জাতীয় ফুল -২
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ৩১ মার্চ, ২০১৬, ০৭:২৭:২০ সকাল
বাংলার জাতীয় ফুল শাপলা দিয়ে শুরু করেছিলাম! বিশ্বে জাতীয় ফুলের মর্যাদা নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুল রয়েছে! অনেক গুলো আমাদের জানা, অনেক জানিনা! এই জানার আগ্রহ থেকেই - ধারাবাহিক ভাবে জাতীয় ফুল নিয়ে লিখার শুরু! এবং এখান থেকে সামনে এগুনোর ইচ্ছা! আসুন- আ দিয়ে শুরু করি!
প্রথমেই আসে আফগানিস্তান এর নাম । এদেশের জাতীয় ফুলের নাম কি?
তার আগে একটু ভূমিকা;
“দুই গাড়ি গম, চার গাড়ি রাই (এক ধরণের দানা শস্য ), চারটে মোটা তাজা ষাঁড়, আটটা মোটা তাজা শুকর, ১২টি মোটা তাজা ভেড়া, দুই পাত্র মদ, চার ব্যারেল বিয়ার, দুই ব্যারেল মাখন, ১০০০ পাউন্ড (প্রায় ৪৫৪ কেজি!) পনীর, একটা পূর্ণ বিছানা, এক প্রস্ত পোশাক ও একটা রৌপ্য পাত্র”!
এর দাম এখনকার বাজারে কত হবে? কেউ এই পরিমাণ টাকা দিয়ে যদি একটা ফুলের বাল্ব কেনে – তাকে কি বলবেন আপনি!
জী! এটা শুধু একটা ভাইসরয় টিউলিপ বাল্ব এর বিনিময় মূল্য ছিল- হল্যান্ডে ১৬৩০ এর দশকে! ইতিহাসে এর চেয়ে বেশী দাম দিয়ে কেউ একটা ফুলের কন্দ কেনে নি!! এছাড়াও সেম্পার অগাস্টাস জাতের একটা বাল্ব এর দ্বিগুন দামে বিক্রি হয়েছিল বলে রেকর্ড রয়েছে!
আফগানিস্থান এর ‘পপি বিশ্ব জোড়া বদনাম এনে দিলেও তাদের জাতীয় ফুল হচ্ছে এই অনিন্দ্য সুন্দর ফুল। টিউলিপ! লিলিয়েসি পরিবারের অনেক সৌন্দর্যময় ফুলের মধ্যে, ফুলের রানী বলতে হয় – টিউলিপকে!
ডিভিশন – MAGNOLIOPHYA পরিবার – LILIACEAE, GENUS – Tulipa!
আজকাল অবশ্য টিউলিপ বলতেই হল্যান্ড বা নেদারল্যান্ডের দিগন্ত জোড়া বিশাল বাগানের অসীম সৌন্দর্য চোখের সামনে ভেসে উঠে! গোলাপ আর চন্দ্রমল্লিকার পর, সৌন্দর্যপিপাসুদের জনপ্রিয়তার তালিকার তৃতীয় শীর্ষস্থানে এই পুস্পরানী! কিন্তু হল্যান্ড এই সৌন্দর্য ধার করেছে তুরস্কের উসমানী সালতানাত থেকে, অন্ততঃ এর শুরুতে! !
টিউলিপের চাষ সম্ভবতঃ ১০ শতকের দিকে, পারস্যের মহাকবি উমর খৈয়াম এবং জালাল উদ্দিন রুমী এই ফুলের উল্লেখ করেছেন! ত্রয়োদশ শতকের পারস্য গীতিকাব্যে এর উল্লেখ আছে! শেখ সাদী’র ‘গুলিস্তাঁয়, বেহেশতের উদ্যানের বর্ণনায় উঠে এসেছে ”সুশীতল শান্তিদায়ী ঝর্ণা আর মৃদুমন্দ হিল্লোল – পাখীর কাকলী- ‘ফলভারানত বৃক্ষ’, পুস্প তরু ছায়া আচ্ছাদিত উদ্যানে উজ্জল রঙের বর্ণাঢ্য “টিউলিপ” আর সুগন্ধি গোলাপ !
তবে ইউরোপে এই সৌন্দর্যের রানী প্রথম বিস্তারলাভ করেছে তুর্কীর মুসলিম সুলতানদের পৃষ্টপোষকতায় । মুসলিমদের জন্য পাগড়ি এক মর্যাদার প্রতীক (পাগড়ি মাথায় ২ রাকাত নামাজ, পাগড়ি ছাড়া ৭০ রাকাত নামাজ পড়ার চাইতে উত্তম; আল হাদিস) । এই পাগড়িকে বলে ইংলিশে বলে Turban! তুর্কী ভাষায় মূল শব্দটি –Dulband! or dulpand ! সম্ভবতঃ তুর্কী ভাষা থেকেই অনুদিত হয়েছে- Turban! Tulip নামটা এসেছে এই Turban থেকেই! বাংলায় যেমন হস্ত- হত্ত থেকে হাত, হয়তো তেমনি তুর্কী ভাষায় তা –Dulband বা dulpand হয়ে tulipan এবং সেখান থেকে Tulip এ এসে দাঁড়িয়েছে! B আর P – কিম্বা L এবং R এর গোলমাল আরবি বা বাংলা ভাষায় হরদম চোখে পড়ে! আরও একটা সাদৃশ্য রয়েছে! ভাল করে টিউলিপ ফুলের দিকে তাকিয়ে দেখুন, পাশ থেকে টিউলিপ ফুলের দলমণ্ডলের যে প্যাঁচানো বিন্যাস- দেখা যায়, একটু কল্পনা প্রবণ হলে দেখতে পাবেন – এ যেন একজন পাগড়ি পরিহিত মানুষের মাথা! এভাবেই মুসলিম সংস্কৃতির পাগড়ির সাথে তথা ইসলামের সাথে ইউরোপে- টিউলিপ এর নাম জড়িয়ে গেছে!
উসমানী সুলতানগণই সর্ব প্রথম ইউরোপে এর চাষ এবং সংকরায়নের মাধ্যমে এর উৎকর্ষ সাধন করেছেন । ১৫৫০ এর দশকে তুরস্ক থেকে হল্যান্ডে এবং অস্ট্রিয়ার রাজকীয় বাগানে টিউলিপ পৌঁছে যায়! তুরস্কে নিযুক্ত তৎকালীন অস্ট্রিয়ার উজির (Ogier Ghislain de Busbecq, Fardinad-I এর রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এখনকার ভাষায়- এমব্যাসাডর ) তার ‘চিঠিতে অস্ট্রিয়ার সম্রাটকে লিখেছেনঃ
“আমরা যখন পাশ দিয়ে যাই ( তুরস্কের সুলতানের বাগান গুলোর পাশ দিয়ে), দেখি, সর্বত্র অজস্র ফুলের সমাহার - নারসিসাস বা হায়াসিন্থ ফুলের মত; তুর্কীরা তাদের বলে tulipan, ঋতু বৈচিত্রকে চমক লাগিয়ে দিয়ে, কারণ তা মধ্য শীত – এবং তা কোন পুস্প বান্ধব আবহাওয়া নয়;---! এই tulipan গুলো, খুব কম সুবাসযুক্ত, বা গন্ধহীন , কিন্তু এর সৌন্দর্য এবং চমৎকার বর্ণ বিচিত্রতা- প্রশংসনীয়!
Ogier Ghislain de Busbecq, Austrian Emperor Ferdinand I's ambassador to the Sultan at Constantinople. De Busbecq described them in a letter home.
"As we passed, we saw everywhere an abundance of flowers, such as the narcissus, hyacinth and those called by the Turks tulipan, not without great astonishment on account of the time of the year, as it was then the middle of the winter, a season unfriendly to flowers. . . . The tulipan . . . have little or no smell, but are admired for their beauty and variety of color."
এখন অব্দি প্রায় ১৪ টি টিউলিপের আদি জাত কেবলমাত্র তুরস্কেই পাওয়া যায়! ১৫৭৩ সালে সে সময়ের খ্যাতিমান এক উদ্ভিদবিদ ক্যারোলাস ক্লুসিয়াস অস্ট্রিয়ার ইম্পিরিয়াল বোটানিক্যাল গারডেনে একে ‘ঐতিহাসিক ভাবে স্থান করে দেন! এবং সেখান থেকে Leiden University এর Hortus Botanicus এ ক্লুসিয়াস ( তিনি এখানে ডিরেক্টর ছিলেন) এর চাষ করেন! এগুলো এখন ইতিহাস!
তুরস্কের রেকর্ড পত্রে দেখা যায়, ১৫৭৪ সালে তুর্কীর সুলতান সেলিম -২ সিরিয়ার আজাজ এর এক কাজীকে টিউলিপের ৫০,০০০ কন্দ (Bulb) পাঠাতে লেখেন। উসমানীয় সুলতানদের এই পুস্পপ্রীতি সহজেই অনুমেয়! ১৫১৫ ত আফগানিস্তান এর হেরাত শহরে র এক পণ্ডিত জনাব কাসিম সাহেব উল্লেখ করেছেন, বাগানে লালিত এবং বুনো এই দুই জাতের টিউলিপের (লালে) কথা ! তারও আগে ১৪৯৫ সালে চুগতাই টার্কিশে (মুঘল সম্রাটদের ভাষা) - হুসাইন বায়কার ‘র লেখা এবং মুঘল সম্রাট বাবুরের আত্মজীবনী – বাবুরনামায় ‘লালে- বা টিউলিপের উল্লেখ রয়েছে! মুঘল সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এই মহাত্মন শুধু নূতন রাজ্য প্রতিষ্ঠা নয়, নয়নাভিরাম উদ্যান, সুন্দর ভবন/ স্থাপত্য, কাব্য /কবিতা চর্চা- ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অগ্রদূত ছিলেন! সুকুমারবৃত্তির পৃষ্টপোষকতায় সে যুগে তার সাথে তুলনা করা যায় এমন বাদশা খুব বেশী ছিল না! ফুল ও বৃক্ষের প্রতি ছিল তার সীমাহীন আগ্রহ! তিনিই প্রথমে তরমুজ এবং আঙ্গুরকে ভারত উপমহাদেশে নিয়ে আসেন এবং এদেশে এর চাষ শুরু করান! ধারনা করা হয় - বাবুর হয়তো টিউলিপকেও এদেশের মাটিতে প্রথম অনুপ্রবেশ করিয়েছিলেন! আর গোলাপ তো পারস্য থেকে ফারসি মুসলিমদের হাত ধরেই ভারতে আসে । এজন্য এক ‘হিংসুটে, ‘চরম মুসলিম বিদ্বেষী লেখক, – বলতে গেলে বর্তমানের বিজেপি ‘শিবসেনার পূর্বপুরুষ –বঙ্কিম বাবু’ তীব্র কটাক্ষ করেছেন এই ঘটনাকে ! কোন এক লেখায় বলেছেন-‘এত সুন্দর ফুল, নিয়ে এল- ম্লেচ্ছ ‘যবণ! তার ভাষায়- মুসলিমরা যেন দৈত্য দানব! এই সুন্দর সুগন্ধি ফুল ভাল লেগেছে, কিন্তু যারা তা নিয়ে এলো তাদের প্রতি চরম ঘৃণা আর অশ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ! ভারতে এখন আরও বেশী দেখি এমন ঘটনা! গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে, এমন চণ্ডালী কারবার কেবল নরেন্দ্র মোদীর ভারতেই সম্ভব! আর এরাই আবার- ‘নিরামিষ ভোজী’র ঢং দেখিয়ে মাংসাশী মুসলিমদের গায়ে ‘নিষ্ঠুরতার লেবেল লাগায়! বাঙ্গালী হিন্দু ‘মছলি খায় জন্য, তাদের দেখে ওরা নাক সিটকায়! তাজমহল নিয়ে গর্ব করছে ভারতীয়দের সংখ্যাগরিষ্ট বিজেপি; কিন্তু আজকের ভারতে তাজমহলের প্রতিষ্ঠাতা মুসলিমদের প্রতি অশ্রদ্ধা আর তীব্র ঘৃণার বহিঃ প্রকাশ দেখছি প্রায়শঃ! যাক সে কথা! – সনাতন ধর্মী সবাই যে ঐ ‘আকাট শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত নয়, এটাই আশার কথা!
স্পেনের তৎকালীন মুসলিম অঞ্চলে- আল আন্দালুসে এর চাষ হত। তুরস্ক থেকে অস্ট্রিয়া ও নেদারল্যান্ডে এই ফুলের আগমন সম্বন্ধে সবাই জানে! তুরস্ক থেকে ১৫৭৩ সালে অস্ট্রিয়ায় সম্রাটের বাগানে প্রথম এর সুত্রপাত, ১৫৯৪ সালে নেদারল্যান্ডে প্রথম টিউলিপ ফুটে বলে ধরা হয়! এর পর শুরু হয় ‘টিউলিপ ম্যানিয়া! একে পাগলামী বললেও কম বলা হয়!
টিউলিপের ‘বাণিজ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে নেদারল্যান্ড সহ কিছু দেশকে! বর্তমান পৃথিবীর সুন্দরতম ফুলগুলোর মধ্যে অন্যতম এই ফুলটি- শুধু বর্ণ আর আকার বৈচিত্র দিয়েই আমাদের মুগ্ধ করেছে তাই নয়, এর ডাঁটা এবং দল মঞ্জরী বেশ পুরু ও শক্ত বিধায়- এক্সপোর্টের ধকল কুলোতে পারে! এজন্য বহু দেশে এর রপ্তানী চলছে! হল্যান্ড এর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় একটা অংশ আসে ফুল রপ্তানি থেকে!
টিউলিপ প্রতিনিধিত্ব করে স্বপ্নচারি, কল্পনাপ্রিয়তা, প্রেমের বহিঃপ্রকাশ এবং প্রকৃত প্রেমিক (প্রেমিকা) !~টিউলিপের রেজিস্টার্ড জাতের সংখ্যা তিন হাজারের উপরে! মার্চ থেকে এপ্রিলে এদের ‘পিক টাইম! তবে মে জুন পর্যন্ত টিকে থাকে এমন সংকরায়িত জাতও রয়েছে!
পেঁয়াজ শেষ হয়ে গেছে! টিউলিপের বাল্ব এর সুন্দর বিকল্প হতে পারে, বলেছেন ভোক্তাদের একজন! পুস্পপ্রেমীদের মনে আঘাত লাগলেও – এটা নির্জলা সত্য যে, পাকস্থলীর চাহিদার আগে সৌন্দর্যচর্চা স্থান পায় না; সুকান্তের ভাষায়ঃ ক্ষুধার জগতে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন--!
বিষয়: বিবিধ
২২৭১ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনাকে ও শুভেচ্ছা।
শুভেচ্ছা।
আপনাকেও!
বরাবরের মতই খুব ভালো লাগলো আপনার এ লেখাটিও!
আলহামদুলিল্লাহ!
আপনাকে ধন্যবাদ৷
মন্তব্য করতে লগইন করুন