আজকের দুনিয়া এবং নেতা, নীতি ও নেতৃত্বের ভেলকি
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১০:৩৮:২১ রাত
ইমাম অর্থ নেতা!
ইসলামের খলিফা বা রাষ্ট্র প্রধানও ইমাম । ইসলামে ইমাম বা নেতার এর স্থান হল সব চেয়ে ঊর্ধ্বে। তিনি রাজা নন, পিতার বা রক্তের উত্তারধিকার দিয়ে তিনি সিংহাসনে বসেন নাই। তাঁর দ্বীনদারী দেখে, জ্ঞান আর প্রজ্ঞা দেখে, বিজ্ঞ মানুষদের- আল্লাহ্ কে যারা বেশী বেশী ভয় করেন – তাদের একটা কাউন্সিল, তাঁকে নির্বাচিত করবেন। ইমাম বা নেতা হবেন সবচেয়ে বিজ্ঞ ব্যাক্তি, তিনি নৈতিকতার দিক থেকে আদর্শ, মানদণ্ড। তাঁর মুখের কথাই রাষ্ট্রীয় আইন, অনুসরণীয় । তিনি ধর্মীয় আইনে যেমন বিশেষজ্ঞ, তার প্রজ্ঞা আর অভিজ্ঞতা, তাঁর কর্মসূচী আর পদক্ষেপ - তাঁর অনুসারীদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে, সুখ সুবিধা আর সমৃদ্ধির দিকে তাঁদেরকে এগিয়ে নেবে!
শুনে মনে হচ্ছে না, বাস্তব বহির্ভূত এক ‘কেতাবী ইউটোপিয়ার কথা বলা হচ্ছে! হ্যাঁ , কেতাব অনুযায়ী সেটাই হওয়ার কথা ! ইসলামের প্রাথমিক যুগে তাই হয়েছে। এর পরে এলো ‘বংশ শাসন’ বা রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পালা। রাষ্ট্র প্রধান – ইসলামিক খেলাফতের রাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করবেন, ‘থিওলজি- নিয়ে মাথা ঘামাবেন না! তারা গৃহ পালিত - বেতন ভোগী ইমাম শ্রেণী- তৈরী করে গেছেন।
যুদ্ধে যারা জয়ী হয়, তাদেরই জয় জয়কার! যে যাই বলুক, মাইট ইস রাইট, তখনও, – এখনও! এবং ইতিহাস তাই বলে- ইতিহাস লেখাও হয় – অনুসৃত হয় – বিজয়ীদের ভাষাতেই। আমরাও তাই মেনে নিয়েছি! ইসলামের কেতাবী অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে, এবং সেটাই ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে মুসলিম সমাজ মেনে নিয়েছে! মেজরিটি ! এখন আসুন দেখা যাক - আমাদের সমাজে কি ঘটছে ?
পিতার তিনপুত্র। পড়াশুনায় বড় জন মোটামুটি, মেজটি খুবই ভাল । তারা রেগুলার স্কুলে পড়ে, ইংরেজী শেখে, বিজ্ঞান শেখে। ছোটটির বুদ্ধি শুদ্ধির উপর আস্থা রাখা যায় না, নেহায়েত তৃতীয় শ্রেণীর। পিতা ভাববেন, মাথা যখন ভাল না, একে মাদ্রসায় দেয়া হোক, আল্লাহ্ বিল্লাহ করে কোন রকমে দিন গুজরান করবে, আর যেন ঐ উসিলায় নিজে, তার পূর্ব পুরুষ সহ, পরকালে পার পেয়ে যাবেন (!)। ভাঙ্গা কুলো দিয়ে ছাই ফেলার কাজ! এই হল আমাদের দেশের গণমানসে ইসলামী শিক্ষার ব্যাপারে ‘কমন’ চিন্তা চেতনা! ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলব না। কিন্তু ঐ যে- ‘কমন’! ধর্মীয় বা পরকালের বিষয় - তৃতীয় শ্রেণীর চিন্তা! দুনিয়ার লোভের কাছে ওগুলো গুরুত্ব পায় না!
এভাবেই, কুরআনের মত এক মহাগ্রন্থের অধ্যয়ন, ব্যখ্যা, প্রচারনা- বা উপস্থাপনা – ‘ঐ ‘তৃতীয় শ্রেণীর মেধা’দের হাতে পড়ে আছে দীর্ঘদিন- শয়ে শয়ে বছর ধরে । মাদ্রাসার কথা বাদ দিলাম, বেশীর ভাগ সরকারি বা বেসরকারী স্কুলে, যিনি ইসলাম শিক্ষা দেন- সেই ‘মৌলভী শিক্ষককে ছাত্ররা কেমন পছন্দ করে? বিজ্ঞানের শিক্ষক মেধাবী, স্মার্ট, শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন, মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন, শিক্ষার্থীদের উদ্দীপিত করতে পারেন! কিন্তু যারা ইসলামের চর্চা করেন,অনুশীলন করেন, তাদের অবস্থা কি? মেধা তো তেমন নেই, এরপর তাদের তো হওয়ার কথা ধৈর্যের প্রতিমূর্তি! অথচ তারাই সবচেয়ে নিষ্ঠুর- জল্লাদ স্বভাবের। নিজেদের ‘অযোগ্যতা আর অদক্ষতা ঢাকতে গিয়ে, তাদের শাস্তির হাত চতুর্গুণ ! তাদের জনপ্রিয়তা কেমন? (ব্যাতিক্রম থাকতে পারে, আমি পরিসংখ্যানের মেজরিটির কথা বলছি)। যদি শিক্ষককেই পছন্দ না হয়, তার আচরণ পছন্দ না হয়,
তার শেখানো শিক্ষার বিষয়ে কেউ মনযোগী হবে না, এটাই সাধারন নিয়ম। বরং উল্টো-হবে, ঐ বিষয়ের উপরে গিয়ে পড়বে যত রাগ! ( এই ধরনের মৌলভীর হাতে ধোলাই খাওয়ার পর থেকে কেউ কেউ ইসলাম বিরোধী ব্লগারে পরিণত হয়েছে কিনা, এদের জিজ্ঞেস করে দেখা যেতে পারে)।
ইসলাম আধুনিক ধর্ম, আরবদের ‘পিতৃ পুরুষের প্রথার বিরুদ্ধে’ বিপ্লব ছিল ইসলাম। কিন্তু ইসলাম যত আধুনিকই হোক, বিশেষ এক শ্রেণীর হাতে আবার ‘বৃত্ত বন্দী হয়ে গেছে ইসলাম। এ থেকে বেরুনোর চেষ্টা অনেকেই করেছে, করছে, অনেকেই ভাবছে, লিখছে- তারা চিহ্নিত হয়েছে ‘দলছুট কিম্বা কলহ সৃষ্টিকারী, সময়ে আরও খারাপ- নাস্তিক হিসেবে। কিন্তু সঠিক পদ্ধতির খুঁজে বের করতে হলে যথেষ্ট গবেষণা ও শ্রম দরকার। বিধর্মীদের অনুকরনে না চলে নিজেদের ‘উদ্ভাবন করতে হবে প্রায়োগিক পদ্ধতি, ইসলামী স্কলারগণকেই তা বের করতে হবে, যাদের তা করার মত জ্ঞান রয়েছে।
ফনা বিহীন ‘নির্বিষ ইসলাম, ইসলামের শত্রুদের কাছে অতি কাম্য! ইসলামের শত্রুরা চেষ্টাও করছে- মুসলিমদের আরও বিভাজন করার, ‘মডারেট ইসলাম’ (পড়ুন ‘নির্বিষ ইসলাম) এর – প্রচার ও প্রসার নিয়ে । সেই যে, ‘ যে সাপের শিং নেই----- করে নাকো ফুঁস ফাঁস, মার নাকো ঢুস ঢাস---। কারণ ‘ তেরে মেরে ডাণ্ডা, করে দিব ঠান্ডা’- তাদের ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করা যাবে সহজেই ! মুসলিম দেশের ‘সুবিধাবাদী – একটা শ্রেণী সেই মতের পৃষ্টপোষক, তারাও ইসলাম এর শত্রুদের সাথে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন। সাধু সাবধান! কিন্তু যে ইসলাম অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর ‘সাহস হারিয়ে ফেলে, কেবল ঘরের মধ্যে ধর্মের ‘রিচুয়াল’ মাত্র দিয়ে নিজেকে আটকে ফেলে, সমাজের প্রত্যক্ষ উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে না, ভাল কাজে মানুষকে উৎসাহিত করে না, খারাপ কাজে সক্রিয় ভাবে বাধা দেয় না, যদি শুধু সাপ্তাহিক জুম্মার নামাজ দিয়ে ইসলাম কায়েম করে – তাহলে সেটা কি আর ইসলাম থাকবে? এজন্যই মুসলিম নামাজ পড়ে – আবার হরদম মিথ্যে বলে, রোজা রাখে আবার ঘুষ খায়, হজ্জ করে আবার অনৈতিক – ইসলাম বিরোধী আচরণে জড়িত হয়! যদি কেউ প্রতিবাদী হয়ে উঠে- তার উপর লেবেল চাপায়- সন্ত্রাসী! জঙ্গি!
ইসলামী স্কলারগণ এর কাছে দ্বীনের দাবী অনেক ! দীর্ঘ দিনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হাত বদলে, মুসলিম নামধারী সামন্ত শাসকগণ, নিজেরা ইসলাম থেকে দূরে থেকে, এক শ্রেণীর বেতনভোগী পেশাদার ইমাম তৈরী করেছে, যারা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব নয়, বরং ঐ শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। ইয়াজিদ ছিল সেই শ্রেণীর প্রথম প্রতিভূ; হজরত হাসান (রাঃ) যার প্রসঙ্গে একদা বলেছিলেন – ‘সিল্ক পরিহিত মাতাল! সে নিজে আল্লাহর নাফরমানি করেছে তাতে সমস্যা নেই, সে ইমাম রেখে দিয়েছে; অন্য মানুষদের সদুপদেশ দেয়ার জন্য। সে নিজে তো বিচারের ঊর্ধ্বে, যেমন আজকের দিনের রাজা রানী ( পড়ুন প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট !) । তাদের হাতে নিয়োগ দেয়া ইমামত প্রাপ্ত ব্যাক্তিরা যেন আরও অনেক পেশার মতই। একজন পুলিশ – এলজন কেরানী বা একজন কর্মকর্তার মতই ‘ মসজিদের ইমাম’ আরও একটা পেশা মাত্র! মানুষকে ভাল কাজের উপদেশ বিলাবেন- সরকারী দায়িত্বে! ঐ কাজ বা দায়িত্ব তো আল্লাহ পাক দিয়ে দিয়েছেন!
আল্লাহর হুকুমের চাইতে, রুটি রুজীর যোগানদার এই পেশার নিয়োগকর্তার হুকুম, তাদের আগে মানার দরকার হয়! নিয়োগকর্তার বিরোধিতা করলে সমূহ বিপদ! আল্লাহর কাছে, সেজদায় গিয়ে মাফ চাইলে আল্লাহ্ মাফ করবেন, নিয়োগকর্তা মাফ করবে এই গ্যারান্টি নেই! কাজেই তারা আর সাহসের সাথে ইসলামের সাম্যের বানী কিম্বা জুলুম আর অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য বিশ্ব মুসলিমকে আহবান জানাতে পারে না! তারা নামাজ রোজা হজ্জ যাকাত এর নিয়মিত রুটিন ঘটিত ‘ ধর্মীয় আচার বা প্রথা গুলো নিয়ে নিজের ঘরে প্রয়োগের কথা বলে, কিন্তু আল্লাহর আইন দুনিয়ায় বা দেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার কথা বলে না বা বলতে সাহস পায় না ! আর এই ইমামদের পেছনে নামাজ পড়া – মুক্তাদী, আমরা – তাদেরই অন্ধ অনুসরণ করি- “এক্তেদাইতু বিহাজাল ইমাম”! তাই আজকের এই মুসলিম আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে একত্রিত হয় না, প্রতিরোধে বা প্রতিবাদে গর্জে উঠে না ! এই এক ফোঁটা প্রানের মুল্য তাঁর কাছে এতই বেশী যে, নিজের জান বাঁচানর জন্য সে শয়তানের সাথে হাত মিলায়, নিজের ভাইয়ের সাথে গাদ্দারী করে – নিজের আক্কীদা আর ঈমান আর দ্বীনের সাথে গাদ্দারী করে- অপশাসনের সাথে আপোষ করে, নতজানু হয় । ভুলে যায় যে, তার তো নতজানু হওয়ার কথা কেবল আল্লাহর কাছে; ভুলে যায় যে, তার জান মাল তো আল্লাহ্ খরিদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে! তাই আজ দিকে দিকে অপশাসনের জয় জয়কার, ইসলামের শত্রুদের জয় জয়কার, পৃথিবীর প্রতিটা কোনায় আজ মুসলিমদের প্রাণ, আব্রু আর ইজ্জৎ ভূলুণ্ঠিত; রহিঙ্গা মায়ের আহাজারিতে আর কোন মুসলিম নেতার তরবারি উত্তোলিত হয় না, তার ‘আল্লাহু আকবর’ রবে আকাশ বাতাস গর্জে উঠে না, অত্যাচারির জালিমের হৃৎপিণ্ড প্রকম্পিত হয় না। মুসলিমের নাম শুনলে একদা বিধর্মীদের রক্তচাপ নেমে যেত, আর আজ মুসলিম শুনলে আরও বেশী জুলুম করার দিন এসেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় যে জাতি অত্যাচারে, নির্যাতনে, জেল জুলুমে নিষ্পেষিত, তারা মুসলিমর । এতে অবশ্য সেই শ্রেণীর মুসলিমদের,- যারা শয়তানের কাছে বিবেক বিক্রী করে দিয়েছে, তাদের কিছুই যায় আসে না, বরং অত্যাচারীদের পক্ষ নিয়ে ‘নির্যাতিতদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করবে তারা, ইসলামের শত্রুদের স্তুতি করবে! এই হল আমাদের বর্তমান ইসলামের অনুসারীদের চাল চিত্র! আরে যাদের নামে সন্ত্রাসের তকমা জুড়ে দিচ্ছে – ওরা তো তদের মত কাপুরুষদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেদের ‘ধ্বংস করতে নেমেছে। সঠিক নেতৃত্ব পেলে ওরা হয়ে উঠবে সত্যিকারের খালেদ ইবনে ওয়ালিদ, তারিক ইবনে জিয়াদের উত্তরসূরি, যারা মৃত্যুর ভয় করে না, যারা জান্নাতের আকাঙ্খায় উদগ্রীব! ইস্পাতের ছুরি খুন করা যায় আবার তা দিয়ে সার্জারিও করা যায়, প্রভেদ এটুকুই – কে তা ব্যবহার করছে এবং কিভাবে!
ইসলামী স্কলার এবং ইসলামের প্রকৃত অনুসারিগণ ! সময় এসেছে-শতাব্দী প্রাচীন ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠার! বিশ্ব মুসলিম আজ আপনাদের সঠিক নেতৃত্বের অপেক্ষায়!
বিষয়: বিবিধ
১১৩৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন