সীরাতের গহীনে – নবুয়ত থেকে হিজরত

লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৪:০৭:০৩ বিকাল

সীরাতের রঙধনুঃ-



যুগের চাহিদা পূরণ করেই আল্লাহ্ পাক নবী-রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন নিজ নিজ জাতির কাছে। যাদুবিদ্যার যুগে মূসা (আঃ) কে পাঠিয়েছেন যাদুর চেয়ে বেশি কিছু দিয়ে। চিকিৎসাবিদ্যার যামানায় ঈসা (আঃ) ছিলেন অলৌকিক চিকিৎসাজ্ঞানের অধিকারী। আর সাহিত্যের সময়ে মুহাম্মদ (সঃ) কে প্রেরণ করেছেন শিক্ষা-সাহিত্য-সভ্যতার সমস্ত উপকরণ দিয়ে।

এরই ধারাবাহিকতায় উম্মতে মুহাম্মদীর শিক্ষা-গবেষণায় চাহিদার ভিত্তিতে পরিবর্তন এসেছে যুগ-যুগান্তরে। চাহিদার ভিন্নতার দরুন সময়ের পালাবর্তনে পরিবর্তন এসেছে সীরাতের রচনাশৈলীতেও।

সীরাত সম্পর্কিত বস্তুসমূহকে আমরা সাতটি স্তরে বিন্যাস করতে পারি এভাবে।

১) বর্ণনা ও রিওয়ায়াত সম্বলিত সীরাতের বইঃ সর্বপ্রথম তাবেঈনদের যুগে এ বিষয়ে পুস্তক রচনা করেন আব্বান বিন উসমান বিন আফফান রাঃ(৩২-১০৫ হি), উরওয়া বিন যুবাইর রাঃ(২৩-৯৩ হি), আব্দুল্লাহ বিন আবি বকর রাঃ(মৃত্যু-১৩৫ হি)।ওমর বিন আব্দুল আযিযের (রা) যুগে এই পটভূমিতে সীরাত রচনা করেন মুহাম্মদ বিন মুসলিম বিন শিহাব যুহরী রাঃ(৫০-১২৪ হি)। এই পুস্তকগুলো ছিলো ঐতিহাসিক বর্ণনা এবং ‘রাবী’ (বর্ণনাকারী) পরম্পরা সম্বলিত প্রাথমিক পর্যায়ের সীরাত। তবে এসব ছিলো নাতিদীর্ঘ কলেবরে।

২) উৎস ও প্রমাণ সম্বলিত সীরাতঃ প্রায় একই ধাপের কিন্তু কিছুটা ভিন্ন ধাঁচের সীরাত রচিত হয় এর পরের সময়ে। এ ক্ষেত্রে অনুপম সীরাত রচনার অধিকারী মুহাম্মদ বিন ইসহাক বিন ইয়াসার(১৫২ হিজরিতে মৃত্যু)এর হাদীস এবং রেওয়ায়াত অবলম্বিত কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া পুস্তক (المغازي)। তবে তার অবশিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে একই ধরণের সংক্ষিপ্ত একটি পুস্তক রচনা করেন ইবনে হিশাম(২১৩ বা ২১৮ হিজরিতে মৃত্যু); যা সীরাতে ইবনে হিশাম নামে পরিচিত। একটু ভিন্ন ধাঁচের ভৌগলিক তথ্য নিয়ে পুস্তক রচনা করেন মুহাম্মদ বিন সাআ’দ (১৬৮-২৩০) যা (الطبقات) নামে পরিচিত।

৩)সাইক্লোপিডিয়ায়া শ্রেণীর সীরাতঃ আবু জাফর মুহাম্মদ বিন জারীর তাবরী’র (تاريخ الطبري), হাফেজ ইবনে কাসীরের পুস্তক (البداية والنهاية), ইবনে খলদুনের (تاريخ ابن خلدون) আধুনিক সাইক্লোপিডিয়ার পথিকৃৎ বলা চলে।

৪) তথ্য ও তত্ত্বীয় ব্যাখ্যামূলক সীরাতঃ বেশিরভাগ সীরাতের বই এই রসদের উপাদানে রচিত। জালালুদ্দীন সুয়ুতীর (الدر المنثور) থেকে শুরু করে ইস্ফাহানীর (دلائل النبوة), সৈয়দ আমীর আলীর ‘দি স্পিরিট অফ ইসলাম’, স্যর সৈয়দ আহমদের “ESSAYS ON MUHAMMAD AND ISLAM”, মাওলানা শিবলী নোমানী ও সুলায়মান নদভীর “সীরাতুন্নবী”, আবুল হাসান আলী নদভীর “নবীয়ে রহমত” সহ রয়েছে নানান ভাষায় অগুণিত সীরাত বই।

৫) দার্শনিক ব্যাখ্যাসম্বলিত সীরাতঃ পরবর্তীকালে যুগের রুচি পরিবর্তনের জের ধরে পাঠকের সামনে আসে ফিলোসফিক্যাল কিছু সীরাত গ্রন্থ। ইবনুল কাইয়ুমের (زاد المعاد), কুস্তুলানীর (مواهب اللدنية), শাহ উয়ালিউল্লাহ দেহল্বীর (حجة الله البالغة), উইলিয়াম মুরের ‘দি লাইফ অফ মুহাম্মদ’,গোলাম মোস্তফা রচিত ‘বিশ্বনবী’ উল্লেখযোগ্য।

৬) বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসম্বলিত সীরাতঃ বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত হচ্ছে সীরাতের উপর প্রচুর প্রবন্ধ ও গ্রন্থ। তবে বিজ্ঞানভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ সীরাত নিয়ে প্রসিদ্ধ লাভ করা বই অত্যন্ত বিরল। হয়তো অচিরেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্বলিত সীরাতের পূর্ণাঙ্গ কোনো বই আমরা দেখতে পাব।

৭) প্রত্নতাত্ত্বিক ও ডকুমেন্টারি সীরাতঃ- নবীজি (সঃ) এর জীবনী অধ্যয়নে তাঁর ব্যবহিত জিনিস ও ঘটনাবহুল স্থান সমূহ নিঃসন্দেহে অনবদ্য রসদ। মক্কা-মদীনা, হিজরতের স্থান, উহুদ-বদর প্রান্তর ইত্যাদি যেমন সীরাতের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, তেমনি নবীজির পবিত্র পোশাক, লাঠি, যুদ্ধাস্ত্র ইত্যাদিও সীরাতের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একইভাবে অধুনা চাহিদার ভিত্তিতে তাঁর জীবনীর উপর নির্মিত ডকুমেন্টারি গুলো সীরাতে যোগ করতে পারে প্রযুক্তিগত নতুন মাত্রা।

মোহাম্মদ (সঃ) ইসলামেরই পূর্ণতম মানবিক রূপ। তাঁর জীবন মহাগ্রন্থ আল-কোরানের হুবহু ব্যবহারিক অনুবাদ। হযরত আয়েশার (রা) ভাষ্যমতে তিনি ছিলেন কোরআনের চলমান কাঠামো। তাই তাঁর জীবনীর প্রাণশক্তি অবিনশ্বর, যার প্রয়োজনীয়্তা ফুরাবেনা কোনোকালেই। এই প্রবন্ধে আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে সীরাতের আধ্যাত্মিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা তুলে ধরার।

নবুয়তের ঐতিহাসিক অট্টালিকার সর্বশেষ প্রস্তরখন্ডটি জুড়ে দেয়ার সব পরিকল্পনা প্রায় সম্পন্ন। শত শতাব্দীকাল ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা ইসলামের সুরম্য দালানটির চূড়ান্ত উদ্বোধন হবে পবিত্র “হেরা” গুহায়।অচিরেই আত্মপ্রকাশ ঘটবে ঈমানের সেই প্রতিশ্রুত মজবুত কেল্লার যা আগত-অনাগত সকল ঘাত-প্রতিঘাত ঠেকিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে সর্বকালব্যাপী। যার আন্তর্জাতিক ও আন্তর্জাগতিক অভ্যুদয় বাঁধাগ্রস্ত করার সামর্থ্য কারো নেই।

কিন্তু যে মহানায়ককে ঘিরে এতো কর্মযজ্ঞ তিনি এখনো এ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, শুধু বিশ্বনিয়ন্তার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে কিছু অদৃশ্য ইশারা আর হৃদয়ের অমোঘ আকর্ষন বশত ইদানিং ছুটে যাচ্ছিলেন হেরা গুহায়। যেন নবুয়তের অভিষেক অনুষ্ঠানের অঘোষিত রিহার্সেল।

ঊষার দুয়ারেঃ-

হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্মের ৪১তম বছরে ২১ রমযান মোতাবেক ১০ই আগস্ট, ৬১০ খৃস্টাব্দ , সোমবারে তিনি অভিষিক্ত হন নবুয়তের জান্নাতী পদমর্যাদায়। তাঁর পবিত্র অন্তরে বপে দেয়া হয় দ্বীনের প্রথম বীজ… اقرأ باسم ربك الذي خلق । প্রথম দফায় অবতীর্ণ হওয়া আয়াতে কলম ও জ্ঞানের আলোচনা ইসলামের বিশ্বব্যাপী পদচারণা, ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এর অবদান ও সাহিত্য আন্দোলনের চিহ্ন বহন করে যার দ্বিতীয় নজির অন্য কোন ধর্ম বা জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাসে নেই।

প্রাথমিক পর্যায়ে হযরতের “ভীতির” সুন্দর একটি কারণ খুজে পাওয়া যায় ডঃ মুস্তফা আস সীবাঈ’র লেখায়-“মুহাম্মদ(সঃ) কখনও নবুয়তের প্রত্যাশী ছিলেন না, তার স্বপ্নও কখনও দেখেননি। আল্লাহ্ পাক উনাকে নির্জনতার ইলহাম করেন যেনো তিনি রিসালাতের কঠিন দায়িত্ব গ্রহনের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি নিতে পারেন। যদি তিনি পয়গম্বরীর প্রত্যাশী হতেন তাহলে অহী নাযিলের সময় ভীত হতেন না এবং খাদিজার(রা) কাছেও সেই ঘটনার ব্যাখ্যা চাইতেন না” । অহী লাভ করার ক্ষেত্রে হেরা পর্বতের অবস্থান ও জিবরীল (আঃ) সাথে আলিঙ্গনের গূঢ় রহস্য বর্তমান টেকনোলজীর যুগে (দুটি ভিন্ন ডিভাইসের পারস্পরিক তথ্য আদান-প্রদান করার জন্য ‘ওয়াইফাই’ কিংবা ‘ব্লুটূথে’র মাধ্যমে PAIR করা বা HOTSPOT তৈরী করার পদ্ধতি। এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতর অঞ্ছলে হেরা পর্বতের অবস্থান আকাশতরঙ্গ অনুগ্রহনে কতটা জরুরী ছিলো তা বর্তমান মোবাইল টাওয়ার বা মানমন্দিরগুলোর পটভূমিতে) অনুমান করাটা মোটেও জটিল কিছু নয়।

রাঙা প্রভাতঃ-

নবীজি (সঃ) এর প্রাথমিক জীবনে অনেক অদ্ভুত, অলৌকিক ও স্বর্গীয় ঘটনা ঘটেছিলো। কিন্তু কোনটাই নবুওত প্রাপ্তির ঘটনাটির মত অভাবনীয় নয়। “ব্যাপারটি ছিলো বড় ধরনের এবং এতে এমন কোন লোকের পরামর্শ গ্রহনের প্রয়োজন ছিলো যিনি বিভিন্ন ধর্ম ও সেসবের ইতিহাস, নবুওয়ত ও তার মেযাজ, অধিকন্তু কিতাবীদের সম্পর্কে বেশ ভালোভাবে অবহিত, যার নিকট আম্বিয়ায়ে কেরামের ঘটনাবলী ও তাঁদের জ্ঞানের ছিটেফোঁটা হলেও বর্তমান । তাই নবীজি (সঃ) হযরত খাদীজা (রাঃ)এর পরামর্শে তার চাচাতো ভাই ‘ওয়ারাক্বাহ বিন নাওফাল’ এর নিকট গেলেন এবং নিশ্চিত হলেন আগন্তুক ছিলেন জিবরীল আমিন, আর তাঁর হৃদয়ে অঙ্কিত পংক্তিমালা ছিলো আল্লাহ্রপবিত্র বাণী।

অবশ্য ইতোপূর্বে স্বপ্নে দেখা রেসালতের স্পষ্ট অহী ও নিদর্শন সমূহ নবীজিকে নবুওয়াতের জন্য পরিপুষ্ট করে তোলে।

ওয়ারাক্বার উক্তি-“একদিন আসবে যখন আপনার জাতি ও সম্প্রদায় আপনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে এবং কষ্ট দেবে, আপনাকে বের করে দেবে, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করবে…” স্বভাবতই নবীজিকে তাঁর ভবিতব্য ঠিক করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং মক্কার পরিবর্তে ইসলাম উন্মেষের জন্য অন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র অন্বেষণে অনুপ্রেরণা যোগায়। সেই সাথে কাফেরদের ভবিষ্যত অত্যাচারে টিকে থাকার আত্মবিশ্বাস ও মনোবল সৃষ্টি করে।

বিজ্ঞানোচিত বিরতিঃ-

অহী বিরতির সময়কাল সম্পর্কে ব্যক্ত বিভিন্ন মতের মাঝে ১০ দিনের হিসাবটি সবচে যুক্তিযুক্ত ও সুন্দর।“যদি অহী নাযিলের ঘটনাটি রমযানের একুশ তারিখ রাতের ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে অহী বিরতিকাল সময়সীমা হবে শুধুমাত্র ১০ দিন।এরপর দ্বিতীয় দফায় অহী নাযিল আরম্ভ হয় নবুয়তের প্রথম বছর শাওয়ালের প্রথম দিবসে বৃহস্পতিবার (অর্থ্যাত, ঈদের দিন) সকালে । সম্ভবত রমযানের শেষ দশদিনের ইতিক্বাফ এর জন্য অহীর বিরতি ও শাওয়ালের প্রথম তারিখ ঈদের দিনে নতুন করে অহী নাযিল হওয়াটা এই ঘটনার মূল রহস্য” ।

অহী বিরতি (فترة الوحي) মানবসত্তা হিসেবে হযরতের জন্য ছিলো একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, “কেননা মানুষের মধ্যে দুটি সত্তা বিদ্যমান; মানবীয় এবং ফেরেশতাগত। তাই মানবীয় ধুম্রজাল ছিড়ে ফেরেশতার বলয়ে প্রবেশ করতে প্রয়োজন হয় কিছু ধাক্কা ও বিরতির…যতক্ষন না আল্লাহর নির্দেশ পূর্ণ হয়” ।

ইবনে হাজর বলেন-“কিছুদিন অহী বন্ধ থাকার কারণ সম্ভবত হযরতের ভয় দূর করা ও অহীর প্রতি উৎসাহী করে তোলা” ।

নব কাফেলার নয়া সফরঃ-

বিরতি পরবর্তি দ্বিতীয়বার অহী নাযিলের প্রারম্ভেই হযরত অন্ধকারাচ্ছন্ন মানবজাতিকে সতর্ক করার নিমিত্তে আদিষ্ট হন “قم فأنذر” ও “وأنذر عشيرتك الأقربين” আয়াত সমূহের মাধ্যমে।

ফলে তিনি প্রথমেই তাঁর নিজ আপন পরিধি ও বন্ধু বলয়ে ইসলামের দাওয়াত পৌছে দেয়ার প্রয়াস পান। সদ্য অংকুরিত ইসলামের সেই চারাটিকে যারা প্রাণপনে আগলে রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হযরতের অর্ধাঙ্গিনী খাদীজা ও পরম বন্ধু আবু বকর (রা)। দুজনেই ইসলামের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস ও ভালোবাসায় নিজেদের উতসর্গ করেছেন; তা না হলে ইসলামের প্রাথমিক পদচারনা কিভাবে নিরূপিত হতো ভাবা যায়না। এরপর ধীরে ধীরে ইসলামী কাফেলার আকার-আকৃতি বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো আর ঈমানের বৃক্ষটি ছড়াতে লাগলো তার সবুজ ডালপালা। মানবেতিহাসে প্রাথমিক সময়েই সাধারণ জনতার পাশাপাশি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের (যেমন আবু বকর, উসমান, আলী, হামযা প্রমুখ রা.) সাড়া পাওয়া ধর্ম হচ্ছে একমাত্র ইসলাম এবং একমাত্র ব্যক্তি হচ্ছেন মুহাম্মদ (সঃ) ।

ইসলামী মিডিয়া বনাম জাহেলী প্রোপাগান্ডাঃ-

“فاصدع بما تأمر وأعرض عن المشركين” এই আয়াতের মাধ্যমে হযরতের দাওয়াতী অভিযান গোপনীয়তার গন্ডি ছেড়ে প্রকাশ্য ময়দানে প্রবেশ করে। এই সময় আরবে একটি প্রথা ছিল। বিপদের সময় নগরবাসীকে আহবান করতে হলে মক্কার সাফা পর্বতের শীর্ষে দাঁড়িয়ে তাকে يا صباحاه বলে চিৎকার করতে হয়। সেই ডাক শুনে নাগরিকরা পর্বতের পাদদেশে সমবেত হতো। আহ্বানকারী তখন তার বক্তব্য সকলকে বুঝিয়ে বলতেন । দ্বীন প্রচারের এই মোক্ষম উপাদানটি হযরত ব্যবহার করলেন সুনিপুনভাবে। নবীজি (সঃ) একদিন প্রভাতে রীতি অনুযায়ী সকলকে ডেকে প্রথমেই সবার মাঝে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা ঝালিয়ে নিলেন। কারণ, একটি সফল মিডিয়া শক্তির প্রধান ও মৌলিক যে দুটি গুণ(সত্যবাদিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা) প্রয়োজন তা হযরতের মাঝে পরিপূর্ণভাবেই বিদ্যমান ছিলো; যা নবুওয়তের পূর্ব থেকেই সর্বজনস্বীকৃত ছিলো। এরপর হযরত উপমা দিয়ে মানব সম্প্রদায়ের স্বীয় আস্তিনে ঘাপটি মেরে থাকা বিপদের যে বর্ণনা দিলেন তা অবিস্মরণীয়। এর থেকে সংক্ষিপ্ত ও সহজ রাস্তা এবং এর চেয়ে বেশি বোধগম্য ও সুস্পষ্ট বর্ণনা আর কিছু হতে পারত না । আল্লাহর নবীর আহবানে সেদিন কেউ সাড়া দিল না বটে, কিন্তু ঐ আহবান বিফলেও গেলনা। মক্কার ঘরে ঘরে পথে প্রান্তরে সকলের মধ্যেই আল্লাহ্ ও রসূলের নাম আন্দোলিত হতে লাগলো। বিরোধ ও অস্বীকৃতির মধ্য দিয়েই ইসলামের বাণী কোরাইশের অন্তর্লোকে অনুপ্রবেশ করলো ।

বিস্ময়কর হলেও সত্যি, সংখ্যাগরিষ্ঠ মক্কার কাফেরদের মাঝে ক্ষুদ্র পরিধি ও স্বল্প রসদের ইসলামী মিডিয়া কুরাইশ সর্দার আব্দুল উজ্জাকে চিরতরের জন্য পরিণত করে দেয় ‘আবু লাহাব’-এ, তদ্রুপ মুহাম্মদী মিডিয়া আমর বিন হিশামকে বদলে দেয় ‘আবু জেহেল’-এ। এমনকি কাফেররাও তাদেরকে সেই নামেই ডাকতে শুরু করে… যাদের প্রকৃত নাম আজো কেউ মুখে আনেনা। প্রকৃত ইসলামী মিডিয়া এমনতর শক্তিশালী।

এরপর আসতে শুরু করলো নানান লোভনীয় প্রস্তাব। কখনোও কুরাইশরা আবু তালিবের নিকট গিয়ে সুদর্শন ধনবান যুবকের বিনিময়ে মুহাম্মদকে চায় , কখনোও সরাসরি নবীজি (সঃ) এর কাছে গিয়ে নেতৃত্ব, ধনসম্পদ কিংবা সুন্দরী নারীর প্রলোভন দেখায়… । প্রতিত্তোরে হযরত চন্দ্র সূর্যের যে দৃষ্টান্ত পেশ করেছিলেন তা এক কথায় তাঁর ইস্পাত-কঠিন সংকল্পের চূড়ান্ত ঘোষণা ।

এবার আরম্ভ হল প্রোপাগান্ডার চিরাচরিত অপপ্রয়াস। কিছুদিন যাদুকর আখ্যায়িত করে তো আর কিছুদিন পাগল ডাকার প্রয়াস চালায়। আবার বিফল হয়ে গণক কিংবা কবি বলে অভিহিত করার চেষ্টা করে। এক সময় নিরাশ হয়ে তারা কোরআনের পিছনে লাগে। এসব “নিছক অলীক কল্পনা, পাগলের প্রলাপ, অতীতের উপাখ্যান, শয়তানের কুমন্ত্রণা” বলে প্রচারণা চালাতে থাকে। শেষমেশ আর না পেরে কখনোও মানুষকে প্ররোচিত করতে থাকে কুরআনের আয়াত না শোনার জন্য। কখনোও কুরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ শোনা না যাওয়ার জন্য শব্দ দূষণ করে। আবার কখনো নিজেরাই আয়াত বানানোর হাস্যকর অপচেষ্টা চালায় । কিন্তু প্রতিবারই কোরানিক মিডিয়া প্রত্যেকটির সমুচিত জবাব দিয়ে তাদের অপপ্রচারকে তৃণমূল পর্যায়েই কবর দিয়েছে । এমনকি এতো বিপুল জনশক্তি ও সম্মিলিত চেষ্টা থাকার পরও কাফেররা তাদের “নাদওয়া” নামক সাহিত্য কেন্দ্রে বসে নবীজি(সঃ)কে কি নামে অভিহিত করা যায় সে ব্যাপারে কখনোও একমত হতে পারেনি। সত্যিই জাহেলী মিডিয়ার কী করুণ পরিণতি!

রক্তপিপাসু জাহেলিয়্যাতঃ-

হক্বের বিরূদ্ধে বাতিল চিরকালই গায়ের জোরে টিকে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছে। দূর্বলচেতা কাফেররা যখন দেখলো মুহাম্মদ (স)কে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা সম্ভব হচ্ছেনা, তখন তারা শারীরিক নির্যাতনের দিকেই হাত বাড়ালো। নৈতিকতার শেষ বিন্দুটিও যখন ফুরিয়ে যায় তখন মিথ্যাবাদীরা নিজেদের দূর্বলতা ঢাকতে হিংস্র হয়ে উঠে।

প্রত্যেক নেতা তার গোত্রের নওমুসলিমদের, প্রত্যেক মালিক তার ইসলাম দীক্ষিত গোলামদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতে থাকে । নবীজির (সঃ) উপর আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে খাদীজা (রা) এর পূর্বতন স্বামী পক্ষের পুত্র হারিস শহীদ হন। অপরদিকে আবু জেহেল এর অমানবিক নিপীড়নে শহীদ হন ইয়াসির পতœী সুমাইয়া (রা)। অত্যাচারের বিভীষিকা থেকে এমনকি আবু বকর (রা) কিংবা খোদ নবী (সঃ) পর্যন্ত রেহাই পাননি ।

এই নির্মম পরিস্থিতির মাঝেও মুমিনরা অটল অবিচল থাকার একমাত্র কারণ ছিলো- দৈহিক কষ্টের বিনিময়ে আত্মিক মুক্তি লাভ। আল্লাহর সন্তুষ্টি, দ্বীনের প্রতি একনিষ্ঠতা, রাসূলের (সঃ) প্রতি সীমাহীন আনুগত্য এবং অন্তরের প্রশান্তির তুলনায় শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জুলুমের তুফান তো কিছুই নয় ।

ইসলাম বিরোধিতার মূল রহস্যঃ-

কূটনীতি ও বাণিজ্যিক অভিজ্ঞানে পরিপুষ্ট কুরাইশরা চাইতো রাজনৈতিকভাবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে আরব উপদ্বীপে প্রভাব বিস্তার করতে। এমনকি কোন গোত্রে একজন প্রতিভাবান কবির আবির্ভাব হলেও অন্যান্য গোত্রের উপর তাদের প্রভাব বেড়ে যেতো; আর সেখানে একজন নবীর আবির্ভাব হলে তো কথাই নেই। তাই মক্কাবাসীরাও মনে প্রাণে চাইতো তাদের মধ্য থেকে একজন নবী আসুক। কিন্তু নবী-আগমনের পর তাঁর বিরোধিতার হেতু কি?

নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে এবং পরে মুহাম্মদ (সঃ) কুরাইশের কাছে সমানভাবে সম্মানিত ছিলেন।তিনি আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন মক্কার সর্বজনবিদিত ব্যাংক স্বরূপ। পূর্বে যেমন তাঁকে তারা আল-আমিন উপাধি দিয়েছিলো, তেমনি পরেও যে তিনি তেমনি ছিলেন হেরাক্লিয়াসের নিকট তার সাক্ষ্য দিয়েছিলেন স্বয়ং আবু সূফিয়ান (তখনও তিনি অমুসলিম ছিলেন) । পবিত্র কুরআনও সে কথাই বলছে-“আমি জানি তারা যা বলে তা আপনাকে ব্যথিত করে, তারা তো আপনাকে অস্বীকার করে না; বরং জালিমরা আল্লাহর বাণীকেই অস্বীকার করে থাকে” । তাহলে তাঁকে কষ্ট দেয়ার কারণ কি?

যদি বলা হয় কুরাইশরা তাদের নেতৃত্ব হারানোর ভয়ে একাজ করেছিলো- তবে তা হবে আংশিক সত্য। কারণ ইতোপূর্বেই আমরা জেনেছি কুরাইশরা নবীজি (স)কে নেতৃত্বের প্রস্তাবও দিয়েছিলো। তাহলে তাদের আর বাকী থাকে কি?

মূলত তাদের ভয় ছিলো সেই প্রভূত্ব হারানোর- যা তারা আল্লাহর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো। যে প্রভূত্বের কল্যাণে তারা সাধারণ জনতাকে পুতুলের মত নাচাতো, পছন্দমত বিধান চাপিয়ে দিতো। যদি সেই ক্ষমতা তারা হারায় তাহলে যে তাদেরকে সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে আসতে হবে… তাই নবী আবির্ভাবের সাথে সাথে তাদের ঠিক সেই অনুভূতিটাই হলো যেটা চুরি করার পর পথে পুলিশ দেখে চোরের হয় । আল্লাহ্ পাক সেটাই বলছেন ভিন্নভাবে-“যারা আল্লাহর আয়াত নিয়ে আপনার সাথে বিতর্ক করে কোনরূপ প্রমাণ ছাড়াই, তাদের অন্তরে অহংকার ছাড়া কিছুই নেই…অথচ সেটাতে তারা পৌছবার নয়” ।

আর সেসব নেতৃবর্গের জবরদস্তিতেই সাধারণ স্তরের কাফেররাও ইসলামের বিরোধিতা করতে বাধ্য হয়েছিলো। কেয়ামতের দিন “আল্লাহর সামনে তাদের সবাইকে উপস্থিত করা হবে, তখন দূর্বলেরা অহংকারকারীদের বলবে- আমরাই তো তোমাদের আনুসারী ছিলাম। এখন আল্লাহর আজাব থেকে তোমরা কি আমাদের কোনোভাবে বাঁচাতে পারবে?” ।

নও মুসলিমদের অত্যাচার করার পরোক্ষ একটি কারণ ছিলো- তাদের সে অসহনীয় কষ্ট দেখে যেনো অন্যরা ইসলাম গ্রহন করতে পিছপা হয় ।

প্রাচ্যবিদরা নতুন একটি মিথ ছড়িয়ে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। তা হলো- “মুহাম্মদ (সঃ) আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানে কাজ করেছিলেন, তিনি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন…”। যা একটি হাস্যকর মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ ইতিহাস বলছে, নবীজি (সঃ) আরবজাতির প্রচলিত সমস্ত কুকর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত বিধান নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিলেন; যা সম্পর্কে তাদের ধারণাই ছিলোনা ।

হিতে বিপরীতঃ-

কুরাইশদের নিপীড়ন পরোক্ষভাবে যে কয়টি উপকার করেছিলো তার মধ্যে হামযা ও ওমর (রা) এর ইসলাম গ্রহণ ও আবু তালিবের সহযোগিতার ঘটনা অন্যতম। হামযা (রা) এর ইসলাম গ্রহনের দরুন কুরাইশদের মনোবলে ভাটা পড়ে। ওমরের মাধ্যমে ইসলামে আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্য উপকরণ সরবরাহ হয়। ফলে কাফেরদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে পড়ে। আর আবু তালিবের প্রত্যক্ষ সমর্থন না হলে ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাস কতটা ভিন্নতর হতো বলা মুশকিল। ইসলামের অংকুরোদম কালে সর্বাধিক সমর্থনদাতা এই মানুষটি একেবারে আলোর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেও কেনো যে ইসলাম অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিলেন তা এখনো ইসলামী ইতিহাসবিদদের কাছে জটিল রহস্য। কিছু কিছু বিষয় আল্লাহ্ তাআলা রহস্যাবৃত রাখেন যার উত্তর খুজে পাওয়া কঠিন।

জ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম মানযিলঃ-

সাফা পর্বতে লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থিত সাহাবী আরকামের বাড়ীটিই ছিলো মূলত মুসলমানদের শিক্ষাকেন্দ্র। সেখানে কুরআন শিক্ষার পাশাপাশি নামাজ আদায় করা হতো। সেই সাথে পরামর্শ সভা হতো আগত পরিস্থিতির মোকাবেলায় কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করতে। চলতো বুদ্ধিভিত্তিক জ্ঞানচর্চা এবং কলাকৌশলের অনুশীলন । তাই দারুল আরক্বাম ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শিক্ষাকেন্দ্রই শুধু নয়, বরং মানবেতিহাসের সর্বপ্রথম SCHOOL OF THOUGHT । নবীজি নিজে প্রকাশ্যে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন; কিন্তু দারুল আরক্বামে সাহাবাদের সাথে মিলিত হতেন গোপনে…যেনো তাঁর কর্মফলে কোন মুসলমানকে ভুগতে না হয়।

নাজ্জাশীর সৌভাগ্যঃ-

যখন কাফেরদের মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার চরম সীমায় পৌছলো নবীজি (সঃ) পরীক্ষামূলকভাবে কিছু সংখ্যক সাহাবীদেরকে হাবশা অভিমুখে হিজরতের অনুমতি দিলেন। একই সাথে হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশী ইসলাম ও মুসলমানদেরকে কিভাবে গ্রহন করে তাও দেখতে চাইলেন। কারণ নাজ্জাশী সম্পর্কে ভালো কথাই তাঁর নিকট পৌঁছেছিলো।

সেবার বারোজন পুরুষ ও চারজন নারী সমেত দলপ্রধান উসমান বিন আফফান (রা) নবুয়তের পঞ্চম বছর রজব মাসে হাবশায় হিজরত করেন ।

দ্বিতীয় দফায় আরো কঠিন পরিস্থিতিতে ৮৩ পুরুষ ও ১৮ নারীর একটি দল হাবশায় হিজরত করে ।

সম্ভবত এ সকল মুহাজির মুসলমানদের সাথে সহাবস্থানের প্রভাবেই নাজ্জাশী ইসলামের দিকে ঝুকে পড়েন।

কূটনৈতিক কূটচাল বানচালঃ-

কুরাইশদের কিছুতেই বরদাশত হচ্ছিলনা মুসলমানরা তাদের হাত ফসকে অন্যত্র চলে যাওয়াটা। তারা দুইজন বাগ্মী ও বিচক্ষণ পুরুষ আমর বিন আস ও আব্দুল্লাহ বিন আবি রাবীআকে হাবশায় পাঠায় নাজ্জাশীকে ভুলভাল বুঝিয়ে নিরীহ মুসলমানদের আবার অত্যাচারের স্টীম রোলারের নিচে নিয়ে আসার জন্য। প্রথমেই তারা উৎকোচ দিয়ে মুসলমানদের হীন পরিচয় দিয়ে নাজ্জাশীর দৃষ্টি অন্যত্র ফিরাতে চাইলো। জাফর বিন আবি তালিবের অনবদ্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী বক্তব্যে তা দুমড়ে মুচড়ে যায়। পরদিন তারা তুনীরের শেষ তীরটি ছুড়লো; একেবারে নাজ্জাশী ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে। এবারো জাফর (রা) তাঁর প্রতিভার ঢাল দিয়ে তা প্রতিহত করেন । ফলে কুরাইশকে সেবার কূটনৈতিক পরাজয় বরণ করতে হয়। এবং অন্যদিকে নাজ্জাশীও ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষ থেকে অনেক উপকৃত হন ।

সূর্যালোককে মেঘে ঢাকার অপচেষ্টাঃ-

হযরত ওমরের (রা) আগমনে মুমিনদের মাঝে নতুন মনোবল সৃষ্টি হলো। শুরু হলো প্রকাশ্যে দ্বীনি কর্মকান্ড। এবার কাফেররা চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য গোপন সভা ডাকল। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে বয়কট করা হলো, এই মর্মে একটি ঘোষণাপত্র ঝুলিয়ে দেয়া হলো কা’বার দেয়ালে। মুষ্টিমেয় কতিপয় লোক একটা আদর্শের জন্য কী কঠিন সময় অতিবাহিত করেছেন তা কাগজের অক্ষরে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। জাগতিক ইতিহাসে এর অনুরূপ ঘটনার দ্বিরুক্তি নেই। এমন সংগ্রামের সময়কালে আবু তালিব তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছিলেন। আর প্রতিদিন সবাই ঘুমানোর পর নবীজির (সঃ) বিছানায় তাঁর সন্তান, ভাই কিংবা ভ্রাতুষ্পুত্রকে শুইয়ে দিতেন যাতে গুপ্তহামলা হলেও মুহাম্মদ (সঃ) বেচে যান ।

প্রকৃতপক্ষে মুহাম্মদ (সঃ) ও তাঁর আত্মীয়দের অবরুদ্ধ করে কুরাইশরা নিজেদেরই ক্ষতি করেছিলো। কেননা পূর্বে মুসলমানদের কর্মকান্ড কুরাইশদের সম্মুখে হতো বলে তাঁদের তৎপরতা সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল থাকতে পারতো। কিন্তু এখন মুসলমানরা যেনো নিজেদের দূর্গে, তাঁদের হয়তো পানাহারে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে কিন্তু নিজেদের অঞ্চলে যেনো তাঁরা পূর্ণ স্বাধীন এবং সুপরিকল্পিত তৎপরতার অধিকারী। কাফেররা যেনো নিজেরাই অন্তরীণ হয়ে পড়লো।

ভবিষ্যতের বদর-উহুদ-খন্দকেরই কি ট্রেনিং দেয়া হয়ে গেলো শীআ’বে আবু তালিবে তিন বছরের সে অবরুদ্ধ সময়ে? দীর্ঘ তিন বছরের অবরোধে মুসলমানরা যখন আগুনে পোড়া খাটি স্বর্ণ কাফেররা তখন নিরাশ হয়ে অনুতাপে পুড়ছে। অবশেষে আল্লাহর প্রত্যক্ষ সিদ্ধান্তে চুক্তিপত্র ছিন্নভিন্ন করলো কিছু পোকা…। বিজয় হাতে মুসলমানরা বেরিয়ে আসলো খোলা প্রান্তরে।

নব দিগন্তের সন্ধানেঃ-

তিন বছরের ভয়াবহ কষ্টের ধকল সইতে না পেরে বৃদ্ধ আবু তালিব মারা গেলেন ছয় মাস পর। তার কিছুদিন পরেই ইন্তিকাল করলেন হযরতের সংগ্রামমুখর মক্কী জীবনের সর্বক্ষণের সাথী খাদীজা (রা) । আক্ষরিক অর্থেই নবীজি (সঃ) এখন সর্বহারা। পার্থিব নিয়মে এই দুটি মৃত্যু তাঁকে মক্কার জমিনে একেবারে নিরাশ্রয় করে দিলো। তারপরও থেমে থাকেনি তাঁর দাওয়াতী কাজ। ফাঁকে ফাঁকে তিনি খুঁজতে লাগলেন ইসলামের নতুন উর্বর ক্ষেত্র । শোকে সংকটে এক দুর্বহ অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিপন্ন দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন পৃথিবীর দিকে। হযরত অনুধাবন করলেন দ্বীনের বিজয় একমাত্র হিজরতেই নিহিত। প্রথমেই তাঁর মনে হলো “তায়েফ”, “হাজর” ও “ইয়ামামার” কথা। তিনি অনতিবিলম্বে “তায়েফ” যাত্রা করলেন। সেখানে থেকে মনোবেদনা নিয়ে রওয়ানা হলেন “বনী কেনানা”র অভিমুখে। কিন্তু সেখানেও সন্তোষজনক উপাদান খুজে পেলেন না। অবশেষে মক্কায় ফিরে আসলেন মুতঈম বিন আদীর আশ্রয়ে ।

অভিনব পন্থায় অভূতপূর্ব সাফল্যঃ-



নবুয়তের দশম বছর (৬১৯ খৃঃ জুনের শেষ কিংবা জুলাইর শুরু) হজের মৌসুম আসলো। দলে দলে আরবের নানা প্রান্তর থেকে লোকজন আসতে শুরু করলো মক্কার দিকে। এই সুযোগটাকে নবীজি কাজে লাগালেন পুরোদমে। প্রত্যেক কাফেলার কাছে কাছে গিয়ে নবীজি দাওয়াত দিতে লাগলেন। সেই সাথে আশ্রয় এবং সাহায্য প্রার্থনাও করলেন। এভাবে বনু কালব, বনু হানীফা, বনু আমের সহ ইয়াসরিব থেকে আগত ছয় জনের একটি দলকেও তিনি নতুন দ্বীনে আমন্ত্রণ জানান । অভাবনীয়ভাবে সেই ছয়জনের দলটি ইসলামের বীজ বহন করে নিয়ে যায় মদীনার বুকে।

বিশ্বনিয়ন্তার আমন্ত্রণেঃ-

মি’রাজের তারিখ নিয়ে নানান মতামত থাকলেও সম্ভবত আকাবার প্রথম শপথের কিছুদিন পূর্বে কিংবা আকাবার দুই শপথের মাঝে এ অভিসার সম্পন্ন হয় । এই সময়টাকে বেছে নেয়ার কারণ এই হতে পারে যে, ভবিষ্যতের ইসলামী রাষ্ট্রের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক ও সামাজিক কর্ম-পরিকল্পনার রূপরেখা সম্পর্কে হযরতকে সম্যক জ্ঞান দান করা।

মহানবী (সঃ) এর ‘ইসরা’ ও ‘মিরাজ’ নিছক কোনো সফর ছিলোনা। এ ছিলো বহুমাত্রিক, ত্রিজাগতিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক একটি ভ্রমণ; যার পরতে পরতে ছিলো শিক্ষা, অভিজ্ঞান এবং রহস্যের ফুলঝুরি। আমরা মিরাজের কিছু চিত্তাকর্ষক বিষয় উপস্থাপনের চেষ্টা করবো-

* হযরতের বক্ষ বিদারণ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের “OPEN HEART SURGERY” এর চাইতেও অনেক অনেক বেশি উন্নত ছিলো। কেননা বর্তমান সময়ের নভোচারীদের শুধুমাত্র হৃৎপিণ্ড পরীক্ষা করা হয়, কারণ তারা পৃথিবীর মাত্র ৫২ মাইল বায়ুমণ্ডল অতিক্রম করে। কিন্তু নবীজি (সঃ) মহাশূন্যের সর্বশেষ বিন্দু অবধি বিচরণ করেছেন। তাই তাঁর হৃৎপিণ্ড অত্যাধিক হালকা করার প্রয়োজন ছিলো।আল্লাহ্ বলেন-“ আমি কি আপনার বক্ষ বিদীর্ণ করিনি? আমি আপনার (বক্ষ থেকে) সরিয়ে দিয়েছি ভারী বস্তুকে। যা আপনার পিঠকে অবনমিত করছিলো” ।

“তাঁর (নবীজির) বক্ষচ্ছেদ ও ঈমান দিয়ে তা পরিপূর্ণ করার প্রকৃত বাস্তবতা হলো- ফেরেশতীয় নূরের প্রাধান্য এবং স্বভাবজাত আগুনের নির্বাপন। সেই সাথে পবিত্র স্বত্তার সাথে সাক্ষাতের জন্য প্রস্তুতিকরণ” ।

* “বোরাক” শব্দের অর্থ বিদ্যুৎ। যার অভিন্ন রূপই হচ্ছে আলো। “সৃষ্টিজগতে একটি চরম বেগ রয়েছে যার থেকে বেশি বেগবান হওয়া সম্ভব নয়। সেই বেগটি পেতে পারে শুধু আলো- যার কোনো ভর নেই” । তখন আলো সময়ের ব্যয় ছাড়াই যেকোনো দুরত্বে যেতে সক্ষম। জিবরীলের নূরের আলো, বোরাকের আলো ও হযরতের অভ্যন্তরে প্রতিস্থাপিত আলো এবং গতির মাঝে ছিলো পূর্ণ সামঞ্জস্য ।

* সমস্ত নবীগণের সাথে সাক্ষাৎ ও নামাযের মূল রহস্য হলো-“যেহেতু পবিত্র স্বত্ত্বার সাথে তাঁদের সকলের রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক; তাই সেই স্বত্ত্বার সাথে মিলিত হওয়ার পূর্বে তাঁদের সাথে মিলিত হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। আর হযরতের পূর্ণ গুণাবলীর প্রেক্ষিতে ইমামতির ঘটনাটি ঘটে” ।

* “সিদরাতুল মুনতাহা হচ্ছে অস্তিত্বের বৃক্ষ। যা এক অংশের উপর অন্য অংশ বিন্যস্ত হয়, এবং একটি অভিন্ন ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণে মিশ্রিত থাকে, যেভাবে পার্থিব বৃক্ষ উর্বরতা ও সঞ্জীবনীর মধ্যে মিশে থাকে…” । বর্তমান নভোবিজ্ঞানের ভাষায় এই ‘সিদরাতুল মুনতাহা’কেই সম্ভবত “SPACE FRONTIER” ।

* “বায়তুল মা’মুর হচ্ছে মূলত খোদায়ী ঐজ্জ্বল্য- যেখানে মানবজাতির সিজদা এবং ইবাদাতসমূহ মিলিত হয়ে একটি মসজিদের রূপ নেয় পার্থিব কা’বা ও বায়তুল মাকদিসের উপরে” ।“এই বায়তুল মামুর কিছুই নয়, মক্কার কা’বা গৃহেরই সত্যরূপ (NOUMENON), অর্থ্যাত মক্কার কা’বা বায়তুল মামুরেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি…এ্টা নিছক ধ্যান বা কল্পনার জগত (WORLD OF IDEAS)” ।

* মিরাজের ঘটনায় এই ইঙ্গিত রয়েছে যে ভবিষ্যতে মানুষ মধ্যাকর্ষণ শক্তিকে জয় করে উর্ধ্বপানে যাবে। মিরাজের ঘটনা প্রমাণ করে মুহাম্মদ (সঃ) ছিলেন মানবেতিহাসের সর্বপ্রথম সফল নভোচারী ।

এছাড়া নবীজির (সঃ) রোজ কেয়ামতের ঘটনাবলী দর্শন প্রমান করে “টাইম ট্রাভেল” মানুষের পক্ষে সম্ভব যদি আল্লাহ্ তাআলা চান।


মদীনামুখি দুটি তরঙ্গঃ-

নবুয়তের দ্বাদশতম বছরে হজের মৌসুমের সাথে সাথে মদীনা থেকে বারোজন সৌভাগ্যবান ‘আক্বাবা’র প্রান্তরে হযরতের সঙ্গে মিলিত হলেন এবং ইসলামের উপর বায়আত নিলেন। নবীজি (সঃ) তাঁদের সাথে মুসআব বিন উমাইর (রা) কে প্রেরণ করলেন দ্বীন শিক্ষা দেয়ার জন্য । যেনো তিনি মদীনায় বহন করে নিয়ে গেলেন ইসলামের এক অমিয় ঝর্ণাধারা। পরের বছর সত্তরজনেরও অধিক মদীনাবাসী একই স্থানে হযরতের সাথে মিলিত হয়। এ বছর খোদ তাঁদের মধ্য থেকেই ১২ জনকে নির্বাচিত করা হলো বায়আত রক্ষার দায়িত্বশীল স্বরূপ। মদীনা পাণে ছুটে গেলো আরো একটি অমিয় তরঙ্গ।

হিজরত যদি হয় মদীনায় ইসলামের নতুন অভিযাত্রা, আকাবার শপথদ্বয় ছিলো সেই যাত্রার প্রাক-ডেলিগেশন স্বরূপ। মুসলমানরা এখন মুক্তির প্রান্তিক সীমায় উপনীত।

সম্মিলিত অপপ্রয়াসঃ-

শয়তানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় কুরাইশরা এবার হযরতকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিলো; তারা দেখলো এটাই শেষ সুযোগ, নইলে মুহাম্মদকে (সঃ) আর বাগে পাওয়া যাবেনা। এদিকে অহী মারফত হযরতও জানলেন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে। নিজের বিছানায় আলী (রা) কে রেখে পরম সাথী আবু বকর (রা) নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এক দুর্গম পথে।

অহী প্রাপ্তির প্রাক্কালেই ওয়ারাকার কাছ থেকে হযরত জেনেছিলেন তাঁকে একদিন এই সহস্র শত্রু পরিবেষ্টিত জনপদ ছাড়তে হবে। সেই থেকেই হযরতের প্রাত্যহিক চিন্তা চেতনায় ছিলো দ্বীনের নতুন ক্ষেত্র বিনির্মানের পরিকল্পনা। বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় সাহাবীদের আগেই বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী অঞ্চলে প্রেরণ করে দেয়া হযরতের প্রজ্ঞার নিদর্শন। যার ফলে একদিকে মুসলমানরা যেমন পেয়েছে নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই, তেমনি ভৌগলিক পরিমন্ডলে ইসলাম পেয়েছে প্রচার ও প্রসার।

আন্তর্জাতিক বলয়ে ইসলামঃ-

নিঃসন্দেহে হযরতের হিজরতের মাধ্যমে ইসলাম তার আঞ্ছলিকতার আঙ্গিনা পেরিয়ে পৌছে যায় আন্তর্জাতিক ও আন্তর্জাগতিক বলয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই ইসলামের সেই ছোট্ট চারাগাছটি পরিণত হবে সুবিশাল মহীরুহে। যার শীতল ছায়ায় পথের দিশা পাবে হাজারো বিপথু।

অনেক অনেকদিন পরে কেউ যখন নবীজির (সঃ) এই সংগ্রামী জীবন নিয়ে লিখতে বসবে সত্যি অবাক না হয়ে পারবেনা।

রেফারেন্স-

. সফিউর রাহমান মোবারকপুরী রচিত الرحيق المختوم ,দারুল ওয়াফা কর্তৃক প্রকাশিত ১৯তম

সংস্করণ।

. আবুল হাসান আলী নদভী রচিত “নবীয়ে রহমত”,আবু সাঈদ মুহাম্মদ ওমর আলী

অনূদিত।

. আস সীরাতুন নাবাউইয়্যা-দুরুসুন উয়া ইবার।মুস্তফা সীবাঈ।দারুল ওয়াররাক-২০০২।

.( صحيح البخاري ,(. باب كيف كان بدء الوحي إلي رسول الله

. শাহ অলীউল্লাহ দেহলবী বিরচিত (حجة الله البالغة) ১ম সংস্করণ,২০০৫। ২য় খন্ড, (أبواب شتي)

. فتح الباري= ১॥

. মুহাম্মদ কুতুব রচিত كيف نكتب التاريخ الاسلامي. , দারুশ শুরুক, ১৯৯৫,

. বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা। একবিংশতিতম মুদ্রণ,আহমদ পাব্লিশিং হাউস।পৃ=৯১।(চলিত ভাষায়

রূপান্তরিত)

. নবীয়ে রহমত, পৃ= ১৪২।

. إبن هشام. ১॥

. পড়–ন সূরা সোয়াদ, কলম, আনাআম, হিজর, মুতফফিফিন, আম্বিয়া, ফুরকান, শুআরা, যুখরুফ, ক্বাফ, জাসিয়া ইত্যাদি।

. তাবাকাত ইবনে সাদ। ৩য় খন্ড, পৃ-৮২। ইবনে হিশাম (আকরাম ফারুক অনূদিত) বাংলাদেশ

ইসলামিক সেন্টার- অষ্টাদশ প্রকাশ- ২০১২। পৃ= ৬৩-৭১ দ্রষ্টব্য।

. থিওরী অফ রিলেটিভিটি, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। মাওলা ব্রাদার্স।২য় মুদ্রণ-২০০৮।

. বৈজ্ঞানিক মুহাম্মদ (দঃ)। মুঃ নুরুল ইসলাম। ৩য় খন্ড। মম প্রকাশ, ২য় মুদ্রণ-মার্চ,২০০৪।

বিস্তারিত পড়তে-

বিষয়: বিবিধ

১৯২৬ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

297104
২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:১২
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:১৯
240575
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ, তবে এতো তাড়াতাড়ি কমেন্ট করলেন .মনে হচ্ছে যেন পুরোটা পড়ে দেখেননি। পুরোটা পড়লে কথা দিচ্ছি কিছু নতুন ইনফরমেশন পাবেন।
আবারো ধন্যবাদ।
297112
২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:৪৭
udash kobi লিখেছেন : অসম্ভব ভালো লাগল। ধন্যবাদ
২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:০৮
240611
স্বপ্নের ফেরিওয়ালা লিখেছেন : আপনার মন্তব্যে সত্যি উদাস হয়ে গেলাম।
রবিউল আউয়াল মাসে ছোট্ট একটি প্রচেষ্টা ছিলো এটি। ব্লগে বেশি থাকিনা, তাই মোটের উপর লেখার চেয়ে ব্লগে পড়ি বেশি। ধন্যবাদ
297205
২৬ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০২:১৯
আফরা লিখেছেন : স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ভাইয়া স্বপ্ন ফেরি করতে কোন এলাকায় আছেন আপনাকে যে দেখায় যায় না ------ লেখাটা অনেক ভাল লিখেছেন অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File