বাঙ্গালী হয় পূজা করবে – নয়তো খুন!
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ১০ মার্চ, ২০১৮, ১০:১৭:৫৫ রাত
ডঃ হুমায়ুন আজাদ এর প্রবচন গুচ্ছে তার এক প্রবচন ছিল এমনঃ
“বাঙ্গালী হয় ‘পূজা করবে, না হয় খুন করবে” – এর মাঝামাঝি কোন রাস্তা বাঙ্গালীর নেই!
এই যে চরমপন্থা – এটা যেন আমাদের মনের উপরে আগুনে পুড়িয়ে ছাপ দিয়ে দেয়া হয়েছে! আমাদের ৪৭ বছরের রাষ্ট্রীয় ইতিহাস প্রমান করে জাতি হিসেবে আমরা চরমপন্থী, সহনশীলতা – সুস্থ বিবেচনাবোধ আমাদের নেই ! আমরা মানুষকে দোষে গুণে মিলিয়ে বিবেচনা করতে শিখিনি! রাষ্ট্রনায়ক – থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা পর্যন্ত –সবাই ‘আবেগের সপ্তম স্বরে উঠে আছি!
ডঃ হু. আযাদের যে সত্যদর্শন হয়েছিল, তা আমরা না চাইলেও স্বীকার করে নিতে হবে! এক জাতীয় নেতার কথা জানি! ’৭১ এ তাঁর অবদানের জন্য চরম মর্যাদায় অধিষ্টিত সেই রাষ্ট্র নায়ক ‘৭৪এর মধ্যে ‘খল নায়কে পরিণত হন, চরম গনধিকৃত হন এবং তাঁর বিরুদ্ধে গন- অসন্তোষ এতটাই তীব্র হয়ে উঠে যে, এরই ফলশ্রুতিতে তিনি ’৭৫ এ সপরিবারে নিহত হন। সে সময়ে তার জন্য দুফোটা চোখের জল ফেলে, এমন কেউ ছিল না দেশে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তার অপমৃত্যুতে অনেক মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। ’৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সময়ে গ্রামে গ্রামে দরিদ্র দুস্থ মানুষদের যে ময়দার ঘণ্ট ত্রান হিসেবে দেয়া হচ্ছিল সেখানেও দুর্নীতি! ইউনিয়ন পঞ্চায়েত বা তাঁর লোকজনেরা ময়দা চুরি করত আর নামমাত্র ময়দা পানিতে সেদ্ধ করে পাতলা ডালের মত এই বস্তু মানুষের পাতে পাতে ঢেলে দিত! এই ‘অখাদ্য নিতেও লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হত ঘণ্টার পর ঘণ্টা, অনেক সময় লাইনের শেষ দিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো পর্যন্ত তা পৌঁছাত না, সারাদিন দাঁড়িয়ে থেকে আশাহত ক্ষুধার্ত মানুষ গুলো, শেখ মুজিবের নামে গালাগাল আর ক্ষোভ প্রকাশ করতে করতে ফিরে যেত! এ সময়ে এক ভিখারীকে বলতে শুনেছিলাম – শেখ মুজিব মরে না! সমস্যা হল, এই চোরদের কোন বিচার হত না, তারাই সমাজের হর্তা কর্তা, দলের মাথা! অবিচার, অনাচার, দুর্নীতি- খুন – ধর্ষণ- ব্যাংক লুট- এমন কোন অপকর্ম নেই – যা সেসময়ে হচ্ছিল না, এবং আরও কষ্টের কথা- অত্যাচারী জালিমদের কোন বিচার হওয়ার উপায় ছিল না! নিরন্ন মানুষ যখন ক্ষুধায় মরছে- শেখ কামালের বিয়ে হচ্ছে বহুত ধুমধামের সঙ্গে, মাথায় মুকুট পড়িয়ে ‘রাজ পরিবারে বধু বরন হচ্ছে, মুখে পাইপ নিয়ে রাষ্ট্র নায়ক এখন রাজাধিরাজের ভূমিকায় ! সুবিধা বঞ্চিত মানুষ গুলো দেশের চরম দুঃসময়ে সে রাষ্ট্রনায়কের এমন আচরণ মেনে নিতে পারেনি! আর তার সপরিবারে মৃত্যুতে এজন্যই কোন দুঃখবোধ বা শোকের প্রকাশ ছিল না! দেশ স্বাধীন করার সময়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ এমন এক জন রাষ্ট্র নায়কের এমন অপমৃত্যু মেনে নেয়া যায় না, কিন্তু সেটাই ঘটেছিল এবং দেশের মানুষ – সংখ্যা গরিষ্ট মানুষ সে সময়ে সেটা সহজ ভাবেই নিয়েছিল!
তার দুই মেয়ে দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যায়; বাঘা সিদ্দিকি একমাত্র ব্যাক্তি যিনি এই গন- খুনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দেশ ছাড়া হন। এগুলো বিদেশীদের হস্তক্ষেপে হয় নাই, বাঙ্গালীরাই করেছে!
মাত্র কয়েক দশকের ব্যাবধানে আবার সেই নায়ক- থেকে খল নায়কের পুনরুত্থান হল, সে ব্যাক্তিকে আক্ষরিক অর্থে ‘পূজা করা হচ্ছে, এই বাঙ্গালীরাই তা করছে। তাকে জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আইন করা হয়েছে, তার অবমাননা করা করলে ‘শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে! বাধ্য করা হয়েছে মানুষকে! সম্মান, শ্রদ্ধা এটা কি বাধ্য করে পাওয়ার জিনিষ!!
প্রমান হল, ডঃ হু. আযাদ সত্য লিখেছেন! খুন অথবা পূজা!
গত কয়েকদিন ধরে ডঃ জাফর ইকবালকে নিয়ে বেশ লেখালেখি হচ্ছে! তাকে কেউ ছুরি মেরেছে- হতে পারে ব্যাক্তিগত আক্রোশ- কিম্বা দলগত, কিম্বা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা- আমরা সঠিক জানিনা । দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ’৭৪ এর মত না হলেও অনেকটা মিল আছে; কেবল ‘ধরন আলাদা! ব্যাংক লুট হচ্ছে, কিন্তু আরও উচ্চতর কৌশলে, পুকুর চুরি, কিন্তু চোরেরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে! পুলিশ ‘উন্মুক্তভাবে চাঁদাবাজি করছে, কে কার বিচার করে! লাখ লাখ টাকার মালিক বনে যাচ্ছে ছাত্র নামধারী গুন্ড পাণ্ডারা- ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায়, খুনের আসামী বিশেষ ক্ষমা পেয়ে বেরিয়ে আসছে জেল থেকে এবং বেরিয়ে এসে আবার খুন করছে; বিচারের অস্তিত্ব নেই! ‘৭২ পরবর্তী ঘটনার সাথে মিলে যায়!ছাত্ররা শিক্ষকদের হেনস্থা করছে- নকল করতে বাধা দিয়েছে – এজন্য; ’৭২ এ এমন হয়েছিল! দেশে প্রায় এক দলীয় শাসন ব্যাবস্থা কায়েম হয়ে গেছে, বাকশালের সময়ে যেমন হয়েছিল, সত্য প্রকাশের বাক-স্বাধীনতা ‘বন্দী হয়ে গেছে, কেউ তাদের মনের কথা ‘মুক্ত ভাবে প্রকাশ করতে সাহস পান না-! স্বাধীনতা অনেক দূর কি বাত! সরকারী সন্ত্রাসের মুখে ‘নিরপেক্ষ সাংবাদিকরা দেশ ছেড়েছে – না হয় মিথ্যা মামলায় বন্দী অথবা সাজা ভোগ করছে! সরকারে নানা দমনমুলক ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে মাস মিডিয়াতে কিছু লিখতেও মানুষ ভয় পায়, পরে না আবার ঝামেলায় পড়তে হয়!
এই যখন অবস্থা-এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ জাফর ইকবালের জীবনের প্রতি হুমকি খুব অস্বাভাবিক নয়, অর্থাৎ এমন ঘটনা এই প্রথম কিম্বা শেষ নয়! একে তো তিনি বিখ্যাত লেখক, ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের ভাই, তদুপরি তিনি নিজেও বেশ জনপ্রিয়- শিক্ষক, লেখক, কলামিস্ট হিসেবে! বিজ্ঞানী হিসেবে যতটা, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা বোধ লেখক হিসেবে! তবে ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি করার যথেষ্ট প্রমান রয়েছে তার বিরুদ্ধে, এজন্যই সব সময় মিডিয়ায় তার চিত্রায়ন বেশ আলোকিত! অদ্যাবধি বেশ প্রভাবশালী হিসেবেই জীবন উপভোগ করে আসছিলেন! তাকে ছুরি নিয়ে হামলা করেছে কে একজন, তিনি আহত হয়েছেন! তিনি আবার নাকি বলেছেন- তোমরা ওকে (আক্রমন কারীকে) মেরো না! প্রায় প্রোফেটিক আচরণ! এ ঘটনার পরে হয়তো একারনেই তাকে এক শ্রেণীর মানুষ তাকে এমন ভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন –তার অবস্থান ‘ফেরেশতাদের থেকে একটু উপরে’!
আবার আরেক শ্রেণী রয়েছে, যারা তার ভক্ত তো নয়ই – বরং দেশের বিভাজিত রাজনৈতিক অঙ্গনের সক্রিয় খেলোয়াড় হিসেবে দেখে তাকে, দেশ জুড়ে এই বিভাজনে তারও ভূমিকা রয়েছে প্রচুর! তার কিছু আচরণই ঠিক বাঙ্গালী সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না! তার পেকে সাদা হয়ে যাওয়া ঝাঁটা গোঁফ – ৩১ ডিসেম্বরের রাতে তরুণ তরুণীদের সাথে নাচা- গানার দৃশ্যে বেশ দৃশ্যমান হয়েছে- মিডিয়াতেও এসেছে সে ছবি! সুন্দরী তরুণীদের সাথে এ বয়সেও তার এমন মাখামাখি অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটূ; তাকে লম্পট বলে উল্লেখ করছে কেউ কেউ! তিনি নাকি নাস্তিক?- আল্লাহর অস্তিত্ব নেই- এমন কথা উচু গলায় বলে- দেশের ধর্মভীরু লোকজনকে রুষ্ট করেছেন, সচেতন ভাবেই! এদিকে তরুণীদের যৌন- হয়রানির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে- যদিও অফিশিয়াল অভিযোগ নয়, জনশ্রুতি! আর এই লোকজন যেন তার অবস্থান শয়তানের থেকে আর এক ধাপ নীচে! একদিকে লম্পট শয়তান- অন্যদিকে ফেরেশতা তূল্য-দেবতা! আপনি কোনটা গ্রহণ করবেন তা নির্ভর করে আপনি -পোলারাইজড রাজনৈতিক মানচিত্রের কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন তার উপরে! তবে ডঃ হু. আজাদের প্রবচন অনুসারে, বেশির ভাগই হয় পূজা করার পর্যায়ে কিম্বা খুনের পর্যায়ে! দুটোই চরমে!
একজন মানুষ, দোষে গুনে মিলে মানুষ! দুটো দিক পর্যালোচনা করে একজন মানুষের ভাল গুন গুলো যদি বেশি হয়, তবে তিনি আমাদের বিবেচনায় উত্তম ! একজন লোক আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করলেই কি - না করলেই কি! আল্লাহর অস্তিত্ব তাতে হুমকির মুখে পড়বে না! আগেও এমন আরও অনেক মহারথী – তা বলে গেছেন, লাখো মানুষের কাছে তাতে আল্লাহর অস্তিত্ব ‘অপ্রমানিত হয় নি! ডঃ জাফর ইকবালের চাইতে অনেক বেশি জ্ঞানী গুণীও আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেছেন এবং এখনো করছেন! এই অপরাধে তাকে ছুরি মারতে হবে? এমন অধিকার কি আল্লাহ কাউকে ‘ইজারা দিয়েছেন? মৃত্যুর পরের জগতে যারা বিশ্বাস করেন, তারা জানেন- সেখানে সকল অপকর্মের জবাবদিহিতা থাকবে, চুল-চেরা বিচার ব্যাবস্থা থাকবে! শেষ বিচারে আমার নিজের কি রায় হবে আমার জানা নেই, বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের মধ্যে জাফর ইকবালের মত একজনকে নিয়ে আমাদের মাথা শিরঃপীড়া কেন? আমি কি পারফেক্ট? নিজের হাতের মুঠো চোখের সামনে ধরলে হিমালয় পর্বতও আর চোখে পরে না! কেউ আল্লাহকে স্বীকার করে না তার বিচারের ভার তো আমার নয়! আমি ঈমানদার হয়ে যে সকল কাজ কর্ম করছি, তার সবগুলোই কি বিধি সম্মত? ইসলামের প্রতিটি ধাপে আমি কি পারফেক্ট? আমার ব্যাবহারে কেউ কষ্ট পাচ্ছে কি না তা কি বিচার করতে পারছি? আমার বাবা মা ভাইবোনের প্রতি দায়িত্ব পালনে, আমার স্ত্রী, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমি কি পারফেক্ট? আমার পরিবার -ভাই বোন-রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় স্বজন, তারা কি পরিপূর্ন ইসলাম পালন করছে? সারা দিনের শেষে – বিছানায় শুয়ে হিসেব করে দেখুন, তাহলে আর কেউ নাস্তিক হলেই তাকে ছুরি নিয়ে আক্রমন করতে যাবেন না!
আর জাতি হিসেবে আমরা যে এখনো নাদান তা এই সব ‘চিত্রায়ন দেখে মনে হয়! মানুষ যেমন ফেরেশতা হয় না, তেমনি শয়তানও নয়, অনেক খারাপ মানুষেরও ভাল কিছু গুণ থাকে! আমরা এই দোষে গুনে মিলিয়ে কবে একজন মানুষকে বিবেচনা করতে শিখব? আবেগের ম্যাচিউরিটি আসতে আরও কত বছর দরকার?
এখন পর্যন্ত সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি ! আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যে দেশটার কোন পরিচয় নেই- ছাগলের পাঁঠার মত আমরা আপোষে লড়াই করতে থাকব আর কত দিন! একটা জাতির ইন্টেলেকচুয়াল অংশটা সাধারণত রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করেনা! বাংলাদেশ বোধ হয় সেদিক থেকে ব্যাতিক্রম ! দেশের প্রায় সকল মানুষ- ইন্টেলেকচুয়াল হোক আর রিকশাওয়ালা হোক- সবাই বিভক্ত- এবং দলের লেজুড়বৃত্তি করে একটা না একটা দলের সমর্থক! ভুল হল – অন্ধ সমর্থক! দেশের কি হল এতে আমাদের যায় আসে না, আমরা দলের পূজায় সর্বস্ব নিবেদন করেছি! এর নাম আর যাই হোক, দেশপ্রেম নয়! আর এমন ‘দল-প্রেমিকদের কারনেই হয়তো বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ হয়েও – বিশ্ব দরবারে ভিখারির চাইতে বড় কোন স্ট্যাটাস ৪৭ বছরে পেল না!
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৬ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন