প্রচলিত ক্ষুদ্রঋন (Micro Credit)-এর শরীআ ভিত্তিক বিকল্পের খোঁজে-

লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ২৭ জুলাই, ২০১৫, ০১:৪৭:৫৭ রাত

(লেখাটি একটি বিশেষ সভায় ক্ষু্দ্রঋণের শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে একটি সম্ভব্য মাধ্যম খুঁজে বের করার প্রয়াশ হিসেবে প্রস্তাবরুপে পঠিত ও পেশ করা হয়েছিলো। উপস্থিত সকলের প্রশংসা ও আগ্রহের ভাজন হওয়া স্বত্ত্বেও এখণ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হতে পারেনি। যদি এরুপ কোন কিছুর প্রতি কেউ আগ্রহী হন তাহলে যথাসম্ভব সহযোগীতা করতে পারলে খুশী হবো। )



সমস্ত প্রশংসার একমাত্র মহান রব্বুল আ’লামিনের জন্য, যিনি নিঃসন্দেহে সকল কর্তৃত্বের একমাত্র ও একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এক ফোঁটা পানি হতে, তাকে দান করেছেন সমস্ত নেয়ামত, ধন্য করেছেন অসংখ্য দক্ষতা ও ক্ষমতা দিয়ে, সর্বোপরি জীবনে পথ প্রদর্শনের জন্য দিয়েছেন প্রজ্ঞাময় গ্রন্থ আল কুরআন। অতঃপর আমরা তার কোন কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবো? অগণিত দুরূদ ও সালাম মানব জাতির ইতিহাসের শ্রেষ্টতম মানব, দুই জগতের বাদশাহ, সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শনকারী, সমগ্র মানব জাতির পর্থ প্রদর্শক, আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর। হে আহমাদ (সাঃ)! আপনার জন্য আমার জান, মাল, পরিবার সবই উৎসর্গ হোক। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) সুযোগ্য সহ-ধর্মীণিগন- যারা বিশ্বাসীদের মা, তাঁর (সাঃ) আসহাবগন-যারা একেক জন এক একটি নক্ষত্রের ন্যায়; তাঁর (সাঃ) আহালগন; মহান আল্লাহ যাদের জান্নাতে উঁচু মাকামের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- তাদের সকলের প্রতি লাখো সালাম। সালাম সেই সকল মহামানবদের প্রতি, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ইসলামী ইলম ও ফিকাহ আজ এত সুবিন্যস্ত যে জন্ম থেকে মৃত্যু, ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র, বাণিজ্য থেকে দান; কোন কিছুই এর আওতার বাহিরে নেই। আল্লাহ তাদের কবরকে জান্নাতী আলোয় আলোকিত করুন- আমীন।

ভূমিকা: ” أَحَلَّ اللّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا” আল্লাহ ব্যবসায়ে বৈধ করেছেন, আর সূদকে করেছেন অবৈধ।”(১)

ইসলাম সাম্য ও ন্যায়পরতার ধর্ম। স্বভাবগত ভাবেই ইসলাম মানুষের উপর মানুষের শোষন-অত্যাচার মূলক নীতি-রীতি ও ব্যবস্থাকে অস্বীকার করেছে। সূদ ব্যবস্থা অনুরূপ একটি শোষন মূলক ব্যবস্থা। এর ভয়াবহতার প্রতি লক্ষ্য রেখে ইসলাম সূদকে শুধু অবাঞ্চিত ঘোষনাই করেনি, তীব্র ভাষায় এর কঠোর নিন্দা ও সমালোচনাও করেছে। এমনকি সুদের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে সরাসরি আল্লাহও তার রাসূলের (সাঃ) বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার হুমকিও দেয়া হয়েছে। (২)

দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রত্যেকেই এই সূদ নামীয় গজবের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছি। তবে এর মূল শিকারে পরিণত হচ্ছে সমাজের নিম্নশ্রেণীর মানুষ, বিশেষত: ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাগণ। ৩য় বিশ্বের স্বল্পোন্নত একটি দেশে ব্যবসায়ীক বিনিয়োগ সক্ষম মানুষের সংখ্যা নগন্য। তেমনিভাবে পুন:লগ্নী তথা চাহিদা অনুপাতে পুঁজির যোগানের সামর্থ্যও খুবই সীমিত। এর সাথে যোগ হয় বিনিয়োগ অক্ষম বেকার শ্রেণি। স্বভাবতই এই দুই শ্রেণির মানুষ খুব সহজেই ক্ষুদ্র ঋণ (Micro Credit)-এর জালে পতিত হয় এবং সুদের যাতাকলে পিস্ট হতে থাকে। এর ফলস্বরূপ বেশ কয়েকটি দূর্ঘটনা, কোলাহ এমনকি অপমৃত্যুর সংবাদও আমাদের কাছে অবিদিত নয়।

একটি পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের একটি স্বকীয়, সম্বৃদ্ধ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে। বিনিয়োগ, পুঁজি, লেনদেন ইত্যাদি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রনে রয়েছে সুষ্টু ও সুষম কাঠামো। ব্যবসায়িক লগ্নী বা বিনিয়োগে পুঁজির যোগান সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানকল্পে রয়েছে মুশারাকা (Joint Financing Policy) বা যৌথ বিনিয়োগী কারবারের কয়েকটি বাস্তবধর্মী ও ফলপ্রশূ স্বরূপ যথা:

(ক) শিরকাতুল মিলক (মালিকানায় অংশিদারিত্ব/Joint Ownership),

(খ) শিরকাতুল আমওয়াল (পুঁজিভিত্তিক অংশিদারিত্ব/Capital based partnership),

(গ) শিরকাতুল আ’মাল (শ্রমভিত্তিক অংশিদারিত্ব/Labor based partnership),

(ঘ) শিরকাতুল ওয়াজুহ (সুনাম ভিত্তিক অংশিদারিত্ব/Reputation based partnership) এবং

(ঙ) মুদারাবা (Investment Policy) ইত্যাদি।

অতীত হতে অদ্যাবধী এই ব্যবস্থাসমূহের প্রয়োগ ওয কোন সুদী ব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর প্রমানিত হয়েছে। পাশাপাশি সুদী ব্যবস্থার মতো কোন এক পক্ষকে অন্যায় ভাবে অধিক লাভবান এবং অপর পক্ষকে ক্ষতিগ্রস্থ বা বঞ্চিত করা হয়নি, শোষণের তো কথাই আসে না।

কিন্তু লক্ষনীয় যে, উপরোক্ত পদ্ধতিসমূহ আভ্যন্তরিন বা পারস্পরিক সমঝোতা মূলক বিনিয়োগ অভূতপূর্ব ফলাফল আনলেও কেন্দ্রিয় বিনিয়োগ বা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ যথা ব্যাংক ইত্যাদির ক্ষেত্রে কিছু বিরূপ ও তিক্ত অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়। এর মূল কারণ উক্ত ব্যবস্থা সমূহের ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা নয়, বরং বর্তমান যুগে মানুষের মধ্যে সততা, ইনসাফ, ঈমানদারী ও ন্যায়পরতার অভাব। ফল ব্যাংক বা সমমনা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সমূহকে উক্ত ব্যবস্থাসমূহ প্রয়োগ হতে ফিরে আসতে বাধ্য হতে হয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা ভাবতে বাধ্য হই ভিন্ন কোন উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে কি না? এর পরিপূর্ণ ও সম্পূরক কোন বিকল্প আদৌ আছে কি না?

যে মহান আল্লাহ সর্বময ক্ষমতার মালিক, যিনি ইসলামকে পূর্নাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষনা করেছেন, তাঁর জ্ঞানের বাহিরে কিছু নেই। তিনি এরও বিকল্প ও সম্পূরক ব্যবস্থা বহু আগেই সৃষ্টি করে রেখেছেন । আমাদের অজ্ঞতা ও অক্ষমতাই উক্ত ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের অনবহিত রেখেছে। অপরদিকে মহান রব তার হাবিবের (সাঃ) মাধ্যমে সেই জ্ঞান ইসলামী ফিকহের বাতিঘর মুজতাহিদদের মধ্যে প্রতিফলিত করেছেন। তাই ফিকহের সাগর মন্থন করতেই বেরিয়ে এলো ক্ষুদ্র ঋণ (Micro Credit)-এর শক্তিশালী শরঈ বিকল্প ”মুরাবাহা লিল বাইয়ে মুআজ্জাল (المرابحة ليل باي المعجل)”

মুরাবাহা লিল বাইয়ে মুআজ্জাল কি : মুরাবাহা (مرابحة) শব্দটির অর্থ “ক্রয়-বিক্রয়” বাইয়ে মুআজ্জাল (باي المعجل) বলতে “বিলম্বিত, পরবর্তী, বাকীতে লেনদেন” ইত্যাদি বোঝায়। সুতরাং মুরাবাহা লিল বাইয়ে মুআজ্জাল শব্দের প্রায়োগিক অর্থ দাঁড়ায় “বিলম্বে বা পরবর্তীতে মুল্য পরিশোধের শর্তে ক্রয়-বিক্রয়।” সহজ বাংলায় যাকে বলে বাকীতে বিক্রি।

সুতরাং, মুরাবাহা লিল বাইয়ে মুআজ্জাল বলতে এমন একটি ক্রয়-বিক্রয়কে বোঝানো হয় যেখানে ক্রেতা বিক্রেতা হতে একটি পণ্য ক্রয় করে মূল্য পরবর্তী সময়ে দেওয়ার, অর্থাৎ বাকীর শর্তে। এক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধের সময় সীমা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতিতে নির্ধারণ করা যেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি হলো, এই লেনদেনের ক্ষেত্রে বিক্রেতা চাইলে পণ্যের মূল্য চলমান বাজার দরের চেয়ে বেশি দাবী করতে পারে (বাকীর শর্তযুক্ত হওয়ায়)। এবং এই অতিরীক্ত মূল্য মেয়াদের ভিত্তিতে কম-বেশী হতে পারে। মেয়াদ বেশী হলে মূল্যও বেশী হবে, মেয়াদ কম হলে মূল্যও কমে যাবে (উদাহরণ ”ক” দ্রষ্টব্য)। তবে এই ক্ষেত্রে অবশ্যই মূল্য পরিশোধের মেয়াদ ও সর্বমোট মূল্য উভয়টি লেনদেনের পূর্বেই স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হতে হবে এবং এর উপর ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি থাকতে হবে। অন্যথায় লেনদেন অবৈধ বিবেচিত হবে (উদাহরণ ”খ” দ্রষ্টব্য)।

উদাহরণ ”ক”: হাসান তার দোকানের জন্য 32 cuft মানের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের একটি ফ্রিজ কিনতে চাচ্ছেন, কিন্তু এই মুহুর্তে কিনতে পারছেন না। হুসাইন তা মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এবং বাকীতে বিক্রি করার কারণে তিনি উক্ত ফ্রিজের মূল্য ১২,০০০/- রাখবেন, যদিও উক্ত ফ্রিজের চলমান বাজার মূল্য ১০,০০০/-। কিন্তু হাসান বললেন, তিনি ৬ মাসের মধ্যে মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন না। বরং ৮ মাস সময়ের মধ্যে পরিশোধ করতে পারবেন। এই প্রেক্ষিতে হুসাইন বললেন, তাহলে ফ্রিজের মূল্য ১৩,০০০/- দিতে হবে। হাসান এই প্রস্তাবে রাজি হলেন। অতঃপর উভয়ের সম্মতিতে বিক্রয়টি উপরোক্ত শর্তে সম্পন্ন হলো।-এই ক্ষেত্রে লেনদেনটি বৈধ বিবেচিত হবে।

উদাহরণ ”খ”:: জামিল তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্টানের জন্যে একটি Core I3 মডেলের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের কম্পিউটার কিনতে আগ্রহী, কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় পারছেন না। শাকিল তাকে জানালেন তিনি তার চাহিদা অনুযায়ী কম্পিউটার বাকীতে সরবরাহ করতে রাজি আছেন, কিন্তু শর্ত হলো কম্পিউটারের মূল্য ৬ মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এবং বাকীতে বিক্রি করার কারণে তিনি উক্ত কম্পিউটারের মূল্য ৪৫,০০০/- রাখবেন, যদিও উক্ত কম্পিউটারের চলমান বাজার মূল্য ৪০,০০০/-। উভয়ের সম্মতিতে বিক্রয়টি উপরোক্ত শর্তে সম্পন্ন হলো। কিন্তু ৬ মাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার কিছুদিন পূর্বে জামিল শাকিলকে জানালেন তিনি বিশেষ কোন কারণে উক্ত মেয়াদের মধ্যে মূল্য পরিশোধ করতে পারছেন। তাই তিনি মেয়াদ বৃদ্ধির অনুরোধ করলেন। শাকিল জানালেন তিনি আরো মেয়াদ আরো ২ মাস বৃদ্ধি করতে রাজি আছেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাকে পূর্বনির্ধারিত মূল্য ৪৫,০০০/- এর পরিবর্তে ৪৭,০০০/- দিতে হবে। জামিল এই শর্তে সম্মতি জানালে শাকিল ২ মাস সময় বৃদ্ধি করেন। -এই ক্ষেত্রে লেনদেনটি বৈধ বিবেচিত হবে না।

শরঈ দৃষ্টিকোণ থেকে মুরাবাহার বৈধতা : সর্বপ্রথম একথা স্পষ্ট রূপে মনে রাখতে হবে, মুরাবাহা গতানুগতিক কোন বিনিয়োগ বা পুঁজি নীতিমালা নয়। শরঈ দৃষ্টিকোণ হতে আদর্শ বিনিয়োগ পদ্ধতি হলো মুশারাকা ও মুদারাবা, মুরাবাহ শুধু মাত্র ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত নীতিমালা।

মুলত : লেনদেন ও ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির ক্ষেত্রে দুটি প্রধান শর্ত সর্বাগ্রে প্রযোজ্য (র) অনুমোদন ও (রর) বৈধতা। অর্থাৎ চুক্তিটি শরঈ অনুমোদন প্রাপ্ত হতে হবে এবং লেনদেনের নির্ধারিত পণ্যটি অবৈধ হবে না। সেদিক থেকে মুরবাহা লিল বাইয়ে মুআজ্জালের পক্ষে কোন স্পষ্ট দলীল নেই। কিন্তু এর নিষেধাজ্ঞা বা কাছাকাছি পর্যায়ের লেনদেনের (যার সাথে এই লেনদেনের সাদৃশ্য থাকায় কিয়াস করা যেতে পারে) উপর নিষেধাজ্হা সম্বলিত কোন বিধানও কুরআন-সুন্নাহতে পাওয়া যায় নি। ইসলামী ফিকহে ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেনের ক্ষেত্রে নীতিমালা হলো, সে ব্যবসা বা লেনদেনকে সরাসরি অবৈধ ঘোষনা করা হয়নি, সে ব্যবসা বা লেনদেন বৈধ। সে দিক বিবেচনা করে ফুকাহায়ে কিরাম এই পদ্ধতির লেনদেনকে ”মুবাহ” পর্যায়ভূক্ত বলে মতামত দিয়েছেন।(৩)

অবশ্য কিছু সংখ্যক আলেম এই পদ্ধতির ক্রয়-বিক্রয়কে অবৈধ হিসেবে মত দিয়েছেন। তাদের কয়েকজনের মতে ”এটা সুদী লেনদেনেরই ভিন্ন রূপ”।

এই মতামতের সমালোচনা করে আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী (দা.বা.) বলেন, ”এই যুক্তিটি বাহ্যিক দৃষ্টিতে যৌক্তিক মনে হলেও মূলত তা শরীয়তী সুদ নিষিদ্ধ হওয়ার উসূলের ভুল বোঝাবুঝির উপর নির্ভরশীল। ব্যাপারটি সঠিকভাবে বুঝার জন্য মুদ্রা ও পণ্য বিনিময়ের মধ্যে পার্থক্যগুলি মনে রাখা জরুরী।”(৪)

সঙ্গত কারণেই অধিকাংশ উলামায়ে হক্ব এই লেনদেনটিকে বৈধতা দান করেছেন। প্রসিদ্ধ চার মাযহাব এবং হাল আমলের গঈরে মুকাল্লিদিন আলেমগণের বেশিরভাগই এই মতের অনুসরণ করেছেন। এবং এই মত গ্রহনের মূল ভিত্তি আমরা ইতোপূর্বেই সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন আমরা মাযহাবী ফকীহদের এ সংক্রান্ত মতামতগুলো দেখবো।

উক্ত বিষয়ে আলোচনা কালে সিংহশতাংস উলামা নিম্নোক্ত আয়াতে কারিমার অর্ন্তনিহিত সারমর্মমে দলীল হিসেবে পেশ করেন।

মহান আল্লাহ কুরআনে ইরশাদ করেন,

” الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لاَ يَقُومُونَ إِلاَّ كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُواْ إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَن جَاءهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىَ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللّهِ وَمَنْ عَادَ فَأُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ”

”যারা সূদ খায় তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি যাকে শয়তান আসর করে মোহাবিষ্ট করে দেয়। তাদের এই অবস্থার কারণ এই যে, তারা (ইহুদিরা) বলতো, ব্যবসা তো সুদের মতোই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন আর সুদকে করেছেন অবৈধ। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং সে বিরত হয়েছে, পূর্বে যা হয়ে গেছে, তা তার। তার ব্যাপার আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। আর যারা পুনরায় সুদ নেয়, তারাই দোযখে যাবে। তারা সেখানে চিরকাল অবস্থান করবে। ”(৫)

এই আয়াতের ”ব্যবসাকে বৈধ করেছেন” অংশই মূল আলোচ্য বিষয়। এই আয়াতাংশের সম্পর্কে মালেকী মাযহাবের আলেম ইবন রূশদ আল জিদ্দ ”আল মুকাদ্দিমাত” গ্রন্থে বলেছেন, “যে সকল ব্যবসাকে ইসলাম নিষেধ করেনি, সেগুলো সবই জায়েয।”

হানাফি মাযহাবের বিখ্যাত গ্রন্থ আল হিদায়ায় ”মুরাবাহা” ও ”তাওমিয়া” অধ্যায়ে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ”উভয় ব্যবসা জায়েয। কেননা এগুলোতে বৈধতার শর্তাবলি পাওয়া যায়।” মুসান্নিফ আরো বলেন, ”এ ধরণের ব্যবসা খুবই প্রয়োজন।”(৬) এই অংশটুকুর ব্যাখ্যাকালে আল হুমাম বলেন, ”বাই মুরাবাহা’ ও ’বাই তাওলিয়া’ জায়েয হওয়ার জন্য বিশেষ কোন দলীলের প্রয়োজন নেই, বরং সাধারণভাবে ব্যবসার জায়েয হওয়ার বৈধতার দলিলই তার সুনির্দিষ্ট শর্তাবলীসহ দুটি ব্যবসা জায়েয হওয়ার দলীল।(৭)

তাবাকাতে হাম্বালিয়ার আলেম শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার (রহ.) বক্তব্য “লেনদেনের ক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাহ যেগুলোকে নিষেধ করেছে সেগুলোকে ব্যতীত বাকী সমস্ত লেনদেন মুবাহ। এক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে, কিতাব-সুন্নাহ যাকে হারাম বলেছে তা ব্যতীত মানুষের প্রয়োজনীয় অন্যান্য লেনদেনকে হারাম বলা যাবে না।”(৮)

আরেকটি সুন্দর ও উপযোগী ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইমাম শাফেঈ (রহ.)। তিনি বলেন, ”সকল ব্যবসার মূলনীতি হলো, যদি ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের সন্তুষ্টি এমন বস্তুর ক্ষেত্রে হয়, যা বেচাকেনা বৈধ, তাহলে তা ”মুবাহ” বা ”জায়েজ”। তবে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) যা স্পষ্টভাবে নিষে: করেছেন এবং যা নিষেধের অর্থবহন করে তা হারাম। আর যা কিছু এর বাইরে রয়েছে উক্ত আয়াতের আলোকে সেগুলোকে আমরা জায়েজ বলবো।”(৯) ইমাম নববী (রহ.) ও উক্ত মতকেই সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ বলে স্বীকার করেছেন।(১০)

উপরোক্ত ভিত্তিতে উলামায়ে মাযহাবে আরবাআ মুরাবাহা ভিত্তিক ক্রয়-বিক্রয়কে মুবাহ বা বৈধ শ্রেণিভূক্ত মনে করেন এবং এটি জায়েজ হওয়ার ফাতওয়া দেন।

সাহাবায়ে কিরামগনের বক্তব্য ও আমলও উক্ত রায়ের পক্ষেই যায়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, কোন পণ্যের ক্ষেত্রে একথা বলতে অসুবিধা নেই যে, নগদ হলে এত দাম আর বাকীতে হলে এত দাম। তবে উভয় সন্তুটির ভিত্তিতেই হতে হবে।(১১)

গঈরে মুকাল্লিদিন আলেমের মধ্যে ইবনে বায, বদর আল মুতাওয়াল্লী, ইউসুফ আল কারাযাভী সহ অনেকেই উক্ত লেনদেনকে জায়েয হিসেবে ফাতওয়া দিয়েছেন। এছাড়াও ১ম ও ৩য় ইসলামী ব্যাংক সম্মেলনে আলেমদের একটি কমিটিও সমার্থক ফাতওয়া দিয়েছেন।

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত উলামায়ে কিরামের অনেকেই এই মতের পক্ষে রায় দিয়েছে, অর্থৎ উক্ত শ্রেণির ক্রয়-বিক্রয়কে বৈধ বলে ফাতওয়া দিয়েছেন। এই উলামাদের মধ্যে অন্যতম

=> হাকিমুল উম্মাত আশরাফ আলী থানভী রহ.(১২),

=> মুফতি মুহাম্মাদ শফী রহ.(১৩),

=> মুফতি মাহমুদুল হাসান গাঙ্গুহী রহ.(১৪),

=> মুফতি কেফায়েতুল্লাহ দেহলভী রহ.(১৫),

=> মুফতি আব্দুর রহিম লাজপুরী রহ.(১৬),

=> মুফতি রশীদ আহমাদ রহ.(১৭),

=> মুফতি হামিদুল্লাহ জান সাহেব রহ.(১৮),

=> পাকিস্তানের জামিয়া বিন্নুরীয়ার ফাতওয়া(১৯),

=> মাওলানা হিফজুর রহমান সেওহারভি রহ.(২০), এবং

=> আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী দা.বা.(২১) একই মত দিয়েছেন।

সূতরাং, উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে ও আকাবীর উলামায়ে কিরামের সুস্পষ্ট ফাতওয়ার দলীলে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ”মুরাবাহা লিল বাইয়ে মুআজ্জাল” নিঃসন্দেহে শরীআ অনুমোদিত একটি মুবাহ বা জায়েজ শ্রেণির ব্যবসা ও লেনদেন।

বিশেষ সতর্কতা: মুরাবাহা লিল বাইয়ে মুআজ্জাল চুক্তির সময়ে কিছু বিষয়ে অবশ্যই সর্তকর্তা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় চুক্তি বাতিল হিসেবে গণ্য হবে।

১. চুক্তিটি অবশ্যই লিখিত রূপে হতে হবে

২. চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ে অবশ্যই পণ্যের নাম, বিবরণ, নির্ধারিত মূল্য, পরিশোধের মেয়াদ ও নিয়ম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এর পর উভয় পক্ষ সম্মত হলেই চুক্তি সম্পাদন করা যাবে।

৩. যে পণ্যের উপর চুক্তিটি সম্পাদিত হবে তা অবশ্যই হয় বিক্রেতার হাতে মওজুদ থাকতে হবে অথবা বাজারে সহজলভ্য হতে হবে। দূর্লভ অথবা সন্দিহান কোন পণ্যের উপর চুক্তি করা যাবে না।

৪. ইসলাম অনুমোদিত নয়, এমন কোন পণ্যের উপর চুক্তি করা যাবে না।

৫. চুক্তির মেয়াদ ও নির্ধারিত মূল্য পরিবর্তন করা যাবে না। বিশেষ অবস্থার ভিত্তিতে মেয়াদ সামান্য বৃদ্ধি করা হলেও, পণ্যের মূল্য কোন অবস্থাতেই বৃদ্ধি করা যাবে না। তবে স্বাভাবিক হারে বিলম্ব জরিমান প্রযোজ্য হতে পারে।

৬. সর্বাবস্থায় কুরআন-সুন্নাহ বর্ণিত উপায় গ্রহণ করতে হবে, এর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ কোন ক্রমেই নেয়া যাবে না। (২২)

তথ্যসূত্র:

১. সূরা বাক্বরা, আয়াত: ২৭৫

২. সূরা বাক্বরা, আয়াত: ২৭৬

৩. ইবনু কাইয়্যিম, ইলামুল মুআক্কিঈন, খন্ড:১, পৃ:৩৮৫

৪. ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থায়ন পদ্ধতি, সমস্যা ও সমাধান, পৃ: ১০৫-১০৮

৫. সূরা বাক্বরা, আয়াত:২৭৫

৬. হিদায়া, খন্ড: ৫, পৃ:২৫১-২৫৩

৭. ফাতহুল ক্বদীর, উল্লেখিত অংশের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য

৮. মাজমাউ ফাতাওয়া, খন্ড: ২৮, পৃ: ৩৮৫-৩৮৬; আস সিয়াসাতুশ শারিয়্যা

৯. আর রিসালা, খন্ড: ৩

১০. আল মু’জামি, খন্ড: ৯, পৃ: ১৪৬

১১. মুসান্নাফে আবি শাইবা

১২. ইমদাদুল ফাতওয়া, খ:৩, পৃ:২০

১৩. ইমদাদুল মুফতিয়ীন, পৃ:৮৬০

১৪. ফাতওয়া মাহমুদীয়া [পুরাতন] খ:৪, পৃ:১৭৫

১৫. কেফায়েতুল মুফতি, খ:৮, পৃ:২৭-১৮

১৬. ফাতওয়া রহিমীয়া [জাদীদ-খন্ডিত], খ:৯, পৃ:১৯৫-১৯৭

১৭. আহসানুল ফাতওয়া, খ:৮, পৃ:২৯

১৮. পাকিস্তানের মিযান ব্যাংকের উপর লিখিত ফাতওয়া, পৃ:৭

১৯. ফাতওয়া বাইয়্যিনাত, খ:৪, পৃ:১২৩

২০. ইসলামী ব্যাংকিং ও অর্থায়ন পদ্ধতি, পৃ: ৯৬-৯৭

২১. ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, পৃ: ১৯৫

২২. বিস্তারিত মুফতী তাকি উসমানি রচিত ”ইসলামী ব্যাংকি ও অর্থায়ন পদ্ধতি, মুরাবাহা পদ্ধতি অধ্যায়”, একই লেখকের ”সুদ বিহীন ব্যাংকি” ও ড. ইউসুফ আল কারাযাভি রচিত ”ইসলামী ব্যাংকিং-এ মুরাবাহা” বইসমূহে দ্রষ্টব্য

ফেসবুকে এখানে; ভিজিট করে কমেন্ট করলে উৎসাহিত হবো



বিষয়: বিবিধ

২৩৫২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

331895
২৭ জুলাই ২০১৫ সকাল ০৯:১৭
রক্তলাল লিখেছেন : উদ্যোগ বা চিন্তাধারা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
যে কোন ভালো কাজের জন্য প্রয়োজন এমন ক্ষেত্র যাখানে মুক্তভাবে তা করতে পারেন।

যেমন ভালো ফুটবল খেলতে প্রয়োজন নিরপেক্ষ এবং ঘুষমুক্ত রেফারী ও আয়োজক/কর্মকর্তারা।
আপনি যদি ভাল খেলতে থাকেন তা দেখে যদি রেফারী এসে টাকা দাবী করে বলে টাকা না দিলে ডিসকোয়ালিফাই করে মাঠ থেকে সরিয়ে দিবে তখন আপনি আর ঐ ভাল খেলাটা খেলতে পারবেন না।

বরং সন্ত্রাসী সাজিয়ে মাঠের আশে পাশে আসা ব্যান করে দিতে পারে।

আপনার ভাল চিন্তা আর কৌশল অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু, শয়তান যালিম যখন ঘাড়ে বসে থাকে জোর করে তখন অনেক ভাল কাজ করা মুশকিল।

আমার মতে সর্ব প্রথম কাজ জঞ্জাল সাফ করা।


২৭ জুলাই ২০১৫ সকাল ১০:৩৪
274125
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : কোন সন্দেহ নেই।
সমস্যা হলো, লাখো মানুষ সেই জঞ্জাল থেকে পরিত্রান চাইলেও এগিয়ে আসার মতো প্রত্যয় আছে মুষ্টিমেয় বা আারো কমের।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File