ব্যাকটেরিয়া – এক উপকারী বন্ধুও বটে !
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ২৬ নভেম্বর, ২০১৪, ০৫:৫২:২৩ সকাল
পৃথিবীতে যদি পচন প্রক্রিয়া হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কি হবে?
একবার কানাডার টরণ্টো শহরের ক্লীণাররা ধর্মঘট করল। তারা এক সপ্তাহ শহরের কোন ময়লা/ গারবেজ পরিষ্কার করে নাই। দুর্গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছিল পুরো শহর, মনে হচ্ছিল ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি! শহর ছেড়ে কোন পাড়া গাঁয়ের দিকে চলে যাই! ক্লীণাররা কত খানি গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ে বুঝলাম!
ব্যাকটেরিয়া হচ্ছে এই প্রকৃতির জন্য ক্লীণার বিশেষ! যদি একবার আল্লাহ্র সৃষ্টি করা, এই বেতন বিহীন ‘ক্লীণাররা- ধর্মঘট করে? যদি পচন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়? এই পৃথিবী কি বাসযোগ্য থাকবে? মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর, গাছ পালা পশু পাখীর বর্জ্য, বিষ্টা, মৃতদেহ, গোটা পৃথিবীতে স্তূপাকারে জমা হতে থাকবে! প্রথম সুযোগেই পৃথিবী থেকে মানুষ পালিয়ে যাবে – যদি তাদের যাওয়ার বা থাকার জায়গা থাকে আর কি! নাহলে রোগে শোকে ভূগে মরতে থাকবে মানুষ – জীব জন্তু! সেই অর্থে ব্যাকটেরিয়া আল্লাহ্ পাকের এক অপূর্ব সৃষ্টি।
প্রতিটি মানুষ জন্মের সময় মায়ের শরীর থেকে ব্যাকটেরিয়া নিয়েই পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয়। এরপর প্রকৃতিতে- মাটি, বাতাস, পানি ও অন্যান্য প্রানী বা উদ্ভিদে অবস্থানকারী ব্যাকটেরিয়ার সাথে মিথস্ক্রিয়া (interaction) করে । কারো সাথে মিলে মিশে থাকে (SYMBIOTIC), কাউকে সহ্য করতে পারে না, তার সাথে যুদ্ধ করে, কখনো জেতে – অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়া মারা যায় বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, অথবা হেরে যায়, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বসে পড়ে এবং তখন মাণব শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে।
মাণব শরীরের এনজাইম ও হরমোন সক্রিয় থাকা বা সক্রিয় হওয়ার জন্য শরীরের তাপমাত্রা একটা বিশেষ লেভেলে থাকার প্রয়োজন হয় । মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট এর কাছাকাছি- স্বাভাবিক ভাবে ৪০ এর উপরে উঠলেই একজনের খবর হয়ে যাবে, তেমনি কয় ডিগ্রি নীচে নামলেও! মানুষ বুদ্ধিমান জাতি, তাই এর বাইরেও, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে এমণকি মহাশূন্যেও একটা পর্যায় পর্যন্ত মানুষ টিকে থাকতে পারে; অক্সিজেন নিয়ে ভূগর্ভে বা সাগর তলেও যেতে পারে। আর এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব ? জন্মগত অবস্থাতেই আগ্নেয়গিরির লাভার গরমেও, কিম্বা হট স্প্রিং বা গরম পানির ঝর্ণায় ও এদের কেউ কেউ টিকে থাকতে পারে ( THERMOPHILE)। ১২২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে অন্য কোন প্রাণী বা উদ্ভিদের বাঁচার সুযোগ হয়তো নেই, এদের আছে! ভূগর্ভে – সমুদ্র গর্ভে – মানুষের বা প্রাণীর পেটের নাড়ীভুঁড়ির মধ্যে- কোথায় নেই!
মানব শরীর ব্যাকটেরিয়ার একটা বড় বাহক। কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক। মানব শরীর এর প্রতি বর্গ সেন্টিমিটার জায়গায় ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ (প্রায়) নিম্নরুপঃ
১। মাথার খুলিঃ ১৫০০/ বর্গ সেন্টিমিটার
২। কপালঃ ২০০,০০০/ বর্গ সেন্টিমিটার
৩। বাহু মূলঃ ১০০০/ বর্গ সেন্টিমিটার
৪। ঊর্ধ্ব বাহুঃ ১১০০০/ বর্গ সেন্টিমিটার
৫।পৃষ্ট দেশঃ ৫০,০০০/ বর্গ সেন্টিমিটার
আরও কিছু জায়গায় যেমন মুখ বা নাকে, আর যেখানে মিঊকাস থাকে- সেখানে আরও বেশী! ওদের বেঁচে থাকার জন্য আদ্রতা খুব গুরুত্বপূর্ণ!
ভাল দিক হল, সব ব্যাকটেরিয়া ক্ষতিকর নয়, আসলে অধিকাংশই ভাল; উপকার করে, কিম্বা উপকার না করলেও ক্ষতি করে না। অনেক ব্যাক্টেরিয়ার সাথে মানব প্রজাতির সিমবায়োটিক (SYMBIOTIC) সম্পর্ক রয়েছে। সুস্থ জীবনের জন্য ওদের প্রয়োজন অনস্বীকার্য । পেটে বা অন্ত্রে রয়েছে ঈশ্চীড়ীচীয়া কোলাই ( Escherichia coli), আর এটা যদি কোন পানিতে পাওয়া যায় তবে বুঝতে হবে- এ পানিতে মানব বর্জ্য এসে মিশেছে! পেটে এর পরিমাণ ও একটা সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট । ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা সেই সীমার অধিক হয়ে গেলেই –তা হোষ্ট এর জন্য সাময়িক বা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার সৃষ্টি করতে পারে। খাবার বা পানির সাথে বহিরাগত পেটে ঢুকলে তা রোগ সৃষ্টি করতে পারে! দু চারটা ব্যাকটেরিয়া শরীরে ঢুকলেই যে একজন অসুস্থ হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়! শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা তাকে বাধা দেবে!
আর ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া অল্প সংখ্যক হলেও এরা যে সুযোগ পেলে মহামারী ঘটাতে পারে পৃথিবীর ইতিহাস তার সাক্ষী। প্লেগ, কলেরা এদের কারণে হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর এমনকি অনেক দেশ শেষ করে দিয়েছে, চোখে দেখা যায়না এই অণুজীব! নিত্য নৈমিত্তিক ডায়রিয়া তো খূব স্বাভাবিক ঘটনা। যক্ষ্মা, কূষ্ট, টাইফয়েড এগুলো ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। সিফিলিস এর কারণ ও ব্যাকটেরিয়া। নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস – ছাড়াও অনেক চর্ম রোগ যেমন– মাংস- খেকো ব্যাকটেরিয়াও রয়েছে। মানুষের গায়ের মাংস ক্রমান্বয়ে পচে যাচ্ছে – ভাবতেই গা শিউড়ে ঊঠে। পায়ের আঙ্গুলের মাথা থেকে হয়তো শুরু হল, গোটা পা কেটে বাদ না দিলে সারা শরীরকে পচিয়ে ফেলবে এই জীবাণু! খারাপ ব্যাকটেরিয়া চেনার একটা ঊপায় আছে! আমাদের মা খালারা বাসী খাবার নাকের কাছে ধরেই বলে দিতেন – ঐ টা খাবার অযোগ্য! কীভাবে? সবগুলো নাহলে ও, অনেক ব্যাকটেরিয়া বেশির ভাগ সময়ে খারাপ গন্ধ ছড়ায় । বিশেষ করে ‘গ্রাম নেগেটিভ জাতের অনেক ব্যাকটেরিয়ার গন্ধ থেকেই তাদের কে ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
ব্যাকটেরিয়ার ভাল দিকও কম নয়। মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে ব্যাকটেরিয়া সরাসরি ব্যবহৃত হয়। ‘ ফলারটি পাকা হয় লূচী দৈ আহারে’ !
এই দৈ তো ব্যাকটেরিয়া ছাড়া তৈরি হবে না! মূলতঃ ব্যাসিলাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়া দুধ থেকে দৈ তৈরী করে! পানির/ চীজ? ফারমেন্টেশন ঘটাণোর জন্য ব্যাকটেরিয়া বা তার খালাত ভাই ‘ইষ্ট মাণব সভ্যতার খূব জরুরি উপাদান। মাটি আর নোংরা পানি পরিস্কার করতে কিম্বা পেট্রোলিয়াম জাত স্পিল পরিষ্কার করতে ব্যাকটেরিয়া অতি গুরুত্বপূর্ণ! ঔষধ বা এনজাইম তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া।
ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থেকে বাঁচতে আর স্বাস্থ্য রক্ষায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা খূব জরুরি, তবে উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যাও যে আমাদের আশেপাশে প্রচুর তা জানা থাকলে ব্যাকটেরিয়া ভীতি একটু কম হবে!
এজন্য গণহারে জীবাণুনাশক ব্যবহার করে, ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার সাথে, ভাল ব্যাকটেরিয়ার পপুলেশনকেও ধ্বংস করে ফেলা কোন যুক্তির কথা নয়। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে হবে এটা ঠিক, তবে তা যেন অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না হয় বা সীমা লঙ্ঘন না করে!
বিষয়: বিবিধ
২৫৭০ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
Normal Flora মানুষের শরীরে কোন ক্ষতি করে না ,উপকার করে ।
Vit B12 তৈরিতে ব্যাকটেরিয়া লাগে, যেটা অন্ত্রের Normal Flora। এরকম বহু Normal Flora আমাদের সারা শরীরে ছড়িয়ে আছে।
কোনভাবে যদি এরা নিজেদের স্পেসিফিক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে আসে তখন মারাত্মক অসুস্থতার সৃষ্টি করে ।
আবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে ( এইডস্ ) একই স্থানের Normal Flora Opportunistic infection ঘটাতে পারে । এটাও মারাত্মক অসুস্থতার সৃষ্টি করে।
Thank you any way!
মন্তব্য করতে লগইন করুন