Tamarind নাকি তমর – ই- হিন্দ!
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ০৬ আগস্ট, ২০১৫, ০৩:৫০:০৩ রাত
দেখা মাত্র জিভে জল চলে আসে এমন কোন ফলের নাম জানতে চাইলে – সবাই একবাক্যে বলবেন তেঁতুল ! দেশে এরচেয়ে হাজার গুনে সুস্বাদু ফল রয়েছে,শতগুণ দুর্লভ সুলভ –সব রকমের ফল রয়েছে, কিন্তু কাউকে হাতে চটকে খেতে দেখলে জিভে জল আসে এমন লোভনীয় ফল আর নেই! বুনো ওল থাকুক না থাকুক আমাদের আজকের আলোচনা সেই বাঘা তেঁতুল নিয়ে !
ইংরেজীতে tamarind – বৈজ্ঞানিক নাম- Tamarindus indica। নাম শুনে ইন্ডিয়ার আদি উদ্ভিদ বলে মনে হলেও তা নয়! উষ্ণ মণ্ডলীয় আফ্রিকার আদি আধিবাসী ! শিম জাতীয় (liguminous) উদ্ভিদের নিকটাত্মীয়- (family-Fabaceae) . আফ্রিকার সুদান, ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া তাঞ্জানিয়া এমনকি ওমান এর সাগর তীরের পাহাড়ি ঢালে বুনো তেতুল জন্মাতে দেখা যায়! যে গাছ যে অঞ্চলের আদি বাসিন্দা, তাদের বুনো ভাইবোনকে সে অঞ্চলে অতি অবশ্যই ‘জংলা অবস্থায় দেখা যাবে- এটা উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের ভাষ্য ! (যেমন ধান - ইন্ডিয়া বা আমাদের দেশের আদি উদ্ভিদ জন্য বুনো ধান এখনো চলন বিলের বা দেশের অন্যত্র হাওড় এলাকায় এমনি এমনি জংলা ভাবে জন্মাতে দেখা যায়) । তবে তেঁতুল, ইন্ডিয়া বা আমাদের দেশে হাজারো বছর আগেই চলে এসেছে এবং এদেশের ‘নেটিভ হয়ে গেছে! (বাংলাদেশকে, ইন্ডিয়া বলে উল্লেখ করে ‘জাতীয়তাবাদের গায়ে আঘাত করার জন্য দুঃখিত, আমি নই, ব্রিটিশ ব্যাটারা এর জন্য দায়ী; বাংলাদেশকে আলাদা ভাবে ইজ্জত না দিয়ে তারা তাদের অধীনস্থ এলাকাকে পুরোটা ‘ ইন্ডিয়া বলে কভার করেছে)। থাক সে কথা! একটু পেছনে যাই!
আরবীতে তমর (Tamar) শব্দের অর্থ খেজুর; শুধু ‘সিজনাল ফল নয়, একজন আরবের কাছে, খেজুর এর থেকে অনেক বেশি কিছু! আমাদের দেশে আমকে দীর্ঘদিনের জন্য ঘরে জমিয়ে রাখা যায়না – জন্য, ‘আম- অতি জনপ্রিয় ফল হয়েও, মধ্যপ্রাচ্যে খেজুরের ভুমিকায় উঠতে পারেনি। পাকা খেজুর তামাটে বা কালচে বর্ণের হয়। অন্য কোন কোন খাবার না থাকলে, মাসের পর মাস কেবল খেজুর খেয়েই মানুষ দিন গুজরান করতে পারে!
মৌসুমী বায়ুর সৌজন্যে আরব দেশের সাথে আমাদের দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক প্রাচীন । আরব বনিকগণ এদেশে পাল তোলা জাহাজে বাণিজ্য করতে আসত। (তখন এদেশকে India বা হিন্দূস্থান হিসেবে বলা হলেও, হিন্দূস্থান বলতে কিন্তু হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের দেশ বলে বুঝাতো না। ‘হিন্দূ ধর্ম বলে কোন ধর্ম স্বীকৃত ছিল না । হিন্দূধর্ম’ – এই নামে একটা ধর্ম স্বীকৃত হয়েছে প্রায় ১০০ বছর আগে! এর আগে ‘সনাতন ধর্ম বলেই তা পরিচিত হত, গাছপালা, পাহাড় পর্বত -পাথর বা গরু, বানর সাপ তথা পশুদের আরাধনা করত যে আদিম জাতি তাদের বলা হত সনাতন ধর্মের অনুসারী! উইকিপিডিয়া বলছে, According to Gavin Flood, "The actual term 'hindu' first occurs as a Persian geographical term for the people who lived beyond the river Indus (Sanskrit: Sindhu)".[19] The term 'Hindu' then was a geographical term and did not refer to a religion. ‘হিন্দু প্রকৃত পক্ষে ফারসি ভৌগলিক শব্দ- ইন্দাস ভ্যালী তথা সংস্কৃতে – ‘সিন্ধু নদীর পেছনের উপত্যকায় বসবাসকারী মানুষদের ফারসি ভাষাভাষী লোকজন ‘হিন্দু বলে বুঝাতো এবং এদের বাসস্থানকেই হিন্দুস্থান বলত! কাজেই হিন্দূ কোন ধর্মের নাম নয় বরং ভৌগলিক পরিভাষা – কোন বিশেষ অঞ্চলে বসবাসকারী জন গোষ্ঠী সম্পর্কিত শব্দ! অনেক ‘আধুনিক হিন্দুই হয়তো সে তথ্য জানে না ! যাই হোক, সেটা ভিন্ন গল্প!
আরব বনিকগণ যখন তাঁদের জাহাজে করে ‘তমর নিয়ে এক সময় নিজের দেশে পৌছাল, মৌসুমী বায়ুর কল্যাণে - দীর্ঘদিন সমুদ্রে থেকে হয়তো তারা এই ফলের নাম ভুলে গেছে! দলা পাকানো পাকা ফলকে রঙের দিক থেকে আরবী খেজুর বলে ভুল হতেই পারে, ( স্বাদে যদিও পার্থক্য অনেক)! কাজেই ‘তমর-ই হিন্দ! এই নামে আরবদের সাথে এর পরিচয় করিয়ে দিল তারা ! তেঁতুল হয়ে গেল - হিন্দুস্থানের তমর বা খেজুর!
আরেক বেণিয়া ইংরেজ যখন তা সংগ্রহ করল আরব বণিকদের কাছ থেকে, এই নাম আরেকবার ‘বাঁক খেয়ে, ‘তমর – ই –হিন্দ দাঁড়িয়ে গেল – Tamarind হিসেবে! পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষীর অনেক শব্দই ইংরেজরা তাদের নিজেদের ভাষায় জুড়ে দিয়ে নিজেদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, কখনো প্রকৃত উচ্চারনে বা মূল উচ্চারণে, কখনও বা বিকৃত উচ্চারণে! তাদের ভাষায় আরও একটি নূতন শব্দ যোগ হল! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গণিত বা অঙ্কশাস্ত্র- তথা শুন্য, ১,২,৩ এর মত গাণিতিক সংখ্যা গুলোও ইন্ডিয়া থেকে আরবদের কাছে, এবং সেই আরবদের কাছ থেকে নিয়ে, বেণিয়া ইংরেজরাই তা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে! মধ্যে থেকে এই সংখ্যা গুলোর নাম হয়েছে – এরাবিক নিউমারেল! আরবী সংখ্যামালা! ইন্ডিয়ান নিউমারেল নয়!!
নামে যাই হোক, কাজে কিন্তু দারুন এই ফল টি। চর্বি কমাতে বা আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে- কলেস্টেরল কমাতে দারুন কার্যকর এই ফল, যদিও মানুষের উপর তার প্রয়োগে গড়িমসি দেখা যাচ্ছে। হয়তো পশ্চিমাদের হাতে এর ভান্ডার নেই, এজন্য! ধাতু পালিশ ও চকচকে করতে তেঁতুলের ব্যবহার অতি প্রাচীন! টক রান্নায় এর বিকল্প কোন ফল এখনও দেখা যায় না!
বাঙ্গালী যখন ইংরেজদের পদানত থেকেছে দীর্ঘদিন, তখনও নিজেদের শব্দ ওদের শিখাতে পারেনি, বরং ওদের নকল করেছে এবং এখনও সে ‘নকল বাজি'র প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে! কাজেই আমরাও সে প্রক্রিয়ার সুত্র ধরে –তেতুলকে Tamarind বলেই আজতক জিভের জল নামিয়ে যাচ্ছি! জয়তু তামারিন্দ!
বিষয়: বিবিধ
২০১২ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন