এক মোহময় রুপালী রাত
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২৯ জুন, ২০১৬, ০৮:৪৯:৫৪ রাত
রহমতের প্রথম দশ দিনে শেষ হয়ে গেছে !
অর্জন তেমন কিছুই হল না, তবে কিছু না কিছু তো হবেই- চেষ্টা করলে, এ আশা তো একজন মুসলিমের আছেই! সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই- রাতে তারাবীহ শেষ করে বেরিয়েছি মসজিদ থেকে । ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত পেরিয়ে! মসজিদের পেছনদিকে প্রলম্বিত পারকিং লট – নিজের গাড়ির দিকে যাচ্ছি; পরিচ্ছন্ন আকাশ, ফকফকে জোস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক, মৃদু বাতাস বইছে। হঠাৎ এক তীব্র সুগন্ধ আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলল! হাসনুহানার সুগন্ধের মত- তবে - এরসাথে কর্পূর আর এলাচকে মিশ্রিত করলে যেমন হবে – এমন তীব্রতা এ গন্ধের! ঠাণ্ডার দেশে বিজ্ঞান সম্মত কারনেই, ফুলের গন্ধ এতটা ছড়ায় না! অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠলাম, জানতেই হবে এর উৎস কি! ইতি উতি তাকাতে শুরু করলাম!
আমার জোসনা- রোগ ছিল, ভরা পূর্ণিমায় ঘুমাতে পারতাম না। এত ভূবন ভরা আলো- ! এর মধ্যে মানুষ ঘুমায় কি করে! এমন চাঁদের আলো- মরি যদি সেও ভাল, সে মরণ – কিসের সমান যেন! শুধু সেই ‘আলোর জগতের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে অনেক বিনিদ্র রাত পার করেছি! শহর বাসী লোকের চশমা ঢাকা চোখে - বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি যেন জোস্নার আলোকে কবেই ম্লান করে দিয়েছে। সে জোসনা প্রীতি এখনো কমে যায় নি, তবে এর উপরে আবরণ পড়ে গেছে! মাঝে মাঝে ক্যাম্পিং এ গেলে অবারিত জোস্নায় সে আবরণ উঠে যায়, সময়ে তা আবার পড়ে!
মসজিদের পেছনে এত বেশী আলো নেই। সেজন্যই চাঁদ তার পশরা মেলেছে। স্বপ্নের হাতছানি দেয়া এক রুপালী রাত্রি !
বেশিদূর যেতে হল না, আমার গাড়ির পেছনেই শেষ হয়েছে পারকিং লট। ওপাশের এক রুপালী পাতা বিশিষ্ট গাছ ।
পারকিং এর ফেন্স এর গায়ে হেলান দিয়ে ; তার ঝোপালো পাতার খানিকটা ফেন্স এর ভেতরে ঠেলে দিয়েছে, রুপালী পাতায় আলো পড়ে ঝিলিক দিচ্ছে- স্বপ্নিল পরিবেশ ! ঘন বুনটের রুপালী পাতা, বেশ জনপ্রিয় গাছ, আশেপাশে অনেক চোখে পড়েছে, ফুল দেখা হয়নি এখনও, ফুল ধরেছে নাকি ? মনে হচ্ছে গন্ধটার উৎস এই রুপালী পাতার গাছটিই!
গন্ধটা এদিক থেকেই আসছে! এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিলাম একটা ডাল! মেয়েদের নাকফুলের মত ছোট ছোট হলুদ ফুল ফুটেছে, এক ডালে পাতার ফাঁকে ফাঁকে অনেক ফুল!
ল্যান্ডস্কেপাররা মাটির উঁচু নিচু ঢাল- জ্যামিতিক আকার – জল নিষ্কাশন –ইউনিক ডিজাইন আর সিজনাল ফুল ফল নিয়েই শুধু ভাবেন না, তারা গাছের পাতার ও ফুলের রং নিয়েও চিন্তা ভাবনা করেন, যে বাড়িটার সামনে ডিজাইন হচ্ছে তার পেইন্টিং এর সাথে কত খানি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে একটা গাছের পাতার ভিন্ন রং - সেটাও বিবেচনা করেন! এর সাথে সে গাছের জীবন আচার- স্বভাব বেড়ে উঠা- সব কিছুই তাদের ভাবতে হয়! টরন্টোর আশেপাশে এই রুপালী গাছটির বেশ কদর দেখি, প্রায়শ বাড়ির পাশে এবং রাস্তার ধারেও বেড়ে উঠে সহজেই, খরা সহ্য করতে পারে (drought resistance) এবং খুব একটা যত্ন আত্তি দরকার পরে না, হয়তো এ কারনেই এর ব্যবহার বাড়ছে!
মজার ব্যাপার হল, এটা জলপাই নয়, তবে এর চালু নাম -রাশিয়ান অলিভ । Elaeagnus angustifolia । রাশিয়া ও এশিয়ার- নেটিভ বলে ভাবা হয় একে, ইরান-আফগান- তুরস্কে দেখা যায়, পারসিয়ান অলিভও বলে অনেকে! কবে এসেছে উত্তর আমেরিকায় বলা মুশকিল, রেকর্ড নেই! তবে উদ্যানের গাছ হিসেবে - ছায়া, বাতাস ও তুষারের বিরুদ্ধে বাধা (barrier), মাটিকে স্থিতিশীল করা, বুনো পরিবেশের ভারসাম্য, মৌমাছির জন্য খাবার আর উদ্যানের রুপালী ঝোপ – সবগুলো উদ্দেশ্যেই একে কাজে লাগানো হয়েছে! তবে ১৯০০’র গোড়ার দিকে সরকারী ভাবে এর বনায়ন করা হয়- মূলতঃ উইন্ড ব্রেকার হিসেবে! ক্যালিফোর্নিয়ার পাহাড়ি এলাকায় সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্দেশ্যে লাগান হলেও এরা নিম্নগামী জলাশয়ের পথ ধরে সমভূমির রাস্তার ধারেও বিস্তৃত হয়েছে! কম পানিতেও টিকে থাকে জন্য সেমি এরিড (Semi arid) এলাকা পেরিয়ে দক্ষিন অ্যামেরিকা পর্যন্ত এরা পৌঁছে গেছে! জমি পুনরুদ্ধারের (Land reclamation) উদ্দেশ্যে এদের কাটিং খনি এলাকায় লাগান হয়েছে – কিছু সাফল্য দেখা গেছে!
কানাডার নোভাস্কোশিয়ায় মূলতঃ সৌন্দর্যের কারনে লাগান শুরু হয় – এরপর অন্টারিওর উত্তরে, এখন দক্ষিণেও! ১৬-২৬ ফুট দীর্ঘ, ক্যানপি ছায়া দেয় প্রায় ৪০ ভাগ। এর তলায় Cheat grass, Canada thistle, stinging nettle (Urtica dioica) এর রাজত্ব!
চাঁদনী রাতের মৃদুমন্দ বাতাসে রুপালী পাতার ঝিলিকেই একরাশ মুগ্ধতা, এর সাথে মদির গন্ধ অন্য কোন ভূবনের ইঙ্গিত বহন করে যেন। আধ্যাত্মিক উন্নয়নের এ মাস – মসজিদের পেছন থেকে ভেসে আসা এ ফুলের সুগন্ধ প্রার্থনারত মানুষ গুলোকে যেন বেহেশতী হাওয়ার পরশ বুলিয়ে এবাদতে মগ্ন করছিল! এমন আচ্ছন্ন করা পরিবেশ ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করে না স্বভাবতঃ। তবে ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই, কালকে অফিস যেতে হবে সকালে এ ভাবনা আমায় তাড়িত না করলে হয়তো আরও কিছুক্ষণ এ মোহময় পরিবেশে থাকা যেত!
এমন মোহাচ্ছন্ন নিরিবিলির নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে গর্জন করে উঠল গাড়ির ইঞ্জিন, পাশের গাড়ির হেড লাইট জ্বলে উঠেছে – আর দেরি করা গেল না! গরজ বড় বালাই, ঘুমাতে হবে- যদি অফিসে নাম খারাপ না করতে চাই! সুনামও এক মাথা ব্যাথা বিশেষ, টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট কাঠ খড় পোড়াতে হয়! আরেকবার ‘তৃষিত নয়নে’ চেয়ে বিদায় নিলাম। অবিরাম সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে রুপালী মোড়কে ছোট ছোট হলুদ ফুল গুলো!~ বাইরে ঝিকঝিক করছে- স্বপ্নিল, রুপালী রাত!
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৩ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমাদের দেশে শহরগুলি হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষহীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন