বাবুরের চোখে বাঙ্গালা মুলুকঃ
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১১:৪১:৪২ রাত
নিজের চেহারা নিজে দেখা যায় না; আয়নার সাহায্য লাগে! তেমনি অনেক সময় নিজের দেশকেও বিদেশীর চোখে দেখলে এক ধরনের দিব্যদর্শন হয়। আমাদের দেশকে বিদেশীরা কি চোখে দ্যাখে, দেশের মানুষকে এমন কি পশু পাখী ফল মূলকে কি ভাবে বিচার করে, সে সম্বন্ধে কিছুটা ভিন্ন ধারনা পাওয়া যায়!
১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদীর সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে তৈমূর বংশীয় রাজপুত্র জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবুর হিন্দুস্তান জয় করেছিলেন। শৈশবে পিতৃহারা হলেও তার পড়ালেখা, জ্ঞান বিজ্ঞান- শিল্প-কলার প্রতি অনুরাগ ইতিহাস তাঁকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে! তাঁর হাতে ভারত বিজিত না হলে-তাঁর উত্তর পুরুষদের হাতে ভারতে তাজমহল তৈরি হত না, ভারতের ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হত।
তিনি ভারতে এসে শুধু ভারতের বিভিন্ন বিষয়, কৃষি, সেচ, নদনদী, গাছপালা, পশু, পাখি, ফল, মূল, তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন এলাকা ও সেখানকার মানুষদের আচরণ- বৈশিষ্ট চমৎকার ভাবে বর্ননা করে গেছেন। গঙ্গাকে তিনি লিখেছেন ‘গাংগ ! নদীকে এখনো চলতি বাংলায় অনেকেই গাংগ বলেন!
ভারতের হাতি নিয়ে তৈমূরের যেমন বিস্ময় ছিল, বাবুরও ব্যাতিক্রম নন! তিনি ‘কালপি’র পশ্চিমা সীমান্তের জঙ্গলে হাতির আবাস বলেছেন! কাররাহ আর মানিক পূরে হাতি ধরা আর পোষ মানানো ব্যাতিত ৩০ /৪০ টা গ্রামে আর কোন কাজ হয় না! বলেছেন, হাতী মানুষের ‘কথা খুব বোঝে, অনুগত হয়, এদের সহজে প্রশিক্ষিত করা যায় ! আকারে যত বড়, তত দাম বেশী! এদের পাকস্থলী বৃহৎ, দুই উটের বোঝা পরিমাণ ভুট্টা খেতে পারে একটা হাতি, তিনি লিখে গেছেন।
আম সম্বন্ধে লিখেছেনঃ হিন্দুস্থানের এক অদ্ভুত ফল এই আম, তারা উচ্চারণ করে স্বরবর্ন ছাড়াই – ‘অম্ব- (সংস্কৃত; নাকি আম্বাহ-) ! উচ্চারণ একটু জটিল, কেউ কেউ এই ফলকে বলে ‘নাগজাক’(আমকে নাগজাক বলা হয়, এই প্রথম শুনলাম!)- যেমন খাজা খসরু বলেনঃ
নাগজাক-ই মা- (জাত- খাস) নাগজ কুন-ই বুস্তান,
নাগজতারিন মেওয়া ( নে’মাত বা নিয়ামাত) –ই হিন্দুস্তান’!
আরও লিখেছেন, আম যখন ভাল, তখন খুবই ভাল; কিন্তু যত খাওয়া হয় তার অল্প কিছু প্রথম শ্রেণীর! সাধারণত এদেরকে কাঁচা আহরণ করা হয়, ঘরে পাকানো হয়। কাঁচাফল দিয়ে চমৎকার ‘টক বানানো যায়; সিরাপে সুন্দর সংরক্ষণ করা যায় (বাবুরকে মধুর মধ্যে সংরক্ষিত ‘আম পাঠিয়েছিলেন দৌলৎ খান ইউসুফ খলিল লোদি, ৯২৯ হিজরিতে)। তবে আম নিয়ে উপসংহারে তার সিদ্ধান্ত কিন্তু এখনো বলবত; “সব কিছু মিলিয়ে আম, হিন্দুস্থানের ফল গুলোর মধ্যে সব চাইতে উত্তম ফল’। কেউ কেউ পৃথিবীর সকল ফলের মধ্যে আমকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন, কেবল মাস্ক মেলন এর পরে”! এরপর তিনি নিজে দেশের পিচ এর সাথে তুলনা করেছেন আমের! “দুই ভাবে এটা খাওয়া হয়ঃ টিপে নরম করে, একটা ফুটা করে রস চুষে খাওয়া; কিম্বা পিচ এর মত ছুলে, কেটে খাওয়া”! “এর বৃক্ষ বিশাল, পাতা কিছুটা পিচ এর মত! গাছের কান্ড দেখতে সুন্দর নয়, গঠনও সুন্দর নয়; কিন্তু শুনেছি গুজরাট আর বাংলা দেশে খুব সুন্দর গঠনের বৃক্ষ দেখা যায়! সম্ভবত আগ্রা বা ফতেহ পূরে বসে আম সম্বন্ধে বাবুর লিখেছিলেন, বাংলাদেশের আমগাছের গল্প শুনেছেন, কখনও চোখে দেখেন নাই!
তিনি মহুয়া নিয়ে লিখেছেন, এর থেকে স্পিরিট বানানো হয়, কিসমিসের মত শুকিয়ে খাওয়া হয়, উল্লেখ করেছেন! কাঁঠাল নিয়ে লিখেছেন, এর সুগন্ধ আর ফল ‘অসম্ভব মিষ্টি’ উল্লেখ করেছেন! জাম, বড়ই, তেঁতুল সহ আরও অনেক ফল তার লেখায় স্থান পেয়েছে! লিখেছেন মাছ এবং অন্যান্য পশু পাখী নিয়ে!
দিল্লী, জুনাপুর, গুজরাট, দাক্ষিনাত্য এবং বাঙ্গালা- তখনকার হিন্দুস্থানের এই পাঁচ মুসলিম শাসিত রাজ্য– সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লিখেছেন; বাঙ্গালা মুলুক নিয়ে তাঁর লিখা আমাদের আজকের বিষয়!
তিনি লিখেছেনঃ এক নুসরাত শাহ্ ছিলেন বাংলা দেশে (Country of Bengal! চমৎকার নয়!) । তাঁর পিতা আলাউদ্দিন (হুসেন শাহ্) সে দেশ শাসন করেছেন, উত্তরাধিকার সুত্রে নুসরত শাহ, রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হন। বাংলাদেশে এক বিস্ময়কর প্রথা হল, সেখানে বংশানুক্রমিক ক্ষমতার পালাবদল দুর্লভ! রাজকীয় দরবার স্থায়ী, আমির উমরাহ্দের- মন্ত্রী মনসবদারদের দপ্তর/ হুকুমদারি স্থায়ী; এই ধরনের দপ্তরকে বাঙ্গালীরা শ্রদ্ধা করে। প্রতিটি দপ্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে নির্দিষ্ট কর্মচারী- হুকুমবরদার, আর্দালি- তারা এই দপ্তরের কাজকামের আনজাম দেয় ।
কিন্তু ‘রাজকীয় দরবার’ এর বিষয়টাই সবচেয়ে অদ্ভুত; কেউ যদি তাদের ‘বাদশাহকে (বাবুর লিখেছেন ‘পাদশাহ) খুন করে সিংহাসনে বসে যায়, আর নিজেই বাদশাহ বনে যায়, আমির উমরা, উজির, সৈনিক এবং চাষী সবাই সাথে সাথে তাঁর কাছে আনুগত্য স্বীকার করে, তাঁকে মান্য করে এবং তাকেই আগের বাদশাহর যথাযোগ্য উত্তরসূরী মনে করে! বাঙ্গালীরা বলেঃ “আমরা সিংহাসনের প্রতি বিশ্বস্ত; যে তা দখল করে, আমরা তার প্রতি ‘অনুগত থাকি”! উদাহরণ হিসেবে, নুসরাত শাহের পিতা আলাউদ্দিন- এর রাজত্বের আগে, মুজাফফর শাহ্ নামের এক হাবসি ক্রীতদাস তাঁর মালিক মাহমুদ শাহ্ ইলিয়াসকে খুন করে এবং শাসক হয়ে বসে, বেশ কিছুদিন রাজত্ব করে। আলাউদ্দিন সেই হাবসী দাসকে খুন করে নিজে বাদশাহ হন। তিনি মারা গেলে, তাঁর পুত্র নুসরত শাহ্ উত্তরাধিকারী হিসেবে বাদশাহ হন।
বাঙ্গালীদের আরেক প্রথা হল, “নূতন শাসক যদি পূর্বের শাসকের রেখে যাওয়া রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সমূদয় অর্থ ব্যায় করে ফেলে, –নূতন শাসকের জন্য তা চরম অপমানজনক, অমর্যাদার; ক্ষমতায় এসে তাকে তার নিজের জন্য ‘সম্পদ আহরণ করতে হবে; সম্পদের পাহাড় গড়া, বাঙ্গালীদের কাছে চরম মর্যাদাপূর্ন!”
বাঙ্গালীদের আরেক প্রথা হল, আদিকাল থেকেই পরগনাগুলো রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডার, আস্তাবল এবং সকল রাষ্ট্রীয় ব্যায় সংস্থানের জন্য খরচ যোগায়; অন্য এলাকায় এর জন্য তহবিল সংগ্রহ করে না।
প্রায় ৫০০ বছরে বাঙ্গালী মানসে -সম্পদের পাহাড় গড়ার বিষয়ে সে ‘মর্যাদাবোধ এখনো বিদ্যমান! চুরি ডাকাতি করে, হারাম হালালের তোয়াক্কা না করে- সম্পদের পাহাড় গড়তে পারলেই হল, সেটা এখনো গর্বের বিষয়!
তবে গত ৫০০ বছরে আমাদের স্বভাবে কিছু পরিবর্তন হয়েছে! এখন যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায়, তারা - রাষ্ট্রীয় কোষাগার শুধু চেটেমুটে খাওয়া নয়, এমন কি ভিক্ষালব্ধ সম্পদ চুষে খেয়ে জাতিকে ফোকলা বানালেও- বাঙ্গালী আর তা ‘অমর্যাদা’র বলে মনে করেনা; ক্ষমতাসীনদের আর ঘৃণাও করে না, বরং এই চোর বদমাশদের প্রতিও ‘বংশপরম্পরায় আনুগত্য” প্রদর্শন করে!
বিষয়: বিবিধ
১৩০৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন