প্রধানমন্ত্রৗর সমুদ্র বিজয়-আমার কিছু কথা
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১১:১৮:০১ সকাল
গত ৭ জুলাই আন্তর্জাতিক আদলত কর্তৃক
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের
সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি মামলার
রায় প্রকাশ হওয়ার পর বাংলাদেশে সমুদ্র
বিজয় উৎসব বা সভা–শোরগোল
হতে দেখা যায়নি,
যেমনটি দেখা গিয়েছিল দুই বছর
আগে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের
সমুদ্রসীমানা বিরোধ মামলার রায় প্রকাশ
হওয়ার পর। সামগ্রিকভাবে সমুদ্রের
জলসীমানা পাওয়া না-পাওয়ার
বিষয়টি বাদ দিয়ে কেবল তেল-গ্যাস ব্লক
বিবেচনায় আনলে এটি অনস্বীকার্য
যে মিয়ানমারের সঙ্গে নতুন
সীমানা নির্ধারণের ফলে বাংলাদেশের
দাবিকৃত ছয়টি গভীর সমুদ্র ব্লক মিয়ানমারের
হাতে চলে যায় এবং তার
ফলে বাংলাদেশ ওই সমুদ্র এলাকা হারায়।
বিষয়টি বিজয় উল্লাসের ডামাডোল ও
শোরগোলে কেবলই ঢাকা পড়ে থাকে।
তবে ভারতের সঙ্গে নতুন নির্ধারিত
সমুদ্রসীমানায় তেল-গ্যাস ব্লক বিবেচনায়
বাংলাদেশ প্রকৃতই বিজয়ী হয়।
এখানে ভারতের
দাবি করা কোনো গ্যাস ব্লকই
বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়নি। ভারতের
সঙ্গে সীমানা নির্ধারণে প্রকৃতপক্ষে বিজয়ী হলেও
এ নিয়ে বিজয় উৎসব বা সভা শোরগোল
না করার সিদ্ধান্তটি সরকারি মহলের
অধিকতর কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় হোক
অথবা ভারতকে বিব্রত না করার মানসিকতাই
হোক, বাংলাদেশের এই সংযত আচরণ
কূটনৈতিক মহলে কিছুটা হলেও
প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।
তবে এবার শোরগোল উঠেছে অপর এক
বিষয়ে। ভারতের একটি সংবাদমাধ্যমের
সূত্রে প্রচারিত একটি খবর এবার বিতর্ক
আলোচনায় স্থান পায়।
যে সংবাদটিকে কেন্দ্র করে নতুন এই
বিতর্ক, তার সূত্র একটি ভারতীয় টেলিভিশন
চ্যানেল। ভারতের নয়াদিল্লি টেলিভিশন
(এনডিটিভি) তার প্রচারিত
একটি অনুষ্ঠানে দাবি করে যে তাদের
কাছে সরকারি অভ্যন্তরীণ নথির সূত্রে খবর
রয়েছে যে সাগরে নিমজ্জিত
তালপট্টি দ্বীপটির স্থানে ভূগর্ভে ১০০
টিসিএফ গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
এনডিটিভি এ তথ্য কোনো তেল
কোম্পানি বা অনুসন্ধানী সংস্থার সূত্র
থেকে জানা গেছে কি না,
সে বিষয়ে কিছু জানায়নি। কেবল
আবিষ্কারটি ২০০৬
সালে ঘটেছে বলে প্রচার করেছে।
১৯৭০ সালে প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের পর
তালপট্টি দ্বীপটি সমুদ্র
থেকে জেগে ওঠে। আর এর
অবস্থানটি হলো ভারত–বাংলাদেশ
সীমান্ত
নদী হাড়িয়াভাঙ্গা যেখানে সাগরে এসে মিশেছে,
ঠিক তার মুখে। বিগত প্রায় ৪০ বছর ভারত ও
বাংলাদেশ উভয়ই সমুদ্র
সীমানা নিয়ে যেমন পরস্পর বিরোধপূর্ণ
অবস্থায় ছিল,
তালপট্টি দ্বীপটি আবির্ভারের পর
থেকে উভয় দেশই এটিকে তার নিজের
বলে দাবি করে আসে।
তালপট্টি দ্বীপটি ২০১০
সালে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে যায়।
তবে আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক
সমুদ্রসীমানা বিরোধ মামলার রায়
অনুযায়ী ওই দ্বীপের স্থানটি ভারতের
অংশে পড়েছে। তাই বিতর্ককারীদের
অভিমত এই যে তালপট্টির অস্তিত্ব
না থাকলেও তার নিচে পাওয়া ১০০
টিসিএফ গ্যাস
হাতছাড়া হওয়াটা বাংলাদেশের জন্য
বিরাট বড় ক্ষতি।
কোনো এক স্থানে ১০০ টিসিএফ গ্যাস
থাকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ
তা বিশাল পরিমাণ। বাংলাদেশ
বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় এক টিসিএফ গ্যাস
ব্যবহার
করে বা চাহিদা আছে এবং সে হিসাবে ১০০
টিসিএফ গ্যাস ১০০ বছরের জোগান।
বাংলাদেশের গ্যাসের বর্তমান মজুত প্রায়
১২ টিসিএফ, ভারতের প্রায় ৫০ টিসিএফ
(আলোচিত ১০০ টিসিএফ না ধরে),
মিয়ানমারের ১০ টিসিএফ
এবং পাকিস্তানের ২৫ টিসিএফ।
সম্প্রতি মিয়ানমার
সমুদ্রবক্ষে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার
হওয়ার পর থেকে তা পাওয়ার জন্য ভারত ও
চীন যে প্রতিযোগিতা ও
রাজনীতি কূটনীতির চাল চালে,
তা লক্ষণীয়। আন্তর্জাতিকভাবে
ছড়িয়ে পড়া সংবাদ সূত্রে জানা যায়, শেষ
পর্যন্ত চীন ৩০ বছরের চুক্তির
মাধ্যমে মিয়ানমারের এ গ্যাস
কিনতে জয়ী হয়েছে। উল্লেখ্য,
মিয়ানমারের ওই গ্যাস মজুতের পরিমাণ পাঁচ
থেকে ছয় টিসিএফ। সম্প্রতি ভারতের অন্ধ্র
প্রদেশে চেন্নাই উপকূলে প্রাপ্ত
গ্যাসক্ষেত্রগুরলো ভারতের গ্যাস
আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য হয়েছে। ভারত এই
আবিষ্কারের পর তাকে ভারতের
ইতিহাসে সর্বোচ্চ বড় গ্যাস আবিষ্কার
হিসেবে গণ্য করে, সামগ্রিকভাবে যার
মোট পরিমাণ ২০ থেকে ২৫ টিসিএফ
বলে দাবি করা হয়। উপরিউক্ত
তথ্যগুলো থেকে এটি স্পষ্টতই অনুধাবন
করা যায় যে, কোনো একটি স্থানে ১০০
টিসিএস মজুতের সন্ধান এককভাবেই
আলোচনার দাবিদার।
কোনো এলাকায় তেল-গ্যাস আবিষ্কৃত
হলে, কোন তেল
কোম্পানি (বা কোম্পানি গোষ্ঠী)
এটি আবিষ্কার করেছে, কারাই-
বা সেখানে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত জরিপ করল,
কত বছর যাবৎ কোম্পানিটি জরিপকাজ
চালিয়েছে, কত গভীরতায়, কোন
ভূতাত্ত্বিক গঠনে গ্যাসের
অবস্থানটি নিশ্চিত করা গেল ইত্যাদি তথ্য
বিশ্বের নানাবিধ পেট্রোলিয়াম
মনিটরিং এজেন্সির মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ
জানা যায়। কেবল তা-ই নয়, ছোট বা বড়
আবিষ্কারের পরপরই আবিষ্কারক নিজের
স্বার্থে তার আবিষ্কারকে পারলে আরও বড়
করে সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরতে চায়,
যাতে শেয়ারবাজারে তার মূল্য বৃদ্ধি পায়
বা সে আরও সুযোগ্য
বলে নিজেকে প্রমাণ করতে পারে। গ্যাস
আবিষ্কার কোনো সামরিক কর্মকাণ্ড নয়,
তাই পৃথিবীর কোথাও
এটি গোপনে করা হয় না; অধিকন্তু
খোলা আকাশের নিচে অনুসন্ধানের
বিশাল কর্মযজ্ঞ গোপনে করাও যায় না।
ভারতীয় টিভি চ্যানেল এনডিটিভি ১০০
টিসিএফ গ্যাসের ব্যাপারে এ
বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি।
বিশ্বের আন্তর্জাতিক পেট্রোলিয়াম
কার্যক্রম মনিটরিং এজেন্সিগুলোর
সূত্রে তালপট্টির নিচে গ্যাস আবিষ্কার
বা অনুসন্ধান কার্যক্রমের কোনো খবর
পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ-ভারত
বিতর্কিত সীমান্তে তালপট্টিতে বড়
আকারের গ্যাস অনুসন্ধান খনন ও আবিষ্কার
বাংলাদেশে দৃশ্যমান হবে তা নিশ্চিত;
কিন্তু এ ধরনের কোনো কার্যকলাপ
কখনো লক্ষ করা যায়নি। সর্বোপরি,
ভারতের পেট্রোলিয়াম মিনিস্ট্রির
অধীনে তেল-গ্যাস ব্যবস্থাপনা, পর্যবেক্ষণ
ও নথিভুক্তকরণের দায়িত্বে নিয়োজিত
ডাইরেক্টর জেনারেল অব
হাইড্রোকার্বনের সমূহ
রেকর্ডে (ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত)
তালপট্টি এলাকায় কোনো গ্যাস
অনুসন্ধান খনন বা আবিষ্কারের তথ্য নেই।
উল্লেখ্য, সংস্থাটি ভারতের
যেকোনো স্থানে যেকোনো গ্যাস-
তেল অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের তথ্য নথিভুক্ত
করে প্রকাশ করে। অর্থাৎ,
এনডিটিভি সূত্রে প্রচারিত তালপট্টি ১০০
টিসিএফ গ্যাসের খবরের
কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা দৃশ্যমান সূত্র
নেই। তথাপি, তর্কের খাতিরে এর
সত্যতা গ্রহণ করলেও প্রশ্ন ওঠে যে ভারত
যেখানে তীব্র গ্যাস
চাহিদা সামলাতে অস্থির এবং তারা যখন
বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের গ্যাস
আমদানি করতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত,
সে অবস্থায় তালপট্টিতে ২০০৬
সালে আবিষ্কৃত এত বিশাল গ্যাস মজুতের
উত্তোলন ও সরবরাহ করে গ্যাস-সংকট
কাটায় না কেন? এর কারণ কি এই যে গ্যাস
আবিষ্কারের এই সংবাদ বাস্তবতাবর্জিত।
এখন আরেকটি বিষয় আলোচনায়
আনা যেতে পারে। তালপট্টি বাংলাদেশ
ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গব্যাপী বিস্তৃত
একটি ভূতাত্ত্বিক বেসিনের (যার নাম
বেঙ্গল বেসিন) পশ্চিম অংশে অবস্থিত। এই
বেসিনে বিগত ৫০ বছরে অনেক অনুসন্ধান
কূপ খননের মাধ্যমে এর বিভিন্ন
অংশে গ্যাস-তেল পাওয়া ও পাওয়ার
সম্ভাবনার তুলনামূলক ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়
যে বেসিনের পূর্বাংশই (কুমিল্লা-চট্টগ্রাম
ও তার সংলগ্ন সমুদ্র জলসীমা) অধিকতর গ্যাস
সম্ভাবনাময় ও এখানেই অধিকাংশ বড়
গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।
পক্ষান্তরে এই বেসিনের
পশ্চিমাংশে (বাংলাদেশের পশ্চিম অঞ্চল
ও সমুদ্রসীমা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও তার
সমুদ্রসীমা অপেক্ষাকৃত কম সম্ভাবনাময়।
প্রকৃতপক্ষে এই পশ্চিমাংশে (ভারতের
পশ্চিমবঙ্গসহ) এখন পর্যন্ত একটি গ্যাসক্ষেত্রও
আবিষ্কৃত হয়নি। তাই এই পশ্চিমাংশের
একটি স্থানে ১০০ টিসিএফ গ্যাস
থাকা অস্বাভাবিক ও তা ইতিমধ্যে জ্ঞাত
ভূতাত্ত্বিক গঠন ও বিন্যাসের
সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, তালপট্টির ১০০ টিসিএফ
গ্যাস আবিষ্কারের প্রচার
কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? যদি তা-ই হয়,
তবে কারা বা কী উদ্দেেশ্য
এটি করা হয়েছে? ভারত–বাংলাদেশ
সমুদ্রসীমানা বিরোধ মামলার
রায়ে ভারত সমুদ্র এলাকার
যে দাবি করেছিল, তা অর্জন করতে প্রায়
পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। বিরোধপূর্ণ ২৫
হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার
মধ্যে প্রায় ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার
পেয়েছে বাংলাদেশ, যা কিনা মোট
আয়তনের পাঁচ ভাগের চার ভাগ। এ
ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জয় ও ভারতের
পরাজয়কে ভারতীয়
কূটনীতিকেরা হাসিমুখে মেনে নিলেও
জনগণের কাছে ভারত সরকারের
দায়বদ্ধতা কমে যায়নি, বরং এটি ভারত
সরকারের ওপর ভেতর থেকে চাপ
হিসেবেই বিদ্যমান বয়েছে। আর এ চাপ
লাঘব করতে জনগণকে কোনো বিকল্প
পন্থায় আশ্বস্ত করা প্রয়োজন। তাই
তালপট্টি দ্বীপ নিমজ্জিত হলেও ওই স্থান
ভারতের পক্ষে পাওয়ার ফলে ১০০ টিসিএফ
গ্যাস তো ভারতের পাওনা হলো—এ
ধরনের প্রচারণা দিয়ে কি ভারত সরকার
তার জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাইছে?
কূটনৈতিক শাস্ত্রমতে এ
সম্ভাবনা যতটা না সত্য
বলে মনে হতে পারে, গ্যাস ভূবিজ্ঞানের
সূত্রে তা অধিকতর সত্য প্রতীয়মান হয়।
বিষয়: বিবিধ
১০৩৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গ্যাস পাওয়া যাক বা না যাক এটা সত্য যে সমুদ্র বিজয়ের নামে বিশাল ক্ষতি হয়েছে। আর সেটা স্রেফ গলা বাজির মাধ্যমে ঢাকার চেষ্টা করছে সরকার।
মন্তব্য করতে লগইন করুন