বাংলার স্বাধীনতা : সিরাজউদ্দৌলা বনাম শেখ মুজিব
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ০২ অক্টোবর, ২০১৪, ০৪:৩৭:৩৫ রাত
[img]
Life is nothing but a combination of coincidences!
জীবন কিছুই নয়, (পূর্ব নির্ধারিত!) কতিপয় ঘটনা দুর্ঘটনার সমষ্টি মাত্র।
অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। অবশ্য ধর্মে মতি আছে যাদের তাঁরা মেনে নেবেন-predestined বিষয় গুলো মেনে নিলে সামনের দিকে এগুনো সহজ হয়ে যায়। তবে ভোগবাদী দুনিয়ার যোগবাদী ( পড়ুন, যৌগবাদী – মৌলবাদীর উল্টো!) মানুষ এত সহজে তা স্বীকার করতে চাইবে না। হাজারো যুক্তি খাড়া করে দেখাতে চাইবে- ধরণী ‘কর্মযোগী’ নরের পদতলে! অবশ্য ‘ Rag to riches এর কিছু কাহিনী যে নেই তা নয়, তবে সেটাও উপরের ফর্মুলায় হয়তো ব্যখ্যা করা যাবে।
পৃথিবীতে অনেকেই প্রচুর শ্রম ও অধ্যবসায়- প্রচুর রক্ত আর ঘাম ঝড়িয়ে মর্যাদার উচ্চ শিখরে আরোহণ করার চেষ্টা করে। এর মধ্য কতিপয় মানুষ তাদের আরাধ্য অবস্থানে পৌঁছুতে সক্ষম হয়, অনেকেই হয় না । যারা হয়না, এদের অনেকে শান্তভাবে ভবিতব্যকে মেনে নেয়। ভাবটা এমন - আমি আমার চেষ্টা করেছি- যতটুকু পাওয়ার আশা ছিল তা না পেলেও ভালই আছি, এর থেকে খারাপতো হতে পারত! এরা ‘প্রত্যাশাবাদি, পজিটিভ মানুষ । অন্যরা এত সহজে ‘পরাজয় শিকার করতে চান না! মনে মনে যাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছিলেন- তাঁদের নানা দোষ খুঁজে বের করতে থাকেন, তাঁদের মামা চাচার হস্তক্ষেপ এবং শেষ পর্যন্ত ‘সিস্টেমের দোষ দিয়ে নিজেদের – অতৃপ্ত আত্মাকে শান্তি দিতে চেষ্টা করেন!এরা নেগেটিভ ধরণের! চলতে থাকুক এই চক্র! জগতে পজিটিভ নেগেটীভ না হলে ভারসাম্য আসবে কি করে!
জীবন যুদ্ধে যারা জয়ী, সেসব কীর্তিমানদের অনেকে তাঁদের জীবদ্দশাতেই বীরোচিত সম্মান পেয়ে যান- একুশে পদক—বীর উত্তম বা বীরচক্র নিয়ে, এক সময় বৌ বাচ্চা- আত্মীয় স্বজন- প্রতিবেশী এমনকি দেশবাসী সব্বাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে – মহা ধূমধামে পরপারে চলে যান ।
আর কেউ কেউ জীবদ্দশাতে নায়ক নন, বরং সংখ্যা গরিষ্ট মানুষ যাকে খলনায়ক হিসেবেই চিহ্নিত করত, যারা তাঁকে যথাযোগ্য ফুলের মালা নয় – বরং জুতার মালা দিয়ে বরণ করতে বেশি আগ্রহ দেখাত, তারা আবার মৃত্যুর পরে সময়ের চক্রে- বা ‘ ভাগ্য চক্রে ‘ডাবল নায়ক হয়ে ফিরে আসেন । এর নামই ভাগ্যচক্র!
“বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি- তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জ্বনাব ! সিরাজউদ্দৌলার ডায়ালগ মুখস্ত বলতে পারবে না আমাদের প্রজন্মের এমন ‘এরশাদ’ ( অর্থ পণ্টক) কেউ নেই। এই সিরাজউদ্দৌলা নবাব হয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন আলীবর্দির কন্যা আমিনা বেগমের ছেলে হিসেবে। থাকতেন নানার কাছে। আলীবর্দি অন্ধভাবে ভালোবাসতেন সিরাজউদ্দৌলাকে। আলীবর্দির মৃত্যুর পর আলীবর্দির ইচ্ছা অনুসারে তিনি হন নবাব। কিন্তু নবাব হতে গেলে যে ধরনের দূরদর্শিতার প্রয়োজন হয়, তা তার ছিল না। সিরাজের দুই আপন খালা (একজন ঘসেটি বেগম!) সব সময় ষড়যন্ত্র করতে থাকেন সিরাজের বিরুদ্ধে। সিরাজের খালা তাঁকে মেরে ফেলে আরেক বোনের ছেলে শওকত জংকে নবাব বানাতে চান- আর এমন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলার আকাশ ছেয়ে যায় ‘দুর্যোগের ঘনঘটায়’ । সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব ছিলেন মাত্র এক বছর ( ১৭৫৬-১৭৫৭)। পলাশীর যুদ্ধ সে আমলের মাপকাঠিতেও একটি বড় যুদ্ধ বলা যায় না। কিন্তু সিরাজ এই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্য এই যুদ্ধে মারা যায় মাত্র ২৩ জন।
আর আহত হয় ৪৯ জন। কিন্তু নবাবের সৈন্য নিহত হয়েছিল ৫০০ জন। আহতের সংখ্যার হিসাব নেই। ১৭৫৭ সালের ২৯ জুন রবার্ট ক্লাইভ ২০০ ইউরোপীয় ও ৫০০ দেশীয় সৈন্য নিয়ে পলাশী থেকে মুর্শিদাবাদ শহরে প্রবেশ করেন। রবার্ট ক্লাইভ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, মুর্শিদাবাদ শহরে তাদেরকে (গোরা বা শ্বেতাঙ্গ সৈন্য) দেখার জন্য রাস্তার দুই ধারে সার বেঁধে বহু লোক দাঁড়িয়ে ছিল। এই বিশাল জনতা ইচ্ছা করলে কেবল ইটপাটকেল ছুড়ে তাদের মেরে ফেলতে পারত। তারা কিন্তু তারা তা করেনি। কারণ, তারা জেনেছিল সিরাজের স্থলে মুর্শিদাবাদের নবাব হয়েছেন মীরজাফর। সিরাজ পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে চলে যেতে চান মুর্শিদাবাদ হয়ে দিল্লির দিকে; কিন্তু তিনি ৩০ জুন রাজমহলের কাছে ধরা পড়েন। তাকে ধরে এনে মুর্শিদাবাদে বন্দী করে রাখা হয়। হত্যা করা হয় ২ জুলাই। তাকে হত্যা করে তার লাশ সারা মুর্শিদাবাদ শহরে হাতির পিঠে করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মানুষকে দেখানো হয়। কিন্তু মুর্শিদাবাদের জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে না। উঠলে ইতিহাস ভিন্ন রূপ হতো। কিন্তু সিরাজের সময়ে দেশবাসী তাকে এই দৃষ্টি নিয়ে বিচার করেনি। সিরাজকে নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক কাব্য-কাহিনী ও নাটক রচনা করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমে তিনি আমাদের কাছে হয়ে আছেন স্বাধীন বাংলার শেষ নবাব। আর নাটক / যাত্রা বা চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে চোখের পানি ফেলে নাই এমন ‘পাষণ্ড খুব একটা নেই। তিনি বাংলার মানুষের ‘চোখের মণি ! বাংলার স্বাধীনতার সূর্য এই নবাবের সময়ই ‘অস্ত গেছে! একজন অযোগ্য নবাব যে কিনা নিজের সেনাবাহিনী দিয়ে ৭০০ সৈন্যের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে – এই ব্যর্থ নবাব তাঁর মৃত্যুর পরে অযাচিত ভাবে অদৃষ্ট পূর্ব সম্মান লাভ করেছেন!
বাংলার স্বাধীনতার সূর্য আরও একবার উদিত হল একাত্তরে। ৭ মার্চে ‘ জীয়তে পাকিস্তান বলে বক্তব্য শেষ করলেও – ওইদিনই ‘পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান বলে তার চেলা চামুণ্ডারা দাবী করতে গিয়ে এখন বাংলার ইতিহাস নূতন করে লেখা হচ্ছে। তাহোক, তবে তাঁর ক্ষমতায় থাকা কালীন চার বছরের ইতিহাস বাংলার এক চরম অরাজকতার ইতিহাস, এগুলো যারা প্রত্যক্ষ করেছে তাঁদের অনেকেই এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। ক্ষমতাসীনদের ফৌজ - রক্ষী বাহিনী, মুজিব বাহিনী – দিনের আলোতে আর রাতের আঁধারে কি করেছে আর কি করে নাই তাঁর সাক্ষী অগণিত মানুষ! এর সমস্ত দায়ভার রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে তাঁর গর্দানেই পড়েছে, এবং প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনা এক অপাংক্তেয়, দুর্ভিক্ষ পীড়িত বৃদ্ধার কথা এখনও মনে আছে। এক বাটী মুজিব ঘাঁটি নিতে আসা এই বৃদ্ধা (মুজিব ঘাঁটি বা মুজিব ঘণ্ট; – মুজিবের আমলে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষকে বাঁচাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘নোঙ্গরখানা খুলা হয়েছিল । বড় ডেকচিতে পানি গরম করা হত, পানি ফুটে উঠলে ময়দা ঢেলে দেয়া হত, প্রয়োজনের তুলনায় নেহায়েত অকিঞ্চিৎকর-(এই ধরনের নোঙ্গর খানার জন্য বরাদ্দ কৃত বেশীরভাগ ময়দাই সে সময়ের রিলিফ চোর আওয়ামি লীগাররা গণভাবে চুরি করে নিজেদের ভোগে লাগাত), ময়দা দিয়ে পানির ঘনত্ব কিছুটা বাড়ত – এই বস্তুই কাতারবন্দী হাজারো মানুষের হাতের বাটী বা থালায় এক চামচ করে ঢেলে দেয়া হত। এই ‘ময়দা গুলানো জল’ এর নাম হয়েছিল মুজিব ঘাঁটি, মুজিবের নামের সাথে ৭১ পরবর্তী আওয়ামী শাসনের এক কলঙ্কিত অধ্যায়কে জুড়ে দিয়েছে এই শব্দটি) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঐ অখাদ্য বস্তুর জন্য অপেক্ষা করেও যখন পায় নি, হতাশ হয়ে বলছিলঃ “ এই মজিবর মরে না! এমন দুর্ভিক্ষের ভেতরেও ‘রাজপুত্র শেখ কামালের বধুবরণ করলেন তৎকালীন রাষ্ট্র প্রধান ; সোনার মুকুট দিয়ে- পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় করে ছবি এল। রাজপুত্রের বিয়ে বলে কথা!
দেশের মানুষের পেটে খাবার নেই, দুর্ভিক্ষে প্রান হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে অগণিত মানুষ- এমন অভাবের সময়ে এমন জাঁকজমকের ‘শাদির অনুষ্ঠান সাধারন মানুষের গালে চপেটাঘাত করেছে।
চরম অরাজকতার এক পর্যায়ে, ১৯৭৫ এর মধ্য আগস্টের রাতে একদল সৈনিক – এক অন্যায় আর দুঃশাসনের সমাপ্তি ঘটায় আরেক অন্যায় করে- নারী শিশু কাউকে রেহাই না দিয়ে। অবশ্য ভুল তারাও করেছে- এবং জাতি এখনও সে ভুলের মাশুল দিয়ে যাচ্ছে! তবে সেটা অন্য অধ্যায়।
তো, শেখ মুজিব যখন মারা গেলেন- জনতা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল । রক্ষী বাহিনী, মুজিব বাহিনী রাতারতি ‘নেই হয়ে গেল ( হুমায়ুন আহমেদ এর মাতাল হাওয়া দ্রষ্টব্য ) । জনতা যদি সত্যই মুজিবের প্রেমে মাতওয়ারা থাকত তবে তাঁরা রাস্তায় নেমে আসত । (অবশ্য একজন এসেছিলেন – বাঘা কাদের নামের একজন- তবে রিলিফ চোরের দল তাঁকে নিজেদের দল থেকে বহিস্কার করেছে, তিনি জাতির বোনের নজর কাড়ার চেষ্টা এখনও লেজ নেড়ে যাচ্ছেন, ক্ষমতার লোভ এড়ানো কঠিন! ) বরং মানুষের স্বতঃ স্ফূর্ত উল্লাস উল্লেখ যোগ্য। –হয়তো রক্ষীবাহিনী মুজিব বাহিনীর শূন্যে মিলিয়ে যাওয়ায়- অনাচার অত্যাচার থেকে বাঁচাযাবে- এ ভরসায় । দেশী বিদেশী অনেকেই এ সময়কে রেকর্ড করেছেন। আর যারা কিছুই করে নাই- কাঁদেও নাই, হাতে তালিও দেয় নাই- তাঁরা– সিরাজদ্দৌলার সময়ের মতই, সাধারন বাঙ্গালী – দর্শকের ভূমিকায় ছিল-! রাজা গেল রাজা এলো- দেখা যাক কি হয় টাইপের! বাংলার স্বাধীনতার নায়ক নন, যেন ‘খল নায়ক হিসেবেই শেখ মুজিব বিদায় নিলেন বাংলার ভাগ্যাকাশ থেকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট।
কিন্তু না। এখন ২০১৪ সাল- তাঁর মৃত্যুর চল্লিশ বছর পুরো হয়নি, ইতিমধ্যে বাঙ্গালী জাতির পিতা হিসেবে তাঁকে অফিশিয়ালী ‘গদ্দিনশীন করা হয়েছে, বাঙ্গালী এটা চায় কি না চায় – এনিয়ে কোন গণভোট হয়নি- ঐ রিলিফ খোর – ‘চাটার দল ( মুজিবের নিজের মুখের ভাষাতেই) সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আবার তাঁর জন্মদিন, তাঁর মৃত্যু দিবস বাঙ্গালীকে দিয়ে মহা আড়ম্বরে পালন করিয়ে নেয়া হচ্ছে-, কর্ম বিমূখ বাংগালীকে আরও ছুটি দেয়া হয়েছে- ফুর্তি করতে, রিলিফ চোরের দল এখন আরও জজবার সাথে পুকুর চুরি করে যাচ্ছে, নূতন করে রক্ষীবাহিনী হাসিনা বাহিনী হয়নি – তবে র্যাব আর পুলিশ- আর ভারতীয় ‘র’ সে শূন্য স্থান পূর্ণ করেছে, গুম, খুন – সব চলছে নির্বিচারে, এদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করলেই- বিনা বিচারে জেল! ব্যাংকের টাকা আর সরকারী সম্পদের লুটপাট চরমে উঠেছে, আবার সেই দুঃশাসনের দিনগুলোর কথা মানুষের মনে পড়ে যাচ্ছে । তাঁর ছবি ছাড়া কোন অফিস নেই, তাঁর বাক্য বেদবাক্যের মত স্মরণ করা হচ্ছে! মোটকথা সেই শেখ মুজিব যেন হঠাৎ করে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে, তিনি এখন পূনরায় বাংলার আকাশের মধ্যগগনে ।
সিরাজদ্দৌলার সাথে কেবল পার্থক্য একটা –! সিরাজদ্দৌলার মত কবি সাহিত্যিকের দল বা তাঁদের লেখা নাটক যাত্রা বা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নয়, শেখ মুজিব এর সুযোগ্য কন্যাকে বাংলার জনগণ আরও এক আন্তর্জাতিক ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দিয়েছে। তবে সিরাজদ্দৌলার মত ব্যর্থ নবাব এর মতই, জীবদ্দশায় শেখ মুজিব নেহায়েত অযোগ্য (প্র)শাসক হলেও, মৃত্যুর পরে একইভাবে - মর্যাদার চরম শিখরে উঠেছেন । এরই নাম বোধ হয় ভাগ্য চক্র! A combination of coincidences!
বিষয়: বিবিধ
১৭৫১ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো আপনার লেখা ...
কেয়ামত তক! ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন