কী হবে...!! আমাদের এতদিনের স্বপ্নের...???
লিখেছেন লিখেছেন মাহফুয রহমান ০৪ অক্টোবর, ২০১৩, ০২:১০:৫৮ রাত
গত সোমবার যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছিলো রাজধানী ঢাকা। জাতীয় দৈনিকগুলোতে এনিয়ে দীর্ঘ রিপোর্ট মুদ্রিত হয়। মালিবাগ থেকে রামপুরা হয়ে টঙ্গী পর্যন্ত রাস্তা অতিক্রম করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় অপেক্ষা করতে হয়েছে যাত্রীদের। গাবতলী থেকে নিউ মার্কেট আসতে সময় লেগেছে ৪ ঘণ্টারও বেশি। মৌচাক থেকে মহাখালী যেতে অপেক্ষার শেষ নেই। গাড়ি চলে না, চাকা ঘোরে না। অসহনীয় যানজটে চরম দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী। পরিস্থিতি সামাল দিতে হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে প্রায় সবক’টি ট্রাফিক সিগন্যাল। হিমশিম খেতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে। গভীর রাত পর্যন্ত রাজধানীজুড়ে লক্ষ্য করা গেছে অসহনীয় এ যানজট এমনিতে যানজট। ঢাকার জন্য কোনো নতুন খবর নয়। কিন্তু যানজটের মাত্রা এতটা অসহনীয় পর্যায়ে কেন পৌঁছেছিল, সে নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে। পত্র-পত্রিকার বিবরণে সে প্রশ্নেরও জবাব পাওয়া গেছে।
পুলিশ বলেছে, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে পলিটেকনিক্যাল শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছে। রাস্তা অবরোধ করে পরিবহন ভাঙচুর করেছে। এদিকে সন্ধ্যায় বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণসংবর্ধনা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানাতে সোমবার বিকাল থেকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন রাস্তায় অবস্থান নেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ফলে দুর্বিষহ যানজটে স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যে দুই কারণে রাজধানীতে অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হলো, তা কি অনিবার্য ছিল? সরকারের দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে সোমবার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা ১৫ দিনের জন্য তাদের আন্দোলন স্থগিত করেছে। ফলে পত্রিকায় শিরোনাম করা হয়েছে, ‘সকালে সহিংস বিকালে শান্ত। বিকালে পলিটেকনিক ছাত্রদের আন্দোলন যখন শান্ত হলো, তখন আবার দেখা দিল সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা জানানোর আয়োজনের নামে দুর্বিষহ যানজট সৃষ্টির আরেক মহাযজ্ঞ। জনগণকে এমন দুর্ভোগে ফেলার কর্মকান্ড উন্নত দেশগুলোতে কল্পনাও করা যায় না। কখনো আন্দোলন, কখনো সংবর্ধনা- এসব যেন লেগেই আছে। এসব কিছু অনেক সময় জনগণের কাছে অসহনীয় উপদ্রব বলেই মনে হয়। আন্দোলনে যেমন মাত্রাজ্ঞান থাকা প্রয়োজন, তেমনি সংবর্ধনার দৌরাত্ম্যে মাত্রাজ্ঞান আরো বেশি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দেশে মাত্রাজ্ঞান শেখানোর ব্যাপারে যারা উদাহরণ হতে পারতেন, তারাই যেন মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে সীমা লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন।
সোমবারের অসহনীয় যানজটের দুর্ভোগ না হয় জনগণ মেনেই নিল। কিন্তু প্রতিদিনের নিরাপত্তাহীনতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা জনগণ মেনে নেবে কেন? জনগণ তো ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করেছে নিরাপদে ও শান্তিতে বসবাসের আকাক্সক্ষায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সরকার বিরোধী দলকে নিষ্ঠুরভাবে দমন কতে বেশ উৎসাহী হলেও, জননিরাপত্তা বিধানে তেমন নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারছে না। পত্র-পত্রিকায় এনিয়ে বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট মুদ্রিত হলেও, তাতে পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতা, নৈরাজ্য ও খুনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আর নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কেমন হবে, সে ব্যাপারে সংলাপ ও সমঝোতা না হওয়ায় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া মাদক ব্যবসা, অবৈধ অস্ত্র, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, প্রেম ও পরকীয়াসহ নানা কারণে একের পর এক খুনের ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধীদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হচ্ছে, পারছে না জনগণকে নিরাপত্তা দিতে। ফলে দুর্বৃত্তরা একের পর এক খুনের ঘটনা সংঘটিত করার সাহস পাচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জামায়াত-শিবিরসহ বিরোধী দলের মোকাবিলা করতে গিয়ে রাজধানীসহ সারা দেশে পুলিশ সদস্যরা এখন খুবই কাহিল। এর পরেও প্রতিদিনই তাদের দৈনন্দিন ‘ক্রাইম ওয়ার্ক’ ছাড়াও রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারের শেষ সময়ের পুলিশী শিথিলতা। এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশজুড়ে এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পেশাদার অপরাধীরা। তারা শয়নকক্ষে পর্যন্ত ঢুকে গুলী করে লাশ ফেলে দিচ্ছে। পথে-ঘাটেও খুন করে পালাচ্ছে। এমন কি খুন হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরাও। কিন্তু অধিকাংশ ঘটনায়ই খুনিরা ধরা পড়ছে না। ফলে এসব ঘটনায় ঘরে-বাইরে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে যশোরের চৌগাছায় জিল্লুর রহমান মিন্টু নামে এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে গুলী করে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। এর রেশ না কাটতেই শনিবার দুপুরে ঢাকার মিরপুরে রূপনগরে নিজ বাসায় সন্ত্রাসীদের গুলীতে খুন হন জাফরুল হক নামে এক ব্যবসায়ী। গত শনিবার রাতে রাজধানীর মগবাজারে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ মাসুদ মুন্নাকে ছিনতাইকারী অপবাদ দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে ও গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এভাবে বিবরণ দিয়ে ফিরিস্তি বড় করা যেতে পারে। কিন্তু ফিরিস্তি বড় করা আমাদের লক্ষ্য নয়। তবে আমরা একথা জানি যে, জননিরাপত্তা বিধান এবং খুনি ও অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের দায়িত্ব। জননিরাপত্তা বিধান, সুশাসন ও জীবনমান উন্নয়নের জন্যই জনগণ ভোটের রায়ের মাধ্যমে সরকার গঠন করে থাকে। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে আমরা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করতে চাই না। বিষয়টি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র বিষয় নয়। বিষয়টি আসলে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও সরকারের দায়িত্বের বিষয়। আমাদের সরকার ও রাজনীতিবিদরা যখন গভীরতর উপলব্ধির মাধ্যমে নিজেদের দায়-দায়িত্বের কথা বিবেচনা করতে সক্ষম হবেন, তখনই হয়তো মানুষ খুঁজে পাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুফল।
মানুষ তো স্বপ্ন দেখে। মানুষ যেমন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে, তেমনি আবার স্বপ্ন দেখে জেগে থেকেও। জনমনে এখন আশঙ্কা, কি ঘটবে অক্টোবরে? দেশ কি সংঘাতের অন্ধকারে চলে যাবে, নাকি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার কোনো পথ রচিত হবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের ঘোষণা দিয়েছেন। বিরোধ দল কি চায়, সংসদে এসে তা পরিষ্কার করে বলতে বলেছেন। তবে সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করার নেই, সে বাধ্যবাধকতার কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের মর্মার্থ উপলব্ধি করা কোনো কঠিন বিষয় নয়। আর বিরোধী দল এমন বক্তব্যের কি ব্যাখ্যা করবে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া আবারও বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকার প্রধান থাকলে সে নির্বাচনে তার দল বিএনপি অংশ নেবে না। ‘এখনও সময় আছে, সরকারকে একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সংসদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনার তাগিদ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। উল্লেখ্য যে, সংবিধান অনুযায়ী ২৪ অক্টোবর শেষ হবে নবম জাতীয় সংসদের মেয়াদ। ২৫ অক্টোবর থেকেই অলআউট আন্দোলনে যাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট, এমন চরমপত্র আগেই দিয়ে রেখেছেন বেগম খালেদা জিয়া। তাহলে জনগণের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে কী? দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পথে দেশ বিপর্যয়ের দিকে যাক, তা চায় না দেশের জনগণ। যদি এমন হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাব মেনে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা নির্দলীয় সরকারের বিল আনার ব্যবস্থা করেন, তাহলে দেশে কেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে? এমন অবস্থায় তো রাজনৈতিক গুমোট পরিবেশ দূর হয়ে আলো ঝলমলে এক সকালের উদয় হতে পারে। জনগণের এমন স্বপ্ন দেখা কি ভুল? সামনের দিনগুলো আমাদের বলে দেবে, এটা কি ঘুমের স্বপ্ন, নাকি জাগরণের স্বপ্ন?
দেশের ভালমন্দ নিয়ে আমরা সবাই কথা বলতে চাই। আর কথা বলতে গিয়ে চলে আসে রাজনীতির প্রসঙ্গ। এ প্রসঙ্গে আমরা সরকার ও রাজনীতিবিদদের ধোলাই কর্মটা কম করি না। সরকার ও রাজনীতিবিদদের দোষ আছে, একথা আমরা জানি। কিন্তু আর সবাই কি দোষ থেকে মুক্ত? এ প্রসঙ্গে ‘শামুকের পিঠে সওয়ার ১২ প্রকল্প’ শিরোনামের খবরটি উল্লেখ করতে চাই। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ও সহযোগিতায় বাস্তবায়নাধীন ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে ১২টির কাজ চলছে শামুকের গতিতে। এসব কাজে গতি বাড়াতে পহেলা অক্টোবর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশস্থ কার্যালয়ে ত্রিপক্ষীয় এক বৈঠক হওয়ার কথা। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে থাকবে বিশ্বব্যাংক, ইআরডি ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের কর্মকর্তারা। এসব প্রকল্পের কাজে অগ্রগতি না হওয়ায় বিশ্বব্যাংক ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির উপর সরকারের গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক তাদের সাহায্যপুষ্ট যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হতাশা প্রকাশ করেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প। ১৪৯ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সাহায্যের এই প্রকল্পটি শুরু হয় ২০০৯ সালে। কিন্তু প্রায় ৩ বছর শেষ হতে চললেও অর্থ ছাড় হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। একই অবস্থা চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নেও। ২ বছরে অর্থ ছাড় হয়েছে মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ। এ প্রকল্পের এখনও প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শেষ হয়নি। প্রায় ১৭ কোটি ডলার ব্যয়ে পল্লী এলাকায় সৌরবিদ্যুৎ চালুর প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ১.৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। এমন চিত্রে জনগণ আশাবাদী হতে পারে না। আর লজ্জার ব্যাপার হলো, জনগুরুত্বপূর্ণ এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতির কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু আমাদের হলো কী? দোষ কি শুধু সরকার ও রাজনীতিবিদদেরই? এসব প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট গুণীজনদের কি আমরা নির্দোষ ভাববো? আসলে সময় এসেছে গভীর আত্মসমালোচনার। নিজ নিজ ক্ষেত্রে আমরা কে কতটা দায়িত্ব পালন করছি, সে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। এক্ষেত্রে সচেতন না হলে আমাদের দেশপ্রেম, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আমাদের সততা ও নিষ্ঠা সবই প্রশ্নের মুখে দাঁড়াবে। কথাগুলো শুনতে একটু তেঁতো মনে হতে পারে, কিন্তু সময়ের দায়িত্ব পালন না করলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো থেকে কেউই বাঁচতে পারে না। তিক্ত হলেও এ সত্যটি আজ আমাদেরই উপলব্ধি করতে হবে।
লেখকঃ
গবেষক ও শিক্ষানবীশ সাংবাদিক
বিষয়: বিবিধ
১১২৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন