বট বৃক্ষের ছায়া : স্ট্রেস নিয়ন্ত্রনে আদর, সহানুভূতি আর ভালবাসা
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৯:৩৬:০৭ রাত
প্রতিটি জীবিত প্রানীকেই ‘স্ট্রেস’ (STRESS ) মোকাবেলা করতে হয়। আরও সূক্ষ্মভাবে বললে – প্রতিটি জীবিত কোষেই স্ট্রেস তৈরি হয়! হতে পারে তা রোদ পানি বাতাসের অভাব! কিম্বা তাদের আধিক্য? খাদ্যের অভাব ? এমনকি খাদ্যের আধিক্য? বিশ্রামের অভাব? ঘুমের অভাব? অতিরিক্ত শ্রম-! প্রতিযোগিতা? সেটা খাদ্য সংগ্রহ হোক বা পার্টনার সংগ্রহ হোক কিম্বা নিতান্ত বিনোদনের জন্য। আজকের দুনিয়া চাকুরী বা কর্মস্থল তো যুদ্ধ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে! রাজনৈতিক পরিবেশ? প্রায় জাহান্নাম! এগুলো সবই পর্যাপ্ত ‘স্ট্রেস তৈরি করতে সক্ষম। চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে যে বৈষম্য, সেটাও তৈরি করে স্ট্রেস! দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস!
সৃষ্টি বৈচিত্রের মজা হল এটাই যে, প্রতিটি প্রাণী বা বিশেষ জাতের কোন প্রাণী, বা একই জাতের ভিন্ন ভিন্ন সদস্যের মধ্যেও এই স্ট্রেস নিয়ন্ত্রন প্রক্রিয়া ভিন্ন। স্ট্রেস এর সময়, সবাই কম বেশী বিষণ্ণ হয়, ‘ডিপ্রেসড হয়। অল্প কিছু মানুষ এই স্ট্রেসকে খুব সহজ ভাবেই নেয়! একটা মাত্র দীর্ঘ নিঃশ্বাসের সাথে তা মনের গভীরে ডুবিয়ে দিয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। কেউ একটু বেশী সময় নেয় স্বাভাবিক হতে। আবার কেউ একটু বেশী মুষড়ে পড়ে! কেউ আবার সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেই না- এমন নজির রয়েছে অনেক। নির্ভর করে স্ট্রেস এর মাত্রা এবং সে ‘জীবের মানসিক বা দৈহিক ‘গঠন এর উপর!
এই ‘জৈবিক – বা পরিবেশের স্ট্রেস যখন আমাদের ক্লান্ত করে তোলে – বিষণ্ণ করে তোলে, তখন আমাদের ইচ্ছে করে কোন ‘বট বৃক্ষের ছায়ায় বসে – দুদন্ড মিলমিলে বাতাসে বসে জিরিয়ে নিতে! সংসারে প্রায় সবারই এমন ‘বটবৃক্ষ রয়েছে! যাদের নেই তারা সত্যিকারের হতভাগা!
এই স্ট্রেস এর প্রভাব সম্বন্ধে অন্য জন্তুদের নিয়ে মানুষ গবেষণা করছে-। কৃত্তিম ‘স্ট্রেস তৈরি করে ব্যাক্টেরিয়াকে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে- তার শরীরে কি কি পরিবর্তন হয়, কি পরিবর্তন ঘটে বায়কেমিক্যাল লেভেলে- কি এনজাইম তৈরি হয়- বা নূতন কোন যৌগ এই স্ট্রেস তৈরির জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি হয় কিনা যা তাকে সেই স্ট্রেস নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে! তা আবার মানুষের ‘স্ট্রেস নিয়ন্ত্রনে কাজে লাগানো যায় কিনা- এমন গবেষণাও চলছে! অবশ্য আমাদের আজকের প্রবন্ধ কোন গবেষণা বা তার ফলাফল বিষয়ে নয়। নেহায়েত আমাদের মানব সমাজের নিত্যদিনের রোজনামচা ।
মা বাবা, ভাই বোন, সহকর্মী, স্ত্রী কিম্বা প্রেয়সীর কোমল গলায় শান্তনা কিম্বা কোমল হাতের স্পর্শ থেকে কেউ কেউ এই স্ট্রেস নিয়ন্ত্রনের শক্তি অর্জন করে। পরিবারের যে সকল ভুমিকার কথা আমরা জানি – তার মধ্যে এই ভূমিকাটি সবচাইতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার উল্লেখ করা হয় সবচেয়ে কম। জীবন বড় জটিল। একটা পরিবারে অভাব থাকতেই পারে; বস্তুগত বা সামাজিক চাহিদা থাকতে পারে, থাকতে পারে আকাঙ্ক্ষা বা অপূর্ণ বাসনা। এরপরেও কিন্তু পরিবারটা দাঁড়িয়ে থাকবে; ধ্বসে পড়বে না। যদি সেখানে সহানুভূতি, সহমর্মিতা আর আশ্বাস থাকে! থাকে সাহস যোগানোর শক্তি! একটু ছোঁয়া- একটি হাতের আদুরে স্পর্শ, একটা মাত্র আলিঙ্গনও অনেক শক্তি রাখে –এ ব্যাপারে।
আমার ছোট ছেলেটা । তার ঈদ উপহার -নিজের পছন্দে কেনা ড্রোন- দুদিনের মাথায়, উড়াতে গিয়ে প্রতিবেশীর উঁচু বিল্ডিং এর ছাদে এমনভাবে আটকে গেল যে, আর কোন ভাবেই তার নাগাল পাওয়া যাবেনা। এই হতাশা – আর নূতন খেলনা হারানোর বেদনা তাকে আচ্ছন্ন করল। বড় ভাই এর ধমক ধামক- খুব স্বাভাবিক। কেন এত উঁচুতে উঠাতে হবে? কেন ঐ ছাদের মাথায় তুলতে গেলি! সে বাড়ি ফিরে এলো – থমথমে, গম্ভীর মুখে! মায়ের বকুনী পাওনা হয়েছে- এত ঝামেলায় –‘মাগরিব কারফিঊ’ ভঙ্গ করেছে সে! বড় ভাই তখনো গজগজ করছে- দুদিন মাত্র খেলা হয়েছে – নূতন খেলনা! এমন বড় ভাই সংসারে প্রায় সবারই রয়েছে! ধমক ধামক- কি হলে কি হতে পারত, কি না হলে কি ঘটতে পারত না- এমন মন্তব্য করার লোকেরও অভাব নেই!
যখন সে ঘরে ঢুকল – বুঝলাম; যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে সে। দারুন স্ট্রেসকেও– কান্না অনেক সময় ধুয়ে দেয়! কেউ কেউ বাক্য ব্যবহারে স্ট্রেস লাঘব করে! আমরা বয়স্করা সে সুবিধা- বঞ্চিত! তবে ‘বয়স্কারা নন! সেও কান্নার বয়স পেরিয়ে এসেছে বলে মনে করতে শিখেছে। কাছে ডাকলাম । এলো সে ধীরে ধীরে! বড় জনের গজগজানিতে আগেই অনুমান করেছি- কি ঘটেছে! কাজেই সে বিষয়ের ধারে কাছেও গেলাম না, জিজ্ঞেসও করলাম না কি হয়েছে! তার এখন দরকার অন্য কিছু!
হাত ধরে কাছে বসালাম। লম্বা চুল কপালে এসে পড়েছে- চোখ ঢেকে দেয়ার মত । হাত দিয়ে সেটা ঠিক করে দিলাম; সে গায়ের সাথে ভিড়ে এলো, একটু জড়িয়ে ধরলাম! ওভাবেই সে থাকল কিছুক্ষণ। সে জানে এখন – আশ্বাস পেয়ে গেছে- সে; আর কিছু ঘটবে না নূতন করে। পছন্দের জিনিষ হারিয়েছে- কিন্তু ভালবাসা আর আশ্বাস তো হারায়নি; সেটা জানাই তার জন্য জরুরী ছিল! অনেক সমস্যার সমাধান এই ‘ছোঁয়া বা স্পর্শ দিয়েই করা যায়! স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্কের মান অভিমান রাগ অনুরাগ নিয়ে ভেবে দেখুন- অনেক সময় আপনি নিজেই তার সফল প্রয়োগ করেছেন। আপনার মধ্যেই সে শক্তি রয়েছে, স্ট্রেসকে সফল ভাবে মোকাবেলা করবার শক্তি!
‘ভয় নেই! ‘আমি আছি তোমার সাথে! চিন্তা করো না! একটু ছোঁয়া, একটা আলিঙ্গন - এই তথ্যটুকু সরবরাহ করে। যোগাযোগের মাধ্যম।
‘আমরা তোমার পেছনে আছি’-ভয় পেও না! ‘তুমি একা নও ! তোমার কষ্টে আমরাও কষ্ট পাচ্ছি! ‘জীবনে এমন সময় আসে –সব্বাইকে কিছু চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তবে এটাই জীবন’ । ‘জীবন কোন কুসুম শয্যা নয়! দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় না’! ‘তুমিও এই দুর্দিন কাটিয়ে উঠবে ! ধৈর্য ধর! হতাশা ভাল নয়! আশা হারিও না’!
এমন অনেক বাক্যই, মানুষকে স্ট্রেস এর মুহূর্তে, কষ্টের বা বিপদের মুহূর্তে শান্তনা যোগায়! যদি এই বাক্য গুলো বিশ্বাসযোগ্য ভাবে বলা হয়-! যাকে বলা হচ্ছে সে যদি বোঝে আন্তরিকতা আর সহমর্মিতা রয়েছে এর পেছনে- ! সে বিশ্বাস করলেই তার মনে সুপ্ত আশার প্রদীপ জ্বলে উঠে ।
নৈরাশ্যবাদী হয়ে কেউ জন্মায় না! আশা সবার মনেই থাকে সুপ্ত থাকে। ক্রমাগত তিক্ত অভিজ্ঞতায় মানুষের উপর বিশ্বাস হারাতে থাকে মানুষ! এভাবে আশাহত হতে হতে মানুষ হতাশ হয়ে যায়- নৈরাশ্যবাদী হয়ে উঠে! কাজেই স্ট্রেস এর প্রতিক্রিয়া সেই মানুষের নিজের অভিজ্ঞতা আর মনঃস্তাত্তিক গঠনের উপর নির্ভর করে। একটা শিশু যদি ক্রমাগত আশ্বাস আর ভালবাসার মধ্যে বড় হয়, সে আশ্বস্ত হতে শেখে-আত্মবিশ্বাসী হতে শেখে; হতাশা কাটিয়ে উঠে সহজেই। কিন্তু সে যদি ক্রমাগত সমালোচনার মধ্যে বড় হয়- তার আত্মবিশ্বাস হয় নড়বড়ে আর এর স্তাহে যদি দুয়েকটা তিক্ত অভিজ্ঞতা যোগ হয়ও- তাহলে তার মানসিক সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়।
সংগত কারনেই এক একজন মানুষের ক্ষেত্রে স্ট্রেস বা চাপের প্রতিক্রিয়া এক এক রকম হয়। আমি আপনিও এক এক সময় এক এক ধরনের পরিস্থিতিতে এক এক ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে ফেলি! না চাইলেও অনেক সময় উদ্ভট কর্ম করে ফেলি। একটু চেষ্টা করলেই কিন্তু তা নিয়ন্ত্রন করা যায়! সমস্যার সমাধান আমাদের মধ্যেই রয়েছে।
ছোটখাটো সমস্যার সমাধান ‘আত্মনিয়ন্ত্রনের মাধ্যমেই করা যায়! বড় ক্ষতের জন্য বা সংক্রামক রোগের জন্য ‘এন্টিবায়োটিক লাগতে পারে; অন্যথায়, কেবল মাত্র স্পর্শ, আলিঙ্গন, মুখের মধু মাখা কথা এগুলোর মাধ্যমেই আপনি আপনার আশেপাশে যারা আছে তাদের স্ট্রেস নিয়ন্ত্রনে দারুন সফল হতে পারবেন!
চিন্তা করুন- বিপদে পড়লে কার কথা মনে হয়! মা? বাবা ? দাদী ? বড় ফুফু? চাচা ? খালা? মামা? বড় বোন বা ভাই! কিম্বা আর কেউ? তাদের সহানুভূতি আপনাকে শক্তি যুগিয়েছে এক সময়! সেটাই অবচেতন মনে রয়ে গেছে ! এখনও চরম পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে – স্মৃতি আপনাকে সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তারা ছিল আপনার জন্য বটবৃক্ষ ! আবার এমন অনেকে রয়েছে আপনার পাশেই- মরে গেলেও আপনি আপনার সমস্যার সময়ে তেমন ‘বিষ বৃক্ষের কাছে যাবেন না!
বিপদে পড়লেই যাদের কাছে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে – তাদের ভালবাসা আর সহানুভূতি যদি আপনার স্ট্রেস নিয়ন্ত্রনে কার্যকর হয়ে থাকে, আপনাকে সাহস যোগায়, আপনি কেন তাদের ভুমিকা নেবেন না!
আসুন – আমরা সবাই চেষ্টা করে দেখি, তেমন বটবৃক্ষ হওয়ার জন্য!
বিষয়: বিবিধ
৯০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন