক্ষ্য করার বিষয়। ইচ্ছে করেই সূরা মরিয়ম বেছে নেয়া । মা মেরি আর যিশুর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে সুরা মরিয়ম এ (১৬-২২ আয়াত)। পবিত্র কুরআনে যীশুর বর্ণনা এখানে মূখ্য বিষয়। ৫০-৬০ জন সাদা কাল বাদামী মানুষ – মনযোগ দিয়ে শুনছে। এদের অনেকেই ইসলাম ধর্মের নাম শুনলেও কুরআন তিলাওয়াত কখনও শোনেনি। তিলাওয়াত শেষ হল। নৈশব্দ ভর করল। আমাদের কাজী ভাই, কাজী হাফিজুল ইসলাম, টরন্টোর ষ্ট্রীট – দাওয়ায় নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম, সে আয়াত গুলোর ইংরেজি অনুবাদ পড়লেন।
এরপর সূরা ইমরান (৪২-৫০ আয়াত); কাজী ভাই অনুবাদ পড়া শেষ করলেন। রোজার উদ্দেশ্য এবং তাৎপর্য নিয়ে কিছু কথা বললেন। আমাকে কিছু বলার জন্য বললেন, কিন্তু খাবার আগে দীর্ঘ সময় নিলে - তা বিরক্তির কারন হতে পারে জন্য, এড়িয়ে গেলাম। পরিবেশনে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম।
বক্তৃতায় একটু সময় লাগছে। সবাই শুনছে, এর মধ্যে একজন ক্ষেপে উঠল। খাবার দিচ্ছ দাও- এত কথা কেন! কিছু নোংরা শব্দে গালাগাল দিতে দিতে সে বের হয়ে গেল। জমায়েতের অনেকেই তাকে চুপ থাকতে বলল, তার এ আচরণে ক্ষুব্ধ হল তারাও। যেতে দাও ওকে, কেয়ার টেকার বলল। অহংকারী সাদাদের একজন! আমাদেরও একটু খারাপ লাগল। ভুল হয়ে গেছে পরিকল্পনায়। খাবার টেবিলে নিয়ে আসার আগে – বক্তৃতা পর্ব শেষ হলে ভাল হত।
খাবার সাজানো হয়ে গেছে টেবিলে। সাজানো প্লেট চামচ কাটলারি! খাবার সার্ভ করা হল, সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে শৃঙ্খলার সাথে খাবার নিয়ে গিয়ে টেবিলে বসল। অনেকেই মিষ্টি খায়না, এমনকি কেকও! দুই ধরণের কেক ছিল, ভ্যানিলা এবং চকোলেট! অধিকাংশের পছন্দ চকোলেট কেক। অঢেল খাবার, যাদের দরকার এসে নিয়ে যাবে- বলে দেয়া হয়েছে।
এলো অনেকেই। অনেকে আবার এলোই না। কয়েকজন আরও এক পিস কেক বা এক পিস তরমুজ কিম্বা চিকেন চাইল। তাদের প্লেটে পৌঁছে দেয়া হল। খুব তৃপ্তির সাথে খেলো তারা। তাদেরকে তৃপ্তি দেখে আমরাও তৃপ্ত হলাম। আরও লোকজন আসতে থাকল, তাদেরকেও খাবার দেয়া হল। ওপেন হাউস।
এক রং চঙ মাখা কালারফুল সাদা মহিলাকে দেখা গেল দরজায়। সে ভেতরে একটা উঁকি দিয়েই ফিরে যাচ্ছিল। আমাদের লোকজন উদাত্ত আহ্বান জানাল, কিন্তু সে সৌজন্য সহকারেই প্রত্যাখ্যান করল। শেলটার এর আরেক চরিত্র। আমরা খাবার রেখে যাব, ‘রাতে এলেও খাবার রাখা থাকবে তোমাদের জন্য’; জানিয়ে দিলাম।
কাজী ভাই জানালেন, চিকেন শেষ হয়েছে! ফিরে এলাম রান্না ঘরে। আরেক ট্রে চিকেন নিয়ে ফিরে গেলাম। এরপর রাইস! যখন ফিরে এলাম দেখলাম মাইক – সাথে আরও ২-৩ জন, খাবার শেষ করে চলে গেল।
আস্তে আস্তে লোকজন চলে যেতে থাকল। খোশগল্প করল দুয়েকজন। তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়া হল। থিতিয়ে এলো ভিড়। টেবিল চেয়ার পরিষ্কার করে রেখে যেতে হবে, সেদিকে মনযোগ দিতে শুরু করলাম; টেবিলে পরে থাকা খাবার টিস্যু পেপার দিয়ে মূছে পরিষ্কার করছি; বেঁচে যাওয়া খাবার রান্না ঘরে শিফট করছি, যারা রাতে আসবে তারা যেন খেতে পায়।
রান্না ঘর থেকে আবার খাবার ঘরে এসেছি, দরজার দিকে চোখ গেল। একটা হুডি পরে মাথা হুড দিয়ে ঢেকে ফিরে এসেছে মাইক। উৎসুক হলাম! কি ঘটনা!
কিছু বলবে?
এক চামচ রাইস আর একটু গ্রেভী হবে? চিকেন দরকার নেই। শুধু রাইস আর গ্রেভি! প্লিজ।
শুধু গ্রেভি কেন? চিকেন এবং আর যা যা চাও সবই দেয়া হবে । এসো আমার সাথে! তুমি ক্ষুধার্ত – এটা আগে বলনি কেন? সে দ্রুত খেয়ে চলে গেছে, মনে পড়ল। আমি রান্না ঘরের দিকে এগুতে থাকি। মাইক আসছে পেছন পেছন।
কেয়ার টেকারের দিকে তাকিয়ে সে কি বুঝল কে জানে; আস্তে করে আমার পেছন থেকে এক পাশে সরে গেল। আমি একটা বড় প্লেটে তার জন্য খাবার দিতে শুরু করলাম। বোধ হয় কেয়ার টেকার এর রক্ত চক্ষু দেখে সেখানেই থমকে গেল মাইক। আমি যেই খাবার হাতে এগুতে যাব, কেয়ার টেকার আমাকে শুনিয়েই মাইককে জিজ্ঞেস করল, তুমি তো খেয়ে গেল এখনই, নয়?
সে মাথা দোলাল! হ্যাঁ!
এখন আর কোন খাবার দেয়া হবেনা! ৯টার পরে স্ন্যাক দেয়া হবে, তখন খেতে পারবে! এখন যাও।
আমার হাতে ধরা প্লেট এর দিকে তাকিয়ে কেয়ার টেকার বললঃ আমাদের শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলতে হয়। নাহলে বিরাট সমস্যা! এখানে যারা থাকে, তাদের অনেকেরই মানসিক সমস্যা, অনেকের শারীরিক । নিয়ম ভাংগলে অনেক যন্ত্রনা! তোমাদের তো একদিনের মামলা, শেষ করে চলে যাবে, যন্ত্রণা সামলাতে হবে আমাকে!
বলতে চাইছিলাম, তুমি তো আর নিয়ম ভাঙ্গছ না, আমি নিয়ম ভাঙ্গলে সমস্যা কি! আমি তো তোমাদের শেলটারের কেউ নই। বললাম না। আমাদের প্রোগ্রামটা চালু রাখতে চাইলে তার সহযোগীতা দরকার। একদিক থেকে চুপ থাকাই ভাল মনে হল। অপরদিকে, নিজেদের আনা খাবার একজন বুভুক্ষুকে দিতে পারব না, এ ভাবনা আমাকে পীড়া দিল। খাবার ওকে দিতেই হবে, সিদ্ধান্ত নিলাম। কেয়ার টেকারকে বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু চোখ তুলে মাইককে দেখতে পেলাম না।
কেয়ার টেকারের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিলাম, বেচারা মাইক ততক্ষনে চলে গেছে । এখন আর কার জন্য লড়াই করব!
আমরা প্রায় ১০০ জনের খাবার এনেছি সত্য, তবে তা দিয়ে আরও অতিরিক্ত ২৫-৩০ জন খেতে পারবে। যথেষ্ট খাবার বেঁচে গেছে, কেয়ার টেকারকে খুব খুশী মনে হল সেজন্য! সে এবং তার সাথের মহিলা এসিস্ট্যান্টকে খেতে বললাম, তারা খুব আনন্দের সাথে খেতে বসে গেল। যে খাবার বেঁচে গেছে সেগুলো আবার ঢেকে ঢুকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে গেলাম। বলে গেলাম যারাই আসে – ক্ষুধার্ত সকল আশ্রিতকে যেন খাবার দেয়া হয়। কিহবে তা বুঝতে পারছি না, তবে আমাদের করনীয় যা সব কিছুই করে যাচ্ছি।
মাইকের হতাশ মুখটা মনে পড়ল। সাথে সাথে মনে পড়ল ছোট বেলায় পড়া কবিতার ক’টি চরন।
কালকে ম’জিদে শিন্নী আছিল অঢেল গোস্ত রুটি,
বাঁচিয়া গিয়াছে! মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি!
মোল্লা সাহেবরা গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে, গায়ের রং বা ধর্ম হয়তো আলাদা, চরিত্র সেই একই- আদিম!
বিষয়: বিবিধ
৮৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন