জ্ঞানীদের কথা-৪
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২০ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৪:৪৮:৫০ রাত
আমরা জাতি হিসেবেইএক ‘অদ্ভুতুড়ে’ জাতি। কেন?
ভিন দেশী কুকুরকে বাঙ্গালী, দেশী ঠাকুরের চাইতে অনেক বেশী শ্রদ্ধা করে! নোবেল বিজয়ী মুঃ ইউনূস এর সাথে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের বা দুয়ারের কাছের ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের মর্যাদা তূলনা করুন।
আমরা জ্ঞান বা জ্ঞানীর কদর করি না। ডঃ কামাল, অর্ধ শিক্ষিত হারুন মিয়ার কাছে ভোটে হেরে যান, হাসিনা বা এরশাদের মত মানুষ দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থাকে!
একজন বাঙ্গালী কাকে সবচেয়ে ঘৃণা করে? আরেক জন বাঙ্গালীকে! দেশের আওয়ামী লীগ ও বি এন পির দা কুমড়ার সম্পর্কের কথা বলছি না, সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না, আম জনতার মধ্যেও একই অবস্থা। আর প্রবাসী মাত্রই হয়তো আমার সাথে এ বিষয়ে এক মত হবেন! দুচার জন ব্যতিক্রম, পরিসংখ্যানে অগ্রাহ্য!
একবার বাজারে যান। গিয়ে দেখবেন, মাণ যত খারাপ হোক, ইন্ন্ডিয়ান রদ্দি মালের চাহিদা এবং মূল্য আমাদের দেশী মালের চাইতে অনেক বেশী! কেউ এনিয়ে উচ্চ বাচ্য করছে না। ‘ফরেন জিনিষের কদর শুধু জ্ঞানী গুনী নয়, অতি মূর্খ, আনপড় বস্তিবাসীও খুব ভাল করে জানে! অবশ্য আমার এক জ্ঞানী বন্ধুর মতে, “বাঙ্গালী নিজেকেই সম্মান করে না। আর এই আত্মমর্যাদা বা আত্মসম্মান বোধ না থাকার কারনে, আর কোন বাঙ্গালীকেও সে সম্মান করে না” ! হয়তো তাঁর কথাই ঠিক! সারকথা হচ্ছে, আমরা পরস্পরকে সম্মান করতে জানিনা, বা করতে শিখি নাই! পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ একটা সুন্দর, সুশীল, সুষম সমাজ গঠনে অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।
আজকের আলোচনা। ‘মধ্যযুগের দুজন স্মরণীয় জ্ঞানী মানুষকে নিয়ে । ওয়েস্টার্ন চিন্তাধারায় ‘মধ্যযুগ হল’ সর্ব নিকৃষ্ট একটা যুগ – ‘মানুষ যখন পশুদের মত বর্বর’ ছিল ! অবশ্য অনেক মুসলিম নামধারী নাদানও ঐ কথার প্রতিধ্বনি করবে- বক্তব্যের সারবস্তু না বুঝেই! তবে ইউরোপে সে সময় সত্যি ‘অন্ধকার যুগ ছিল । তাদের লেখাপড়া, ব্যাক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন, নিজেদের মধ্যে হানাহানি – ইতিহাস পড়ে দেখুন। আমরা পশ্চিমাদের মত, মধ্যযুগ কে অন্ধকার যুগ ভাবি না, অনেক অর্থেই তখন ছিল স্বর্ণযুগ, প্রাতঃস্মরনীয় অনেক মহান ব্যাক্তির জন্ম হয়েছিল সে যুগে। হাসপাতাল – গড়ে উঠেছে, এতীমখানা – অনাথ আশ্রম গড়ে উঠেছে মুসলিম রাষ্ট্রের তত্তাবধানে, অসহায় মানুষকে সাহায্য, মানুষে মানুষে সাম্যতা- সবার জন্য সমান বিচার –রাস্তা ঘাটে নিরপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,! অবশ্য এখনকার পরিস্থিতির দিয়ে তৎকালীন পরিস্থিতি বিচার করলে তো হবে না; সে পরিস্থিতিতে তারা উদ্যোগী যে সকল কাজ শুরু করেছিলেন- ভেবে আশ্চর্য হতে হয়।
সেই সময়ের এমন দুজন প্রাতঃস্মরনীয় মানুষের বিষয়ে আলোচনা শুনা যাক তাহলে!
জায়েদ ইবনে সাবিত – রাসূল (সাঃ) এর তরুণ সাহাবাদের একজন । রাসূল (সাঃ) তিরোধানের সময় তার বয়স মাত্র ২২ বছর। একাধারে তিনি রাসূলের ওহী লেখক ছিলেন, পরবর্তীতে মদিনার অন্যতম জাজ ও বিচারকদের পরামর্শদাতা, ইসলামিক উত্তরাধিকার আইনের বিশেষজ্ঞ এবং সর্বোপরি কুরআনের সংকলক –এবং প্রথম যুগের হাফিজদের একজন ও কুরআন বিশেষজ্ঞ। তিনি খুব অল্প বয়সে রাসুলের সংস্পর্শে আসেন এবং সরাসরি রাসূলের নিকট থেকে শিক্ষালাভ করেন। কুরআনের গভীর জ্ঞানের কারনে তাঁর উপরে সর্বপ্রথম কুরআনকে গুছিয়ে একটা পুস্তকে রূপ দিতে দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রথমে হযরত আবু বকর (রাঃ) এর সময়ে তা শুরু হলেও, উসমান (রাঃ) সময়ে তা শেষ হয়। এ কাহিনী প্রায় সবার জানা যে, ইয়ামামার যুদ্ধে প্রায় ৭০জন কুরআনের হাফেজ শহীদ হলে, কুরআনের সংরক্ষনের প্রয়োজন অনূভূত হয়। কুরআন সংকলনের এর সিংহ ভাগ কৃতিত্ব দেয়া যায় হযরত জায়েদ বিন সাবিত কে।
আরও একজন, যিনি জন্মের পর মুহূর্তেই শিশু হিসেবে রাসূলের আশীর্বাদ লাভে ধন্য হন, তিনি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ)। রাসুলের অজুর পানি এগিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে – প্রায় সর্বদাই তাঁর খেদমতে হাজির থাকতেন। রাসূল (সাঃ) তাঁর এই ক্ষুদে অনুসারীকে খুব পছন্দ করতেন এবং তাঁর জন্য প্রায়ই দু’য়া করতেন, ‘ইয়া আল্লাহ্, তাকে জ্ঞান দান কর’ (তার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও)’। । রাসূল (সাঃ)দুয়ার বরকতে তিনি সত্যিই জ্ঞানী হয়েছিলেন। তাঁকে পরে বলা হয়েছে, ‘ওয়ান ম্যান ইউনিভারসিটি’ – কারণ তাঁর বাসার সামনে সর্বদা মানুষের ভীড় লেগে থাকত, একদল বেরিয়ে গেলে অন্য দল ঢুকে পড়ত, ইসলামের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞান অর্জনের জন্য। আর এ কারনে এক সময় তিনি তাদেরকে এক একদিনে এক একটা বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার সিস্টেম চালু করেন। তাঁর মেধা, তাঁর শানিত যুক্তি, কুরআন, ফিকাহ, ইতিহাসে তাঁর জ্ঞান ও বাগ্মীতা তাঁকে স্বনামখ্যাত পণ্ডিতে পরিণত করেছিল, আর সর্বোপরি তিনি ছিলেন রাসূল (সাঃ) এর পরিবারের মানুষ, রাসুলের চাচা আব্বাস (রাঃ) পুত্র।
একবার জায়েদ ইবনে সাবিত কোথাও যাচ্ছিলেন, তরুণ আব্দুলাহ পাশেই বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে । জায়েদ (রাঃ) যখন ঘোড়ায় সওয়ার হতে যাচ্ছেন, তাঁর ঘোড়ার লাগাম ধরে, ঘোড়াকে স্থির করে রাখলেন বিনয়ী আবদুল্লাহ-আজ্ঞাবাহী দাসের মত, যেন জায়িদ আরামে ঘোড়ায় সওয়ার হতে পারেন ।
জায়েদ বলে উঠলেন , “না, এটা করো না। ও রাসূলের চাচাতো ভাই! জায়েদ (রাঃ) রাসূল ( সাঃ) এর চাচাতো ভাইকে এমনটা করতে দিতে চাইছিলেন না, যদিও বয়সে ও মর্যাদায় জায়েদ, সে সময়ে, আবদুল্লাহ ইবেন আব্বাসের (রাঃ) থেকে অনেক বড়।
“আমরা এভাবেই আমাদের জ্ঞানীদের কদর আর সম্মান করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি” - শান্তভাবে আবদুল্লাহ জবাব দিলেন।
এবার জায়েদ বললেন, “তোমার হাতটা আমায় দাও”;
আবদুল্লাহ তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। জায়েদ সাদরে তাঁর হাত গ্রহণ করে, আদবের সাথে তার হাতে চুমু দিলেন।
“আর আমরা আমাদের রাসূলের খান্দান এর সাথে এমন আচরণ করতেই আদিষ্ট হয়েছি”।
ইসলামের জ্ঞানী ব্যাক্তিদের এই হল সম্মান ও প্রতিসম্মান প্রদর্শনের তরীকা!
বিষয়: বিবিধ
১৬৮৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে আমি মন্তব্যের উদ্দেশ্যে লিখি না। নিজের ভাল লাগার ‘তাড়না থেকে লিখি!
আবারও ধন্যবাদ আপনাকে!
মন্তব্য করতে লগইন করুন