কেফিরঃ Drink of the prophet
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৮:৩২:৪০ সকাল
অণুজীববিজ্ঞানীদের ভাষায়, কেফির হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া এবং ইস্ট এর এক যৌথ (Symbiont) পিণ্ড, যা সাধারণ তাপমাত্রায় দুধকে গাঁজিয়ে দৈ জাতীয় পানীয় প্রস্তুত করতে পারে! এর অনেক নাম- যেমন রাসুলের পানীয়, তিব্বতি মাশরুম, ইউগার্ট মাশরুম। দেখতে অনেকটা সাদা ফুলকপির মিনি ভার্সন, তবে গমের দানা সাইজের অনেক পিণ্ডের সমষ্টি। প্রধানতঃ saccaharomyces kefir, Torula kefir, Lactobacillus caucasicus, Leuconnostoc sp., Lactic streptococci সহ এর মত প্রায় ৩০-৪০ টা অণুজীব একত্রে অবস্থান করে এই ‘পিন্ডে। সাধারন দই প্রস্তুত করতে একটা মাত্র ব্যাকটেরিয়া বা বেশী হলে দুই বা তিনটা ব্যাকটেরিয়া ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রায় ৩০~৫০ টা উপকারী অণুজীব একত্রে পিণ্ড আকারে যূথবদ্ধ থাকে। এজন্যই এটা সাধারণত দৈ বা ইউগারট এর চাইতে অনেক বেশী শক্তিশালী প্রোবায়োটিক!
রাশিয়ায় এটা অত্যন্ত জনপ্রিয় পানীয়। বছরে বিলিয়ন লিটারের বেশী বিক্রয় হয়। রাশিয়ানদের হাতে এই কেফির এসেছে ককেশাস এর পাহাড়ি এলাকা থেকে! অনেকের জানা থাকার কথা ককেশাস বা চেচনিয়ার বাসিন্দা হচ্ছে রাশিয়ার সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়, তবে এদের সংখ্যা কম হলেও বড় মজবুত মুসলিম এরা। গত শতবছর বা তারও বেশী সময় ধরে রাশিয়ান জুলুমের বিরুদ্ধে টিকে আছে এই পাহাড়ি মুসলিমরা! তাদের সাহস আর তাকতের প্রশংসা করে তাদের দুশমনরাও। যাক, সেটা অন্য গল্প।
শত শত বৎসর ধরে মানুষ শুধু ককেশাসে গেলে এই ‘দারুন পানীয় ভোগ করতে পারত, এর বাইরে কোথাও তা পাওয়া যেত না! এর ম্যাজিক ক্ষমতা সম্বন্ধে অনেক গুজব রটেছিল, শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী এই পানীয় পেতে রাশিয়ার চিকিৎসকরা চরম আগ্রহী হয়ে উঠেছিল । বিদেশীরাও এর গুণাগুণ জানতে পেরেছে ইতালিয়ান পরিব্রাজক মার্কো পোলোর ভ্রমণ কাহিনী থেকে! মার্কো পোলো তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এ ব্যাপারে।
কোথা থেকে এলো এই কেফিরঃ
কথিত আছে, ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাদেরকে উপহার দিয়েছিলেন এই কেফির। এটা রাসূলের একটা উপহার – কাজেই খুব যত্ন করে রাখত সবাই । কাথিত আছে তাদের বলা হয়েছিল এটা অন্যদেরকে না দিতে, তাহলে এর কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। অথবা, সময়ে এমন বিশ্বাস চালু হয়ে গিয়েছিল, এটা অন্যদের দিয়ে দিলে তা আর কাজ করবে না, এর গুণ নষ্ট হয়ে যাবে। তবে যারা ইসলামের জ্ঞান রাখে, তাদের জানার কথা রাসুল (সাঃ) শুধু আরব বা কোন বিশেষ গোত্রের জন্য প্রেরিত পুরুষ নন, বরং সমগ্র দুনিয়ার মাণব জাতির জন্যই তিনি প্রেরিত পুরুষ। কাজেই সেজন্যই হয়তো এখন সারা পৃথিবীর মানুষ তার সে উপহারের ফল ভোগ করতে পারছে!
যাহোক, ককেশাস এর মুসলিমরা খুব যত্ন করে এই ‘বিশেষ বস্তু’ লালন করত। এবং তারা পাহারা দিয়ে নিশ্চিত করেছিল, যেন কোন ভাবেই এ বস্তু তাদের এলাকার বাইরে বেরিয়ে না যায়! এর উপকারিতা থেকে ফায়দা পেয়েই সন্তুষ্ট ছিল না –- অতি ‘গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ’ টি হাতিয়ে নেয়ার জন্য আগ্রহী উঠেছিল অনেকে! বিশেষ করে সংখ্যা গরিষ্ট রাশিয়ান সমাজ। রাশান চিকিৎসকরা এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও পাকস্থলী ও অন্ত্রের চিকিৎসায় এর গুরুত্বের কথা জানতে পেরে কিভাবে এটা হাত করা যায় এর চেষ্টা করছিল। এক পর্যায়ে তারা মস্কোর এক ডেইরী কোম্পানির মালিক নিকোলাই বালান্দভ এর স্মরণাপন্ন হয়!
রাশিয়ার এই সম্মিলিত গ্রুপ এক পরমা সুন্দরী মেয়েকে টোপ দেখিয়ে একাজের জন্য মনোনীত করে। নাম তার ইরিনা সাখারোভা! তাকে দায়িত্ব দেয়া হল, সে যেন ককেসাস এর রাজপুত্র – বেক (বেগ) মীর্জা বকরভ –এর সাথে ভাব জমিয়ে তার কাছ থেকে কেফির এর ‘বীজ সংগ্রহ করবে। সে চেষ্টায় সে রমনী প্রথম পর্যায়ে সফল হয়, অর্থাৎ ভাব জমিয়ে ফেলে রাজপুত্রের সাথে। কিন্তু মীর্জা বেগ রাসূলের উপহারকে অন্যের হাতে দেয়ার যে নিষেধাজ্ঞা তাদের এলাকায় চালু হয়ে গেছে – তা লঙ্ঘনে রাজি হয়নি! ইরিনা আরও জায়গায় চেষ্টা করতে গিয়ে কিডন্যাপ হয়ে যায়! তখন ‘বিয়ের কন্যা’ চুরি করার রেওয়াজ ছিল! যারা কিডন্যাপ করেছে, জান বাঁচানোর জন্য তাদেরকে ইরিনা জানায় সে – মীর্জা বেগ বাকরভের বাগদত্তা! এভাবে কিডন্যাপারের হাত থেকে সে বেঁচে যায়, এবং তাকে মীর্জা বেগ এর হাতে পৌঁছে দেয়া হয়!
এবার মীর্জা বেগ তাকে বিয়ে করতে চাইলে – ইরিনা রাজি হয় না। তার উদ্দেশ্য তো বিয়ে নয়, প্রতারণা ! কাজেই সে রাজী হবে কি করে! এ সময় ষড়যন্ত্রকারীদের একটা গ্রুপ তাকে সে পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে এবং মীর্জা বেগ এর বিরুদ্ধে ইরিনা অভিযোগ করে রাশিয়ার ‘জার ( Tsar) এর কাছে!
রাশিয়ান জার, বিচারে মীর্জা বেগকে দণ্ড দিতে মুখিয়েই ছিলেন, হাজার বছরের অবিশ্বাস আর ঘৃণা – বর্ণবাদ সবকিছুই হয়তো জড়িত! ক্ষতিপুরন হিসেবে ১০ কিলো কেফির দিয়ে দিতে মীর্জা বেককে আদেশ করলেন জার! বিচারের সম্মুখীন হয়ে মীর্জা বেগ এর কিছু করার ছিল না!
এভাবে রাশানরা এই ‘ম্যাজিক কেফির হাতে পেল! স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে দিতে হল । এজন্যই হয়তো – সে কেফির এক অতি উপকারী পানীয় হিসেবে আজও কাজ করছে, ককেশাস এর মুসলিমদের এলাকায় শুধু নয়, তা সাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এখন, কিন্তু ফায়দা লুটছে অন্য মুনাফাখোররা। ককেশাসবাসী ‘কপিরাইট পেল না এই যা দুঃখ!
কি উপকার হয়ঃ
পেটের সমস্ত সমস্যা দূর করে, কষ্টকাঠিন্য দূর করে, গ্যাস দূর করে, ইমিউনিটি বাড়ায়। উচ্চ মাত্রায় ভিটামিণ বি ১২, কে ২ – আয়রন, ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম বায়োটিন, ফোলেট রয়েছে কেফির মিশ্রিত পানীয়ে! ৬ আউন্স এর এক ক্যান কেফির এর মধ্যে পাওয়া যাবে যথাক্রমে ৬ গ্রাম প্রোটিন, ২০% ক্যালসিয়াম, ২০% ফসফরাস, ১৪ % ভিটামিণ বি ১২, রিবোফ্লাভিন (B2) ১৯%, ম্যাগনেসিয়াম ৫%, পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি এবং কে ২ সব মিলিয়ে প্রায় ১০০ ক্যালরি,ওল্প কিছু কার্বোহাইড্রেট সহ। কিন্তু আর খুব সামান্য পরিমাণে যা আছে তার গুরুত্ব আরও বেশী, জৈব এসিড এবং কিছু বায়ো একটিভ কম্পাউণ্ড। আর সব কিছু বাদ দিলেও এই অল্প কিছু সক্রিয় যৌগ মানবদেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো সহ দারুণ কিছু কাজ করে, যা এর দশ গুণ পরিমাণ ঔষধ দিয়েও সম্ভব নয়! আর সবকিছু মিলিয়ে এ যে কাজ করে তার একটা লিস্ট নিম্নে দেয়া হলঃ
পেট ভাল রাখে
হজমে সহায়তা করে
কোষ্টকাঠিন্য দূর করে
অন্ত্রে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বাড়ায়, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দূর করে
হাঁপানি, এলার্জির সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে
কাশ, ঠাণ্ডার সংক্রমণ হ্রাস ও এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাড়ায়
ব্রণ সমস্যা দূর করে
ক্ষতিকর ইষ্ট সংক্রমণ রোধ করে
এণ্টি বায়োটীক খেয়ে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সাথে ভাল ব্যাকটেরিয়াও নিকেশ হয়, এটা সেই ভাল ব্যাকটেরিয়ার পূণঃ যোগান দেয়!
প্রকৃতিগত ভাবে ভাল অনুভূতির সৃষ্টি করে, পান করলে সূনিদ্রা হয়
ডায়রিয়া ভাল করে
আলসার ভাল করে
শক্তিশালী প্রোবায়টিও, ব্যথা বেদনা কমায়
ওজন কমাতে আজকাল ব্যবহার হচ্ছে, কারন পেট ভাল তো সব ভাল আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় । প্রোবায়টিক !
কিভাবে প্রস্তুত?
আমাদের দেশের দই এর মত করেই প্রস্তুত করা হয়, তবে দুধ জ্বাল দেয়ার প্রয়োজন নেই! এটা আমাদের দেশের দই থেকে একটু কম ঘন আর একটু বেশী টক! দুধের পাত্রে কেফির এর পিন্ড ডুবিয়ে ১২ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা রেখে দিলেই দই তৈরি হবে। এরপর দই ঢেলে নিয়ে ঐ পাত্রে কেফির পিন্ড (বীজ) রেখে, সেখানে আবার দুধ ঢেলে দিলে আবার কেফির তৈরি হবে, এই ভাবে চলতে থাকবে চক্র! তবে এ ব্যাপারে এক মজার গল্প শুনা গেছে !
চামড়ার মশকে কেফির সহ দুধ ভরে, ঘরের দরজার পাশে ঝুলিয়ে রাখা হত! এবার সে বাড়ির সদস্যদের যে কেউ দরজা দিয়ে বের হচ্ছে বা ঢুকছে, সে-ই দুধ ভর্তি মশকের গায়ে একটা ঘুসি মেরে যাবে বা একটা ধাক্কা দিয়ে যাবে! এতে করে কেফির দুধের সাথে মিশে যাওয়ার সুযোগ হল! বারবার এরকম ঘর্ষণে সাড়া মশকের দুধ, দইতে পরিণত হবে আস্তে আস্তে! ঘরের সবাই মিলে নিজেদের পাণীয় তৈরি করছে – মজার নয় ব্যাপারটা? দুধের সাথে কেফির বীজের মিশ্রিত হওয়াটাই আসল কথা~! অণুজীব গুলো দুধের ল্যাকটোজ ভেঙ্গে ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে, এজন্য এসিডের আধিক্যে এক পর্যায়ে দই টক হয়ে যায় প্রসেসটা এরকমই!
বিনা পরিশ্রমে শুধু দুধের যোগান থাকলেই বছরের পর বছর ধরে, এক টুকরো কেফির বীজ দিয়ে এমন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা পাণীয়ের যোগান দেয়া সম্ভব। যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে, আপনার আমার পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আর আমরা তো জানি, prevention is better than-----!
বিষয়: বিবিধ
১৩৭০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন