মৌলিক চিন্তা
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ৩০ মে, ২০১৪, ০৩:৪৫:১৩ রাত
আমাদের মৌলিক চিন্তা করার ক্ষমতা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। নকলবাজদের ভীড়ে দেশের মুক্ত চিন্তার মানূষদের খুব কমই চোখে পড়ে আজকাল। বাংলাদেশ কি বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে?
মুক্ত চিন্তার বিকাশ আশঙ্কাজনক ভাবে হ্রাস পেয়েছে –মুক্তিকামী মানুষ কি একবার ও ভাবছে না এ বন্ধ্যাত্ব একটা স্বাধীন জাতির জন্য কি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে?
ধরে নেয়া যাক এক জন সাধারন শিক্ষিত মানুষ পত্রিকা পড়ে। কয়েকটা দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম দেখুন- বড় অক্ষরে ছাপা শব্দ গুলোর অবিকল অনুবাদ বা নকল করেছে অধিকাংশ পত্রিকা, যদি সুযোগ থাকে কিছু বিদেশী পত্রিকায় চোখ বুলান - তাহলে দেখবেন এপি, রয়টার বা বিবিসি বা voice of america’ বা অন্য কোন বিদেশী পত্রিকার অবিকল নকল ! নুতন কিছু করতে হলে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ে। পড়তে হয়, সময় ব্যায় করতে হয়, কাটা ছেঁড়া করতে হয়- গবেষণা করতে হয়, সৃষ্টির যে কষ্ট - তা সহ্য করতে হয়। একজন মায়ের প্রসব বেদনা দেখার সুযোগ হয়েছে কারো ? তাহলে নুতন ভাবে কিছু সৃষ্টি করার যন্ত্রণা কিছুটা উপলব্ধি করা গেছে !
অবশ্য এটা স্বীকার্য যে একজন শিক্ষার্থী যা পড়বে- তার পাঠ্য থেকে সে প্রভাবান্বিত হবেই। নিজের লেখায় অন্যের লেখার রেফারেন্স উল্লেখ করা দোষের কিছু নয়! কিন্তু যেটা আপত্তিকর সেটা হচ্ছে অবিকল নকল ! এই কপি করার বিষয় নিয়েই আজকের লেখা।
ধরা যাক বি বি সি একটা হেড লাইন করলো – “ইয়র্কশায়ারে বিস্ফোরণ” গতকাল রাতে ইয়র্কশায়ারে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে – ধারনা করা হচ্ছে এটা ইসলামিক টেরোরিষ্টদের আত্মঘাতি বোমা হামলা হতে পারে, অনুসন্ধান চলছে ।
এই খবরটুকু কোন বাংলাদেশী পত্রিকার সাংবাদিক সরাসরি অনুবাদ করে বাংলায় ছাপাবে। এই যে বোমা হামলার সম্ভাব্য কারণ সম্বন্ধে ‘অনুমান ব্যাপারটা রয়েছে। এর আভাস মাত্র অনুবাদে পাওয়া যাবে না, বাংলা অনুবাদ পড়লে মনে হবে – ‘ধারনা নয়, সত্যি সত্যি মুসলিম টেরোরিষ্টরা এ হামলা চালিয়েছে।
এই খবরে বিষয় রয়েছে তিনটা- বিস্ফোরণ, কেন এবং কারা দায়ী ! আর অনুবাদের ক্ষেত্রে ও এখন প্রণিধান যোগ্য হল তিনটি বিষয়। যে বাংলায় অনুবাদ করছে –তার ভাষা জ্ঞান কেমন, আর তার রাজনৈতিক মতাদর্শ কি-এবং সর্বোপরি তার উদ্দেশ্য কি! তার ভাষাগত অদক্ষতা কোন বড় অপরাধ নয়, এটা চর্চা আর অধ্যয়নের মাধ্যমে সংশোধন যোগ্য। যদি এই ব্যাক্তির রাজনৈতিক মতাদর্শ যদি ইসলাম বিরোধী হয়, তবে তা সংশোধনের অযোগ্য, সে শুধু ‘আনুমানিক বিষয়কে সত্য প্রমানের জন্য চেষ্টা করবেনা বরং এটাকে ‘সত্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রনী হবে। কাজেই ‘অনুমিত বিষয় আর অনুমিত হবে না, এটা ‘ফ্যাক্ট হয়ে যাবে। আবার একজন অমুসলিম, ইংরেজ সাংবাদিক যে অর্থে ইসলামকে ‘হুমকী হিসেবে দেখে, আর সকল মুসলিমকে সন্দেহের চোখে দেখে, একজন মুসলিম সাংবাদিকের (ধরে নিচ্ছি ৯০ ভাগ সম্ভাবনা বাঙ্গালী সাংবাদিক মুসলিম।) তো সেই অর্থে সমস্ত মুসলিমের উপর সন্দেহভাজন হয়ে সংবাদ লেখা বা যে কোন দুর্ঘটনা বা বিস্ফোরণকে, না জেনেই, সম্ভাব্য ‘শত্রু শিবির-(এখানে মুসলিম) এর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করার কথা নয়। ‘ইসলামিক টেররিস্ট’ এটা একটা রেসিস্ট (Racist) শব্দ, কিন্তু মৌলিক চিন্তা চেতনা না থাকার কারনে আমাদের কারো কাছেই তা নগ্ন বা অশ্রাব্য ঠেকে না। পশ্চিমা পত্র পত্রিকায় ইহুদী টেররিস্ট বা খ্রিষ্টান টেররিস্ট এমনকি হিন্দু টেররিস্ট বলে কেউ কক্ষনও কোন শব্দ দেখতে পেয়েছে কি? নরওয়ের কুখ্যাত Racist খুনী অ্যান্ডার্স ব্রেভিককে ও ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান মিডিয়া ‘খ্রিষ্টান টেররিস্ট’ বলে নাই ( এমণ কি টেররিস্ট’ ও বলে নাই! ) যদিও সে ঠাণ্ডা মাথায়, তার ভাষায়- খ্রিষ্টান ধর্ম রক্ষার অজুহাতে, ৭৫ জন তরতাজা তরুণ তরুণীকে খুন করেছে । শ্রীলংকার তামিলদেরকেও হিন্দু টেররিস্ট’ বলা হয় নি! কেন?
কারণ, একটা বৃহত্তর জাতি গোস্টী কে কতিপয় ব্যাক্তি বা একটা ক্ষুদ্র দলের কর্মের জন্য দায়ী করা যায় না। এ ধরণের ‘লেবেল লাগানো হলে একটা ক্ষুদ্র দলের অপকর্মের দায়ভার গোটা জাতির গায়ে লাগানো হয়, যেটা যৌক্তিক নয়। কিন্তু জায়োনিস্ট বা খ্রিষ্টান চরম পন্থীদের –প্রচারের কূট কৌশল হিসেবেই ইসলাম বা মুসলিমদের ক্ষেত্রেই শুধু এই ‘লেবেল’ লাগানো হয়। এপি রয়টার বা বিশ্বের অন্যান্য প্রায় সব খ্যাত সংবাদ সংস্থা এই ‘স্মিয়ার ক্যাম্পেন ( Smear campaign ) এর সাথে যুক্ত। পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে যে কোন নাশকতার সাথে মুসলিম নামের কেউ যুক্ত থাকলে বা তার অনুমান নির্ভর বা সম্ভাবনা থাকলেই তারা এই ‘ শব্দটি ঢালাও ভাবে ব্যবহার করে। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী গ্রুপ একই ধরণের কর্মে জড়িত থাকলেও – তাদের বর্ণনা করতে, – তাদের ধর্ম পরিচয় ঊল্লেখ করা হয় না। এই বৈসাদৃশ্য কেন?
টেররিস্ট’ বা টেররিজম শব্দটি যেন শুধু ইসলাম এর অনুসারীদের জন্য স্পেশাল ভাবে রেখে দেয়া হয়েছে! একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলেই আমাদের দেশী সাংবাদিকরা তা বুঝতে পারত। কিন্তু তাদের সময় নেই এসব নিয়ে মৌলিক চিন্তা করার। বাঙ্গালী আজ আর গভীর ভাবে চিন্তা করতে পারে না। কপি করা অনেক সহজ, সময় বাঁচে – আর প্রফেশনাল হিসবে প্রতিষ্ঠা পেতেও এতে তাদের অসুবিধা হচ্ছে না।
আর একটা উদাহরণ দেয়া যাক। আমি নর্থ আমেরিকার কাগজ গুলো দেখে আসছি অনেক দিন ধরেই । এরাও পদ্ধতিগত ভাবে – খারাপ কাজের সাথে কোন মুসলিম জড়িত থাকলে, বিশেষ করে তার নামে যদি ‘মুহাম্মদ থাকে তবে সে নাম এরা উল্লেখ করবেই । কিন্তু ভাল কাজের সাথে এই একই নামের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে ‘মুহাম্মদ’ নামটা আর হাইলাইটে আসে না । একটা উদাহরণ দেয়া যাক! একজন এশিয়ান – সম্ভবতঃ পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত এক ট্যাক্সি ড্রাইভার কে- কোন এক অপকর্মের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পেতেই পত্রিকায় তার নামে রিপোর্ট বেরুনো শুরু হল। তার নামের প্রথম – মধ্যম এবং শেষ অংশ ( সাধারণত নামের শেষ অংশ উল্লেখ করা হয়) থাকলেও এক্ষেত্রে প্রথম নাম ‘মুহাম্মদ কমপক্ষে তিন বার উল্লেখ এই রিপোর্টে করা হল। আবার ঊল্টো দিকে, একই ধরণের এক ট্যাক্সি ড্রাইভার, নিউ ইয়র্কে তার ট্যাক্সিতে ফেলে যাওয়া প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার মালিককে ফেরত দেয়ার জন্য পুলিশ অফিসে দিয়ে যায়। এত বড় একটা খবর, স্বাভাবিক ভাবেই সংবাদ শিরোনাম হয়। আমি এই ইভেন্ট টি খেয়াল রাখছিলাম। সকালে তার প্রথম নাম মুহাম্মদ উল্লেখ করা হয়, কিন্তু দুপুরের দিকে রিপোর্টে মিঃ অমুক ( শেষ নাম) এবং রাতের টিভি নিউজে পূরো নাম ব্লাক আউট করা হল। বলা হল, নিউ ইয়র্কের জণৈক ট্যাক্সি ড্রাইভার, তার গাড়িতে ফেলা যাওয়া এক মিলিয়ন ডলার মালিককে ফেরত দিয়েছে। হয়তো এর নামের সাথে ‘মুহাম্মদ না থাকলে – সে নাম উল্লেখ করা হত! এই হল এদেশের মিডিয়ার প্রকৃত চরিত্র ।
এখাণে সাজা পাওয়া আসামিকে অনেক সময় সেই অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট ঊপণামে ডাকা হয়। যেমন এক মুসলিম ( শিশু সৈনিক-) ‘ওমর খদর’ কে সব সময় ‘কণভীক্টেড টেররিষ্ট’ বলেই উল্লেখ করা হয় ( আমেরিকান আদালত দ=এই ১৩ বৎসরের শিশুকে প্রায় একযুগ আটকে রেখে তার স্বীকারোক্তি আদায় করে আট বছরের সাজা দিয়েছে, এখনও সে কানাডার কারাগারে বন্দী । কিন্তু “কণড়াড ব্লাক” নামে ‘নাইট উপাধি পাওয়া এক জন সাজা পাওয়া অপরাধী রয়েছে এই টরোন্টোতেই, যে অনেক দিন জেল খেটে ছাড়া পেয়েছে। তাকে কখণোই ‘কণভীক্টেড প্রতারক ( সে প্রতারণার অভিযোগে সাজা পাওয়া অপরাধী – কয়েক মিলিয়ন ডলার এর মামলা ) বলে পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় না। এই বৈপীরিত্ব কেন? আমাদের দেশের সাংবাদিকগন কি এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় পায়? পশ্চিমাদের ব্যবহৃত ‘শব্দাবলী সরাসরি অনুবাদ করার আগে তারা যদি একটু চিন্তা করত – হয়তো বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতা আর একটু ঊচ্চ মর্যাদা লাভ করত।
পৃথিবীর প্রতিটি জাতি এক অর্থে ইউনিক- তাদের ভাষা আলাদা, তাদের আলাদা ডেমোগ্রাফিক, আলাদা সমস্যা- আর এ সমস্যা সমাধানের রাস্তাও আলাদা হওয়ার কথা। তাই প্রতিটা দেশের বুদ্ধিজীবী বা ইণ্টেলেক্ট নিজের দেশের জন্য আলাদা সমস্যার জন্য আলাদা সমাধান ব্যবস্থা চিন্তা করেন। আমাদের দেশের অবস্থা দেখলে মনে হয় – আমাদের জন্ম হয়েছে অন্য দেশের বা জাতির ‘ভোক্তা হওয়ার জন্য, আমরা অন্যদের বাহ্যিক বিষয় যেমন পোষাক- ভাষা- আচরণ প্রমোদ সব কপি করার জন্য এক পায়ে খাড়া ( কেবল মাত্র কঠোর পরিশ্রম করার বিষয়টি ছাড়া! ) । ১৬ কোটি লোকের হাতে ৩২ কোটী মোবাইল ফোণ, অথচ মোবাইলের একটা স্ক্রু ও এখাণে তৈরি হয় না !
প্রায় প্রতিটা দেশে তাদের নিজেদের সিস্টেম তৈরির চেষ্টা করছে, জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ড়ক্ষাড় জন্য যা অতি জরুরি। এদেশে সিস্টেম তো দুরের কথা- একটা স্ক্রু তৈরির উদ্যোগ ও কি নেয়া হয়েছে? যাদের তা করার কথা – তারা তো ‘বিলাতী বস্তু বলতে অজ্ঞান! এমনকি ‘ইন্ডিয়ান মেড’ বস্তু বা প্রমোদের স্রোতেও আমাদের নেতা নেত্রীরা ভেসে যাচ্ছে। এর শেষ কোথায় ?
এই দেউলে পড়া মানসিকতা নিয়ে কোন দেশ কি কোনদিন পৃথিবীর ম্যাপে সম্মানজনক স্থান করে নিতে পারবে? এভাবে কোন জাতিই পারে নাই।
যারা পেরেছে তারা প্রচণ্ড পরিশ্রম করেই পেরেছে, হয়তো অন্যদের সাহায্য নিয়েছে- তাদের মডেলকে অনুসরণ করেছে, তার পরে নিজেদের সিস্টেম তৈরী করে ফেলেছে! বাংলাদেশকেও একই পথে এগুতে হবে। সাফল্যের কোন শর্ট কাট রাস্তা নেই।
কিন্তু কথা হল, আমরা কতদিনে তা বুঝতে পারব? আমাদের ইণ্টেলেক্ট শ্রেণী ক্ষমতাসীনদের পায়ে তেল দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে! হয়তো আমাদের দেশের উন্নতির জন্য এখন অন্য দেশ থেকে জ্ঞানী গুনী বুদ্ধিজীবী ভাড়া করে আনা ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই! কিন্তু ভাড়াটে জ্ঞানীদের বুদ্ধিজীবী দিয়ে কি কোন দেশ উন্নতি করতে পেরেছে? ভারবাহী গাধা আর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, উভয়েই পয়সার বিনিময়ে নিজের শ্রম বিক্রী করে। এই নপুংসক শ্রেণীর কোন আত্ম মর্যাদা নেই, বা কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষাো নেই; যা আছে তা হচ্ছে ‘প্রভূর মন তুষ্ট করে এমন স্তুতি স্তাবকতা আর তার ছুঁড়ে দেয়া হাড্ডি বা ‘উচ্ছিষ্ট গলাধঃকরন করার জন্য বিশালকায় পেট!
সময় সময় মনে হয়, এই ভাড়াটে গাধা আর ক্লীব কাপুরুষে ভর্তি হয়ে গেছে দেশ
আর কোন আশা নেই। স্বাধীন ভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচার মত বাংগালী – মৌলিক ভাবে চিন্তা করার – দেশকে সে পথে এগিয়ে নেয়ার দেশকে নির্দেশনা দেয়ার – মত কেউ আর অবশিষ্ট নেই। আমাদের এই হত দরিদ্র দেশ এই ভারবাহী গাধাদের দখলে চিরস্থায়ী এক বন্ধ্যাভূমি হয়ে গেছে। হে ধরণী দ্বিধা হও!
বিষয়: বিবিধ
১১৯৩ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কি বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে?
মন্তব্য করতে লগইন করুন