একজন সালাউদ্দীন স্যার ও আমার ছাত্রজীবন
লিখেছেন লিখেছেন হাসমত ০৫ অক্টোবর, ২০১৩, ০১:১৩:৪৫ রাত
১৯৮৯ সাল।ককসবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাশ নাইনে। বি সেকশান। ৮ম শ্রেণি হতে এক সাবজেক্টে ফেল করে নাইনে উঠি। ক্লাশ যথারীতি শুরু হয়ে গেছে। লম্বা, স্লীম শরীরের একজন ভদ্র কিন্তু মেজাজী ধরণের ক্লাশ টিচার। সালাউদ্দীন স্যার। তার ক্লাস আগে পেয়েছিলাম কিনা মনে নেই। তবে শুনেছি তিনি খুব কড়া একজন শিক্ষক। তাই তাকে দেখলে খুব ভয় হতো।
সে সময় বিজ্ঞান বিভাগে পড়ুয়াদের কঠিন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সিলেকশান দেয়া হতো। যথারীতি ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা দেয়া হল। আমি সেই পরিক্ষায় অংশ নিলাম না। বিজ্ঞান পড়ার শখ আমার ক্লাশ এইটেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিসব সংকেত, যোজনী, ব্যাঙ্গের জীবনচক্র, বিদ্যুতকোষ ইত্যাদিসহ এসো নিজে করি করতে করতে।তাছাড়া আমি ছিলাম গ্রামের ছেলে যেখানে তখনো বিজ্ঞান পৌঁছেনি। বাবা-মা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না বলে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবার কোন ইচ্ছাই আমার ছিলনা।
স্যার যথারীতি খবর দিলেন। জানতে চাইলেন কেন আমি বিজ্ঞান পড়তে চাইনা। আমি স্যারকে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু স্যারের এক কথা- তুমি পারবে। আর আমার কথা ছিল- আমি পারব না। সেদিন স্যার আমার উপর রাগ করেছিলেন কিনা জানিনা।
দুয়েক মাস ক্লাশ হতে না হতেই একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এক্সিডেন্ট। স্যারের হাতে ফ্রেকচার। ফলে স্যারকে তিন/চার মাস রেস্টে যেতে হয়। ক্লাশ দেয়া হল অন্য একজন স্যারের উপর। ঐ চার মাস সময়ে আমার একদিন ক্লাসে যাওয়া হয়নি। এরকম তো হতেই পারে। চলছিল দিন কোনভাবে। স্যার সুস্থ হয়ে আবার ক্লাশে ফিরে আসলেন। আমাকেসহ অনেককে একেক করে ডাকলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার কি হয়েছিল। অমুক দিন স্কুলে আস নি? আমি তো অবাক। এতদিন পরে স্যার স্কুলে এসেই আমাদের সবার হাজিরা খাতা উল্টিয়ে স্যার আমাদের খবর নিচ্ছেন। একদিনের অনুপস্থিতি। তার জন্য ও জবাব দিতে হল। স্যার বললেন- আর কোন্ দিন স্কুল কামাই করবেনা। আমি জ্বী বলে সেদিন পার পেয়েছিলাম। তবে তারপর আর কোন দিন ক্লাশ নাইনে কখনো অনুপস্থিত থাকিনি। অন্য ক্লাশে ও মনে হয়না আমি এবসেন্ট ছিলাম।
প্রতি মাসে আমরা স্কুলের বেতন দিতাম। দেখতাম স্যার একেকদিন একেকজনকে ডাকতেন। কাউকে দশ পয়সা, কাউকে তিরিশ পয়সা ফেরত দিতেন। জরিমানার টাকা দেয়ার পর ভাংতি না থাকলে তা স্যার নোট রাখতেন আর যথাসময়ে তা ছাত্রদেরকে ফেরত দিতেন। আমার মনে হয় স্যারের কাছ থেকে কেউ এক আনা ও দাবী করতে পারবে না।
ক্লাশ নাইনেই আমার পড়ালেখার গতি বেড়ে যায়। বার্ষিক পরিক্ষায় রেজাল্ট চমক আসে। বেশ ভাল করেই দশম শ্রেনীতে গেলাম। যদিও আগের কোন রেজাল্ট এত ভাল হয়নি।
স্যারকে প্রায় দেখতাম আমার খবর নিতে। অন্য স্যারদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতেন। বলতেন—তারা যেন আমাকে একটু যত্ন করেন। করলে আমি নাকি ভাল রেজাল্ট করতে পারব। কয়েকজন স্যার অবশ্য আমার ব্যাপারে আস্থাশীল ছিলেন না। কিন্তু সালাউদ্দীন স্যার ছিলেন অত্যন্ত আশাবাদি। তাঁর আশা আমি পূর্ণ করেছিলাম। কুমিল্লা বোর্ডের মানবিক বিভাগ হতে ( সে সময় চট্টগ্রাম বোর্ড ছিলনা, কমার্স ও ছিলনা) মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিলাম। আমার মনে হয় স্যার আমার এই রেজাল্টে এত খুশী হয়েছিলেন যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়নি।
স্কুল ছেড়ে কলেজে চলে আসলাম। স্যারের শিক্ষা। নিয়মিত ক্লাশ করবে। তা ধরে রেখেছিলাম। কলেজে ও স্যারের মত কিছু অভিবাবকের মত স্যার পেয়েছিলাম। জাফর স্যার ( বর্তমানে চট্টগ্রাম কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল), নুর নবী স্যার ( বর্তমান অধ্যক্ষ, ককসবাজার মহিলা কলেজ), অধ্যক্ষ কাজী নুরুল হক স্যার, অধ্যক্ষ হোসাইন আহমদ স্যার, অধ্যক্ষ ফজলুল হক স্যার, মোসতফা স্যারদের ভালবাসা আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
কার অবদান ফেলে রাখি। সবাই তো আমাকে গড়তে সাহায্য করেছেন। কিন্তু আমার জীবনের টার্ণিং পয়েন্ট ছিল ক্লাশ নাইন। যেখানে আমি আমার শ্রদ্ধেয় সালাউদ্দীন স্যারের মত প্রিয় মানুষকে পেয়েছিলাম।
২০০৩ সালে আমি বিয়ে করি। যথারীতি আমার প্রিয় স্যারকে দাওয়াত দেই। তিনি গিয়ে হাজির। কিন্তু আমার পৌঁছুতে অনেক দেরী। স্যার অসুস্থ ছিলেন। তবুও অনেক্ষণ অপেক্ষা করে বাসায় চলে যান। দায়িত্ব দেন আমার কয়েকজন বন্ধুকে। যেন তারা আমাকে খবর পৌঁছায় যে, স্যার আমার বিয়েতে এসেছিলেন।
স্যার যতদিন স্কুলে ছিলেন, ময়লাযুক্ত কাপড়, লম্বা চুল, নখ রেখে কেউ স্কুলের আঙ্গিনায় প্রবেশ করেছে বলে আমার জানা নাই।
সালাউদ্দীন স্যারের মত একজন আদর্শ শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরে আমার পুরো জীবনটা ধন্য। স্যার তো আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর অসংখ্য ছাত্র আজো বিভিন্ন জায়গায় আছেন। তারা ও নিশ্চয় স্যারের যোগ্যতম ছাত্র।
স্যারের মত শিক্ষক হওয়া আমার স্বপ্ন। জানিনা, হতে পারব কিনা?
আজ শিক্ষক দিবসের এই দিনে স্যারকে অন্তুর থেকেই স্মরণ করি। স্যারের জন্য দোয়া করি। সকল সম্মানিত শিক্ষকদের জন্য দোয়া করি। সকলকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি।
বিষয়: বিবিধ
১৬০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন