কানাডার শরৎকালঃ এক বর্ণীল উচ্ছ্বাস
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ১৯ অক্টোবর, ২০১৫, ০৬:৩৬:৩৭ সন্ধ্যা
এদেশের হাইওয়ে গুলো দ্রুতগতির জন্য তৈরী; কোন সিগন্যাল লাইট নেই! ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১০০ কিমি. বেগে গাড়ি চলার কথা থাকলেও ১২০ কিমি. বা তার বেশী বেগে চলে হরদম ।
এই রাস্তার দুপাশে না তাকালেও চোখে পড়বে এখন- গাছ গুলোতে যেন আগুন ধরে গেছে! পাতা গুলো যেন সোনার পাতায় চেয়ে গেছে, হলুদ কমলা আর লাল- এক সাথে এত উজ্জল রঙের মিশ্রণ –বছরে আর কোন সময় চখে পড়বে না! মনে হবে, কোথাও বসে দুদন্ড যদি চোখ ভরে দেখা যেত এ নয়নাভিরাম দৃশ্য! এ দেশের শরত কাল, এ যেন এক বর্ণীল উচ্ছ্বাস - ! জংগলের সমস্ত আবেগ যেন একসাথে ফুটে বেরিয়েছে এর পাতায়- এ বলছে আমায় দেখো, ও বলছে আমায় দেখো! পৃথিবীর আর যে কোন সঙ্গীত এত বাঙময় হবে কি! জংগলের দিকে তাকালে যত দূর চোখ যায়, লাল কমলা হলুদের হাত ছানি, মাঝে মাঝে গাঢ় সবুজ যেন লাল হলুদের ঘনত্বকে আরও উজ্জলতর করেছে! এ অপার সৌন্দর্যের কোন তুলনা হয় না, নাওয়া খাওয়া ভুলিয়ে দেয়ার মত অতি মনোহর, মনোমুগ্ধকর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য!
প্রশ্ন আসবে কেন এই সময় রঙ্গিন হয়ে যায় পাতা গুলো?
শরৎ কালে গাছের পাতার রঙ্গিন হয়ে যায় কেন?
মানব দেহকে যদি বরফের স্তুপে ফেলে দেয়া হয়- তাহলে কি ঘটবে? তাপমাত্রা যদি খুব বেশী নীচে নেমে যায়, দেহ তখন ব্রেন এবং হৃৎপিণ্ডের কর্ম চালু রেখে হাত পা- ইত্যাদি- প্রান্তীয় এলাকার কর্মসূচী বন্ধ করে দেবে –অর্থাৎ দূরবর্তী অঞ্চলে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দেবে । এতে হাত পা তাপ হারিয়ে অসাড় হয়ে যাবে, এক সময় ব্রেনও কলাপ্স করবে,কিন্তু হৃৎপিন্ড ধুঁক ধুঁক করে চলবে, শরীরটাকে বাচিয়ে রাখার জন্য, বৈরী পরিবেশের বিপক্ষে টিকে থাকার স্বার্থে এটা ব্রেনের স্বাভাবিক সাড়া! এভাবেই পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে জীবদেহ খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে।
শরতে দিন ছোট হয়ে যেতে থাকলে, তাপ কমে এলে এবং রাত লম্বা হতে থাকলে- পরিবেশে ঠাণ্ডার স্পর্শ পেলে, গাছপালাও বুঝতে পারে – শীত আসছে, ‘ঘর গুছাতে হবে! দীর্ঘ শীতের বিরুদ্ধে নিজের জীবন রক্ষার্থে, সে তখন “সুপ্তাবস্থা” (Dormancy) র জন্য প্রস্তুতি নেয়! জীবনের জন্য চালু – বিপাক প্রক্রিয়ার অধিকাংশ ‘বন্ধ করে দিয়ে, বৈরি পরিবেশে টিকে থাকার প্রচেষ্টা! কাজেই, শরত কালে গাছপালার এ অসম্ভব সুন্দর বর্ণ পরিবর্তন – হাউইএর মত, শেষ হয়ে যাওয়ার আগে শেষ জ্বলে উঠা! ঝরে যাওয়ার পূর্বে পাতা গুলোর রং পরিবর্তিত হয়- এ এক নিয়মিত প্রাকৃতিক পরিবর্তন! বহুবর্ষজীবী প্রশস্ত পাতা বিশিষ্ট বৃক্ষ আর গুল্ম জাতীয় গাছপালা এক্ষেত্রে বেশী সক্রিয় হয়! আর বর্ষজীবীরা তো ফুল ফল ও বীজ ( ক্ষেত্র বিশেষে) তৈরী করে, ‘উদ্ভিদ জনম’ সফল করে মারাই যায়! পাইনের মত চিরসবুজ বা সূচ আকারের পাতা বিশিষ্ট গাছের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কাজ করেনা!
শীতের প্রারম্ভিক প্রস্তুতি হচ্ছে হেমন্ত কাল! আর হেমন্তে এই ‘সুপ্তাবস্থার প্রস্তুতিতে, গাছের পাতা তার সবুজ রং হারিয়ে নানা বর্ণে রঞ্জিত হয়। হলুদ, তীব্র লাল-ও কমলা এবং এদের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার মিশেলে বনজঙ্গল এর বৃক্ষরাজি- তরু লতা যেন ‘রং এর হোলী খেলায় মেতে উঠে! এই কর্মের (আসলে কর্মযজ্ঞ) সরাসরি নিয়ন্ত্রনের পেছনে রয়েছে তিন মহারথী-তাপমাত্রা, আলোক আর pH!! এর সাথে পানির অভাব, শর্করার আধিক্য- এবং রঞ্জক কণিকাগুলোর ভূমিকাও এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য!
সাধারন উষ্ণতায় গাছের পাতায় ক্লোরোফিল (Chlorophyll) নামের সবুজ কণিকার পরিমাণ এত বেশী থাকে যে, তা অন্য বর্ণের কণিকার উপস্থিতিকে ঢেকে রাখে! মা যেমন তার সন্তানকে সযত্নে ‘ঝড় ঝাপ্টা থেকে আড়াল করে রাখে! এখন প্রায় সবাই জানে -এই ক্লোরোফিল গাছের খাদ্য প্রস্তুতি তথা সালোক সংশ্লেষণের মূল সৈনিক! আলোক, পরোক্ষভাবে, গাছের পাতার এই ক্লোরোফিল এর সংখ্যা বা মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে; শরৎ কালে যখন দিন ছোট হতে থাকে, দিনের দীর্ঘতা হ্রাসের সাথে সাথে তাপ এবং আলোকের পরিমাণও হ্রাস পায়, কাজেই এসময়ে ক্লোরোফিল তৈরীও হ্রাস পায়। কিন্তু এর ডিকম্পোজিশন এর মাত্রা আগের মতই থাকে, কাজেই পাতায় সবুজ বর্ণের আধিক্য হ্রাস পেতে থাকে ! হঠাৎ বন্যায় ক্ষেত ডুবে গেলে- ভবিষ্যতের কথা ভেবে, মধ্যবিত্ত কৃষক ও যেমন সংসার খরচে - চাল ডালের উপর রেশনিং চালু করে, তেমনি উত্তরের শীতল বাতাসে পরিবেশের তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে গাছের বা পাতার মেকানিক্যাল টিস্যু সক্রিয় হয়, পানি সরবরাহ ও খাদ্য প্রবাহ রেশনিং এর পর্যায়ে নিয়ন্ত্রন করে! পাতা যেহেতু খাদ্য তৈরির মূল ফ্যাক্টরি, এসময়ে পাতায় তৈরী শর্করার পরিমাণ হঠাৎ করে বেড়ে যায়, (পাতায় পানির পরিমান হ্রাস পেলে সুগার এর ঘনত্ব ও বেড়ে যায়), ফলে পাতার আরেক রঞ্জক কণিকা, অ্যান্থোসায়ানিন- এর উৎপাদন বেড়ে যায়!
অ্যান্থোসায়ানিন সমৃদ্ধ পাতাগুলোই লাল বর্ণ ধারন করে! পাতায় আরও থাকে ক্যারোটিনয়েড যার উৎপাদন আলোকের উপর নির্ভর করে না, কাজেই ক্লোরোফিল এর মাত্রা কমে যাওয়ায় এখন সেটাও দৃশ্যমান হয়! হলুদ, কমলা ও লাল এই তিন বর্ণ সৃষ্টিতেই এর ভূমিকা রয়েছে, তবে হলুদের প্রখরতাই বেশী । কোন পাতায় একই সাথে অ্যান্থোসায়ানিন, ক্যারোটিনয়েড ( হলুদ) এবং জ্যান্থফিল (কমলা) এর উপস্থিতি-এবং এর পরিমাণের উপর পাতার বর্ণ হলুদ, কমলা নাকি লাল হবে –এবং তা কতখানি হবে- এর মাত্রা নির্ভর করে! চিরসবুজ (evergreen) প্রজাতিগুলো এতে অংশ নেয় না- এদের মেকানিজম কোন ‘পরিবর্তন’কে সরাসরি নাকচ করে দেয়; যুদ্ধের সময়ও পোস্ট অফিস বা এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস এর মত জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন দিনে রাতে কাজ করে- তেমনি চিরসবুজ গাছপালা বরফে ঢাকা পড়লেও –বিপাক নিস্ক্রিয় হয়ে পড়লেও, রং বদলায় না- অপরিবর্তিত থাকে; তবে সেটা অন্য গল্প!
গাছের প্রজাতি ভেদে এর পাতার রঞ্জক পদার্থের বিভিন্নতা তো থাকেই, এর মাত্রাও থাকে ভিন্ন । কাজেই এই শরৎ কালে- বনের হাজারো প্রজাতি, সবুজ, হলু্দ, কমলা ও লাল এবং এর অন্তর্বর্তী অসবর্ণ মিলিয়ে - রং ধনুর মত নানা রঙের বৈচিত্রে বনভূমি আলোকিত করে তুলে। প্রকৃতির এই চরম রূপ দর্শনে আমরা মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ি ! এর সৌন্দর্যের ছটায় দিকচক্রবাল ‘আলোকিত হয়ে যায়! এখানে সেখানে সবুজের মাঝখানে লাল হলুদাবা কমলা রং এর মুকুট পড়ে মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছেন বৃক্ষ মহারাজ! তাকে স্যালুট না করে উপায় নেই! এ সময়ে প্রকৃতির বর্ণ পরিবর্তন এতই নাটকীয় যে, অন্ধ না হলে এই বর্ণচ্ছটা চোখে না পড়ার কোন কারণ নেই!
গত সপ্তাহ থেকে টরণ্টো এলাকার বনে জংগলে রাস্তার ধারে গাছপালার চলছে এই বর্ণ পরিবর্তনের যৌবন কাল (এদের ভাষায় বলে Peak) । বাতাসের তাপ ফ্রিজিং তাপমাত্রার উপর থাকলে অ্যান্থোসায়ানিন এর আধিক্য বাড়ে, তাই বাড়ে লালের উজ্জলতা! গত সপ্তাহ থেকে ৩- ৪ ডিগ্রীতে থেমে আছে তাপমান যন্ত্র, কানাডিয়ান ম্যাপল বা red maple (Acer rubrum) তাই ‘আগুনে লাল’। অনেক ধরনের মেপল এর মধ্যে Autumn flame, Bowhall, Brandywine, Northwood, October glory – এগুলো হল এর কয়েকটা জনপ্রিয় cultivar!
পরিচ্ছন্ন পরিস্কার আকাশ, রোদেলা দিন- এমন বর্ণময় সৌন্দর্য দেখার জন্য সবচেয়ে উপযোগী! গতকাল এবং আজকের এই সপ্তাহান্ত (সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনি, রবিবারকে এখানে উইকএন্ড বা সপ্তাহান্ত বলা হয়) ছিল এমনি এক মধুক্ষন। জ্যাকেট পড়তে হয়েছে- কিন্তু এই ‘বর্ণচ্ছটা দেখতে দেখতে প্রায় ভুলেই গেছি কখন সন্ধ্যা হল। এ বলছে আমায় দেখো, ও বলছে আমায় দেখো –আমি কাউকে হতাশ করার পক্ষে নই ! কখন যে আকাশে মহরমের চাঁদ উঁকি দিতে শুরু করল ! – ঠাণ্ডার কারনে জংগলে পাখির কলরব অনুপস্থিত, হয়তো শক্তি সঞ্চয় করে রাখছে দুর্দমনীয় শীত পাড়ি দেয়ার জন্য! দু একটা কানাডা গুজ (Goose/Geese) আঁতকে উঠার মত করে ডাক ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে দক্ষিণে; যে “কাক চক্ষু-জল-পুকুরের পাশে আস্তানা গেড়েছিলাম সেখানে এমন ‘নিস্তব্ধতা যে, হাসি কাশি দিলেও ‘বোমা ফাটার মত মনে হবে~ ! জলচর পোকা মাকড়ও বোধ হয় ‘শীতনিদ্রা নিয়ে নিয়েছে! এ এক অনুপম নৈশব্দ! শুধু হিমেল আবেশে ঝরে পড়ছে ‘আয়ূ ফুরিয়ে আসা, বিবর্ণ রঙ্গিন পাতাগুলো ! হাল ছেড়ে দিয়েছে! পতিত পাতা - এর মধ্যেও এদের অতীতের ‘মধ্য-যৌবনের ‘বর্ণময় অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যাচ্ছে! ইতিমধ্যে পায়ে চলার পথের ধারে স্তূপ গড়ে ফেলেছে – গাছের তলায়, পাশে। এ যেন রাতভর বিয়ের জমজমাট আয়োজন শেষে বরযাত্রী বিদায় নিয়েছে –শুধু পরিত্যাক্ত হয়েছে ভুক্ত খাবারের উচ্ছিষ্ট! এক বিয়োগান্ত নাটকের ইতিবৃত্ত! অবশ্য সেগুলোরও এক ধরনের সৌন্দর্য রয়েছে! ‘পা গেছে- শুধু পড়ে আছে পায়ের স্মৃতি!
এরও পেছনে রয়েছে রসায়ন! সব গুলো পাতার যোগফল হল গাছের –বৃহৎ ‘উন্মুক্ত তল’ বা ক্ষেত্র ! এরা শুধু খাদ্য প্রস্তুতই করে না, পাতার পত্ররন্ধ্র গুলো গাছের অতি প্রয়োজনীয় গ্যাস বিনিময় করে (শ্বসন), অতিরীক্ত জলীয় বাষ্প ছেড়ে দেয়, গাছের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করে! গাছ যেন দ্রুত জলীয় বাষ্প না হারাতে পারে, আসন্ন শীতের প্রাক্কালে তার জন্য এই পত্ররন্ধ্রের জানালা গুলো বন্ধ করতে হবে! শীতের স্পর্শের শীতল শিহরণ পাতার সালোক সংশ্লেষণ সহ অন্যান্য ‘সিন্থেসিস ও বন্ধ করে দেয়। হরমোন / এনজাইম –এবং এর সাথে আর এন এ সিন্থেসিস বন্ধ হতে থাকে, অক্সিন এর পরিমান কমে যায়! কিন্তু অপর পক্ষে Abscisic acid এর পরিমাণ বেড়ে যায়, এর সাথে বাড়ে ইথিলিন। এই ইথিলিন পাতার বোঁটায় এবসিসান স্তর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে! শরীর থেকে দ্রুত পাতা খূলে ফেলে দিয়ে শরীরকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হয় এই Abscission layer!
কাজেই – এই বর্ণীল নাটকের শেষ দৃশ্য বড় মর্মান্তিক, হৃদয় বিদারক! একে একে ঝরে যাবে এই রঙ্গিন রুপবান / নাকি রুপবতী পত্র পল্লব ! পত্রশুন্য হয়ে যাবে সমস্ত বৃক্ষ, অপেক্ষা করবে শীতের আগ্রাসী আলিঙ্গনের!
সেতো অনেক পরের কথা! আমি এখন ভেসে যাচ্ছি পাতায় পাতায় বর্ণের এ অপরূপ সমারোহে – ভবিষ্যতের দুঃস্বপ্নের ভাবনা ভেবে – বর্তমানের মধু-সময়ে নিজেকে কেন বঞ্চিত করব! এখন জীবনের বর্ণময় শোভা উপভোগ করার উপযুক্ত সময়! এরপর আসবে অমোঘ নিয়তির মতই শেষ পরিণতি- ‘যেও না শেষ পাতা গো- শাখায় তুমি থাকো
বিষয়: বিবিধ
২৫৩৪ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ!
চমৎকার বর্ণনা! মনে হলো পাতায় পাতায় ভ্রমন করে এলাম কানাডা!
চেরী ব্লোসম পড়ে ভেবেছিলাম আপনি জাপানের বাসিন্দা , এখন কনফিউজড জাপান না কানাডা?
যাই হোক- ভালো লাগা ময় অসাধারণ মায়াবী প্রকৃতি নিয়ে লিখা পোস্টটির জন্য আন্তরিক শুকরিয়া!
লিখাটি স্টিকি হলে আরো ভালো লাগবে
হানামী মনে রেখেছেন – এজন্য অশেষ ধন্যবাদ!
পুরোটা পড়ে শেষ করতে পারিনি তবে যতটুকু পড়েছি ভাল লেগেছে আর ছবি গুলো অসাধারন লেগেছে.....
দারুন লিখেছেন। অসাধারন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন