হিরোইন পপি Papaver somniferum
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২৫ এপ্রিল, ২০১৬, ০৯:৪৫:২৩ সকাল
হাসপাতালে দুর্ঘটনা কবলিত রোগী এসেছে, ভাঙ্গা পায়ের ব্যথায় চিৎকার করে পাড়া মাথায় করছে। অপারেশন চেম্বার দূরের কথা – এই অবস্থায় তার চিৎকার আর কষ্ট লাঘব করা অতি জরুরী! ডাক্তার একটু দেখে নিয়ে তড়িঘড়ি করে একটা ইঞ্জেকশন ফুঁড়ে দিলেন! আস্তে আস্তে রোগীর সাড়া শব্দ কমে এলো; তার ব্যথা এখন সহনীয় পর্যায়ে, আস্তে করে ঘুমিয়ে পড়ল সে! কি ইঞ্জেকশন দিলেন ডাক্তার! ওহ, মরফিন! আমরা প্রায় সবাই জানি এই ঔষধের নাম! কোন গাছ থেকে তৈরি করা হয় এই ঔষধ?
অত্যাধুনিক চিকিৎসার অঙ্গ, অতি প্রয়োজনীয় এক সৌন্দর্যময় ফুল! আবার কুখ্যাতিও যার দুনিয়া জোড়া! অসংখ্য সুন্দরী ললনা যে নাম নিয়ে ধন্য হয়েছে, এই দ্বৈত চরিত্রের ফুল আমাদের আজকের আলোচ্য। নাম তার পপি!
আফিম এর নাম প্রথম জেনেছিলাম শরৎচন্দ্রের গল্প পড়তে গিয়ে! আফিম বা opium এর উৎস হল এই চমৎকার, আকর্ষণীয় ফুলটি! যখন পপির কল্পনা করি, এক লাল টুকটুকে অনিন্দ্য সুন্দর চেহারা– যেন ছুঁয়ে দিলেই ঝরে যাবে- এমন স্পর্শকাতর – মোহনীয় ত্বকের ফুল, চিকন, নরম সবুজ কাণ্ডের উপর মৃদুমন্দ বায়ে মস্তক হেলিয়ে ডানে বামে দুলছে’ – এমন চিত্র দেখতে পাই ! কতই না সুন্দর এ দৃশ্য ! যখন সবুজ ঘাসের গালিচায় গোটা মাঠ জুড়ে লালে লাল হয়ে ফুটে থাকে অজস্র পপি! এমন হাজারো ‘পপি-ফোটা’ মাঠের ধারে, গাছের নীচে শুয়েই বোধ হয় ওমর খৈয়াম লিখেছিলেনঃ
এক সোরাহী – একটু রুটির ছিলকে আর,
প্রিয়া সাকি, তাহার সাথে একখানি বই কবিতার;-------- এমন অনুভূতির কাছে
সমরখন্দ বোখারা নস্যি!
যে সময়ের কথা হচ্ছে, সে সময়ে সমরখন্দ, বোখারা ছিল আজকের নিউইয়র্ক, লন্ডন বা তো-কিও ( টোকিও নয়, যদিও অনেকে সেটাই শুদ্ধ ভাবেন!) এর সম পর্যায়ের শহর, সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু বিশেষ!!
বর্ণমালা ক্রমে আজকের পালা আলবেনিয়া! পপি -আলবেনিয়ার জাতীয় ফুল হলেও, অনেক দেশেই পপি কিন্তু বিশেষ ফুলের মর্যাদায়- । কানাডায় প্রতি বছর ১১/১১ (নভেম্বরের ১১) তে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সৈন্যদের স্মরণে, পপি ফুল ধারন করা হয়; বুক পকেটে পপির প্রতিকৃতি – এ সময় এক স্বাভাবিক দৃশ্য! দেশপ্রেমের প্রতীক মনে করা হয়! প্রতিটি শপিং মলে পপি ফুলের ছবি সহ দান বাক্স রাখা থাকে । অনেক ভলান্টিয়ার পপি ফুলের প্রতিকৃতি বিক্রি করে দান সংগ্রহ করে, যা সৈন্য বা তাদের স্মৃতি বা তাদের পরিবারের সহায়তায় কোন ফাণ্ডে চলে যায়! আলবেনিয়ার জাতীয় ফুল যে পপি (Papaver rhoeas), তা বহুল আলোচিত সে পপি নয়, সে বিখ্যাত বা কুখ্যাত পপি হচ্ছে Papaver somniferum!
Papaver somniferum যার অর্থ হল “ঘুম টেনে আনা পপি”! এই প্রজাতিই কেবল আফিম বা Opium এর উৎস, এই আফিম থেকে আরও অনেক প্রয়োজনীয় ড্রাগ উৎপন্ন হয়। “হিরোইন এর মরণ ছোবল” এমন শিরোনামের সাথে, কঙ্কালসার মৃতপথযাত্রী যুবকের দেবদাস মার্কা ছবি পত্রিকায় আমরা হরহামেশাই দেখি! এই গাছেরই ফলগাত্র (Pod) থেকে সংগৃহীত রেসিন-বা উপক্ষার হল এই মরণঘাতী নেশাদ্রব্যের উৎস! উপক্ষার থেকে পরিশোধিত মূল রাসায়নিক দ্রব্যটি হচ্ছে মরফিন ! এছাড়াও এথেকে পাওয়া যায়thebaine, codeine, papaverine, noscapine । মরফিন মূলতঃ ব্যথা নাশক তথা ঘুমের ঔষধ (SEDATIVE) আর, এ থেকেই আরও পরিশোধিত করে তৈরি হয় মরণ নেশা ‘হিরোইন; সুন্দরী নায়িকাই – তবে মরণ পথের!
১৮৯৮ সালে হিরোইন প্রথম তৈরি করে এক জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি- BAYER; মূলতঃ তারা একে বাজারজাত করে যক্ষ্মা রোগের ঔষধ হিসেবে, আবার তা দিয়ে মরফিন এর নেশারও চিকিৎসা করা যাবে! হা হতোস্মি! কার্যত প্রমাণ হয়েছে- এই হিরোইন আরও বেশী নেশাকর; এখন সেই হিরোইনের আসক্তির চিকিৎসার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে! এর চিকিৎসায় আরও এক সাবস্টিটিউট ‘মেথাডোন’ ব্যবহার করার ব্যবস্থা হল, (এর আবিস্কারকও জার্মান বিজ্ঞানীরা, অস্ত্রোপচার এর জন্য ব্যথানাশক খুঁজতে গিয়ে এর আবিস্কার! ) ইউ এস এ রপ্তানী হওয়ার পরে ১৯৪৭ এ এর নাম দেয়া হল ডলোফিন (Dolophine) । দুর্ভাগ্যক্রমে দেখা গেল, এটির আসক্তি আরও বেশী! আমার এক উস্তাদ যথার্থই বলেছিলেন- “কুইনিন জ্বর সারাবে বটে, কিন্তু কুইনিন সারাবে কে”?
১৯৯০ এর দশকে জরীপে দেখা গেছে হিরোইন আসক্তদের মৃত্যুহার অন্যান্যদের চাইতে ২০ গুণ বেশী! এর ভয়াবহতা প্রমাণিত! তবে এর জন্য তো আমাদের ‘পপি বেগমকে দায়ী করা যাবে না!~ এ যেন পরমাণু শক্তির মত, একে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কিম্বা ক্যন্সারের চিকিৎসায় যেমন ব্যবহার করা যায়, আবার পরমাণু বোমা মেরে হিরোশিমা নাগাসাকির মত নিমিষে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলা যায়; দোষ তো আমাদের মত দু’পেয়ে জানোয়ারদের, পরমাণুর নয়!
হিরোইনকে ইঞ্জেকশন হিসেবে, নাক দিয়ে টেনে বা ধূমপানের সাথে শরীরে অনুপ্রবেশ করানো হয়; রক্তে মিশে গেলে এর প্রতিক্রিয়ায় ব্যবহারকারী- কিছুক্ষণের জন্য নেশার ‘ঊর্ধ্বগগনে উঠে যায়, প্রচণ্ড যৌন তাড়না অনূভব করতে পারে (সাময়িক), পিপাসার্ত হতে পারে, কিন্তু এর আসক্তি থেকে বের হয়ে আসা খুব কঠিন! এটার দাম অত্যাধিক জন্য, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে- নানা ধরণের ভেজাল মিশ্রিত হয়ে এটা বাজারে বিক্রি হয়। নেশাকারী জানেও না সে কি ঢুকিয়ে নিচ্ছে শরীরে- ওভারডোজ হচ্ছে নাকি তা বিষাক্ত, তা জানার উপায় নেই! আর এ ভেজাল গুলো রক্তপ্রবাহের নালীতে ‘রক্ত জমাট (Blood clot) করে দিতে পারে- এখান থেকে ইনফেকশন হতে পারে! ব্রেইন, ফুসফুস বা কিডনিতে এমন ইনফেকশন হলে জীবন ঝুঁকি পূর্ণ হবেই! একবার অভ্যস্ত হলে নেশাকারীর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ( immune system) খুব দ্রুত ভেঙ্গে পড়ে। চিমসে, দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত, শুকনো হাড্ডিসার চেহারা দেখে নেশাকারীর অবস্থা অনুমান করা যায়!
“সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তা হল কিভাবে হিরোইন সংগ্রহ করা যাবে এবং তা শরীরে ঢুকান হবে, বিকেলে তা পাওয়া গেল এবং নেয়া হল, রাতে হিরোইনের নেশায় ঘুম, শুধু যেন এর জন্যই বেঁচে থাকা – আর সব গৌণ! “বাড়ী, গাড়ী সব গেছে, আমার যা কিছু মূল্যবান ছিল অল্পদিনের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে; এর পর যা কিছু মায়ের ছিল তাও গেছে; পথের ভিখারির যে মর্যাদা থাকে আজ আমার তাও নেই”!
“চুরি করেছি, প্রতারণা করেছি, গৃহহীন হয়েছি, এত যন্ত্রণা সহ্য করার চেয়ে, মনে হয় মরে গেলেই ভাল ছিল-!”
উপরের বাক্য গুলো, বাস্তবেই কিছু নেশাসক্ত মানুষের বুক ফাটা আহাজারি!!
যদিও আমাদের প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্যের বাইরে; তবুও এ সম্পর্কে মানুষকে ন্যূনতম ধারনা দেয়ার জন্য এ তথ্য টুকু যোগ করা হল! মানুষ যেন সচেতন হয় এই ভয়ংকর নেশা দ্রব্য সম্বন্ধে, সতর্ক হয় নিজে এবং সতর্ক করে অন্যদেরকেও!
পপি ফলের গায়ে ধারালো কিছু দিয়ে দাগ টেনে দিলে বা খূব হালকা ভাবে ফলত্বক চেঁছে নিলে, এর গা থেকে সাদা, আঠালো কষ বা রেসিন বেরিয়ে আসে (ছবি- ); বাণিজ্যিক ভাবে, এই কষ সংগ্রহ করে, তা পরিশোধনের মাধ্যমে মরফিন তৈরি করা হয়!
ওষধি গাছ, বর্ষজীবী, দ্বি বর্ষজীবী ( কিম্বা সংক্ষিপ্ত বহুবর্ষজীবী) ! ৩ থেকে ৬ ফিট উঁচু হতে পারে পপি গাছ, ফুল গুলো ৩- থেকে ৬ ইঞ্চি ব্যস এর মধ্যে! চার থেকে ছয় পাপড়ির ফুল, মাঝখানে পুংকেশর গুলি মিলে মিশে সত্যিকার ‘চক্র তৈরি করে। পাপড়ী রং লাল, বেগুনি তো বটেই, সাদা ও কাল রং এর পপিও রয়েছে! উজ্জল হলুদ বর্ণের ক্যালিফোর্নিয়া পপি (Eschscholzia californica ) ও অত্যন্ত মনোহর! এর মধ্যেও বিচিত্র ভ্যারিয়েশন রয়েছে, লাল বা বেগুনি পপির পাপড়ির কিনারা ঘেঁষে সাদা ‘লেস আরও বৈচিত্রতা যোগ করে, সুন্দরী মেয়ের কপালে বর্ণময় একটা উজ্জল ফোঁটা যেমন তার সৌন্দর্যে আরও এক ব্যঞ্জনা যোগ করে, তেমনি! এর গায়ে বা পাতায় আঠালো রেসিনের উপস্থিতি ঠিক স্বস্তিদায়ক নয়, ক্ষেত্র বিশেষে মনে হয় সাদা ধরণের পর্দা পড়ে আছে যেন। তামাক গোত্রের সাথে আত্মীয়তা আছে- এ থেকে জ্ঞানীজনরা বুঝে নেন ।
মধ্য এশিয়া - বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এর আদিবাস বলে অনুমান করা হয়, কারণ এখনও এদিকে পাহাড়ি ঢালে, বা প্রান্তরে, অযত্নে, অজস্র বুনো পপি ফুটে থাকে! উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে, যে সব গাছপালা যে সকল এলাকায় বুনো অবস্থায় বা অযত্নে জন্মাতে দেখা যায়, সে এলাকাই আসলে এর আদি বাসভূমি! ধানের ক্ষেত্রে যেমন উড়িষ্যা (ধানের উদ্ভিদ তাত্ত্বিক নামের প্রথম অংশ ‘Oryza এসেছে এই উড়িষ্যা থেকেই, এ এলাকায় বুনো ধান এখনও জন্মায়! যদিও উত্তর বঙ্গের চলন বিল এলাকাতে দেখেছি বুনো ধান জন্মাতে, সেজন্য বাংলাদেশও ধানের আদি বাসভূমির অন্তর্ভুক্ত, বাংলা- বিহার -উড়িষ্যা- খুব দূরের নয়; যাক সেটা অন্য গল্প)। এরপর, ধরে নেয়া হয় পশ্চিম ও সেন্ট্রাল ইউরোপের আদিবাসীদের হাতে খৃষ্টপূর্ব ৬০০০ থেকে ৩৫০০ বছরের মধ্যে ইউরোপে এর সমাজায়ন (domestication) হয়েছে! এখনতো সাড়া বিশ্বে এ ফুলকে একনামে চেনেনা – এমন মানুষ কমই আছে!
নেশা বা ড্রাগ কিম্বা ঘুমের ঔষধ নয়, খাবার হিসেবেও এর ব্যবহার রয়েছে! পপি বীজ ‘কেক এর ডেকোরেশন এ ব্যবহৃত হয়। ফলত্বক মারাত্মক উপক্ষারের উৎস, কিন্তু বীজে এর উপস্থিতি অতি সামান্য! পপি বীজে তেল, শর্করা প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম রয়েছে আনুপাতিক হারে যথেষ্টই! এই তেল সালাদ বা অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা যায়! অপার সৌন্দর্যের উৎস এই ফুল, কাজেই হৃদয়ের খোরাক তো বটেই, আবার ক্ষতিকর নেশাদ্রব্যের স্পর্শ এড়িয়ে, পপি বীজের স্বাদ আস্বাদনও করা যাবে ‘অতি উপাদেয় কেক খেয়ে! জয়তু পপি!
বিষয়: বিবিধ
৩৯৬৯ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিন্তু হচ্ছেনা। দুঃখজনক ।
শিরোনাম টা পাঠককে আকর্ষণ করতে পারছেনা
Click this link
মন্তব্য করতে লগইন করুন