গাজা সীমান্তের চেয়েও ভয়ঙ্কর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত
লিখেছেন লিখেছেন হাশেমি ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৩:০৫:৪১ রাত
[img]http://[1378757434.jpg/img]
ইসরাইলের গাজা সীমান্তের চেয়েও ভয়ঙ্কর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। গাজায় যুদ্ধের সময়ও নিরীহ জনসাধারণকে এভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় না যেভাবে বিএসএফ বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করছে। অথচ নির্বাচিত সরকার থাকার পরেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ বা কঠোর প্রতিবাদ করা হচ্ছে না। কিশোরী ফেলানী হত্যার পর বিচারের নামে বাংলাদেশের সাথে ব্যঙ্গ করেছে ভারত সরকার। আমাদের বিজিবির হাতে অস্ত্র থাকলেও গুলি করার মতো শক্তি নেই তাদের। অথচ দেশের সাধারণ মানুষের করের টাকায় বেতন হচ্ছে বিজিবির কর্মকর্তা ও সদস্যদের।
গতকাল সোমবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ব্যবসায়ী সৈয়দ মোজাহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফয়ের হাতে নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যাকান্ডের ঘটনায় এ ভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দেশ প্রেমিক প্রতিটি নাগরিক আজ ক্ষুব্ধ সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায়। গতকাল সোমবারও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর সীমান্তে বজলুর রহমান (৪৫) নামের এক বাংলাদেশী কৃষককে বাংলাদেশ ভূ-খন্ডের ৩শ’ গজ ভেতর থেকে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের পক্ষ থেকে বহুবার এই সীমান্তহত্যা বন্ধের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অর্থাৎ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার সীমান্তহত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু সীমান্তহত্যা বন্ধ হয়নি। এখন বিএসএফ সীমান্তে রীতিমতো বেপরোয়া। গুলি করে নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যার পাশাপাশি নারকীয় নির্যাতন চালাচ্ছে বিএসএফ। এ বিষয়ে এখনই সর্বোচ্চ প্রতিবাদ করা প্রয়োজন।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শামসুল হক টুকু গত রাতেবলেন, এ ধরনের নৃশংস হত্যাকা- থেকে বিএসএফকে বিরত থাকা অতিজরুরী। কোন দেশেরই এ ধরনের হত্যাকা- মেনে নেয়া যায় না। বিজিবির পক্ষ থেকে যথাযথভাবে সীমান্ত হত্যাকা- ও নির্যাতনের জোর প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ভারতের সাথে বাংলাদেশ ছাড়া আরো ৫টি সীমান্ত রয়েছে। কিন্তু শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে বিএসএফ। বর্তমান সরকারের আমলে ২শ’রও বেশি নিরীহ বাংলাদেশী নিহত হয়েছে সীমান্তে। এ সময় ভারতের সঙ্গে অন্য পাঁচটি সীমান্তে যেমন একটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেনি, তেমনি বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির হাতে ভারতের কোন নাগরিকের মত্যুও ঘটনা ঘটেনি। অথচ দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় এবং মন্ত্রী পর্যায়ের একাধিক বৈঠকে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করবে না এমন ঘোষণাও দিয়েছিল। বাংলাদেশ সীমান্তের ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কথা ও কাজে কোন মিল নেই। তারা মানুষ হত্যা বন্ধের কথা বলে বাংলাদেশীদের খুন করে কাঁটা তারে ঝুলিয়ে রেখে। যা প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের প্রতি সভ্য আচরণ নয়।
অধিকার ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক আলোচনায় বলা হয়, ভারতের বিএসএফ প্রতি চারদিনে একজন বাংলাদেশীকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করছে। সীমান্ত এলাকায় লাখ লাখ বাংলাদেশীর প্রতিটি দিন কাটে আতঙ্কে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিজিবির একজন সাবেক মহাপরিচালক গত রাতে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বিএসএফ নিয়ন্ত্রণহীন। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দায়িত্ব হলো, সীমান্তের অপরাধ দমন করা। অথচ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রায়ই অত্যন্ত দরিদ্র ও নিরীহ কৃষক বা শ্রমিকরা হত্যা এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি কাগজে-কলমে প্রতিবাদ করার বাইরে কিছুই করে না। এ বিষয়ে বিজিবিকে আরো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক পর্যায়ে আরো জোরালো প্রতিবাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবেও পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ভাবে চলতে থাকলে বিজিবির প্রতি দেশের মানুষের যে শ্রদ্ধাবোধ যা রয়েছে তা নষ্ট হয়ে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সীমান্ত সূত্রে জানা গেছে, সীমান্ত থেকে বাংলাদেশী নাগরিকদের আটক করে কিংবা সীমান্ত এলাকা থেকে ধরে টেনেহিঁচড়ে বিএসএফের ক্যাম্পে নিয়ে হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, বিএসএফের হাতে গত বছরে তার আগের বছরগুলোর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হত্যা, নির্যাতন ও গুমের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বিএসএফের অপহরণের শিকার অনেক বাংলাদেশী নাগরিকের খোঁজই মেলেনি।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর তথ্য অনুযায়ী, গত ১২ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ৯৬৬ জন বাংলাদেশীকে হত্যা, ৭৫৪ জনকে নির্যাতন এবং ১০৩২ জনকে অপহরণ করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের কোনো প্রতিশ্রুতিরই তোয়াক্কা করছে না বিএসএফ। অনেক ক্ষেত্রে বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশীদের লাশও ফেরত দিতে গড়িমসি করেছে তারা। বিজিবি ও বিএসএফের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তহত্যাকা- বন্ধের ঘোষণা হলেও বিএসএফ তা মানছে না। এদিকে একের পর এক বাংলাদেশীকে বিএসএফ ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় সীমান্তজুড়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সীমান্তবর্তী কৃষক নোম্যান্সল্যান্ড এলাকায় তাদের জমিতে কাজ করতে যেতে ভয় পাচ্ছেন। দৌলতপুর এলাকার কয়েকজন কৃষক জানান, বেশ কিছুদিন ধরে বিএসএফ মারমুখী হয়ে উঠেছে। তারা আপাতত গুলি না চালালেও প্রায়ই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বাংলাদেশী লোকজনকে অহেতুক ধরে নিয়ে যায়। এ কারণে তারা তাদের নিজ জমিতে কাজ করতে যেতে ভয় পাচ্ছেন। এ নিয়ে একাধিকবার বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠক হলেও সীমান্ত পরিস্থিতি কোনোভাবেই যেন শান্ত হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি মাসে কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ফেরার পথে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন ১৫ বছর বয়সী কিশোরী ফেলানী। এর পর কাঁটাতারের বেড়ায় তার লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়। কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি প্রকাশ হলে তখন ব্যাপক সমালোচনায় ঝড় উঠে সারবিশ্বে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি বিশেষ আদালতে এই হত্যাকান্ডের বিচারের নামে অবশেষে অভিযুক্ত বিএসএফ জওয়ানকে খালাস ঘোষণা করা হয়। গতকাল সোমবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রের ব্যানারে ফেলানী হত্যার রায় প্রত্যাখ্যান এবং সীমান্তে হত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে রাজধানীর গুলশানে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে কিছু ছাত্র মানববন্ধন করেছে।
কুষ্টিয়া থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কুষ্টিয়া সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের হাতে ২ জন বাংলাদেশী নাগরিক নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছে।
আমাদের দৌলতপুর (কুষ্টিয়া) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ভারত সীমান্ত সংলগ্ন রামকৃঞ্চপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর এলাকায় এক বাংলাদেশী কৃষককে পিটিয়ে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। এ ঘটনায় বিজিবি কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বিএসএফকে পত্র দিয়েছে।
বিজিবি ও এলাকাবাসী জানায়, রামকৃঞ্চপুর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামের আজাহার আলীর ছেলে বজলুর রহমান বজলু (৫০) গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ভারত সীমান্ত সংলগ্ন ১৫৭/১ এস সীমানা পিলারের ৩শ’ গজ বাংলাদেশ অভ্যন্তরে মোহাম্মদপুর এলাকায় মাথাভাঙ্গা নদী থেকে কলমিলতা সংগ্রহ করছিল। এসময় ভারতের নদীয়া জেলার হোগলবাড়িয়া থানার বিএসএফ ৯১ ব্যাটালিয়নের বাউশমারী ক্যাম্পের সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে লাঠি ও রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে লাশটি একটি ডোঙ্গায় করে মাথাভাঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। অন্যান্য কলমিলতা সংগ্রহকারীরা নদীর মধ্যে ডোঙ্গায় বজলু’র লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে খবর দিলে বিজিবি সদস্যরা লাশ উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে আসে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি’র ৩২ ব্যাটালিয়নের চিলমারী সদর কোম্পানী কমান্ডার সুবেদার ইউনুস ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, নিহতের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন থাকায় ধারণা করা হচ্ছে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহতের লাশটি ময়না তদন্তের জন্য দৌলতপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ ঘটনায় বিজিবি কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে পতাকা বৈঠকের জন্য বিএসএফকে পত্র দিলেও বিএসএফ এ রিপোর্ট লেখা অবধি কোনরূপ সাড়া দেয়নি।
বিষয়: বিবিধ
১৪৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন