অন্তরের কাঠিন্য !!!
লিখেছেন লিখেছেন Shopner Manush ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৭:৩৯:৫০ সকাল
রহমান রহীম আল্লাহ্ তায়ালার নামে
হালাল ও হারাম সম্পর্কিত একটি বিখ্যাত হাদীসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্তেরর গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন :
“আমাদের শরীরে এমন একটি মাংস পিণ্ড রয়েছে যা সুস্থ থাকলে সারা শরীর সুস্থ থাকে আর যা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেটি হচ্ছে হৃদয়।” [সম্পূর্ণ হাদীসটি হচ্ছে : আন-নু’মান বিন বাশীর কর্তৃক বর্ণিত : আমি আল্লাহ'র রাসূলকে বলতে শুনেছি, “হালাল ও হারাম উভয়েই স্পষ্ট, কিন্তু এ দুটির মাঝখানে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়সমূহ যা অধিকাংশ লোকই জানেনা। সুতরাং যে নিজেকে সন্দেহজনক বিষয় থেকে বাঁচিয়ে চলে, সে তার দ্বীন ও সম্মানের সংরক্ষণ করে।
আর যে সন্দেহজনক বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে, তার উদাহরণ হচ্ছে সেই রাখালের মত যে তার মেষপাল চরায় কোন সংরক্ষিত চারণভূমির কাছাকাছি এমন ভাবে যে, যে কোন মুহূর্তে সে তাতে প্রবেশ করবে। (হে লোকসকল!) সাবধান! প্রত্যেক বাদশাহরই একটি সংরক্ষিত সীমানা আছে এবং আল্লাহর সংরক্ষিত সীমানা হচ্ছে তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ। সাবধান! আমাদের শরীরে এমন একটি মাংস পিণ্ড রয়েছে যা সুস্থ (পরিশুদ্ধ) থাকলে সারা শরীর সুস্থ থাকে, কিন্তু যদি তা কলুষিত হয়ে যায় সারা শরীর কলুষিত হয় এবং সেটি হচ্ছে হৃদয়।”] (বুখারী. প্রথম খণ্ড. ৪৯ নং হাদীস)
কথাটি তিনি বলেছেন, প্রথমে একথা ব্যাখ্যা করার পর যে হালাল স্পষ্ট, হারামও স্পষ্ট এবং এদের মাঝখানের ক্ষেত্রটি অস্পষ্ট যা অনেকেই জানেনা। যাহোক, যা একজন মানুষকে হারাম থেকে বাঁচতে ও হালাল অবলম্বন করতে সাহায্য করে তা হচ্ছে জ্ঞান ; এবং জ্ঞান ছাড়া আর যা একাজটি করতে পারে, তা হচ্ছে অন্তেরর অবস্থা। যদি অন্তর পরিশুদ্ধ হয়, জ্ঞানকে ব্যবহার করে তা হারাম এড়িয়ে চলতে পারে। যদি তা কলুষিত হয়, জ্ঞান কোন উপকারে আসে না এবং মানুষ নিষিদ্ধ বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে।
বিদায় হজ্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাদের ও অনাগত মুসলিম জাতিসমূহের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, কোন অনারবের উপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই ; কালোর উপর সাদার কোন প্রাধান্য নেই, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে সেই শ্রেষ্ঠ যে আল্লাহকে ভয় করে – যে তাকওয়া অর্জন করেছে। এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তিনি বলেন, “তাকওয়ার অবস্থান হচ্ছে আমাদের অন্তের।” এটি এবং অনুরূপ আরো বক্তব্যে অন্তেরর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে – যাকে আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট অন্য সব অঙ্গের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।
ঈমানের অবস্থান এখানেই। শরীরের অন্য কোন অঙ্গ যদি আল্লাহর আরো কাছের হতো, তাকওয়া সেখানেই অবস্থান করতো, কারণ মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো ঈমান। এ ছাড়া আর কিছুরই মূল্য নেই। যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, যারা তাঁর বাণী গ্রহণ করেছে এবং যারা জান্নাতকে জাহান্নামের পরিবর্তে বেছে নিয়েছে – ঈমান তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ঈমান বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য। দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে ঈমানের মূল্য বেশী। সেজন্য আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কোন একজন মানুষকেও ইসলামের পথ দেখানো দুনিযার সব কিছুর চেয়ে উত্তম। কারো জন্য অন্য কাউকে ঈমান অর্জনে সাহায্য করা যে কোন পার্থিব বস্তুর চেয়ে মূল্যবান।
কাজের শুদ্ধতার বিচার করা হয় হৃদয়ের অবস্থা দিয়ে। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্ললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে :
“কর্মের বিচার করা হয় নিয়ত অনুসারে।” নিয়ত বা ইচ্ছার স্থান ঠোঁটে নয়, হৃদয়ে। [হাদীসটির পূর্ণ বক্তব্য : উমর বিন খাত্তাব বর্ণনা করেছেন : আল্লাহর রাসূল বলেছেন, “কর্মফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেকই তা পাবে যা সে চেয়েছে। অতএব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য হিজরত করেছে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যেই। আর যে কোন পার্থিব স্বার্থ অর্জন বা কোন মহিলাকে বিয়ের উদ্দেশ্যে হিজরত করেছে, তার হিজরত সে জন্যই যে জন্য সে হিজরত করেছে।”] (বুখারী, প্রথম খণ্ড, ৫১ নং হাদীস)
আমরা যে কাজই বাহ্যিকভাবে করি না কেন, আমাদের হৃদয়ের অবস্থা তখন কি ছিল, তা দিয়েই তার বিচার হবে। এগুলি হচ্ছে ভাল কাজ। মন্দ কাজ মন্দই, কিন্তু ভাল কাজ বলতে আমরা যা বুঝি তা সেসব কাজ যা ন্যায়পরায়ণতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ বিচার করবেন সত্যিই সেগুলি ন্যায় কাজ কিনা।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন যে প্রথম যে তিন ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুনে ফেলা হবে তারা মানুষের দৃষ্টিতে বড় বড় কল্যাণকর কাজে লিপ্ত ছিল। তারা হচ্ছে জ্ঞানের প্রচারে নিয়োজিত আলেম, ধনী ব্যক্তি যে তার সম্পদ থেকে দান করতো এবং আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে শাহাদাৎ বরণকারী। একটি সহীহ হাদীসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে তারা প্রথম জাহান্নামে নিক্ষিপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে। কারণ সেই আলেম আল্লাহর সন্তুটির জন্য জ্ঞান প্রচার করতো না, করতো মানুষের কাছে বড় একজন জ্ঞানী হিসাবে সম্মান ও প্রশংসা পাওয়ার জন্য। আলাহ তাকে বলবেন : “দুনিয়াতে তুমি যা চেয়েছিলে সেই প্রশংসা তুমি পেয়ে গেছো, আখিরাতে তোমার জন্য কিছু নেই।” তারপর তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। একইভাবে ধনী লোকটিও তার ধন-সম্পদ উদার হস্তে দান করতো যাতে লোকে তাকে মহান দাতা হিসাবে প্রশংসা করে। কিন্তু আল্লাহ বলবেন, “তুমি প্রশংসার জন্য দান করেছ এবং তা পেয়েছো। তুমি বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর জন্য তা করনি। যতক্ষণ লোকে প্রশংসা করেছে, তুমি বদান্যতা দেখিয়েছো, কিন্তু লোকে যখন তোমার প্রতি মনোযোগ দেয়নি, তুমিও দান করা বন্ধ করে দিয়েছ। তোমার বদান্যতা ছিল শর্তযুক্ত, আলাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়।” অতঃপর তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। আর যে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছিল, আল্লাহ তাকে বলবেন : “তুমি এজন্য যুদ্ধ করেছো যে লোকে তোমাকে বলবে কত বড় একজন শক্তিশালী ও বীর যোদ্ধা তুমি!” লোকে তার প্রশংসা করেছে, কিন্তু সে আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করেনি, সুতরাং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে।
এসব কিছুই আমাদের এই শিক্ষা দিচ্ছে যে যদি হৃদয় অসুস্থ হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, বড় বড় সৎকর্মও কোন কাজে আসবে না। সুতরাং হৃদয়ের প্রতি আমাদের গভীর মনোযোগ দেওয়া উচিত। নিজেদের হৃদয়ের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাদের প্রচুর সময় দিতে হবে। যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর সিদ্দীকের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে মানুষকে বলছিলেন, তিনি বলেছিলেন;
“সে তোমাদের চেয়ে বেশী সালাত আদায় করে না বা রোযা রাখেনা, তোমাদের অনেকেই তার চেয়ে বেশী সালাত আদায় কর ও রোযা রাখ, কিন্তু তার হৃদয়ে এমন কিছু আছে যা গভীরভাবে প্রোথিত … তা হচ্ছে তার হৃদয়ে অবস্থিত ঈমান।”
এখানেই ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। অতএব একজন মুমিনের কাছে মানব শরীরে ও অস্তিত্বে আর কোন যোগ্যতা থাকতে পারে না যে সম্পর্কে সে আরো অধিক সচেতন হবে। আল্লাহ যেভাবে চান সেভাবে এই দক্ষতা/যোগ্যতা ক্রিয়াশীল করার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। এ সম্পর্কে আমাদের খুব বেশী সচেতন হতে হবে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই দুআ শুরু করতেন এভাবে :
“হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই এমন জ্ঞান থেকে যা উপকারী নয় এবং এমন হৃদয় থেকে যা ভীত নয়।”
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। তিনি মানুষের সাথে খুবই নম্র ব্যবহার করতেন। তাঁর স্ত্রীরা বলেছেন যে তাঁরা এমন কোন ঘটনার কথা মনে করতে পারেন না যেখানে তিনি তাঁদের সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলেছেন বা তাঁদের আঘাত করেছেন। তিনি তাঁর নম্রতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। এবং আল্লাহ এই গুণটিকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেছেন। সূরা আলে-ইমরানে আল্লা বলেছেন :
“আল্লাহর দয়ার কারণেই তুমি তাদের সাথে নম্র। যদি তুমি রূঢ় ও কঠিন-হৃদয় হতে, তাহলে তারা তোমার কাছে থেকে দূরে সরে যেতো।” (সূরা আলে-ইমরান, ৩ : ১৫৯)
নবীদের বৈশিষ্ট্য ছিল এটাই এবং এই বৈশিষ্ট্য তাদেরও অবশ্যই অর্জন করতে হবে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ দেখায়। যেহেতু নবীদের জন্য এই গুণটি আবশ্যকীয়, এটি আমাদের জন্যও আবশ্যকীয়। যারা জ্ঞানের সন্ধানী তাদের জন্য এটি দরকারী, সব মানুষের জন্যই এটি দরকারী। আর পিতামাতার জন্যও ছেলেমেয়েদের প্রতি কোমল-হৃদয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।
হৃদয়ের কোমলতা এমন একটি বিষয় যাতে আমরা প্রচুর সময় দিলেও যথেষ্ট হবে না। একবার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল-আকরা বিন হারিস এর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার একটি বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে আদর করে চুমা দিলেন। আল-আকরা বলল : “আমার আরও দশটি ছেলেমেয়ে আছে, কিন্তু আমি কখনো তাদের কাউকে চুমা দেইনি।” এটি ছিল একটি গর্বের বিষয়, পৌরুষ – যা কোমল নয়, কঠোর। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, “আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া সরিয়ে নিয়ে থাকেন, তাহলে আমার কি করার আছে!” তিনি আরো বললেন, “যে অন্যকে দয়া করে না সে দয়া পাবে না।”সুতরাং বাচ্চাদের প্রতি কোমল আচরণ করা পিতামাতার জন্য জরুরী। যে ঘরে বাবা ছেলেমেয়েদের প্রতি দয়ালু ও ক্ষমাশীল, সে ঘর সুখ ও আনন্দে ভরা থাকে।
দয়া এমন কিছু যা ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। যারা জ্ঞানের সন্ধানী, যেহেতু দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক, জ্ঞানের সাথে যদি সে কোমল হৃদয়ের অধিকারী না হয়, তবে জ্ঞানের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা সম্ভব হয় না। যেমন হাসান আল-বসরী বলেছেন, “যদি কেউ জ্ঞান অনুসন্ধান করে, তা তার চেহারা, হাত ও জিহবায় এবং আল্লাহর প্রতি তার বিনয়ে প্রকাশ পাবে।” এর বিপরীত কথাটিও সত্য যে কোন কিছুই জ্ঞানকে এবং দ্বীনের প্রতি আহ্বানের কাজকে ততটা নষ্ট করে না যতটা করে হৃদয়ের কাঠিন্য। যেখানে হৃদয় কঠিন হয়ে যায়, সেখানে জ্ঞান ব্যক্তির নিজেরও কোন উপকারে লাগে না বা সে তা দিয়ে অন্যেরও উপকার করতে পারে না।
হৃদয়ের কোমলতা সত্যিকার মুসলিমের বৈশিষ্ট্য। এর অনুপস্থিতিতে জীবন দুর্ভোগ ও অস্বচ্ছান্দ্যে ভরে যায়। এটা আল্লাহর ওয়াদা। যাদের হৃদয় কোমল নয় তারা দুর্ভোগময় জীবন যাপন করবে। যেমন সূরা আয-যুমারে আল্লাহ বলেছেন :
“যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তাদের জন্য দুর্ভোগ।” (সূরা আয-যুমার, ৩৯ : ২২)
তারা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে। তাদের জন্য দুর্ভোগ যারা কুরআন শ্রবণ করে কিন্তু তারপরও তারা ভীত ও বিনীত হয় না। দুর্ভোগ তাদের জন্য যাদের চোখকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও আল্লাহর ভয়ে তা ক্রন্দন করে না। দুর্ভোগ তাদের জন্য যাদের কাছে আল্লাহর সতর্কবাণী পৌঁছানোর পরও তারা তাঁর বাণীর প্রতি শ্রদ্ধাবনতও হয় না। কঠিন-হৃদয় বিশিষ্ট হওয়া একটি অভিশাপ আর হৃদয়ের নম্রতা সৌভাগ্যের কারণ। জীবনের সমস্ত কাম্য বস্তুর অধিকারী হলেও কঠিন হৃদয়-সম্পন্ন ব্যক্তি কষ্ট ভোগ করে। আপাত দৃষ্টিতে সুখময় মনে হলেও তা এক শূন্য জীবন — একাকীত্বে পূর্ণ। তারা মনে এবং অন্তের শান্তি পায় না, কারণ তাদের অন্তর আল্লাহর প্রতি কঠিন – আল্লাহকে বিশ্বাসের ব্যাপারে ও তার আনুগত্যের ব্যাপারে। সেজন্যই আল্লাহ বলেছেন, যে তাঁর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে দুদর্শাগ্রস্ত জীবন যাপন করবে।
“… যে আমার বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য রয়েছে সংকীর্ণ জীবন, আর বিচার দিবসে আমরা তাকে উত্থিত করবো অন্ধ করে।” (সূরা তা-হা, ২০ : ১২৪)
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেনম একমাত্র আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় শান্ত হয়।
“যারা বিশ্বাস করে, এবং যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে তৃপ্তি লাভ করে : নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণেই হৃদয়সমূহ শান্তি লাভ করে।”(সূরা রা’দ, ১৩ : ২৮)
এ জীবনে সবচেয়ে উপকারী বস্তু হচ্ছে একটি কোমল হৃদয়। আমরা হৃদয়ের কোমলতা অর্জনে চেষ্টা করবো। কারণ এছাড়া সবকিছুই অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। কিভাবে আমরা তা অর্জন করতে পারি ?
এ জীবনে সবচেয়ে উপকারী বস্তু হচ্ছে একটি কোমল হৃদয়। আমরা হৃদয়ের কোমলতা অর্জনে চেষ্টা করবো। কারণ এছাড়া সবকিছুই অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। কিভাবে আমরা তা অর্জন করতে পারি ?এটা কোন গোপন বিষয় নয়। এমন কিছু নয় যা অল্প কিছু মানুষ জানে এবং বিশেষ অধিবেশনে এবং জমায়েতে শুধু তা জানানো হয়। যেমন নবী মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “আমি তোমাদের রেখে যাচ্ছি পরিষ্কার সাদা সমতলে, যার দিন তার রাত্রির মতই। যে কেউ তা থেকে বিচ্যুত হবে, সে ধ্বংস হয়ে যাবে।” তাঁর পথ আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় কিভাবে আমরা হৃদয়ের কোমলতা অর্জন করব।
প্রথম পদ্ধতি – দুআ
প্রথম উপায় হচ্ছে দুআ করা।হৃদয়কে কোমল করে দেওয়ার জন্য ও তা দয়ায় পূর্ণ করে দেওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে চাওয়ার মতো কার্যকরী আর কিছু নেই। এটাই তাঁর ওয়াদা যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন যে, “আল্লাহ কে ডাক নিশ্চিত হয়ে যে তিনি তোমার ডাক শুনবেন, কিন্তু একই সাথে জেনে রাখো যে আল্লাহ উদাসীন অন্তেরর দুআ কবুল করেন না।” কিন্তু তাতে আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে। যদি আমরা শুধু হাত তুলে বলি, “হে আল্লাহ, আমার হৃদয় কোমল করো!” এবং অন্তর থেকে না চাই, তাহলে এটা মৌখিক চাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়! বিশুদ্ধ চিত্তে আল্লাহর কাছে চাইতে হবে, তিনি অন্তরকে কোমল করে দেবেন, “আমাকে ডাক এবং আমি তোমাদের ডাক শুনি।” কুরআনের ভাষায়:
“আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আমি নিঃসন্দেহে তাদের কাছেই আছি : আমি প্রত্যেক আহ্বানকারীর আহ্বানে সাড়া দেই যখন সে আমাকে ডাকে ; তারাও যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমাকে বিশ্বাস করে ; যাতে তারা সঠিক পথের অনুসারী হয়।” (সূরা আল বাক্বারাহ, ২ : ১৮৬)
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবাদের জীবনে আমরা যে বহু ঘটনার উদাহরণ পাই, তা একথাই প্রমাণ করে যে শুধু আল্লাহই অন্তেরর পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। আমরা উমর বিন খাত্তাবের (রা) ঘটনাটি চিন্তা করি।
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ইসলামের প্রতি তাঁর মনোভাব এত কঠোর ছিল যে একদিন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার জন্য বের হন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর প্রচেষ্টা ও ইসলামের প্রসারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে তিনি নিজেই ব্যাপারটার একটা নিষ্পত্তি করে ফেলতে চাইলেন। খোলা তলোয়ার হাতে বেরিয়ে গেলেন। পথে একজনের সাথে দেখা হলো, যিনি প্রথমে তাঁকে তাঁর বোনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে বললেন। বিস্মিত হয়ে তিনি বোনের বাড়িতে গেলেন, দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে বোনকে ও বোনের স্বামীকে প্রহার করে রক্তাক্ত করলেন। তারপর তিনি থামলেন ও দেখলেন তিনি কি করেছেন। ঘরে প্রবেশের পূর্বে তিনি কুরআনের কিছু অংশ শুনেছিলেন এবং তা তাঁর মনকে স্পর্শ করেছিল, কিন্তু তাঁর ক্রোধ সেই ভাবকে অন্তের স্থায়ী হতে দেয়নি। যখন তিনি বোনকে আঘাত করলেন এবং রক্ত প্রবাহিত হল, তাঁর চেতনা ফিরে এল। যা তিনি পূর্বে শুনেছিলেন তা তাঁর অন্তরকে নাড়া দিল। তিনি সেটা আবার শুনতে চাইলেন এবং কুরআনের কিছু অংশ তাঁকে পড়ে শোনানো হলো। তিনি বদলে গেলেন। তাঁর আমূল পরিবর্তনের জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল। ইনিই উমর। আরেকবার, অন্য কোন সময়ে সাহাবারা তাঁকে দেখলেন তিনি বারবার হাসছেন, তারপর কাঁদছেন। তাঁরা তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন : “আমার মনে পড়েছিল জাহেলী যুগে আমার একটি দেবতা ছিল খেজুরের তৈরি। একদিন আমি এত ক্ষুধার্ত হলাম যে তার একটি টুকরা খেয়ে ফেললাম। তারপর আমি কাঁদছিলাম আমার কন্যার কথা মনে করে যাকে আমি জ্যান্ত কবর দিয়েছিলাম। যখন আমি তাকে গর্তে নামিয়ে দিচ্ছিলাম, সে আমার দাড়িতে লেগে থাকা ধূলা ঝেড়ে দিচ্ছিল।” এবং তিনি তাকে জ্যান্ত কবর দিয়েছিলেন। এটাই ছিল তখনকার রীতি—যারা কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়াকে অসম্মানজনক মনে করে তাকে হত্যা করতো। তাঁর হৃদয় তখন কত কঠিন ছিল—কত কঠিন সেটা হতে পেরেছিল কন্যাটিকে জীবন্ত পুঁতে ফেলার সময়। কিন্তু তাঁর হৃদয় পরিবর্তিত হয়েছিল। এতখানি যে উমর যখন সালাতে ইমামতি করতেন, কান্নায় তাঁর কন্ঠ এমনভাবে আটকে যেত যে এমনকি তৃতীয় সারি থেকেও লোকে তাঁর কান্নার আওয়াজ শুনত। ইনিই ছিলেন উমর, এমন একজন যিনি এত কঠোর, এত শক্তিশালী, এত সাহসী ব্যক্তি… কিন্তু ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে তাঁর হৃদয় পরিবর্তিত হয়ে গেল। তাই আমাদের উচিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর উপদেশ মত আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া, তাঁর কাছে কোমল হৃদয় চেয়ে দুআ করা এবং নির্ভীক হৃদয় থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া। এই একই দুআয় তিনি আল্লাহর কাছে এমন চোখ থেকে আশ্রয় চাইতেন যা অশ্রুসিক্ত হয় না, যা কখনো কাঁদে না।
দ্বিতীয় পদ্ধতি – মৃত্যুকে স্মরণ করা
দ্বিতীয় পথ হচ্ছে আখিরাতকে স্মরণ করা, মৃত্যুকে স্মরণ করা। এটিই একমাত্র বিষয় যে সম্পর্কে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত যে আমরা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করব, যদিও বা আমাদের আল্লাহর অস্তিতে সন্দেহ থাকতে পারে, এমনকি আমাদের নিজেদের অনুসৃত পথ অন্যান্য বহু মত ও বহু পথের ভিতরে সঠিক কিনা তা নিয়েও আমাদের সংশয় থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের জীবনটা এমন যে আমরা এতে জড়িয়ে পড়ে মৃত্যুর কথা ভুলে যাই। যেমন আল্লাহ বলেছেন, সম্পদ জমা করার আগ্রহ তাদেরকে জীবনের বাস্তবতা তা থেকে এমনভাবে প্রতারিত করে রেখেছে যে কবরে যাওয়ার সময়ই কেবল তাদের চৈতন্যোদয় হয়।
“প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে এমনকি তোমরা কবরে পৌঁছে যাও। কিন্তু না, তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে বাস্তবতা)…” (সূরা আত-তাকাসুর, ১০২:১-৩)
এটি একটি ভীতিজনক বক্তব্য যে, আমরা মৃত্যু সম্পর্কে অসচেতন থেকে জীবনযাপন করে যাব এবং গতানুগতিক ব্যাপার নিয়ে মেতে থাকব, যা পরবর্তী জীবনে আমাদের কোন কাজেই আসবে না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
“ইসলামের প্রথম যুগে আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছি। কিন্তু এখন আমি তোমাদের কবর জিয়ারতের নির্দেশ দিচ্ছি কারণ তা তোমাদের আখিরাতের কথা মনে করিয়ে দেবে।” [“আমি একসময় তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, (এবং এখন আমি বলছি) তোমাদের তা কর, যাতে জিয়ারত মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উপকার করতে পারে।” (মুসলিম ও অন্যান্য)]
[আল হাকিমের এর ভাষ্য : “... কারণ (এরকম জিয়ারত) হৃদয়কে নরম করে, চোখে অশ্রু প্রবাহিত করে এবং আখিরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়, (কিন্তু সতর্ক থাক) যাতে নিষিদ্ধ কথা না বলা হয় (অর্থাৎ জিয়ারতের সময়)” (সহীহ আল জামি, ৫৪৮৪)] কবরস্থানে গিয়ে কবরবাসীদের অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করা উচিত (সেই কবরবাসীরা যেই হোক না কেন)। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : “কারো কবর জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্যে একটি বাগান হবে অথবা জাহান্নামের আগুন ভরা গর্তের একটি হবে।” কবরে এমন মানুষ আছে যারা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে, কিন্তু সাহায্য করার কেউ নেই। যখন মুনকার ও নকীর এসে তাদের প্রশ্ন করে, “তোমাদের রব কে? তোমাদের দ্বীন কি? সেই নবী কে যাঁকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল?” তারা কোন উত্তর দিতে পারে না! [সহীহ আল বুখারী, দ্বিতীয় খণ্ড, ত্রয়োবিংশ পুসক্ত , ৪২২ নং হাদীস : আনাস কর্তৃক বর্ণিত : নবী বলেছেন, “যখন কোন মানুষকে কবরে শোয়ানোর পর তার সঙ্গীরা চলে যায় এবং তাদের পদধ্বনি শোনা যেতে থাকে, দুজন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করে : ‘মুহাম্মাদ সম্পর্কে তুমি কি বলতে?’ সে বলবে ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।’ তখন তাকে বলা হবে, ‘জাহান্নামে তোমার জন্য তৈরি ঘরটি দেখ, এর পরিবর্তে আল্লাহ তোমাকে জান্নাতে একটি ঘর দিয়েছেন।’” নবী আরো বললেন, মৃত ব্যক্তি তার দুটো বাসস্থানই দেখতে পাবে। কিন্তু একজন অবিশ্বাসী বা মুনাফিক ফেরেশতাদের বলবে, ‘আমি জানি না, কিন্তু লোকে যা বলতো আমিও তাই বলতাম!’ তাকে বলা হবে, ‘তুমি জানতে না এবং তুমি হিদায়াত গ্রহণও করোনি (কুরআন পাঠের মাধ্যমে)।’ তারপর তাকে একটি লোহার হাতুড়ি দিয়ে দুই কানের মর্ধবর্তী স্থানে আঘাত করা হবে, এবং সে চিৎকার করবে, তার সেই চিৎকার মানুষ ও জ্বিন ছাড়া আর সবাই শুনতে পাবে।]
এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা আছে কি নেই তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ বিষয়টি সেটা নয়। পরবর্তী জীবনে লাঞ্ছনার অংশ হিসাবে আমরা প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হব। আমরা জানি যে উত্তরটি হচ্ছে পরবর্তী জীবনের চাবি, কিন্তু চাবিটি আমরা ব্যবহার করতে জানি না। এ জীবনে আমাদের অন্তরে তা গ্রহণ করিনি, তাই পরবর্তী জীবনে আমাদের প্রবেশাধিকার নেই। যদি আমাদের হৃদয়ে এই বোধ এ জীবনে না আসে যে আল্লাহ আমাদের রব, মুহাম্মাদ আমাদের নবী এবং ইসলাম আমাদের দ্বীন, তাহলে এই জ্ঞান আখিরাতে আমাদের কাজে লাগবে না।তাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সকলকে এরই ভিত্তিতে কবর জিয়ারত করতে বলা হয়েছে, কারণ এর উপকারিতা শুধু পুরুষদের জন্য নয়, নারীদের জন্যও আছে। তবে নারীদের প্রকৃতির আবেগ প্রবণতার জন্য কিছু সংখ্যক আলেম বার বার জিয়ারত করতে নিষেধ করেছেন। যদিও তাদের কবর জিয়ারত করা নিষিদ্ধ নয়। তাই নিয়মিত না হলেও তাদেরও পুরুষের মতই মৃত্যুকে স্মরণের জন্য অনিয়মিত জিয়ারত করার প্রয়োজন রয়েছে। আখিরাতের স্মরণ যাদের উপর প্রভাব ফেলে আল্লাহ কুরআনে তাদের কথা বলেছেন। রাতেই এর প্রকাশ ঘটে।
“…তারা রাত্রিতে সামান্যই ঘুমাতো, রাতের শেষ প্রহরে তাদেরকে পাওয়া যেত ক্ষমা প্রার্থনারত অবস্থায়।” (সূরা আয যারিয়াত, ৫১:১৫-১৮)
পরবর্তী জীবন, কবরের পরীক্ষা এবং আসন্ন বিচারের চিন্তায় রাতে তারা জেগে ওঠে। তারা সেসময়ে তাদের বিছানা ত্যাগ করে যখন ঘুম সবচেয়ে মধুর ও গাঢ় হয়। ভাই ও বোনেরা, আসুন আমরা পরবর্তী জীবন নিয়ে চিন্তা করি। মৃত্যুর পর কি হয় তা নিয়ে চিন্তা করি ; মৃত্যুর সময়ে কি হয় তা নিয়ে-কিভাবে মু’মিনের দেহ থেকে রুহ নিয়ে যাওয়া হয়, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “পাত্রের নল দিয়ে পানির ফোঁটা যেভাবে করে পড়ে” ; কিন্তু অবিশ্বাসীদের জন্য, “কাঁটার উপর দিয়ে রেশমী কাপড় টেনে নিয়ে যাওয়ার মত”-ছিন্নভিন্ন করে। আল্লাহর ভয়ে ভীত রুহকে আসমানের উপরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানকার ফেরেশতারা তার প্রশংসা করে। পরে তাকে তার দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং জান্নাতের বাগানের একটি দরজা তার দিকে খুলে দেওয়া হয় পুনরুত্থান পর্যন্ত। কিন্তু যাদের অন্তত আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠিন, তাদের আত্মা আসমানে আরোহণের সময় বাধাগ্রস্থ হবে। তার দেহে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হবে। তাদের মন্দ কাজ কুৎসিত জীবের আকারে তাদের সামনে উপস্থিত হবে এবং তারা যন্ত্রণা ভোগ করবে। জাহান্নামের একটি জানালা তাদের দিকে খুলে দেওয়া হবে এবং পুনরুত্থান পর্যন-তারা সেই উত্তাপে দগ্ধ হবে। এবং পুনরুত্থান দিবসে কি ঘটবে যখন আমরা আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হয়ে আমাদের কৃত প্রতিটি কাজের জবাবদিহি করবো, যখন কিছুই আল্লাহর দৃষ্টি এড়াতে পারবে না, যখন জীবনের কোন কিছুই আমাদের কোন কাজে আসবে না? আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর সময় কেবল একটি জিনিসই আমাদের কাজে লাগবে, একটি সুস্থ হৃদয়।
তৃতীয় পদ্ধতিঃ কুরআন পাঠ
তৃতীয় যে উপায়ে আমরা আমাদের হৃদয়কে নরম করতে পারি, তা হচ্ছে কুরআন পাঠ আল্লাহ কুরআনে বলছেন :
“যারা মু’মিন, তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? তারা তাদের মতো যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তঃকরণ কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।” (সূরা হাদীদ, ৫৭ : ১৬)
যদি আমরা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করি, তা আমাদের হৃদয়কে বিগলিত করার ক্ষমতা রাখে। আলল্লাহ সেই জ্বিনের সম্পর্কে বলেছেন, যে কুরআন শুনেছিল,
“নিশ্চয়ই আমরা শুনেছি এক অত্যাশ্চর্য কুরআন ; তা আমাদের আল্লাহর দিকে পথ নির্দেশ করে এবং আমরা তাতে বিশ্বাস করি এবং আমরা আল্লাহর সাথে কোন শরীক করব না।” (সূরা আল-আহকাফ, ৪৬ : ২৯-৩২)
আল্লাহ সৎকর্মশীলদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন : “যদি তারা (খৃস্টানদের মধ্য থেকে) শোনে যা নাযিল হয়েছে রাসূলের উপর, তুমি দেখবে তাদের চক্ষু অশ্রুপূর্ণ তারা যা সত্য বলে জানে তা আনয়নের জন্য।” ইথিওপিয়ার শাসকের অবস্থা ছিল তাই। যখন মুসলিমরা সেখানে আশ্রয় চেয়েছিল এবং কুরআনের এক অংশ পাঠ করে শুনিয়েছিল, তারা দেখেছিল তাঁর চোখ অশ্রুতে পরিপূর্ণ। আমাদের এমনই হওয়া উচিত। কুরআন শোনার সময় আমাদের এর অর্থের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত। কুরআন যেন আমাদের কাছে পপ গান শোনার বিকল্প না হয়। মানুষ কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হয়ে প্রিয় তেলাওয়াতকারীর রেকর্ড কেনে। কুরআন শোনাটা যেন সঙ্গীত শোনার সমতুল্য হয়ে গেছে। আমরা এতে এতই মুগ্ধ যে যখন ক্বারী তেলাওয়াত করেন, পিছনের লোকজনকে বলতে শোনা যায় “আল্লাহ! আল্লাহ!” পপ শোতে যেমন হয়, মানুষ পিছনে নানা ধরনের কথাবার্তা বলতে থাকে। এটা কুরআন নয়…। আল্লাহ আমাদের বলেছেন,“তারা কি এর অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে না?” কুরআন একটি পথ নির্দেশিকা এবং এর অর্থ অনুধাবন করেই আমরা এ থেকে উপকার পেতে পারি, এজন্য কুরআনকে আমরা কিভাবে ব্যবহার করি তা পুনরালোচনা করা উচিত। রমযানে পড়ার জন্য রেখে না দিয়ে নিয়মিত আমাদের কুরআন পাঠ করা উচিত। আমরা যেন গভীরভাবে চিন্তা করি… রমযানে সম্পূর্ণ কুরআন পড়ে শেষ করবার জন্য না পড়ি। রমযানে কুরআন খতম হলো কি না হলো তাতে কিছু যায় আসে না। বেশীর ভাগ রমযানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন খতম করেন নি। অধিকাংশ সাহাবারাও করেন নি। বর্তমানে, কুরআন খতম ছাড়া আমাদের রমযান সম্পূর্ণ হয় না। আমরা হাফিজ ভাড়া করে আনি ৯৯ মাইল বেগে কুরআন তিলাওয়াতের জন্য, একজন আরবী ভাষী লোকের বুঝতে কষ্ট হয় যে কুরআনের কোন্ জায়গা হাফিজ পাঠ করছেন! এটাই নজীর হয়ে দাঁড়িয়েছে-রমযানে কুরআন খতম করা, পারলে দুবার! কিন্তু কুরআন এজন্য নয়। কুরআন চিন্তা-ভাবনা করার জন্য, যাতে যখন আমরা কুরআন শুনি তখন আল্লাহ যেমন বর্ণনা করেছেন তেমনি, মুমিনদের মত, তিলাওয়াত শুনে আমাদের শরীর যেন শিউরে উঠে। যা তাদের মন ছুঁয়ে যায় এবং হৃদয়ে কম্পন সৃষ্টি করে। (আযযুমার ৩৯ : ২৩)
যখন আমরা কুরআন শুনব, তখন তার প্রতিক্রিয়ায় আমাদের চোখে পানি না এলেও আমরা কান্নার চেষ্টা করবো। কারণ এভাবে কুরআনের ডাকে সাড়া দেওয়া উচিত। যদি আমরা তা না করি, আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হব! এটা আল্লাহর কথা, যা আদম থেকে বর্তমান পর্যন্ত সমস্থ অবতীর্ণ গ্রন্থ মূহের মধ্যে একমাত্র সংরক্ষিত বাণী! এটা আল্লাহর সংরক্ষিত বাণী! কুরআন পাঠের সময় আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে যে আল্লাহ আমাদের সাথে কথা বলছেন, কারণ তা তাই। আল্লাহই সরাসরি আমাদের সাথে কথা বলছেন।
যখন তিনি ইহুদীদের সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেন, আমরা সেটাকে শুধুমাত্র একটি তথ্য হিসাবে গ্রহণ করবো না যে ইহুদীরা এমন বা তারা তেমন ছিল। না! যখন আল্লাহ তাদের সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেন, সেটা আমরা একটা সতর্কবাণী হিসাবে নেব-যাতে আমরা তাদের মতো না হয়ে যাই। আল্লাহ সূরা ফাতিহায় বলেছেন, “… গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়া লা দ্বাল্লিন…”, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাখ্যা করেছেন যে আল-মাগদুবি আলাইহিম হচ্ছে ইহুদিরা এবং আদ-দ্বাল্লিন হচ্ছে খৃষ্টানরা। যাদের উপর আল্লাহ ক্রুদ্ধ তারা ইহুদী এবং যারা পথভ্রষ্ট, তারা খৃষ্টান। ইহুদিদের উপর আল্লাহ এ কারণে ক্রুদ্ধ যে তারা সত্যকে জানে কিন্তু মেনে চলে না। “তোমরা মানুষকে সৎকর্মের প্রতি আহ্বান জানাও কিন্তু নিজেরা তা করতে ভুলে যাও।” তারা কিতাবের পরিবর্তন করেছিল। খৃষ্টানদের সঠিক জ্ঞান ছিল না, তারা ছিল বিভ্রান-। তারা মনে করে আল্লাহ একজন মানুষ! এটা আমাদের জন্য সাবধানবাণী। যখনই আমরা এই আয়াতগুলি পাঠ করি, আল্লাহ আমাদের সতর্ক করে দেন যেন আমরা তাদের মত না হই-আমাদের কাছে সত্য আছে, কিতাব আছে, কিন্তু আমরা তা অনুসরণ করি না। আমরা যদি জ্ঞান অনুসন্ধান না করি, জানতে চেষ্টা না করি আল্লাহ আমাদের কাছে কি চান, তাহলে আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাব। যখনই আমরা পড়ি “… গাইরিল মাগদুবি আলাইহিল ওয়া লা দ্বাল্লিন..” এটা যেন আমাদের স্পর্শ করে। আমরা যেন চিন্তা ভাবনা করি এ নিয়ে। সারা কুরআনে ছড়িয়ে থাকা বহু আয়াত আমাদের আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, বিচার দিনের লক্ষণগুলি মনে করিয়ে দেয়। কুরআনের যে কোন অংশ খুলে পড়লেই আমরা তা জানতে পারব। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়েই আল্লাহ পরবর্তী জীবনের কথা বলেছেন। যা অন্তরের নম্রতা অর্জনের দ্বিতীয় উপায়ের সাথে সম্পর্কিত-কবর জিয়ারত করা এবং আখিরাতকে স্মরণ করা। কুরআন তা নিয়ে চিন্তা করতে বলে।
চতুর্থ পদ্ধতিঃ সৎকর্ম
হৃদয় নরম করার চতুর্থ পথ হলো সৎকর্মের মাধ্যমে। আল্লাহর জন্য বিশ্বস্তভাবে যে সৎকর্ম করা হয়, তা হৃদয়কে বিনীত করে। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা হয়তো তা বুঝতে পারবো না, কিন্তু আমাদের আস্থার সাথে লেগে থাকতে হবে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ কর্তৃক অবশ্যকরণীয় কাজগুলো সম্পাদনের মাধ্যমে বান্দা তাঁর যতটা নিকটবর্তী হয়, ততটা আর কোন কিছুতে হয় না। সেগুলো হচ্ছে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রোযা ইত্যাদি। প্রার্থনার সময় প্রায়ই আমাদের মনে হয়, “কি লাভ হচ্ছে? পরিবর্তন কোথায় হচ্ছে?” আমাদের বুঝতে হবে যে লেগে থাকতে পারলে উপকার পাওয়া যাবে। তাৎক্ষণিক ফলাফল হয়তো পাওয়া যাবে না। এটা একটা ধারাবাহিক ব্যাপার, অনেকটা একজন মানুষের বেড়ে ওঠার মতো। বাচ্চারা চিন্তা করে কখন তারা বড় হবে এবং দেওয়ালে দাগ দিয়ে রাখে এই আশায় যে একদিন ততটুকু লম্বা হবে। তারা নিজেদের বেড়ে ওঠাকে বুঝতে পারে না, কারণ সেটা ঘটছে তাদের শরীরের অভ্যন্তরে।
সৎকর্মের ব্যপারেও একই কথা… এবং প্রথম সৎকর্ম হচ্ছে যা আল্লাহ আদেশ করেছেন। প্রাথমিক অবশ্যকরণীয় কাজগুলি ত্যাগ করে অন্য কাজে আমাদের লিপ্ত হওয়া যা আল্লাহ আমাদের করতে বলেননি, একটি ভুল পদক্ষেপ। আমরা যদি প্রতিদিন যথাসময়ে পাঁচবার সালাত প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হই, তাহলে আমরা আর যা কিছুই করি না কেন তাতে কিছু যায় আসে না। সেটা অর্থহীন। এটা ভিত্তি-যদি আমরা আল্লাহ যা করতে বলেছেন, যা আমাদের কাছে দাবী করছেন তা করতে না পারি, তবে কিভাবে অন্য কিছু করে আমরা তাঁকে খুশি করতে পারি? অর্থাৎ তখন আল্লাহকে আমরা নিজের মত করে খুশি করতে চাই-যা আমাদের খুশি করে তাই আল্লাহকে খুশি করবে। এটা আল্লাহকে খুশি করা নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “জাহান্নামের আগুনকে আমাদের পছন্দনীয় বস্তু দ্বারা পরিবেষ্টন করা হয়েছে এবং জান্নাতকে আমাদের অপছন্দনীয় কাজ দ্বারা পরিবেষ্টন করা হয়েছে।” “যা আমাদের অপছন্দনীয়” বলতে যে মন্দ কিছু বোঝাচ্ছে তা নয়, এগুলো তাই যা আমাদের নফস করতে পছন্দ করে না, কারণ এতে পরিশ্রম ও চেষ্টার প্রয়োজন। আমরা সহজ কিছুই পছন্দ করি। সুতরাং সালাত আমাদের অপছন্দনীয় এবং কেউ যদি বলতো যে সালাতের দরকার নেই, আমরা খুশি হয়ে “আলহামদুলিল্লাহ” উচ্চারণ করতাম। এটা আমাদের স্বভাব, এতে আমরা খুশি হই। কিন্তু আমাদের দুঃখ হওয়া উচিত এজন্য যে আমরা শুধু এ জীবনেই সালাত আদায়ের সুযোগ পাব, পরবর্তী জীবনে নয়। সালাত আমাদের কাজে লাগবে এখানেই। পরবর্তী জীবনে আমরা সালাত আদায় করতে চাইব, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবো। আল্লাহ তাদের বর্ণনা দিয়েছেন যাদেরকে বিচারের জন্য তাঁর সামনে আনা হবে :
"যখন তারা তাদের কর্মসমূহ দেখবে এবং জানবে যে তারা নিজেদেরকে জাহান্নামে পাঠানোর জন্য তৈরি করেছে। তারা কি করবে? তারা কি আল্লাহর সাথে তর্ক করবে কেন তাদের জাহান্নামে পাঠানো হবে? না, তারা আল্লাহর কাছে আরেকবার দুনিয়ায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেতে চাইবে, যাতে তারা সেখানে গিয়ে আল্লাহর নির্দেশিত সৎকাজ করতে পারে এবং আরো বেশি করে "(সূরা আ’রাফ, ৭ : ৫৩)।
কিন্তু আল্লা জানেন যে তারা মিথ্যা বলছে, তারা তাই করবে যা তারা আগে করেছে। কারণ যদি আল্লাহ আমাদের আবার দুনিয়াতে ফেরৎ পাঠান, তাহলে নবলব্ধ এই সচেতনতা ও জ্ঞান সহ পাঠাবেন না। আমরা আগে যা ছিলাম তেমনি ভাবেই পাঠাবেন। সালাত হচ্ছে আমাদের উপকারের জন্য। এতে করে আমরা আল্লাহকে উপকৃত করছি না। যদি পৃথিবীর সমস্থ মানুষ সালাত আদায় করতো, তা আল্লাহর কোন উপকারে আসতো না। তেমনি কেউ যদি সালাত আদায় না করতো, তাতে আল্লাহর কোন ক্ষতি বা হ্রাস ঘটতো না। সালাত আমাদের নিজেদের জন্য। সেজন্যই নবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলতেন, “বেলাল, আযানের মাধ্যমে আমাদের শান্তি দাও।” সালাতকে আনন্দের সময় বলে বিবেচনা করা হয়, অথচ আমাদের কাছে তা বোঝা মাত্র। যত তাড়াতাড়ি তা আদায় করা যাবে, ততই ভাল, তাহলে আমরা আবার আমাদের জীবনের ব্যস্ততায় ফিরে যেতে পারব। এটা একটা ভুল…আমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। ইহুদিদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন :
"তাদেরকে সমস্থ নিদর্শন দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে। আমাদের হৃদয়ও কঠিন হয়ে গেছে। আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি, আমরা ইসলামের প্রতি সজাগ হয়েছি এবং ইসলামের বিধি নিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করছি, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আমাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে। "(সূরা হাদীদ, ৫৭ : ১৬)
সালাত আমাদের কাছে আনন্দদায়ক না হলেও আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং বুঝতে হবে যে এটাই স্বাভাবিক। ঈমান বাড়ে ও কমে। অন্তর কঠিন হয়ে যায় এবং আমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি ও তা নরম হয়… মৃত্যু পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এই সংগ্রাম চলবে। আমরা শুধু এই দুআ করি যেন আমরা ভীত ও বিনীত হৃদয় সহ মৃত্যুবরণ করতে পারি। আমরা সংগ্রাম করতে থাকব এবং এর মাঝেই ঈমানের স্বাদ পাব, সালাত আদায়ের বিধান কেন দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে পারব, আমাদের জীবনে আল্লাহর স্মরণ বলতে কি বোঝায় তা উপলব্ধি করতে পারব। নবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম তাদের কথা বলেছেন, যারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে-যেদিন কোথাও কোন ছায়া থাকবে না : তারা হচ্ছে যারা আল্লাহর স্মরণে কাঁদে, তাদের হৃদয় বিনম্র। [বুখারী, অষ্টম খণ্ড, পুসিক- া ৭৬, ৪৮৬ নং হাদীস : আবু হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত : নবী বলেছেন, “আল্লাহ সাতজনকে পুনরুত্থান দিবসে তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। তাদের অন্যতম হচ্ছে সে যে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ অশ্রুতে ভেসে যায়।”] [বুখারী, প্রথম খণ্ড, একাদশ পুস্তিকা ৬২৯ নং হাদীস : আবু হুরায়রা কর্তৃক বর্ণিত : নবী বলেছেন : “আল্লাহ সাতজনকে তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেন সেই দিন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। (এই সাতজন হলো) ন্যায়পরায়ণ শাসক, সেই যুবক যে আল্লার ইবাদতের মধ্যে বড় হয়েছে (অর্থাৎ শিশুকাল থেকে বিশ্বস্তভাবে আল্লার ইবাদত করছে), সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে লেগে থাকে (অর্থাৎ জামাতে সালাত আদায়ের জন্য ব্যাকুল থাকে), সেই দুই ব্যক্তি যারা পরস্পরকে আল্লাহর জন্য ভালবাসে এবং তারা আল্লাহর জন্যই পরস্পর মিলিত হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয়, এমন এক ব্যক্তি যে কোন সুন্দরী উচ্চবংশীয়া মহিলার আহ্বানকে উপেক্ষা করে এই বলে : আমি আল্লাহকে ভয় করি, এমন ব্যক্তি কে এত গোপনে দান করে যে তার ডান দান করলে বাঁ হাত সেটা জানতে পারে না (অর্থাৎ কেউ জানে না সে কত দান করেছে), এবং সে ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।”]
সুতরাং সৎকাজ থেকে আমরা দূরে থাকব না, যা আমাদের অন্তর কে বিনম্র করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, হাসিমুখে মুসলিম ভাই বোনদের সম্ভাষণ জানানো হচ্ছে সাদকা। কোন কাজকেই আমরা ছোট মনে করবো না, কোন সৎকাজই ছোট নয়। আমরা যে কোন ভাল কাজ করার চেষ্টা করবো। কিন্তু প্রথমে আমরা সেসব কাজ দিয়ে শুরু করবো যা আল্লাহ আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন। যেভাবে আল্লাহ বলেছেন সেভাবে আমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করবো, যেভাবে দেওয়া উচিত সেভাবে যাকাত দেবো, রোযা রাখবো যেভাবে রাখা উচিত এবং সক্ষম হলে হজ্ব ও ওমরা পালন করবো। এই মৌলিক বিষয়গুলো আল্লাহর উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে, এগুলোই আমাদের অন্তর বিনম্র করার ভিত্তি। এই কাজগুলো নিয়মিত করা এবং এর সাথে আরও অতিরিক্ত কিছু করার মাধ্যমে আমরা ক্রমান্বয়ে আল্লাহর কাছে আসতে পারবো, তখন আল্লাহর বক্তব্য অনুসারে তাঁর চোখ আমাদের চোখ হয়ে যাবে যা দিয়ে আমরা দেখবো, বাস্তবে আমরা কেবল এতটুকুই দেখয যা আল্লাহ চান যে আমরা দেখি। আমরা আল্লাহ যা পছন্দ করেন না তা দেখা হতে বিরত থাকবো, আমরা কেবল ততটুকুই নেব যা আল্লাহ চান, সেখানেই যাব যেখানে আল্লাহ চান যে আমরা যাই…। যদি আমরা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করি ও আল্লাহকে ডাকি, তিনি আমাদের ডাক শুনবেন। এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওয়াদা।
আমার ভাই ও বোনেরা, আমি আপনাদের ও আমার নিজেকে আহ্বান জানাই আমাদের অন্তরের কথা স্মরণে রাখতে, আমাদের হৃদয়ের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করতে। যখন আমরা সময় পাই আমরা যেন প্রশ্ন করি, আমাদের অবস্থা কি? যাতে আমরা আমাদের হৃদয়কে নরম করার কাজে সফল হতে পারি আল্লাহর রহমত ও ক্ষমার মাধ্যমে। আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে আমরা এই কাজ শুরু করবো। আজ রাত্রের পরবর্তী সালাতে, আসুন আমরা আল্লাহর দিকে ফিরি ও আন্তরিকভাবে আমাদের হৃদয়ের কোমলতার জন্য দুআ করি। এতে যদি আমরা বিশ্বস্ত হই, আমাদের অন্তর বিগলিত হতে থাকবে। এটা রাসূলুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর ওয়াদা। আমাদের উচিত কুরআন পাঠ করা ও যথাসম্ভব সৎকাজ করা। কবর জিয়ারতের মাধ্যমে ও তাদের জন্য নির্ধারিত দুআ পাঠ করে ও পরবর্তী জীবন সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু বলেছেন তা পড়ে আমাদের উচিত আখিরাতের চিন্তায় গভীর মনোনিবেশ করা। আমি আগে যেমন বলেছি, এরপরও যদি আমরা আমাদের অন্তরের কোমলতার সন্ধান না পাই, আমরা কাঁদতে চেষ্টা করবো। আমরা জোর করেই কাঁদতে চেষ্টা করবো যাতে আমরা আমাদের ভিতরের অনুভূতিগুলোকে সরিয়ে দিতে ও মুক্ত করে দিতে পারি, তা নাহলে অন্তর নরম হবে না।
সুতরাং আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি ও চাই যে আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে কোমল হৃদয় দান করেন, যে হৃদয় আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি, আমাদের সন্তানদের প্রতি, আমাদের পিতামাতার প্রতি, মুসলিম ভাই ও বোনদের প্রতি করুণায় ভরা থাকবে… এমনকি যারা মুসলিম নয় তাদের প্রতিও। আমি অমুসলিমদের জন্য আমাদের হৃদয়ে কোমলতা এজন্য চাই যেন আমরা তাদের কাছে যথাযথভাবে হেদায়েতের বাণী পৌঁছাতে পারি। আল্লাহ যেন আমাদের তাঁর কুরআনের দিকে ফিরে আসার ও নিয়মিত তা পাঠ করার, তা বোঝার ও তা থেকে হেদায়েত গ্রহণ করার তাওফীক দেন এবং আমাদের বিনম্র অন্তর দান করেন। আসসালামু আলাইকুম।
বিষয়: বিবিধ
১৮০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন