আসব গুল (অশ্বফুল) বা ইসবগুলের ভূষি: এক সম্ভাবনাময় ফসল

লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ১৪ নভেম্বর, ২০১৬, ০৭:০১:৩২ সকাল



গোলাপ বলতেই মন মাতানো সুগন্ধি এক ফুলের চিত্র আমাদের মানস পটে ভেসে উঠে! আমরা যে গোলাপের নামে পাগল, তার মূল শব্দ হল- ‘গুল! ফারসী –‘গুল অর্থ ফুল- আর গুলাব অর্থ গুল মিশানো পানি (আব অর্থ পানি- আমরা অনেকেই জানি!) বা গোলাপ জল! গুলাব কিভাবে যেন বাংলায় গোলাপ হয়ে গেছে ! আমাদের ভাষায় আর তা ফুল মিশ্রিত পানি নয়, পুরোটাই ফুল! ভাষাবিদগন এর তাৎপর্য ব্যখ্যা করবেন, আমরা শুধু বলব, দেশভেদে- একটা শব্দ, ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার হতে পারে। ভূমিকা শেষ।

‘ইসবগুল নামটা খুব একটা রোমান্টিক নয় – স্বীকার করতেই হবে। গরু বাছুরের খাদ্য বলে মনে হওয়া সম্ভব, তবে উপকারী ভেষজদের সামনের কাতারে এক স্থান দিতেই হবে। কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই কোষ্টকাঠিন্য (Constipation) দূর করার ক্ষেত্রে এর জুড়ি নেই! তার সাথে আধুনিক গবেষণায় ডায়রিয়া রোধ এবং কলেষ্টেরল কমানোর ক্ষেত্রে এর ভূমিকা এই ভেষজকে আবার সামনে টেনে নিয়ে এসেছে!



শতাব্দী প্রাচীন এই ভেষজ সম্ভবতঃ পারস্য সংস্কৃতির হাত ধরে দিল্লী হয়ে আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ করে থাকবে! এর নামের ইতিবৃত্ত সেটাই বলে! আসপ গুল বা আসব গুল এসেছে ফারসী আসব (অর্থ -অশ্ব) এবং গুল ( অর্থ -ফুল) থেকে - যা এর ঘোড়ার কান সাদৃশ্য বীজের আকৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, ফার্সি ‘আসব – অপভ্রংশ হয়ে - ‘ইসব এবং শেষে ইসফ গুল’ নাম ধারন করেছে! এখন সবাই একে আমাদের দেশী নাম- কথ্য ভাষায়-একে ইসবগুলের ভুষি বলেই চেনে! আমাদের আশপাশে যেটা সহজ লভ্য – সেই মূল উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Plantago ovata। Plantago গণে প্রায় ২০০ প্রজাতি রয়েছে! এর মধ্যে সাগুর পরে বোধ হয় এটাই বেশী ব্যবহৃত হয়! ওষধি ধরণের বর্ষজীবী উদ্ভিদ, ১২- ১৮ ইঞ্চি লম্বা বা এর থেকে অনেক সময় অধিক দীর্ঘ হতে পারে। গাছের গোড়া থেকে বাণিজ্যিক ভাবে অনেকগুলো মিউসিলেজ তৈরি হয় এবং খাদ্য জমাট করার জন্য আঠালো উপাদান (Thickener) উৎপাদনেও এর ব্যবহার হচ্ছে! অবশ্য বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে এ থেকেই কোষ্টকাঠিন্যের প্রচলিত ঔষধ Metamucil তৈরি করা হয়। সারা পৃথিবীর উৎপাদিত ৬০ ভাগ ইসবগুল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বানিজ্যিক পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া আইস ক্রিম এবং কেক বা এ জাতীয় খাবার তৈরিতে এর আঠালো গুণকে কাজে লাগানো হচ্ছে! এই আঠা অন্য শর্করা জাতীয় আঠা থেকে প্রায় ৬ গুণ বেশী কার্যকর! এর আঁশ থেকে প্রস্তুত মিউসিলেজ এর আরও কিছু কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট রয়েছে। ২০-৫০ ডিগ্রী তাপমাত্রা, পি এইচ (pH) মান ২-১০, এবং লবণাক্ততা মাত্রা ০.১৫ M একে তেমন প্রভাবিত করে না । এমন ভৌত গুণাবলীর সাথে প্রাকৃতিক ডায়েটারি ফাইবার- হিসেবে এর জন্মগত বৈশিষ্টের কারনে, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য শিল্পে – ফুড-গ্রেড মিউসিলেজ এর চাহিদা ক্রমশঃ ঊর্ধ্বগতি হচ্ছে! যতই মানুষ চাকুরি নির্ভর হচ্ছে- বাড়ছে ‘রেডি মেড খাবারের চাহিদা।

আর রেডিমেড বা বাণিজ্যিক বা খাবার তৈরির অর্থ –হচ্ছে আরও অনেক উপাদানের পাশাপাশি অরগানিক মিউসিলেজের চাহিদা বৃদ্ধি- যা মূলতঃ ইসবগুলের মত ফসলএর চাহিদাকে বৃদ্ধি করবে!

পশ্চিমা বিশ্বে ‘ঘাস –স্থাপনা একটা শৈল্পিক রূপ নিয়েছে! বাসার সামনে বা পেছনে, রাস্তা বা পার্কে সুবিন্যস্ত সবুজ ঘাসের গালিচা বড়ই মনোহর। এই ঘাস এর বীজ বুনে দেয়ার পর যেন দ্রুত তা শুকিয়ে না যায়, বীজের সাথে পানি ধরে রাখতে, হাইড্রোকলয়ডাল (hydrocolloidal) এজেন্ট হিসেবে ‘ইন্ডাস্ট্রি-গ্রেড মিউসিলেজ ব্যবহার করা হচ্ছে! এমনকি উদ্ভিদের ট্রান্সপ্লান্ট বা কলমের সাফল্যের জন্য, নার্সারি শিল্পে এমন ধরণের আঠা ব্যবহৃত হচ্ছে! নার্সারি ব্যবসাও আর যেন তেন কাজ নয়, বড় বানিজ্যের আকার নিচ্ছে ক্রমশঃ!



এই বর্ষজীবী গাছের ছোট্ট বাদামী বর্ণের বীজ, ঘোড়ার কানের মত দেখতে জন্য একে ‘অশ্বকর্ণ (horse’s ear) বলেও ডাকা হয়। বীজের গায়ের যে গাত্রাবরণ – এটাই এখানে তাৎপর্যপূর্ণ। বীজ গুলো মেশিনে এমন ভাবে ভাঙ্গানো হয়, যাতে করে এই আবরণ গুলো উঠে আসে। এই গাত্রাবরণ সাদা বর্ণের এবং পানি শোষক বা পানি ধরে রাখতে পারে (Hydrophillic)। পানি শোষণ করে এটা নিজের আকৃতির চেয়ে প্রায় দশ গুণ ফুলে যায়!



Plantago গোত্রের অনেকগুলো উদ্ভিদের বীজ থেকে বানিজ্যিক ভাবে মিউসিলেজ তৈরি করা হয়- এদের একত্রে ইংরেজীতে বলে Psillium। ঠাণ্ডা ও শুষ্ক পরিবেশে এই জাতের উদ্ভিদ গুলো জন্মায়! এর ব্যবহার মূলতঃ ডায়েটারী ফাইবার হিসেবে। ক্ষুদ্রান্ত্রে এই আঁশগুলো শোষিত হয় না। আগেও উল্লেখ করা হয়েছে, এই আঁশ এর যান্ত্রিক বৈশিষ্ট হল, পানি শোষণ এবং পিচ্ছিলকরন! বিধায় এরা স্বাভাবিক ‘বাওয়েল মুভমেন্টকে প্রভাবিত করে; সোজা বাংলায়, ‘কোষ্টকাঠিন্যের সমস্যাকে দূর করে।

যদিও ‘মিউসিলেজ বা আঠা হিসেবে এর বানিজ্যিক ব্যবহার হয় বেশী, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, কোষ্টকাঠিন্য ও হালকা ডায়রিয়া দূর করতে এর জুড়ি নেই! কোষ্টকাঠিন্যের অনেক ঔষধ রয়েছে, তবে সমস্যা একটাই – এদের ব্যবহার- পেটে গ্যাস বৃদ্ধি করে! এক সমস্যা সমাধানে আরেক সমস্যা তৈরি হবে! সাইড ইফেক্ট! কিন্তু এই ভেষজের অতি উত্তম বৈশিষ্ট হল, এর ব্যবহার- পেটে গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি করে না! রাসায়নিক দিক থেকে আঁশগুলো – HEMICELLULOSE এবং ARABINOXYLAN। ইংল্যান্ডে এর থেকে প্রস্তুত জনপ্রিয় প্রোডাক্ট হল ফাইবোজেল। শুধু ঔষধ নয়, গোখাদ্য বা সত্যিকারের ভুষি হিসেবে এই প্রাকৃতিক আঁশ অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। মেশিনে ভাঙ্গিয়ে মিউসিলেজ সংগ্রহ করার পর, বীজের বাঁকি অংশ গুঁড়ো করে শর্করা ও ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার প্রস্তুত করা হয়, যা গোখাদ্য ও হাঁস মুরগীর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়!

চাষঃ

এটা ১২০-১৩০ দিনের শস্য, ঠান্ডা ও শুকনো পরিবেশে ভাল ফলন হয়। বানিজ্যিক ভাবে P. ovata এবং P. psyllium কিছু ইউরোপিয়ান দেশ সহ ভারত পাকিস্তানে এর চাষ হয়। ভারতে চাষ হয় P. ovata এবং ভারত একাই পৃথিবীর উৎপাদনের প্রায় ৬০ভাগের যোগান দেয়। ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিশরা P. psyllium ব্যবহার করে । বীজ বুনার প্রায় দুই মাসের মাথায় ফুল আসে, ফল পডের মধ্যে জন্মায়, পেকে গেলে উন্মুক্ত হয়। আমাদের দেশে রবি শস্যের সাথে বুনলে ইসবগুলের ভাল সম্ভাবনা আছে- যেহেতু প্রচুর সূর্যালোক এবং নিষ্কাশন ব্যবস্থা সমৃদ্ধ বেলে দোয়াশ মাটি সহ শুকনো আবহাওয়া এর উৎপাদন বাড়ায়!

আধুনিক জীবন যাত্রার এক অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হিসেবে এই আসবগুলের ব্যবহার ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে । কাজেই এর চাষ বাস শুরু করলে ভবিষ্যতে ক্যাশ- ক্রপ ( Cash crop) হিসেবে তা অত্যন্ত লাভ জনক হবে- সে ভবিষ্যৎবাণী বোধ হয় নির্দ্বিধায় করা যায় ।











বিষয়: বিবিধ

৩৫১৭ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

379703
১৪ নভেম্বর ২০১৬ সকাল ১০:৫০
আবু জান্নাত লিখেছেন : ভালো লাগলো, ধন্যবাদ
০৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল ০৭:০৪
314876
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে!
379709
১৪ নভেম্বর ২০১৬ রাত ০৮:৩৯
হতভাগা লিখেছেন : কোষ্টকাঠিন্যে ভালই কাজ দেয় - মাশা আল্লাহ । তবে বেশী ঘন হয়ে গেলে গলায় আটকে যাবার ভয় থাকে।
০৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল ০৭:০৪
314877
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ !
379716
১৪ নভেম্বর ২০১৬ রাত ০৮:৫০
স্বপন২ লিখেছেন :
ভালো লাগলো / অনেক ধন্যবাদ
০৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল ০৭:০৫
314878
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে!
379719
১৪ নভেম্বর ২০১৬ রাত ১১:০১
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam. What a wonderful presentation with excellent history n pictures. Very important discussion for everybody who needs isbgul. Jajakallahu khair.
০৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল ০৭:০৬
314879
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ওয়া আলাইকুম সালাম!
অসংখ্য ধন্যবাদ! মিস করি আপনাকে! ভাল থাকুন!
379739
১৫ নভেম্বর ২০১৬ দুপুর ০১:৪২
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ। ছোট বেলা থেকেই খেয়ে আসছি। আজকে ডিটেইল জানলাম। আমাদের দেশেও কিছু উৎপাদন হয় জানি। এই ইসুপ গুল এর আরেকটি ব্যাবহার ছিল আমাদের ছোটবেলায়। ঘুড়ির সুতা ধারাল করার জন্য মাঞ্জা তৈরি করতাম এটা দিয়ে!!!
০৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল ০৭:০৭
314881
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন :
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকেও!
379742
১৫ নভেম্বর ২০১৬ দুপুর ০৩:২১
সন্ধাতারা লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতাহু পরম শ্রদ্ধেয় ভাইয়া।


আপনার অভিজ্ঞতাপূর্ণ সুন্দর লিখাটা পড়ে অনেক অজানা বিষয় জানা হল। মাশাআল্লাহ। বিশেষ করে ফুলের পাঁপড়ির ভাঁজে ভাঁজে যেভাবে ইসব গুলের আবির্ভাব তা বেশ আকর্ষণীয়। আমার তো মনে হয় এমন কোন পরিবার নেই যারা এই ইসব গুলের সাথে পরিচিত নয়।


উপভোগ্য অতীব প্রয়োজনীয় একটি বিষয় উপস্থাপনের জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।


গতকাল মন্তব্যটি টাইপ করেও ব্লগিয় সমস্যার কারণে দিতে পারিনি। তাই আজকে দিয়ে দিলাম।
০৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল ০৭:০৭
314880
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ওয়া আলাইকুম সালাম!
অসংখ্য ধন্যবাদ! মিস করি আপনাকে! ভাল থাকুন!
382254
১৫ মার্চ ২০১৭ সকাল ১০:১৯
সাইয়েদ ইকরাম শাফী লিখেছেন : কৈশোর পেরিয়ে তরুণ বয়সে এসে মারাত্মক গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় ভুগে বহু ঔষধ খেয়েছি। ঔষধের পিছনে ব্যয় করেছি বেশুমার টাকা। কিন্তু গ্যাস্ট্রিক থেকে মুক্তি মেলেনি। এক মুরব্বির পরামর্শে সকালে খালি পেটে ইসবগুলের ভুষির শরবত পান শুরু করলাম। এটা নিয়মিত পান শুরু করার কিছুদিন পর গ্যাস্ট্রিক অামার কাছ থেকে বহু দূরে চলে গেছে। পেটের সদস্যাও নেই। আলহামদু লিল্লাহ্। এখন হালাল সব কিছু থেকে পারি। ফিচারটি লেখার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File