ইনস্ট্যান্ট নুডলস এর নীরব বিষ (slow poison)- এবং হৃদরোগ

লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ১৬ আগস্ট, ২০১৪, ০২:৫৬:০৬ রাত



পৃথিবী খুব দ্রুত এগিয়ে চলছে। কত দ্রুত! ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের এই আপাতঃ স্থবির গ্রহটি সূর্যের চতুর্দিকে প্রতি সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার বেগে দৌড়ুচ্ছে (মিনিটে ১৮০০ কিমি. আর ঘণ্টায় ১০৮০০০ কিমি.) ! দেখিয়াও যেন না হয় প্রত্যয়! আমরাও খুব ব্যস্ত, এত ব্যস্ত যে নিয়মিত খাবার তৈরী করারও সময় নেই। কর্মজীবী মানুষের লাঞ্চ ব্রেক এর সীমিত সময়ে, টেলিফোন ইত্যাদির কারনে, সহজে গলাধঃকরন করা যায় এমন খাবারই উত্তম। সূপ হলে আরও ভাল। নিদেনপক্ষে স্যান্ড উইচ! ইনস্ট্যান্ট নুডুলস বা কাপ নুডুলস হলে আরও ভাল। ফাস্ট ফুড! ফাস্ট! ফাস্ট!!

এক সহকর্মী – নিয়মিত নয়টা পাঁচটা চাকুরীর সাথে আরও কিছু করছে- কিছু বাড়তি আয়ের জন্য। এর জন্য নিয়মিত কাজের মধ্যে সারাদিন টেলিফোনে কথা বলে। সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় হয় না তার, লাঞ্চ খায় আমাদের সাথে একই টেবিলে। প্রায় প্রতিদিনই, ডজন হিসবে কিনে রাখা – ইনস্ট্যান্ট নুডুলস ভর্তি- ষ্টাইরোফোমের একটা “কাপ বা ‘পেয়ালা’ নিয়ে আসে। দামেও সস্তা, মাত্র ৫০ সেন্টস বা অর্ধ ডলারে লাঞ্চ! ষ্টাইরোফোমের ঐ কাপের ঢাকনা খুলে –কেবল গরম পানি ঢেলে দিয়ে ৩ মিনিট অপেক্ষা করলেই ‘রান্না শেষ! এরপর এর সাথে একটা পলিথিনের পাউচে রাখা ‘মশলা যোগ করলেই- মহার্ঘ প্রস্তুত! এবার গরমাগরম খেয়ে যাও।

বছর কয়েক আগে -জাপানে পড়াশুনা করার সময়ে – দেখতাম, সহপাঠী জাপানিজ ছাত্র/ ছাত্রীরা এর উপরেই টিকে থাকত। নাস্তা, লাঞ্চ বা সাপার – এই এক বস্তুতেই চলছে। জাপানের নিশিন কোম্পানীর এই ‘যুগান্তকারী’ আবিস্কার একদিকে সস্তা, অন্যদিকে সহজ পন্থায় গলাধঃকরন করা যায় এমন মুখরোচক আহার্যের - অঢেল সরবরাহ! Cheaper & Convenience! কলেজ – ইউনিভার্সটির ছাত্র/ ছাত্রী, ব্যাচেলর ডরমিটরি – ব্যাস্ত কর্মজীবী সব্বাইকে যেন এর নেশায় পেয়ে বসেছে ।

সম্প্রতি Journal of Nutrition এর এক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে, এই বস্তু নিয়মিত ভক্ষন, একজনের হৃদ রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বা রিস্ক বাড়িয়ে দেয়।

‘এই গবেষণার ফলাফল অতীব গুরুত্ব বহন করে – কেননা, অসংখ্য মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্বন্ধে কিছু না জেনেই, ইনস্ট্যান্ট নুডলস খেয়ে যাচ্ছে’ এক প্রেস রিলিজে বলেছেন- মুখ্য গবেষক ডাঃ Hyun Joon Shin (Hyun Joon Shin, Harvard School of Public Health এর clinical cardiology fellow )

এই গবেষণায় , ২০০৭-২০০৯ সালের, ১৯-৬৪ বছর বয়সের ১০৭১১ জন মানুষের ডাটা লক্ষ্য করা হয়েছে। যারা সপ্তাহে দুই বার এই ইনস্ট্যান্ট নুডলস খেয়েছে তাদের শরীরে cardiovascular, renal, and metabolic systems এর অনেক অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েছে যা শেষ পর্যন্ত হৃদরোগ এর দিকে এগিয়ে যাবে।

যদিও এক্ষেত্রে মূল ক্ষতিকর উপাদানকে নির্দেশ করা হয়নি, তবে গবেষক ‘জুন শিন বলছেন, ষ্টাইরোফোমের এই প্যাকেটে bisphenol A (BPA) এর মত একটা জ্ঞাত হরমোন-বিধ্বংসী (hormone disruptor) উপাদান রয়েছে, এছাড়া এতে রয়েছে MSG, chemical preservative – Tertiary Butyl hydroquinone(TBHQ)সহ প্রচুর পরিমানে অস্বাস্থ্যকর উপাদান ( যেমন saturated fat), যা মানব স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর ভূমিকা রাখতে পারে । অবশ্য দীর্ঘদিন প্যাকেটে থাকবে এমন খাবারে উচ্চ মাত্রার লবণ ( সোডিয়াম) ও পর্যাপ্ত preservative যোগ করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা।

সমসাময়িক কালে, গড় পড়তা উচ্চ মাত্রার ইনস্ট্যান্ট নুডলস ভক্ষক হচ্ছে কোরিয়ান জনগণ, এ সময়ে তাদের হৃদ রোগ আর বিষম মোটা (obese) হওয়ার পরিমাণ ও বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে যদিও যুক্তরাষ্ট্রের consumption গড় ৬ নম্বরে (চীন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম এবং ভারত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আগে), তারপরেও ২০১৩ সালে এ বস্তু কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই বিক্রয় হয়েছে ৪৩০০ বিলিয়ন ইউনিট !

অবশ্য ইনস্ট্যান্ট নুডলস নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। ২০১২ সালে ইনস্ট্যান্ট নুডলস হজমের জটিল প্রক্রিয়ার এক ভিডিও চিত্র ধারন করা হয় পরিপাক তন্ত্রের মধ্যে ক্যামেরা রেখে, যা নেহায়েত দর্শন যোগ্য ছিল না। Dr. Braden Kuo’র এই গবেষণায় দেখা গেছে, এ বস্তু খাবার পরে তা হজমের জন্য পাকস্থলীকে অতিরিক্ত খাটতে হচ্ছে – প্রচুর সময় ব্যায় করেও নুডুলস এর সুত্রগুলোকে ভেঙ্গে ফেলা সহজ হচ্ছে না। নুডুলস সাথে যোগ করা প্রিজারভেটিভ- Tertiary Butyl hydroquinone (TBHQ) -যা কিনা একটা পেট্রোলিয়াম এর বর্জ্য (bi product) ‘অখাদ্য’– সম্ভবতঃ এর জন্য দায়ী। এরও বছর খানেক আগে, মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ ইনস্ট্যান্ট নুডলস খাওয়ার বিষয়ে এক সতর্ক সংকেত দিয়েছিল- এর উপাদান গুলোতে যে thickeners, stabilizers, sodium, and preservatives রয়েছে তা স্ট্রোক, হৃদরোগ আর কিডনি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। প্রসঙ্গতঃ সোডিয়ামের বিষয় ধরা যাক। আমেরিকায় প্রতিদিনের খাদ্য- তালিকায় একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের জন্য সোডিয়ামের গ্রহন যোগ্য মাত্রা হচ্ছে- ১৫০০ মিলিগ্রাম (অনেক দেশে আরও কম!) আর একটা ইনস্ট্যান্ট নুডলস এর কাপে সোডিয়ামের পরিমাণ ২৭০০ মিলিগ্রাম!

‘মমফুকু আন্দো’ নামে এক জাপানিজ এর স্রষ্টা । ১৯৫৮ সালে জাপানে তারই নিশীন কোম্পানি প্রথম এর বাণিজ্যিক উৎপাদন করেছে চিকেন রামেন নামে, পরে ১৯৭১ সালে নিশিন ‘কাপ রামেন’ বাজার জাত করা হয়। প্রথমে বাজার জাতকরনে একটু সমস্যা হলেও এদের ব্যবসা জাপানের গাড়ি কোম্পানি টয়োটা বা হোন্ডার চেয়ে পেছনে নেই। কথিত আছে, কোম্পানির ভবনের সামনে আন্দো’র আবক্ষ মূর্তি শোভা পাচ্ছে- যা নাকি সোনা দিয়ে বানানো !

শেষকথা হচ্ছে, হঠাৎ একদিন একটা কাপ নুডুলস খেয়ে ফেললেই যে কারো হৃদ রোগ হয়ে যাবে তা নয়, আমাদের শরীরের অভিযোজন ক্ষমতা নেহায়েত কম নয়। তবে কেউ এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লে তার জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে, এটা বলা যায়।

আর ঘরে মায়ের হাতে বানানো খাবারের স্বাদ ও গন্ধ বাজারের বাণিজ্যিক সম্ভারের চকমকে প্রভার তুলনায় দ্যুতিহীন বা কম আকর্ষণীয় হলেও, স্বাস্থ্য রক্ষায় তা অতুলনীয়, অপরিহার্য এবং অমূল্য।

বিষয়: আন্তর্জাতিক

১৪২৬ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

254782
১৬ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৭:০৭
জাকির হোসাইন লিখেছেন : ধন্যবাদ এ বিষয়ে সচেতন করার জন্য!
২০ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৯:৩০
200063
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকেও!
254787
১৬ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:১০
কাহাফ লিখেছেন : সচেতনতা বাড়াতে এ পোস্ট অনেক ভূমিকা রাখবে। অনেক ধন্যবাদ ভাই।
২০ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৯:৩০
200064
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকেও!
254796
১৬ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৯:২৮
আহ জীবন লিখেছেন : crank মুভিটা দেখেছেন? ওইটার মতই অবস্থা আমাদের। তার সব কিছুই ঘটেছে স্পীডে আমরা স্লো মোশনে।
254845
১৬ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ১২:৫৭
আতিক খান লিখেছেন : ধন্যবাদ সচেতন করার জন্য। তবে এগুলো খেয়েও জাপানিরা গড় আয়ু চার্টে শীর্ষে (প্রায় ৮০) আর আমরা মশলা, ভেজাল খেয়ে নিচের দিকে (৬৮), প্রকৃতপক্ষে আরও কম। ফার ইস্ট আর আমেরিকান প্রবাসিদের অবশ্য সতর্ক হওয়া ভাল।
২০ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৯:৪৩
200068
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : গড় আয়ূর হিসেব নিকেশ একটু আলাদা, শিশু মৃত্যু এক্ষেত্রে বিরাট একটা ফ্যাক্টর । এছাড়া বাংলাদেশের মত খাদ্য দ্রব্যে ভেজাল পৃথিবীতে আর কোথাও আছে বলে মনে হয়না।
হৃদরোগ আমাদের দেশে উচ্চ মাত্রায় বাড়ছে – যা কিনা ২০/ ৩০ বছর আগে এর অর্ধেকও ছিল না। এখন বাড়ছে ক্যান্সার – সারা বিশ্ব জুড়ে। ক্যান্সার এর হার জাপানেও কম নেই! ‘সময় বাঁচানো – ‘ঝামেলা বাঁচানো - এই Convenience – আধুনিক সভ্যতায় অনেক সমস্যাই টেনে আনছে এবং আনবে। নিজেদের সচেতন ও সতর্ক হওয়াটা জরুরী, যতদূর সম্ভব।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File