আলী ও আমর : হযরত আলী (রাঃ) এর আত্মনিয়ন্ত্রনের এক অমর কাহিনী
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৭:৫৯:৪৬ সকাল
ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষায় খন্দকের যুদ্ধের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা তা নিয়ে বিশাল বিশাল কিতাব রচিত হয়েছে.। আমরা সেদিকে যাব না । এর একটা ক্ষুদ্র ঘটনা নিয়ে আমাদের আজকের লেখা। ইসলাম এর ইতিহাস যে সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, এ তারই একটা।
খাইবারের ইহুদী নেতা হুইয়াই বিন আখতাব তার দোসরদের সাথে নিয়ে মক্কায় এসে কুরাইশদের যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালার কাজ সফল ভাবে সম্পন্ন করেছে, এমনকি মদীনায় - শপথ ভেংগে, ইহুদী সহায়তা প্রদানের জন্য কুরাইশ নেতা সাফওয়াণ এর সাথে শপথ করেছে। কুরাইশ বাহিনীর চার হাজার সৈন্য, তিনশত ঘোড় সওয়ার, আর ১৫০০ উটের সাথে যোগ দিয়েছে বনু গাফফান এর ২০০০ যোদ্ধা- উয়াইনা বিন হিসণ এর অধীনে, ইহুদি গোত্র বণূ নাদির তাদের বাৎসরিক ফসল –খেজুরের অর্ধেক, বণূ গাফফাণকে দিতে অঙ্গিকার করে এদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়েছে । বনু সুলাইমের আছে ৭০০ যোদ্ধা । বনু আসাদের যোদ্ধা সংখ্যা কত তার রেকর্ড নেই। আরও অনেক ছোট ছোট গোত্র যারা কুরাইশদের মিত্র ছিল তারাও সৈন্য সরবরাহ করেছে। আবু সুফিয়ান ইবনে হারব এর নেতৃত্বে কুরাইশদের অধীনে সর্বমোট প্রায় দশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী ইসলামকে দুনিয়া থেকে চিরতরে মুছে ফেলার অঙ্গীকার নিয়ে মদীনার দিকে আসছে । আমরা এই সম্মিলিত গোত্রের – সম্মিলিত সামরিক বাহিনীকে আজকের দিনের মত ‘বহুজাতিক বাহিনী বলব ।
৬২৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী, সোমবার- সম্মিলিত সামরিক জোট বা ‘বহুজাতিক বাহিনী মদীনার নিকটবর্তী হয়ে – ক্যাম্প করল । ওহুদ পাহাড়ের পশ্চিমে, বনভূমির দক্ষিনে – নালাগুলোর সম্মিলনস্থলে, আস্তানা গেড়েছে কুরাইশ বাহিনী; ওহুদ যুদ্ধের সময় তারা যেখানে ছিল । গাফফান আর অন্য গোত্র গুলো ঘাঁটি গেড়েছে ‘জানাব নাকনিয়াতে, ওহুদ পাহাড়ের দু’ মাইল পূর্বে । যেমন আফগানিস্থানে মার্কিন বাহিনীর থেকে একটু দূরে ব্রিটিশ, ফরাসী বা অন্য কন্টিনজেন্ট গুলোর অবস্থান ছিল! এখানে অবস্থান করেই বহুজাতিক বাহিনী মদীনা আক্রমণের জন্য সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে এলো ।
এরা সম্মিলিত ভাবে জোটবদ্ধ হওয়ার আগেই মদীনায় খবর এসেছিল । রাসুল (সঃ) শেষ খবর পেলেন যে দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য মদীনার দিকে ধেয়ে আসছে । মুসলিমগণ সব সময়েই সংখ্যার দিক থেকে অমুসলিমদের চেয়ে কম ছিল, বদর বা ওহুদে, শত্রু সৈন্যের এক তৃতীয়াংশ বা এক চতুর্থাংশ । যদিও সেই মুহূর্তে মদীনায় মুসলিম সংখ্যা তিন হাজারের মত, এদের অনেকেই ছিল মুনাফিক- ওহুদে তারা যুদ্ধ করেনি; এদের উপর আর যাই হোক যুদ্ধকালীন সময়ে ভরসা করা যায় না। এদের বিরুদ্ধে দশ হাজার যোদ্ধার সমাবেশ - এক ভয়াবহ সংখ্যা, হিজাজের ইতিহাসে এত সৈন্য একত্রে যুদ্ধের জন্য এর পূর্বে কখনও একজোট হয়নি । অবশ্য আফগানিস্থানের ইতিহাসেও কাকতালীয় ভাবে বহুজাতিক বাহিনী – সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে একটা রেকর্ড! চেঙ্গিস খান বা তৈমুর লং এর ঘোড় সওয়ার বাহিনীতে এত সৈন্য ছিল না।
এই মহাবিপদকে কিভাবে মুকাবিলা করা যায় তার জন্য একটা পরামর্শ সভা আহবান করা হল। তা ছিল রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ, এই ধরনের পরামর্শ সভায় সবার মতামত জিজ্ঞেস করা হত। ইরান দেশের সাহাবি সালমান ফারসী (রাঃ) পরামর্শ দিলেন,- ডিফেন্সিভ যুদ্ধে পারস্য বাহিনী- বিশাল শত্রু বাহিনীর মুকাবিলায়, অনেক সময় খন্দক খুঁড়ে নিজেদের অবস্থান সংহত করে থাকে। খন্দক এতটুকু প্রশস্ত ও গভীর হবে যাতে শত্রুপক্ষের জন্য তা এক বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তারা সহজে তা ডিঙ্গিয়ে এসে আক্রমণ পারবেনা। আরবদের কাছে এ এক আজব সমর কৌশল -কিন্তু রাসূল (সাঃ) এর গুরুত্ত বুঝলেন, আর এ প্রস্তাব গৃহীত হল।
রাসূল (সাঃ) খন্দক খুঁড়তে হুকুম দিলেন। যারা এ কৌশলের গুরুত্ব এখনও বুঝে উঠতে পারে নি, তারা পাথুরে ভূমিতে গর্ত খুঁড়ার মত কায়িক শ্রমের কাজে গড়িমসী করল আর মুনাফিকরা তো এ কাজকে অহেতূক বা অপ্রয়োজনীয় – উৎকট ঝামেলা বলে অন্যদেরকে ভুল বুঝানোর প্র্য়াস পেল। কিন্তু যখন রাসূল (সাঃ) নিজে হাতে গর্ত খুঁড়া শুরু করলেন, কোন আত্ম মর্যাদা সম্পন্ন মুসলিম কি আর বসে থাকতে পারে? গর্তের পরিমাপ করা হল, আর প্রতি দশজন মুসলিম এর এক গ্রুপকে চল্লিশ হাত পরিমাণ গর্ত খুঁড়ার জন্য বরাদ্দ দেয়া হল । মুসলিমরা যখন কঠোর শ্রমে ঘর্মাক্ত হচ্ছে, হাসান বিন সাবিত নামে এক কবি- সম্ভবতঃ সে সময়ের অন্যতম কবি- নূতন কবিতা লিখে উচ্চ স্বরে তা পাঠ করে মুসলিমদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন । যে কোন বিষয় বা যে কোন ঘটনায় তিনি তার কবিতার ছন্দে - মানুষকে সহজে আবেগপ্রবন করে তুলতে পারতেন, এ পর্যন্তই তার যোগ্যতা ; কিন্তু প্রকৃত সশস্ত্র যুদ্ধে এই ‘কলম সৈনিকের ভূমিকা ছিল শূন্যের কোঠায়!
এই খন্দক খুঁড়া হল- ‘ শাইখান থেকে জুবাব পাহাড় পর্যন্ত এবং সেখান থেকে বনী উবায়েদ পাহাড় পর্যন্ত । দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সংযোগসস্থল গুলো খন্দক খুঁড়ে জূড়ে দেয়া হল, আর পাহাড় গুলো তো প্রাকৃতিক বাধা । পশ্চিম দিকে, বনী উবায়েদ এর পশ্চিম দিকের পাহাড়ের বাম পাশ কভার করে খন্দক দক্ষিনে ঘুরে গেল । শাইখান এর পূর্বে আর বনী উবায়েদ পাহাড়ের দক্ষিন পশ্চিম দিক বিস্তীর্ণ লাভা ক্ষেত্র- অসমতল, বড় বড় বোল্ডার থাকায় তা এমনিতেই যে কোন সেনা বাহিনীর জন্য দুর্গম । খন্দকের কেন্দ্রস্থলের একটুঁ দক্ষিনে, সিলা পাহাড় , যা প্রায় ৪০০ ফুট উঁচু, এক মাইল দীর্ঘ আর প্রশস্ততায় তার চেয়ে একটু কম- উত্তর –দক্ষিন বরাবর অবস্থান, তবে এর স্পার গুলো সর্বদিকে বিস্তৃত বিধায় এটা ও এক প্রাকৃতিক বাধা।
গর্ত খুঁড়া যখন শেষ, বহুজাতিক বাহিনী অবরোধ করে ফেলেছে মদিনার মুসলিমদেরকে। খন্দক মূলতঃ তাদের হতভম্ব করে দিয়েছে, খন্দক ডিঙ্গানোর জন্য দু এক বার চেষ্টা যে করেনি তা নয়, তবে খন্দকের ওপারে বসে থাকা মুসলিম তীরন্দাজদের তীর আর বর্শার আঘাতে আর পেরে উঠেনি বহুজাতিক বাহিনী। ক্ষ্যান্ত দিয়ে- খন্দকের অপর পাশে অপেক্ষা করছে মাস খানেক ধরে। মাঝে মধ্যে দুপক্ষের মধ্যে তীর বিনিময় – হয়, যুদ্ধ এ পর্যন্তই। ডিফেন্সিভ পজিশন বা প্রতিরক্ষা মুলক অবস্থান সংহত করতে খন্দকের ব্যবহার আরব উপদ্বীপে এটাই প্রথম, অভিনব, অত্যন্ত কার্যকরী এবং বহুজাতিক বাহিনীর জন্য এক দারুন চমক হিসেবে প্রমানিত হল!
বাইরের সাথে সংশ্রব বিহীন, অবরুদ্ধ মদীনার মুসলমানদের খাদ্য ভান্ডারে টান পড়েছে, অর্ধ রেশন থেকে এক পর্যায়ে রেশন-বিহীন অবস্থা- রাসূল (সঃ) ডিপ্লোম্যাসির চেষ্টা করছেন এ অবরোধ ভাংগার জন্য, ণুয়াইম বিন মাসূদ এর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, বহুজাতিক বাহিনী ও ইহুদীদের আঁতাতে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয়েছে।
বহুজাতিক বাহিনী ও ভাল অবস্থায় নেই, দীর্ঘদিন অবরোধের পরিকল্পনা নিয়ে তারা আসেনি, তবে নিজেরা তো আর অবরোধের মধ্যে নেই, বহিঃবিশ্বের সাথে যোগাযোগ আছে, তাদের অবস্থা একটু ভাল, কিন্তু তারা ও তড়িঘড়ি যুদ্ধের একটা ফয়সালা করে ঘড়ে ফিরতে চায়। এক মাসের উপরে বসা, একশন নেই, অলস সময় পার হচ্ছে, যোদ্ধাদের মনোযোগ ধরে রাখা বড় একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শনিবার ১৫ মার্চ, ৬২৭। কুরাইশ বাহিনীর সাথে থাকা খালিদ বিন ওয়ালিদ আর ইকরিমাহ বিন আবু জাহেল, এই দীর্ঘ অবরোধে ক্লান্ত। বহু জাতিক বাহিণীর সম্মিলিত প্রচেষ্টা কোন ফল বয়ে আনছে না দেখে বিষয়টা তারা নিজেদের হাতে নেয়ার চেষ্টা করলেন। জুবাব পাহাড়ের পশ্চিমে- যে জায়গায় খন্দক অন্য এলাকার মত ততটা প্রশস্ত নয়, শক্তিশালী ঘোড়া হয়তো ঐ দূরত্ব লাফ দিয়ে পেরুতে পারে – এ আশায় তাদের ঘোড় সওয়ার বাহিণীর বাছাই করা কয়েকজন ঘোড় সওয়ার নিয়ে ওখানে হাজির হলেন। ও পাশেই, সিলা পাহাড়ের পাদদেশে মুসলিম ক্যাম্প।
ইকরিমাহ ও তার স্কোয়াড্রন প্রথম পদক্ষেপ নিল। ইকরিমাহ সহ সাত জনের একটা ছোট এলিট গ্রুপ- নিখুঁত ভাবে ঘোড়া সহ লাফিয়ে ঐ খন্দক পার হয়ে মুসলিমদের দিকে ল্যান্ড করল। এদের মাঝেই- দলের অগ্র ভাগে ছিল, বিশালকায় ঘোড়ায় আসীন- বিশালবপূ এক যোদ্ধা, সে মুসলিম বাহিণীর অবস্থান জরীপ করছে। মুসলিমগণ, যারা কুরাইশদের এই মুভমেন্ট প্রত্যক্ষ করছে, তারা চরম অবাক হয়েছে – এই গ্রুপের অসম সাহস আর কীর্তি দেখে!
এই বিশালবপূ যোদ্ধা, ততোধিক বিশাল এক ঘোড়ায় চড়ে, বিশাল আকৃতি নিয়ে অন্যদের মধ্যে স্তম্ভের মত উঁচু হয়ে আছে। তাকে অবাস্তব মনে হচ্ছে- বিশাল, শক্তিশালী- অকূতোভয়, তার যুদ্ধের ইতিহাস তার বন্ধুদের যেমন চমৎকৃত করে, –শত্রুদের মনে তেমনি ত্রাস সঞ্চার করে।
তার নাম আমর বিন আব্দু উদ। এর পর থেকে আমরা তাকে দৈত্য বলব।
অতিকায় ঘোড়া আর তার সওয়ার স্থির দাঁড়িয়ে, নিতান্ত অবহেলায় দৈত্য তার দৃষ্টি প্রসারিত করে দিয়েছে সামনে– মুসলিম বাহিনীর উপরে, যেমন এক হুলো বেড়াল, প্রানঘাতী আঘাতের আগে, তার শিকার- ইঁদুর এর দিকে খেলাচ্ছলে অবহেলায় তাকিয়ে থাকে!
হঠাৎ দৈত্য তার মাথা উঠিয়ে গর্জন করে উঠল – “আমি আমর বিন আব্দু উদ! আমি আরবের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা, আমি অপরাজেয়-আমি---- ! নিজের মর্যাদা সম্পর্কে তার অতি উচ্চ ধারনা; “তোমাদের মধ্যে কারো এমন সাহস আছে যে আমার সামনে এসে আমার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে?
মুসলিম পক্ষ নিস্তদ্ধ । একজন আরেক জনেরদিকে মুখের দিকে তাকাচ্ছে । তারা রাসুল (সাঃ) এর দিকে তাকাচ্ছে। দৈত্যের চ্যালেঞ্জ গ্রহনের জন্য স্বতঃ প্রবৃত্ত আগ্রহ কারো মধ্যে দেখা যাচ্ছে না।
দৈত্য তার শক্তিমত্তা আর সমর কৌশলের জন্য অত্যন্ত খ্যাতিমান। এনিয়ে প্রচুর কাহিনী চালূ আছে। অনেকবার আহত হলেও – আজ পর্যন্ত কোন দ্বন্দ্বযুদ্ধে সে হারে নাই, প্রতিপক্ষের কেউ বেঁচে নেই। বলা হয়ে থাকে- সে একাই পাঁচশ ঘোড় সওয়ারের সমান। একটা বড় ঘোড়াকে দুহাতে তুলে সে ছুঁড়ে ফেলতে পারে, একটা বাছুরকে এক হাতে তুলে যুদ্ধের সময় সে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, সে পারে –হেন তেন-- এমন কাহিনী অজস্র। আরবদের কল্পনা মানসে এই অতিকায় দৈত্য –এক অপরাজেয় বীর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
মুসলিমদের অখণ্ড নীরবতায়- দৈত্য বিদ্রুপের হাসি হাসল। এই হাসির সাথে খন্দকের অপর পাশের কুরাইশরাও যোগ দিল,– তারাও ঘটনা স্থল থেকে খুব বেশি দূরে দাঁড়িয়ে নেই, তারাও এ মজার ঘটনা দেখছে, শুনছে আর উপভোগ করছে।
“তাহলে, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার পুরুষের মত সাহস আছে? আর তোমাদের ইসলাম এর কি হল? আর তোমাদের নবীর?”
এই ধর্ম- বিদ্বেষী কটাক্ষ আর বিদ্রুপে, তরুণ হযরত আলী আর স্থির থাকতে পারলেন, নিজের জায়গা থেকে সরে এসে রাসূল (সাঃ) সামনে দাঁড়ালেন, অনুমতি চাইলেন ঐ চ্যালেঞ্জ এর জবাব দেয়ার জন্য, প্রতিপক্ষের উদ্ধত জিভকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য।
রাসুল (সাঃ) বললেন, ‘স্থির হও, ওর নাম আমর’। আলী নিজের অবস্থানে ফিরে গেলেন।
আবার একবার বিদ্রুপের হাসির বন্যা বয়ে গেল, আবারও তীব্র কটাক্ষ – বিদ্রুপ বাণ, আবার চ্যালেঞ্জ। আলী আবার এগুলেন এবং রাসূলের সামনে এলেন, রাসূল অনুমতি দিলেন না। আবার এক প্রস্থ হাসি, আবার নগ্ন ইঙ্গিতসূচক স্লেষবাক্য!
আবার আমর এর পক্ষ থেকে চ্যালেঞ্জ এলো, আগের চেয়ে আরও অপমান জনক বিদ্রুপবান! “ কোথায় তোমাদের জান্নাত”? সে চিৎকার করলো। “তোমরা যার সম্বন্ধে বল, তোমাদের মধ্যে যারা যুদ্ধে হেরে যাবে তারা সেখানে প্রবেশ করবে? আমাকে মুকাবেলা করার মত একজন পুরুষও কি তোমরা পাঠাতে পারবে না?
তৃতীয় বারের মত হযরত আলী রাসূল (সাঃ) এর সামনে অনূমতি নিতে এলেন, রাসূল ( সাঃ) আলীর চোখে সেই দৃষ্টি দেখলেন, যা তিনি খুব ভাল করে চেনেন ও জানেন যে, আলীকে আর নিরস্ত করা যাবে না। বড়ই মায়াময় দৃষ্টিতে তিনি আলীর পাণে তাকালেন, আলী তার বড় স্নেহের – বড়ই আদরের, পুত্র স্নেহে তাকে বড় করেছেন। যে কোন জীবিত পুরুষ মানুষের চেয়ে আলী তার কাছে প্রিয়! এই সেই বালক, যে দুনিয়াতে সর্বপ্রথম রাসূলের ঐশী বার্তার সমর্থন করেছে। সমস্ত কুরাইশ গোত্রপতিদের সামনে রাসূল যখন আল্লাহ্র বাণী প্রথম বর্ণনা করেছেন, ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন আর জিজ্ঞেস করেছেন ‘ –---এই বিষয়ে কে আছে যে আমার সমর্থন করবে ( আমার ডেপুটি হবে) ? এক ত্রয়োদশ বর্ষীয় বালক উঠে দাঁড়িয়ে বলেছেন, আমি। ইয়া রাসূলুল্লাহ। এ বিষয়ে আমি আপনার সমর্থন করছি! এই সেই বালক! রাসূল (সাঃ) নিজের মাথার পাগড়ি খুললেন, অতি যত্নে তা আলীর মাথায় বেঁধে দিলেন। নিজের কোমর থেকে তরবারি খুলে নিলেন, আলীর কোমরে বেঁধে দিলেন। এবং দুয়া করলেন, “ হে প্রভূ, তার মদদ কর’! ( ইবনে সাদ, পাতা ৫৭২)।
যে তরবারি আল্লাহ্র রাসূল আলীর হাতে এই মাত্র তুলে দিলেন, তা ছিল এক কাফের ‘মুনাব্বা বিন হাজাজ এর, বদর যুদ্ধে সে মারা যায় এবং ‘মালে গনিমত’ হিসেবে তা মুসলমানদের হাতে আসে। এই তরবারি রাসূল (সাঃ) নিজের ব্যবহারের জন্য নিয়েছিলেন; যা আজ থেকে আলীর হাতে এল, আর এই তরবারি ইসলামের ইতিহাসে চরম খ্যাত হয়ে যায়, ন্যায় সঙ্গত দ্বন্দ্বযুদ্ধে যে কোন তরবারির চেয়ে অধিক মানুষ মৃত্যু বরন করেছে এর আঘাতে, যার নাম হল– জুলফিক্কার, বিশ্লিষ্ট কারী! মাথার দিকে যা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, সাপের জিহ্বার মত!
বর্ণনা করতে যে সময় লাগে ঘটনা তার চেয়ে দ্রুত ঘটে যায়! এইবার আলী দ্রুত কয়েকজন মুসলিম যোদ্ধা সাথে নিয়ে আমর এর দলের মুকাবিলায় অগ্রসর হলেন। সেই বিশাল দৈত্যের কাছে থেকে একটু দূরে এসে থামলেন। বলা বাহুল্য, দৈত্য মক্কায় থাকা অবস্থাতেই আলীকে খুব ভাল করে চিনে। সে আলীর পিতা, মক্কার সর্দার আবু তালিবের বন্ধুদের একজন ছিল।
একজন সমর্থ পুরুষ যেমন করে একজন বালকের দিকে করুণাভরে তাকায়, তেমনি করে সে আলীর দিকে চেয়ে সহানূভূতির হাসি হাসল।
‘হে আমর। এটা কি বিশ্বাস যোগ্য যে- কুরাইশদের মধ্যে যদি কেউ তোমাকে দুটো প্রস্তাব দেয়, সব সময় কমপক্ষে তার একটা তুমি গ্রহণ কর”? আলী জিজ্ঞেস করলেন।
‘সত্য!
‘তাহলে তোমার জন্য আমার দুটো প্রস্তাব আছে ! প্রথমটা হলঃ তুমি আল্লাহ্ আর তার রাসূলকে মেনে নাও, ইসলাম কবুল কর!’
‘ আমার তাতে প্রয়োজন নেই!
‘তাহলে ঘোড়া থেকে নেমে আমার মুকাবিলা কর?’
কেন – হে আমার ভাতিজা? তোমাকে হত্যা করার কোন ইচ্ছা আমার নেই!
‘কিন্তু এখন তোমাকে হত্যা করতে আমি খুবই আগ্রহী– আলী বললেন’। (ইবনে হিশাম, ভলিউম২, পাতা ২২৫)
দৈত্যের সংশয় ক্রোধে পরিণত হল, মুখ রক্তিম বর্ণ ধারন করল। আক্রোশের সাথে হুংকার দিয়ে সে ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নীচে নামল, এত বড় শরীর নিয়ে এত দ্রুত গতিতে সে মুভ করল যে, তা সবাইকে চমকে দিল। দ্রুত ঘোড়াকে পিছে ফেলে- তরবারি কোষমুক্ত করে সে আলীর দিকে ছুটে এল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
এ সময়ে রাসূল (সঃ) তার ঐতিহাসিক মন্তব্য করলেন ‘সমগ্র ঈমান, সমগ্র কুফরির মুকাবিলা করছে”।
আক্রমন করল আমর। সে তীব্র আক্রোশে আঘাত এর পর আঘাত করে চলল, আলী অক্ষত থাকলেন ! হয় আলী নিজের তরবারি দিয়ে তা প্রতিহত করলেন, কিম্বা নিজের বর্মের উপরে অবলীলায় তা গ্রহণ করলেন- কিম্বা দ্রুত আমরের তরবারির আওতা থেকে সরে এসে – নিজেকে রক্ষা করলেন। দৈত্য এক সময় অবাক হয়ে থেমে গেল, পিছিয়ে গিয়ে দম নিল। সে স্তম্ভিত, এটা কি ভাবে হয়! দ্বৈরথে তার সাথে এতক্ষন পর্যন্ত কেউ টেকে না! আর এই বালক - শুধু অক্ষত নয়, এমন ভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে যেন সে কোন মজার খেলা খেলছে!
এর পর এত দ্রুত যা ঘটল তার ধারাবাহিকতা- মুসলিম বা কুরাইশ, কোন পক্ষই যেন ভাল ভাবে তা অনূধাবন করতে পারল না, এমন কি সে দৈত্য নিজেও নয়! আলী নিজের ঢাল তলোয়ার মাটিতে ফেলে দিয়েছেন, তাঁর শরীর বিদ্যুৎ গতিতে দৈত্যের দিকে উড়ে গেল, এক হাতে দৈত্যের গলা পেঁচিয়ে ধরে, আলী দক্ষ রেসলার মত এক লাথিতে দৈত্যের ভারসাম্য নষ্ট করে দিলেন, মুহূর্তের মধ্যে দৈত্য প্রচন্ড শব্দে ধরাশায়ী হল। এখন সে মাটিতে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছে, আলী তার বুকের উপরে চেপে বসে আছেন, এখনও দুহাতে দৈত্যের গলা চেপে ধরা! দুই বাহিনী এক সাথে গুঙ্গিয়ে উঠল – বিস্ময়ে নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে যেন- দম বন্ধ করে ফেলেছে সবাই!
দৈত্য হতবিহ্বল হয়ে গেল! শেষ পর্যন্ত কেউ তাকে ধরাশায়ী করল! তাও এই বাচ্চা ছেলেটা – যে আকৃতিতে তার নিজের সাইজের অর্ধেকের চেয়েও ছোট! যাক- পড়ে গেলেও – এখন ও সব শেষ হয়ে যায় নি! সে এখন ও দ্বৈরথ জিতে আরবের অপরাজেয় যোদ্ধার হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারে! এখনও সে এই বালককে ‘ঝড়ের মুখে শুকনো পাতা’র মত ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে!
দৈত্যের মুখ রক্তাভ থেকে বেগুনী হয়ে গেল! তার গলার সমস্ত শিরা উপশিরা উঁচু হয়ে উঠেছে- তার হাতের আর বুকের বিশাল মাংসপেশী কিলবিল করে উঠল, সর্ব শক্তি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে সে আলীর বজ্রমুষ্টি থেকে ! কিন্তু সে নিজেকে এক ইঞ্চিও নড়াতে সক্ষম হল না – এমনই ইস্পাতের কাঠিন্য আলীর মাংসপেশীতে।
“জেনে রেখ, ও আমর! আলী নরম সুরে বললেন। জয় পরাজয় আল্লাহ্র ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। ইসলাম কবুল কর! এতে শুধু তোমার জীবনই রক্ষা পাবে না, ইহকালে ও পরকালে, আল্লাহর রহমত উপভোগ করবে”। আলীর হাতে শোভা পাচ্ছে এক ধারালো খঞ্জর আর তা আমরের গলার কাছে ধরা।
কিন্তু দৈত্য যা হজম করতে পারে, এ তার থেকে অনেক বেশী! এই কি সেই অপরাজেয় আরব বীর যে তার বাঁকি জীবন পরাজয় আর গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকবে? তাকে বলা হবে এই সে ব্যাক্তি যে প্রতিপক্ষের দেয়া শর্তে আত্মসমর্পণ করে নিজের জীবন রক্ষা করেছে? নাহ! এ ধিক্কারের জীবন তার নয়। সে – আমর বিন আব্দু উদ! তরবারির জোরে সে বেঁচেছে, তরবারি দিয়েই সে মরবে ! যে জীবন সংঘাতে বেঁচেছে – সংঘাতেই তার শেষ ! সে তার মুখের থুথু জমা করতে শুরু করল- আর তা নিক্ষেপ করলো – তার বুকের উপরে মুখ ঝুকিয়ে বসে থাকা – আলীর মুখে!
সে জানে এর পর কি ঘটবে! সে জানে – ঘৃণাভরে আলী দ্রুত একবার শ্বাস নেবে, তার খঞ্জর ধরা ডান হাত উপরে উঠবে আর তীব্র গতিতে নীচে নেমে আসবে তার গলা লক্ষ্য করে । আমর এক অকূতোভয় – সাহসী যোদ্ধা, মৃত্যুকে সে ভয় পায় না! সে এক ঝাঁকিতে তার পিঠ বাঁকা করে – গলা আর থুতনি উঁচু করল, আলীর আঘাত গ্রহণ করার জন্য! সে জানে এর পর কি হবে, কিম্বা বলা যায় – সে ভেবেছিল সে জানে!
কিন্তু এরপর যা ঘটল, তা তাকে আরও হত- বিহ্বল করে দিল! আলী খুব শান্ত ভাবে তার বুকে থেকে উঠে দাঁড়ালেন, মুখ থেকে থুথু মুছলেন আর কয়েক ধাপ সরে এলেন এবং নিজের ভূপাতিত প্রতিপক্ষের দিকে একান্তে তাকিয়ে বললেন, ‘ জেনে রাখ, হে আমর! আমি শুধু আল্লাহ্র কারনে কাউকে হত্যা করি, আমার ব্যাক্তিগত ( প্রতিহিংসার) কারনে নয়! ‘তুমি যখন আমার মুখে থুথু দিয়েছ, তোমাকে খুন করা এখন আমার জন্য ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কারন হয়ে যাবে। কাজেই আমি তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, তুমি উঠে তোমার নিজের দলের কাছে ফিরে যাও”! আলী আর থামলেন না, পেছনে না তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন।
দৈত্য উঠে দাঁড়াল। পরাজিত হয়ে নিজের দলের লোকদের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না! সে বাঁচতে হলে জয়ী হয়েই বাঁচবে, অন্যথায় নয়! তবে জয়ের জন্য সে আর একবার শেষ চেষ্টা করবে। সে তার নিজের তরবারি তুলে নিল আর অতি দ্রুততার সাথে আলীর দিকে ছুটল – সম্ভবতঃ আলীকে অপ্রস্তুত অবস্থায় হাতে পাবে!
আলী এই মুভমেন্ট লক্ষ্য করলেন এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় কেবল তার নিজের জুলফিক্কার আর ঢাল তুলে নিতে পারলেন, নিজেকে প্রস্তূত করারও সময় নেই। দৈত্য তার সর্বশক্তি দিয়ে আলীকে আঘাত করল- এক আঘাতে আলীকে দুখন্ড করে ফেলবে – এ অভিপ্রায়ে!
আলী কোন ক্রমে ঢাল পেতে প্রচন্ড আঘাতটা নিলেন, এত জোরে আঘাতটা করা হয়েছে যে আলীর ঢাল ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেল, কিন্তু এতে আমরের তরবারির শক্তিও নিঃশেষ হয়ে এসে আলীর ঘাড়ে এসে পড়ল- একটা অগভীর ক্ষত সৃষ্টি করল। আলী এটাকে আমল দিলেন না, দৈত্য তার তরবারি ২য় বার উঠানোর পূর্বেই, মরু সূর্যের তীব্র আলোয় ঝিকিয়ে উঠল জুলফিক্কার, আর এর অগ্রভাগ দৈত্যের গলার সামনেটা ছিন্ন করে দিয়ে গেল! রক্তের বন্যা ভাসিয়ে দিল দৈত্যের বুক!
এক মুহূর্তের জন্য দৈত্য নিশ্চল হয়ে থাকল, এরপর মাতালের মত তার শরীর একটু সামনে পেছনে দুলে- মুখ এর উপর সশব্দে ধরাশায়ী হল। পড়ে গিয়ে, একেবারে নিশ্চল হয়ে গেল, আর নড়ল না।
দৈত্যের পতনে ভূপৃষ্ট কেপে উঠল না সত্যি, কারণ ভূপৃষ্ট বিশাল! তবে প্রায় দুই হাজার মুসলিম এর গগন–বিদারী আল্লাহু আকবর ধ্বনি সিলা পাহাড়ের শৃঙ্গ গুলোকে কাঁপিয়ে দিল। মুসলিমদের বিজয় বারতা নিয়ে এই আল্লাহু আকবর ধ্বনি, মরু প্রান্তরে মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বে- সমস্ত উপত্যকার কন্দরে কন্দরে প্রতিধবনিত হল ।
এরপর আমর এর সঙ্গীরা লেজ তুলে পালাতে গেল। কেউ পারল, কেউ পারল না। ইকরিমাহ তার ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে পালানর সময়, হাত থেকে বল্লম ফেলে দিল, এ নিয়ে কবি হাসান অনেক ব্যাঙ্গাত্মক কবিতার পঙক্তি লিখে ফেলল। তাদের একজন নুফায়ল বিন আব্দুল্লাহ, খালেদের চাচাত ভাই, পালাতে গিয়ে খন্দকে পড়ে গেল, মুসলিমগণ তার উপর প্রস্তর ছুঁড়ে মারতে শুরু করলো, এক পর্যায়ে এই ব্যাক্তি বলে বসল, হে আরবগণ! নিশ্চয়ই এর চেয়ে মৃত্যুও ভাল’ (তাবারী, ভলিউম২, পাতা ২৪০)। খন্দকে নেমে আলী তাকে মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিলেন, শেষবারের মত।
মুখে থুথু নিক্ষেপ কারী, চরম অশ্রদ্ধাকারী ভূপাতিত শত্রুকে না আঘাত করে, আলী তাকে ছেড়ে দিয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ তার নিজের ‘নফস বা অহমিকাবোধ চাইছিল এই অশ্রদ্ধার প্রতিশোধে আমরকে খুন করতে। কিন্তু ইসলামের সৈনিক তো নিজের ‘জিঘাংসা চরিতার্থ করতে খুন করে না! নবীর শিক্ষা তা ছিল না! আত্ম নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে আলী সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন – যা সাড়া পৃথিবীর মানুষের জন্য আজও এক দারুন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে!
বিষয়: বিবিধ
৩৬১৯ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখেই তো আমরা বেঁচে থাকি!
তাঁদের কলমযুদ্ধের মূল্যও কম নয়!
রসুলুল্লাহﷺ তাঁর মিম্বর ছেড়ে দিয়েছেন কলমযোদ্ধার জন্য- এ থেকে তাঁদের মর্যাদা বোঝা যায়!
(সাঃ) না লিখে ﷺ বা অনুরূপ ব্লক ব্যবহার করা উত্তম মনে হয়!
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন