(সপ্তর্ষিমণ্ডল) যাদের কবি কবি ভাব তাদের জন্য
লিখেছেন লিখেছেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০১:৩১:০৪ দুপুর
বিংশ শতাব্দির ঊষালগ্ন থেকেই বিশ্বের বুকে অতি যত্নের সাথে তিলে তিলে গড়ে তোলা মুসলিম মহাসভ্যতার সুদৃঢ় দালানে চিড় ধরতে শুরু করে। আরো পরে একসময় তা ভেঙ্গে পড়ে তাসের ঘরের মতো, কিছু মুসলিম কুলাঙ্গারদের কৃতকর্মের ফলে। মুসলমানদের নেতৃত্বের তারকা অবস্থান নেয় অস্তাচলে, টলমলে হয়ে উঠে তাদের অস্থিত্ব। কবি ফররুখের বর্ণনায় সে পরিস্থিতিটা স্পষ্ট ফুটে উঠে—
শুধু গাফলতে, শুধু খেয়ালের ভুলে
দরিয়া-অথৈ ভ্রান্তি নিয়াছি তুলে
আমাদের ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি
দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা-শশী;
মোদের খেলায় ধূলায় লুটায়ে পড়ি
কেঁদেছে তাদের দুর্ভাগ্যের শর্বরী।।
মুসলিম সমাজের অসি শক্তি ক্ষয় হয়ে গেলেও মসি শক্তি ছিল সম্পূর্ণ অটুট, কারন কালের আবর্তনে ইসলামী সাহিত্য-সংস্কৃতি আরোহন করেছিল সমৃদ্ধির সবোর্চ্চশৃঙ্গে। তাই এই সংকটময় ক্রান্তিকালে মসি প্রতিভারা কোমর বেঁধে নেমে পড়েন অসিবাহকদের হৃদয়ের নিভু নিভু অঙ্গারে আবার সংগ্রামী স্ফুলিঙ্গ জ্বালতে। প্রতিশোধের আগ্নেয়গিরিত সাহসিকতার অগ্ন্যুৎপাত জাগাতে। মুসলিম যুবসমাজের অন্তরে আবারো দ্বীনের ঢেউ তুলতে।উদ্বুদ্ধ করার এই সংগ্রামী অভিযানে যিনি সবচে আগ্রগামী ছিলেন তিনি হলেন উপমহাদেশের কাব্য-প্রতিভা, কবিসম্রাট ডঃ ইকবাল। মুসলিম সমাজের অন্তসারশুন্য দেহে চেতনা ফিরিয়ে আনতে তাঁর প্রচেষ্টা ছিলো অনুপম।তার অন্যতম একটি উদ্দীপকঃ-
তুমি এক তরবারি, নিজের খাপ থেকে বাইরে এসো
বাইরে এসো, বাইরে এসো, বাইরে এসো
সম্ভাবনাকে ঢেকে ফেলা সব পর্দা ফেলো ছিঁড়ে
চন্দ্রকে নাও, সূর্যকে ধরো, নক্ষত্রকে পুষো
মুসলিমদের হস্তার্জিত পাপের প্রায়শ্চিত্যের দিকে ধাবিত করতে তাঁর প্রয়াসটি ছিলোঃ-
‘যে তরু তুলেছে আকাশেতে শির
আমারি জলের সেচনে আজ
কে পারিবে তার নোয়াইতে মাথা?
লাজে ফিরে যাবে দীপ্ত বাজ।
নতুন দিনের নব কর্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে তিনি রচনা করেনঃ-
‘বাহু তো তোমার বলীয়ান তাতে তৌহীদ করে শক্তিদান
স্বদেশ তোমার ইসলাম জেনো, মুসলিম তুমি মুক্ত প্রাণ।
পুরাতন সেই দৃশ্য আবার নূতন যুগেরে দেখিয়ে যাও
মুসলিম তুমি? তবে তো এ নব মূর্তিরে আজ গুঁড়িয়ে দাও।’ (জাতীয়তাবাদ )
মুসলিমের আত্মমর্যাদায় আঘাত হেনে তিনি উস্কে দিতে চাইলেন তার আত্মবিশ্বাসঃ-
অসনে বসনে খৃষ্ট তোমরা, হিন্দু তোমরা সভ্যতায়
তুমি মুসলিম? যাহারে দেখিয়া ইহুদিও লাজে মরিয়া যায়!
সৈয়দ কেহ মীর্জা কেহ বা আফগান কেহ তোমরা হও,
সব কিছু তুমি, বলতো এখন, মুসলিম তুমিও হও কি নও?’
বাংলার মাটিতে যারা এ ভয়াবহ অবস্থা-পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের মধ্যে কবি নজরুল ছিলেন অন্যতম।কারন তিনি একাধারে যেমন কলমসৈনিক ছিলেন তেমনি ছিলেন একজন অকুতোভয় বীরসৈনিক;বিশ্বযুদ্ধে যোগদান যেমন করেছেন,ব্রিটিশদের মসনদে ‘বিদ্রোহ’র গোলা নিক্ষেপও করেছেন অবলীলায়।বন্দুকের গুলির চেয়ে কলমের নিশানা যে প্রচণ্ডতর অব্যর্থ তার প্রমান অনবদ্য সৃষ্টি“বিদ্রোহ”।বাংলার মুসলমানদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র দেখে তিনি অঙ্গিকার করলেন-
আমি সেই দিন হবো শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল
আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না।। ( খালেদ )
তেমনি মানবতার অধিকার আদায়েও তিনি ছিলেন সোচ্চার-
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান !
যুগযুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে দিতে হবে অধিকার।।(কাণ্ডারি হুশিয়ার,সর্বহারা)
কবি গোলাম মোস্তফা(১৮৯৭-১৯৬৪) নেমেছিলেন একেবারে কোমর বেধে।মুসলিম সমাজের ঐতিহ্য,গৌরব আর শ্রেষ্ঠত্ব আবার মনে করিয়ে দিতে তিনি রচনা করেছিলেন “হিন্দু-মুসলমান” কবিতা যা চরম সমালোচিত হয়েছিলো নাস্তিক,ধর্মনিরপেক্ষ আর উগ্রহিন্দু সমালোচকদের দ্বারা।
তবে সবচে বেশি যিনি সমালোচিত আর নিন্দিত হয়েছিলেন ধর্মীয় গোঁড়াপন্থি, ইসলাম দরদি বলে তিনি হলেন মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদুত ফররুখ আহামদ (১৯১৮-১৯৭৪)। কতভাবে কতকরে যে তিনি মুসলিম যুব-সমাজকে আশান্বিত করার, উদ্যমী করার, অগ্রগামী করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন তার ইয়ত্তা নেই।কখনো মুসলিমদের অবহেলার নিন্দা করে-
ঘন সন্দল কাফুরের বনে ঘোরে এ দিল বেহুশ
হাতীর দাতের সাঁজোয়া পরেছে শিলাদৃঢ় আবলুস
পিপুল বনের ঝাঁঝালো হাওয়ায় চোখে যেন ঘুম নামে
নামে নির্ভীক সিন্ধু শকুন দরিয়ার হাম্মামে ।।(সিন্দাবাদ )
কখনো তাদের নাজুক পতনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে-
কালো মাস্তুলে ঝড়ের কান্না শুনেছি একলা জেগে
শুনেছি কান্না রাত জেগে দূর মরুভূর কুলে কুলে
বাদামের খোসা এসেছিলো এক ভেসে তুফানের বেগে
আমার বুকের সকল পর্দা উঠেছিলো দুলে দুলে।। (দরিয়ার শেষ রাত্রি )
কখনোবা তাদের পুরনো ঐতিহ্য মনে করিয়ে দিয়ে-
কায়খসরুর স্বপ্ন কংকালের ব্যর্থ পরিহাস
জীবাণুর তনু পুষ্টি করিয়াছে কবে তাদের লাশ।। (এইসব রাত্রি )
কখনো যুব সমাজকে নতুন অভিযানের স্বপ্ন দেখিয়ে-
নতুন পানিতে সফর এবার হে মাঝি সিন্দাবাদ
পাকে পাকে ঘুরে তীরবেগে ছুটে আবর্তে দিশেহারা
ক্ষুধার ধমকে ঘাস ছিড়ে খেয়ে আকাশে জাগায়ে সাড়া
জালিমের চোখ আগুনে পোড়ায়ে গুড়ায়ে পাপের মাথা
দেখেছি সবুজ দরিয়া জাজিমের স্বপ্ন রয়েছে পাতা।। (সিন্দাবাদ)
আবার কোনও সময় তাদের অবহেলা-গাফ্লতি-আলস্য দেখে হেঁকে উঠেন-
আজকে তোমার পাল উঠাতেই হবে
ছেড়া পালে আজ জুড়াতেই হবে তালি
ভাঙ্গা মাস্তুল দেখে দিক করতালি
তবুও জাহাজ আজ উঠাতেই হবে।। (সাত সাগরের মাঝি )
তাঁর বিখ্যাত ‘পাঞ্জেরী’ কবিতা মুসলিম পুনরজাগরনের অনন্য মন্ত্র-
পাঞ্জেরী
জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রূকুটি হেরী
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রূকুটি হেরী
দেখ চেয়ে দেখ সূর্য উঠার কত দেরী,কত দেরী! (পাঞ্জেরী)
তাঁর পবিত্র ইচ্ছা তিনি ব্যক্ত করেছেন কাব্যে-
তৌহিদে রাখি দৃঢ় বিশ্বাস
আমরা সৃজিব নয়া ইতিহাস
দেবো আশ্বাস দুনিয়ার বুকে
দেখাবো নতুন পথ।।
এভাবে পুরো একটা কবিদল নেমেছিলো কলমযুদ্ধে- যাঁদের ব্রত ছিল মুসলিম যুবকদের মাঝে জাগৃতি সৃষ্টি করা। শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বের কবি বলয় এগিয়ে এসেছিলো এ আন্দোলনে-সংগ্রামে, তাদের পরিচয় এককথায় শাহাদাত হোসেনের ভাষায়-
নবশাহানামা ফেরদুসী রচে-মস্নবি রচে রুমী
খাইয়াম জাগে নব রুবাআ’তে সাকীর পেয়ালা চুমি
সাদীর সাধনা, হাফিজের ধ্যান নবযুগ রূপায়ন
ইকবাল-হালী-গালেবের মাঝে লোভেছে চিরন্তন।।
আসুন, মুসলিম নব প্রজন্মের নব জাগরণের জন্য আবার একটি কবি বলয় তৈরী করি আমারা সবাই মিলে।।
বিষয়: সাহিত্য
১৬৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন