যদি কাগজে লিখো নাম---!!
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ১২ অক্টোবর, ২০১৫, ০৭:৪৮:৪৯ সন্ধ্যা
যদি কাগজে লিখো নাম – কাগজ ছিঁড়ে যাবে,
যদি পাথরে লিখো নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে,
যদি হৃদয়ে লিখো নাম – সে নাম রয়ে যাবে!
মানুষ মরে গেলে পচে যায় এটা ঠিক, তবে তার আগে সে কোন ‘চিহ্ন রেখে যেতে চায়! হয়তো তেমন মানুষ হলে তাঁর ‘পদচিহ্ন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ‘উদাহরণ হয়ে থাকে ! আর আপনি তেমন ব্যাক্তি যদি নাই হলেন, মানুষের জীবনে কি সাধ আহ্লাদ থাকবে না! গাছপালার এই যে ফুল, বীজ – এগুলো তো আর কিছুই নয়, তাদের পদচিহ্ন রেখে যাওয়া ! ধরা ধাম ত্যাগ করলেও তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে না, রেখে যাচ্ছে প্রজন্ম (৭১!) যা অতীতে তার এক সময়ের উপস্থিতি, ভবিষ্যতে জানান দেবে! আমরাও - কেউ মরে গেলে যেমন বলি - he is survived by------a loving wife, a daughter and 2 sons !! এও তেমনি- প্রাকৃতিক আবেদন!
এই চিহ্ন রেখে যাওয়ার মত, বিশেষ জায়গায় কারো কারো নাম লিখে রেখে যাওয়াটা (নাকি উৎকীর্ণ করা!) যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় তা জেনেছিলাম ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়! স্থপতি ফরহাদ নাকি তাঁর শিরির জন্য পাথর কেটে অমর ‘কীর্তি রেখে গেছেন ! একদিন আমাদের ক্লাশের জনৈক ‘ফরহাদ বেঞ্চের উপরে ব্লেড দিয়ে কেটে H + K লিখে এক নূতন ‘কীর্তির স্বাক্ষর রাখল । স্কুলের ‘হিটলার বি এস সি স্যার জোড়া বেত নিয়ে যখন একজনের অপরাধে সবাইকে ‘গন শাস্তি দেয়া শুরু করলেন- তখন বোধোদয় হল, বিষয়টা অতি গুরুতর! ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী না হলেও- রং ঢং (এখন চলতি বাংলায় বোধ হয় বলে- সেক্সি!) এর জন্য খ্যাত হাসিনা বানূর (শেখ নয়!) নামের আদ্যাক্ষর যে H সেটা অধমের মত নালায়েকও বুঝে নিল, কিন্তু K? নিয়মিত নামাজী করিম, না! ক্লাশের ফার্স্ট বয় – কামাল! নাহ! সার্টিফিকেট ধারী দুষ্টু, কবির ? হলেও হতে পারে! কিম্বা উপরের ক্লাশের জ্যাঠা ছেলে –কায়েস! অবশ্য অসম্ভব নয়! নানা মূণির নানা মত । বিষয়টা অস্পষ্টই থেকে গেল। বিনা অপরাধে সেই গণ-শাস্তির তীব্রতা মস্তিস্কের ‘নিউরনে এক অমোচনীয় ছাপ রেখে গেল! অনেক সময় প্রয়োজনীয় কথা মনে থাকে না, কিন্তু কেন যেন কোন কোন অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে ব্রেন ‘সোনার অক্ষরে সাজিয়ে রাখে! রহস্যময় মানব মস্তিস্কের এও এক অপার রহস্য!
বিশ্ববিদ্যালয়ের টয়লেট গুলোও এই ‘চিহ্ন রেখে যাওয়ার - রোগ থেকে মুক্ত ছিল না ! বিশেষ করে ‘সুন্দরীদের নামের উপর লেখনীর ‘বলৎকার চলত। যে যত ‘সুন্দরী (সুন্দর করে বললে – যে যত ‘আবেদণময়ী!) তার নামে তাতে দেয়াল লিখন! (হলিউডে 'তারকা রমণীদের নামে স্টার ছাপিয়ে ফূটপাতে পূতে দেয়া হয়, আম জনতার পদতলে পিষ্ট হয় এই নাম গুলো প্রতিনিয়ত- এতে নাকি তাদের 'ইজ্জত বেড়ে যায়! টয়লেটের দেয়ালে লেখা নামের 'ফ্রিকুয়েন্সি থেকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরীদের 'কদর সম্বন্ধে তেমন একটা ধারনা পাওয়া যেতে পারে, বিশ্ব সুন্দরী নির্বাচনে এই 'ডাটা ব্যবহার করার নিয়ম করলে খারাপ হয় না!) অবশ্য পরে বুঝে গিয়েছিলাম- ভীরু, মুখচোরা দুর্বল মনের ‘আপাতঃ প্রেমিক, যারা 'সরবে নিজেদের হৃদয়ের আকুল আকূতি ‘জায়গামত পৌঁছূ দিতে পারত না, তাদের অব্যক্ত বেদনার নীল দলিল এই টয়লেটের দেয়াল গুলো বয়ে চলত! আবাসিক হলের টয়লেট গুলোও ‘ব্যর্থ, অপ্রকাশিত প্রেম আর অব্যক্ত মনের ‘কাতর অভিলাষের স্বাক্ষর বহন করে চলত!
তো, কানাডা আমেরিকার সুপার মার্কেটের টয়লেটেও ও জিনিষ দুর্লভ নয়। পেন্সিলে আঁকা কাঁচা হাতের স্কেচে নর নারীর আদিম দৃশ্য, ফোন নাম্বার লিখে রেখে যাওয়া – এখানেও হৃদয়ের ‘আকূলি বিকুলি উঁকি ঝুকি মারছে ! পাবলিক পার্ক এর কাঠের বেঞ্চ, টেবিল, এমনকি কংক্রিটের বেঞ্চও মানব হৃদয়ের অব্যক্ত ‘জ্বালার বিষময় তীব্রতা ধারন করে আছে! টুরিস্ট স্পট গুলোতে- কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে- আক্ষরিক অর্থেই – পাথর- পাহাড়, এমনকি জীবন্ত বৃক্ষ ! বিশাল এক ছায়াদার গাছের ছাল কেটে লেখা, Dan + Nancy আমাকে ক্লাশ সিক্সে ফিরিয়ে নিয়ে গেল- এক ধাক্কায়! কাজেই আমাদের দেশের –“বেঞ্চ আর্টিস্টদের লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই! অপরিপক্ক – মুখচোরা- লাজুক-নাবালক আদম সন্তানই যে কেবল এ কাজ করেন তাও ঠিক নয়! মন্ট্রিয়লে বেড়াতে গিয়ে ২৫ প্লাস ‘এক যুগলকে এ কর্ম করতে দেখলাম পাবলিক পার্কে, দিনে দুপুরে পাবলিক প্লেসে উন্মুক্ত ভাবে ‘জল বিয়োগ করার মতই আমার কাছে তা অশালীণ মনে হলেও, আমিতো আর পাবলিক পার্কের ‘কিউরেটর নই ! সেই তাদের কোন ভাবান্তর নেই; পেশাদারী ভঙ্গিমায় নিজেদের গৌরবময় কর্মে তারা বিভোর !
নিজের শরীরের চামড়ায় উল্কি দিয়ে প্রেমিকের নাম লেখার ‘রোগও এদেশে যথেষ্ট ! সমস্যা হল, শরীরের এমন জায়গায় এই নাম লেখা হল, যা ‘বর্তমানের এই Honey, ভবিষ্যতে যখন Hemlock হয়ে যাবে ( এই Honey দুই/ চারজনের মধ্যে তা সীমিত থাকে ভাবলে ভুল করা হবে, ১২ থেকে ৪২ এর মধ্যে - অনেক হানিই দ্রুত হেমলক হয়ে যায়!) তখন পরের Honey বলা বাহুল্য, আর সেটা পছন্দ করবে না! কলম কাগজ শেয়ার করলেও, – বান্ধবী বা স্ত্রী শেয়ার করার মত ‘পঞ্চ পান্ডবীয় উদারতা’ আজকালকার ‘কৃষ্ণদের মাঝে অনুপস্থিত! এমনকি এই ‘শ্বেতকায় কৃষ্ণরাও নেহায়েত ‘ঈর্ষা পরায়ণ! উল্কি আঁকা যেমন সহজ, তুলে ফেলা এত সহজ নয়, ব্যথা বেদনার সাথে, নগদ নারায়ণও জড়িত!
কলেজে পড়ার সময়, পার্শ্ববর্তী গার্লস স্কুলের এক সাহসী বালিকার কথা জানতে পেরেছিলাম- যে তার বাম হাতের ভেতরের দিকে, কনুইয়ের নীচে, নিজে নিজেই ব্লেড দিয়ে চামড়া কেটে তার প্রেমিকের নাম ‘উৎকীর্ণ করেছে-। টাইটানিক মুভির ‘ডি ক্যাপ্রিওর জন্য, তার নায়িকার এমন চরম আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিল কি? চার অক্ষরের এক জ্বলজ্বলে শব্দ’- পরে এই ‘বিভীষিকা কোন এক মুহূর্তে একবার দেখারও ‘সৌভাগ্য হয়েছে! সৌভাগ্যকর্মে, যার নাম তিনি হাতে লিখেছেন, তার সাথেই ঘর করছেন ! উনি এখন মহিলা, বাচ্চার মা এবং ‘পারমানেণ্ট ভাবে বাম হাত ‘ওড়নায় ঢেকে রাখেন! কাজেই অবলা নারীদের এত ‘স্পষ্ট ভাবে পাবলিকের সামনে নিজেদের অন্তরকে উন্মুক্ত করার মত ‘রসবোধ নেই তা বলব না, তারাও সাহসী এবং একাজে পুরুষদের থেকে তারাও পিছিয়ে নেই! সম অধিকার- জিন্দাবাদ!
শুধু যে প্রেমিক প্রেমিকার আবেগই যে টয়লেটে, মাঠে ঘাটে পাহাড়ে ‘উৎকীর্ণ হয় তাও নয়। মক্কার হেরা গুহা দেখতে গেলাম । যথেষ্ট উঁচু এই জাবাল নূর- ‘গড় এ হেরা’ র পাহাড়! অবাক লাগল, বিশ্বনবী এখানে ধ্যনস্থ হতেন, আর এখানে মা খাদিজা তাঁর জন্য খাবার নিয়ে আসতেন, তখনতো তাকে এই চরাই ভেঙ্গে পাহাড়ে উঠতে হত খাবারের থলি নিয়ে! মহিলাদের জন্য চরম ক্লেশ সাধ্য এই কাজ, বিশেষ করে যখন কোন সিঁড়ি ছিল না ! এখনতো সিঁড়ি হয়েছে, আফগানী মুহাজির ভাইদেরকে, এই পাহাড়ে উঠার জন্য, সিঁড়ি তৈরী করতে দেখে মনটা আদ্র হয়ে গেল! আরও অনেকের মত নিজেও পকেটে হাত ঢুকিয়েছি- এদের কষ্ট করা দেখে,আহারে! সাধারণ মানুষদের সুবিধার জন্য তারা নিজেদের উদ্যোগে এ কাজ করে যাচ্ছে, যা করার দায়িত্ব ছিল সউদী বাদশাহর। আমাদের দেশের ‘বাদশাহ বা বেগমদের মতই – তারাও ‘অন্য দায়িত্বে ব্যস্ত, হয়তো! যাক, সে অন্য গল্প!
পাহাড়ের মাথায় উঠে এসেছি, হেরা গুহায় ঢুকতে যাচ্ছি, একটা বড় বোল্ডার আমার দৃষ্টিসীমাকে বাধা দিচ্ছে! এটাকে পাশ কাটালেই দেখতে পাব সেই পবিত্র গুহা, যেখানে ১৪০০ বছর আগে স্বর্গীয় ফিরিস্তা জিব্রাইল, মর্ত্যের এক ‘আন- পড়’ মানুষকে – আলিঙ্গন করে বলেছেন, “ইকরা- বি ইসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক্ক” (পড়- তোমার প্রভূর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন) আর তিনি বলছেন, “আনা বি ক্কারিইন- আমি তো পড়তে জানি না”। এখান থেকে ক্কাবার মিনার দেখতে পাচ্ছি –এই গুহার সাথে - এক নির্ভুল সরলরেখায়! কিন্তু সেই গুহা দেখার আগেই দৃষ্টি আটকে গেল! এক বঙ্গ সন্তান সেই গুহার সামনের কাল পাথরে ‘আ মরি বাংলা ভাষা’য় নিজের নাম, দক্ষিণে তার জিলা (নাকি বিভাগ!) এবং তাঁর রাজনৈতিক দলের নাম ‘সাদা রং দিয়ে ‘উৎকীর্ণ করে গেছেন! বড় ‘বিসদৃশ লাগলেও তা একটানে আমার মনের আবেগকে ‘ ধুলির ধরায় নামিয়ে আনল! আমার সেই দেশী ভাই হয়তো কোন ‘সওয়াবের(!) নিয়তে করা এই ‘পবিত্র কর্ম করে নিশ্চয়ই বিমলানন্দ উপভোগ করেছেন! এই পাথরও হয়তো আমার মতই, প্রতিবাদ করার ভাষা খুঁজে পায়নি!
আমার বর্তমান বাস যে শহরে, তার পাশে এক বিশাল লেক। দুধের স্বাদ ‘কোকাকোলায় মেটানোর মত, সুযোগ পেলেই সমুদ্র দর্শনের মত, লেক দর্শন করতে যাই। এখানে সাগরের ঢেউ এর মত উথাল পাথাল ঢেউ নেই তা ঠিক, তবে এর অবারিত বিশালতা মনের গণ্ডীকে একটু ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে, নাগরিক জীবনে খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়া আর তার সাথে সাথে আকাশের রং বদল দেখতে ভালই লাগে! আশেপাশে অনেক পার্ক, সব দিন এক পার্কে যাইনা, ‘স্বাদ বদলের জন্য বিভিন্ন পার্কে ঢুঁ মারি, সময় সুযোগ বুঝে! এই পার্ক গুলোর বেঞ্চেও “নাম লেখা’ খেলার কাটাকূটি দেখেছি অনেক! গত সপ্তাহে এমনি এক পার্কে গেছি! হঠাৎ করেই লাল ছাদের ছোট এক জ্যামিতিক আকৃতি চোখে পড়ল ! উৎসাহ নিয়ে এগুলাম! আরে! কি অবাক কাণ্ড। সারপ্রাইজ! বড় ধরনের ‘সারপ্রাইজ! এ যে দেখছি আমাদের বেঞ্চ আর্টিস্টদের জন্য তৈরী করা ‘নয়া প্রমোদ কক্ষ ! এখানে ‘নাম উৎকীর্ণ করার জন্য পরিষ্কার আহ্বান সম্বলিত নোটিশ বুকে ঝুলিয়ে সগৌরবে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন!
পাবলিক প্লেসের সৌন্দর্য রক্ষায় এবং ‘বেঞ্চ আর্টিস্টদের ‘অধিকার রক্ষা করতে পার্ক ‘কর্তৃপক্ষের এমন অভিনব ‘সংযোজন ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য! সাপও মরল না লাঠিও ভাঙ্গল !
বিষয়: বিবিধ
১৭২৬ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাল লাগল সুন্দর পোষ্টটি।
Thanks for your comment!
সুন্দর লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে
স্কুল কলেজের টয়লেটে এর মহামারী এখনও আছে কিনা কে জানে!
http://www.bdfirst.net/blog/blogdetail/detail/9039/GaziSalauddin1/65081#.ViEfrmeIOUk
মন্তব্য করতে লগইন করুন