অ্যাভোকাডোঃ সম্ভাবনার এক নূতন দিগন্ত
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৬:৪৮:১৫ সকাল
কাজ থেকে ফিরেছি। অসম্ভব ক্লান্তি লাগছে। দিন শেষে ক্লান্তি, খুব স্বাভাবিক। একটা অ্যাভোকাডো বের করে নিলাম। ফল কেটে এর শাঁস, এক গ্লাস দুধের মধ্যে মিশিয়ে নিতে- দিলাম ঘুঁটা! তৈরি হল অ্যাভোকাডো শেক! এক গ্লাসেই কম্ম কাবার। ক্লান্তি ঝরে গিয়ে, চনমনে হয়ে উঠল দেহ মন। এমন ম্যাজিক এই অ্যাভোকাডোর।
সপ্তাহান্তে, টিভিতে খেলা শুরু হওয়ার আগে, দুটো অ্যাভোকাডো, একটা পেঁয়াজ, একটু রসুন, ঝাল মরিচ আর এক চিমটি লবণ, ধনেপাতা এবং অলিভ অয়েল-ব্লেন্ড করে নিলেই তৈরি হয়ে গেল মজার ডিপ ( Dip) গুয়াকামলি (Guacamole- মেক্সিকান স্প্যানিশ উচ্চারনে ‘ওয়াকামলি), চিপস এর সাথে অতি উপাদেয় । তিন ঘণ্টা টিভির স্ক্রিনে আটকে থাকতে আপনাকে উদ্যম যোগাবে, যদি ক্রিকেট ‘ওয়ান ডে’ হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা! অনেকে গ্রিন পিজ ( Green Peas) বা সবুজ মটর যোগ করে এর সাথে। কিন্তু নিউইয়র্ক টাইমসে এমন রেসিপি দেখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা টুইট করলেনঃ "Respect the nyt, but not buying peas in guac. onions, garlic, hot peppers. classic. ( নিউইয়র্ক টাইমস মাথায় থাকুন, গূয়াকামোলীতে গ্রিন পিজ চাই না। পেঁয়াজ, রসূন, মরিচ। ক্লাসিক। )
তবে বারাক হোসেন যাই বলুন, কেউ কেউ টক দই যোগ করে এতে; কিম্বা লেবুর রস । আপনিও আপনার পছন্দের বস্তু যোগ করে বানিয়ে নিতে পারেন আপনার নিজস্ব রেসিপি। জিনিসটা মজার হলেই হল। মেক্সিকোতে গুয়াকামলি’র জাতীয় দিবস পালিত হয়, তাদের স্বাধীনতা দিবসের সাথে- ১৬ সেপ্টেম্বরে।
Super food বলতে যতগুলো খাবার আজকালকার দুনিয়ায় খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, অ্যাভোকাডো তাদের অন্যতম। মূঠো আকৃতির ফল, পুরু সবুজ খোসার গায়ে সাদা ফুটকী, আর ভেতরে সাদাটে সবুজ ক্রিম ধরণের শাঁস, ঘিরে আছে তার ভেতরে বড় গোলাকার, একমাত্র বীজকে। এই হল অ্যাভোকাডো। সবুজ কাঁচামিঠে আমের সাথে বাহ্যিক মিল আছে কিছুটা, কিন্তু এর আকৃতি প্রায় ছোট পেঁপের কাছাকাছি, গোলাকার ধরণের।
বৈজ্ঞানিক নাম Persea americana, LAURACEAE পরিবারের সদস্য। একমাত্র বীজ বিশিষ্ট, বেরি ধরণের ফল । গাছ বেশ বড়ই হয়, ফল গুলো লম্বা বোঁটায় ঝুলতে থাকে। গাছে একবারে অনেক ফল আসে! বীজের গাছ হলে, ফল ধরতে কয়েক বছর লেগে যায়। আংশিক স্বপরাগী উদ্ভিদ, তবে ফলের বৈশিষ্ট অক্ষুণ্ণ রাখতে অঙ্গজ বংশ বিস্তার বা GRAFTING ব্যবহৃত হয়। মেক্সিকোর পূয়েবলোতে এর উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়, ফসিল বা জীবাশ্ম ঘটিত প্রমাণ বলছে, লাখো বছর পূর্বেও এর নিকটাত্মীয়রা জন্মাতো উত্তরে ক্যালিফোরনিয়া পর্যন্ত। এ এলাকার আবহাওয়া অ্যাভোকাডোর জন্য সুবিধাজনক। অ্যাজটেক বা ইনকা সভ্যতার সাথে এদের সম্পর্ক রয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। মেক্সিকো থেকে স্প্যানিশদের হাত ঘুরে দক্ষিণ আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়া এবং সিরিয়ান এলাকায় পৌঁছে যায় অ্যাভোকাডো। পেরু এবং কলম্বিয়াতে এখন প্রচুর উৎপাদিত হচ্ছে এই ফল, রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপের বাজারে।
১৯০০ সালের দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাভোকাডো চাষীরা তাদের ফল বাজারজাত করতে খুব সমস্যায় পড়েছে। মানুষ তখন এর ব্যাপারে জানত না; চাহিদাও কম ছিল। তখন এ ফলকে বলা হত, আহূকাতে (AHUAKATE), অ্যাজটেক ভাষায় যার অর্থ ‘অণ্ডকোষ। এমন নাম সংগত কারণেই মানুষকে আকৃষ্ট করেনি; এরপর একে বলা হয়েছে- ‘এলিগেটর পিয়ার (ALLIGATOR PEAR) এজন্য এর নাম বদলানো হয় – এবং অ্যাভোকাডো হিসেবে তা পরিচিত হয়। এবং এখন এর জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী । এর মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে শিগগীরই, যদি না এই ফল সহজলভ্য হচ্ছে বা অন্য এলাকায় এর চাষাবাদ শুরু করে এর উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে!
গুণাগুণঃ
যাদেরকে ডাক্তার মাছ মাংসের চর্বি খেতে বারণ করেছে, তাদের জন্য এই ফলজ ফ্যাট – বা অসম্পৃক্ত উদ্ভিজ্জ তেল (Mono unsaturated fat ) খুব প্রয়োজনীয়। ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের পরিমাণের দিক থেকে এর ধারে কাছে খুব বেশী ফল আসতে পারবে না । এতে শর্করা (স্টার্চ) রয়েছে, তবে চিনির (সুগার) পরিমাণ খুব কম। ডায়েটারী ফাইবার, ভিটামিন বি১, বি২, বি৩,৫,৬,ফোলেট, ভিটামিন সি, ই এবং কে; ক্যালসিয়াম,ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস আছে প্রচুর, পটাসিয়াম রয়েছে অনেক বেশী। এসব গুনের কারনেই একে সুপার ফূড এর তালিকায় নিয়ে আসা হয়েছে।
কেমন জনপ্রিয় হয়েছে এই ফল?
২০০০ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এই ১৫ বছরে অ্যাভোকাডোর চাহিদা শুধু আমেরিকায়, মাথাপ্রতি ২ পাঊণ্ড থেকে ৭ পাঊণ্ডে এসে পৌঁছেছে। ইংল্যান্ডেও ২০১৫তে রেকর্ড পরিমাণে বিক্রি হয়েছে অ্যাভোকাডো। ‘শুধু মাত্র অ্যাভোকাডো’র রেস্টুরেন্ট রয়েছে লন্ডনে। এই তো সেদিন জাপানের ম্যাকডোনাল্ড, তাদের নিয়মিত ‘উপকরণ হিসেবে অ্যাভোকাডো অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে, এর জনপ্রিয়তার কারণে। অস্ট্রেলিয়ায় মাথাপিছু অ্যাভোকাডোর চাহিদা ৩ পাঊণ্ড থেকে ১২ বছরে বেড়ে ৬.৫ পাঊণ্ড হয়েছে। স্বাস্থ্যগত ব্লগ আর ফেসবুক সহ মিডিয়ার কল্যাণে এর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে ।
পরিবেশগত সমস্যাঃ
এর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে । অথচ সে তুলনায় অ্যাভোকাডোর উৎপাদন রাতারাতি বাড়ছে না। অ্যাভোকাডোর গড় উৎপাদন বেশী, হেক্টর প্রতি ২০ টনের কাছাকাছি, উচ্চ মাত্রার। কাজেই একবার ভাল ফলন হলে ২য় বৎসরে আর তেমন ফলন হয় না, আম গাছেও এমন এক বছর অন্তর অন্তর ভাল ফলন আসে। এদিকে খরা বা আবহাওয়াগত পরিবর্তন, স্বাভাবিক ভাবেই মাঝেমধ্যে উৎপাদনে ঋণাত্মক ভূমিকা রাখে।
চাহিদার কারণে, অধিক উৎপাদন করতে গিয়ে, চাষাবাদের জমি বাড়াতে বন জংগল কেটে চাষ যোগ্য জমি বাড়ানোর চেষ্টা করছে কৃষক। অনেক প্রাকৃতিক বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এভাবে। ফার আর পাইনের বন কেটে ফেলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাভাবিক বনভূমির তুলনায় অ্যাভোকাডো চাষের জমি প্রায় দ্বিগুণ পানি খরচ করে। এদিকে প্রাকৃতিক বনভূমি কেটে ফেলায় ‘মোণার্ক প্রজাপতি (Monarch butterfly ) আর পানি স্তরের স্বাভাবিক প্যাটার্ন পাল্টে যাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়েগো উপত্যকাকে বলা হয় ‘অ্যাভোকাডো রাজধানী। এখানে পানির সরবরাহ কম হওয়ায় অ্যাভোকাডো চাষিরা কলোরাডো নদীর পানি সেচ হিসেবে ব্যবহার করে। সমস্যা একটাই- এতে লবণের পরিমাণ বেশী। এবং অ্যাভোকাডো লবনের ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর। এজন্য ফলের আকার হয়েছে ছোট – ফলন মার খেয়েছে। জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণও বাড়ছে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিলান্ডেও আবহাওয়া-জনিত সমস্যার কারণে ফলন কমেছে। ৪ ডজনের এক বক্স অ্যাভোকাডোর ডাম ৪৫ ডলার থেকে বেড়ে ১০০ ডলার হয়েছে। খুচরো বিক্রেতারা তার দাম দুই গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অতিরিক্ত চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে, এদের পরিবেশগত সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে না। আমেরিকা এখন শুধু মেক্সিকো থেকে নয়, কলাম্বিয়া থেকে অ্যাভোকাডো আমদানির অনুমতি দিয়েছে। চাহিদা বাড়লে, প্রয়োজনে অন্য দেশ থেকেও তা আসবে-।
সমাধানঃ
যে কোন ব্যবসার মূল নিহিত থাকে এর ভবিষ্যত চাহিদায়। কেউ যদি কোন পণ্যের আগাম চাহিদা অনুমান করতে পারে – সে আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে আর সে ব্যাক্তি যে ব্যাবসাতে সফল হবে, সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং আদ্রতা মেক্সিকোর সাথে মেলে। ক্যাশ ফসল (CASH CROP ) হিসেবে এমন দামী এবং উপকারী ফলকে চাষের আওতায় আনলে দেশের জন্য তা উপকারী বৈদেশিক মুদ্রা বয়ে আনবে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের দুয়েকজন সৌখিন বৃক্ষপ্রেমিক এই ফলের গাছ লাগিয়ে ফল পেয়েছেন বলেও রিপোর্ট পাওয়া গেছে। কাজেই এই ‘ফল আমাদের দেশে অপার সম্ভাবনার এক নূতন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
বিষয়: বিবিধ
১৭০৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুপার মার্কেট, গ্রোছারী সহ সকল ফুডষ্টপে সহযেই পাওয়া যায়।
জুসের দোকানগুলোতে আভোকাডোর দাহিদা মোটামুটি ভালই।
আপনার ইন্ফরমেশনের জন্য ধন্যবাদ।
কিন্তু অ্যাভাকাডো যদি বাংলাদেশে উৎপাদন করতে যায় তবে েএকই রকম পরিবেশ বিপর্যয় এর ঘটনাই ঘটবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন