সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী ঐতিহাসিক বদর দিবস
লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ০৬ জুলাই, ২০১৫, ০৪:৩৭:০১ বিকাল
ফেসবুকে পড়ুনে এখানে
ভালো লাগলে একটা লাইক তো প্রত্যাশা করতেই পারি; তাই না!
রমজানুল মোবারকের আজ ১৭ তারিখ। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্দেশক মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল কারিম নাজিলের মাসে আজকের দিনটি অসাধারণ তাৎপর্যের অধিকারী। আজ ঐতিহাসিক বদর দিবস। হিজরি দ্বিতীয় সনের ১৭ রমজান মদিনা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে বদর প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছিল আল্লাহর একত্ব ও তার পাঠানো রাসূল সা:-এর প্রতি অবিশ্বাসী বিশাল সুসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসী মুষ্টিমেয় দলের প্রত্য সশস্ত্র লড়াই। তাতে মানুষের সব ধারণা নাকচ করে দিয়ে প্রায় উপকরণহীন মুষ্টিমেয় দলটিকে জয়ী করেন মহান রব্বুল আলামিন। সত্য -মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের ইতিহাসে সংযোজিত হয় নতুন অধ্যায়। তাই শুধু ইসলামের ইতিহাসে নয়, বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এ দিনটি অনন্য অবস্থান দখল করে রেখেছে।
আর এটা ছিল ইসলামের অস্তিত্বের লড়াই। এক দিকে সংখ্যালঘু ও নব্য মুসলমান অপর দিকে জিহাদ, তা-ও রমজানে। এটি সত্যিই ত্যাগের অনুপম দৃষ্টান্ত। মুসলমানদের গৌরবময় উজ্জ্বল ইতিহাসের স্বর্ণখচিত দিন। তাই এ দিনটি ঐতিহাসিক বদর দিবস নামে খ্যাত।মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর দীর্ঘ ১৩ বছর অতিবাহিত করেন মক্কায়। এরপর তিনি আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় বসবাসরত সাহাবীদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে মদিনায় হিজরত করেন। সেখানে তিনি গঠন করেন একটি ইসলামী রাষ্ট্র। তার সে রাষ্ট্র হিজরী দ্বিতীয় সনেই ইহুদিদের নানা হুমকির মুখে পড়ে। সিরিয়া থেকে ফেরার পথে মক্কার কাফেরদের একটি বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম শক্তির প্রতিরোধের মুখে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মক্কা থেকে এক হাজার কাফের সেনার একটি সশস্ত্র দল মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরে অবস্থিত ‘বদর’ ময়দানে এসে যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু হয়। এ অবস্থায় ৩১৩ জন সাহাবিকে নিয়ে রাসূল (সা.) রণেক্ষেত্র উপস্থিত হন। এ যুদ্ধের আগে আল্লাহর হাবিব মহানবী (সা.) সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। হৃদয় উজাড় করে প্রার্থনা করতে থাকেন। ‘হে প্রভু! আজ তুমি যদি মুসলমানদের এ ক্ষুদ্র দলটিকে সাহায্য না করো, এরা যদি নিশ্চিহ্নই হয়ে যায়, তাহলে তোমার মহিমান্বিত নামটি কে উচ্চারণ করবে? আর এ পৃথিবীর বুকে তোমার নাম উচ্চারণের কেউই তো থাকবে না।’নবী অসাধারণ ধৈর্য ও ত্যাগ-তিতিক্ষার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে ইসলামের শাশ্বত নূরের বাণী প্রচারে অগ্রসর হলেন। একদিকে নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকল। অন্য দিকে সত্যের গতিও হল অপ্রতিরুদ্ধ। যুলুম, নির্যাতন এতটাই বৃদ্ধি পেল যে, শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর হুকুমে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হলেন। কুরাইশরা এতেও ক্ষান্ত হল না। তারা ভাবল ইসলামের শক্তি সঞ্চয় প্রকৃতপক্ষে তাদের জাহেলী ব্যবস্থারই মৃত্যু ঘটার শামিল। অপর দিকে মক্কাবাসীদের জীবিকার একটি বড় উপায় ছিল ইয়েমেন ও সিরিয়ায় বাণিজ্য। আর যাতায়াতের পথ ছিল মদীনার উপর দিয়ে। সুতরাং মদীনায় মুসলমানদের শক্তি অর্জনের অর্থ ছিল তাদের চিন্তার কারণ। একদিকে বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা অপর দিকে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে যেভাবেই হোক, চিরতরে মিটিয়ে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। বাণিজ্য কাফেলা রক্ষার অজুহাত খাড়া করে মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করল। হিজরতের পর দু’বছরও অতিক্রান্ত হয়নি। সহায়, সম্বল সব হারিয়ে মুহাজিরগণ রিক্তহস্ত। আনসারগণ যুদ্ধ বিদ্যায় তেমন পারদর্শী নয়। অন্যদিকে ইহুদী গোত্র বিরোধিতার জন্য প্রস্তুত। খোদ মদীনায় মুনাফিক ও মুশরিকদের উপস্থিতি আভ্যন্তরীণ বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনি অবস্থায় কুরাইশরা যদি মদীনা আক্রমণ করে, তাহলে মুসলমানদের এই মুষ্টিমেয় দলটি হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। আর যদি হামলা না-ও করে বরং আপন শক্তিবলে শুধু কাফেলাকে মুক্ত করে নিয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে শত্রুরা মাথা তুলে দাঁড়াবে। ফলে মুসলমানদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। এই চরম সংকট কালে আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম আসলো “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ, তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে; আল্লাহ নিশ্চয় তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম”। (সূরা হাজ্জ-৩৯)। এসব কারণেই রাসূল (সা.) সিদ্ধান্ত নিলেন যতটুকু শক্তি আছে, তা নিয়েই ময়দানে টিকে থাকার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। যুদ্ধের সূত্রপাত দ্বিতীয় হিজরীর শা’বান মাস (ঈসায়ী ৬২৩ সালের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাস) কুরাইশদের এক বিরাট কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার পথে প্রত্যাবর্তনকালে মুসলিম অধিকৃত এলাকার কাছাকাছি এসে পৌঁছালো। কাফেলাটির সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার আশরাফী মূল্যের সামগ্রী এবং ৩০/৪০ জনের মত রক্ষী ছিল। তাদের ভয় ছিলো, মদীনার নিকটে পৌঁছলে মুসলমানগণ হয়ত তাদের ওপর হামলা করতে পারে। কাফেলার নেতা ছিল আবু সুফিয়ান। সে এই বিপদাশঙ্কা উপলব্ধি করেই এক ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্যে মক্কায় পাঠিয়ে দিল। লোকটি মক্কায় পৌঁছেই আরবের প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী উটের কান কেটে ফেলল, তার নাক চিরে দিল, উটের পিঠের আসন উল্টে দিল, নিজের জামা সামনের দিকে ও পিছনের দিকে ছিঁড়ে এই বলে চিৎকার করতে থাকল ‘হে কুরাইশগণ! তোমাদের বাণিজ্য কাফেলার খবর শোন। আবু সুফিয়ানের সাথে তোমাদের যে সম্পদ রয়েছে, মুহাম্মাদ তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে তার পেছনে ধাওয়া করেছে। তোমাদের তা পাবার আশা নেই। সাহায্যের জন্য দৌড়ে চল।’ কাফেলার সঙ্গে যে সম্পদ ছিল, তার সাথে বহু লোকের স্বার্থ জড়িত ছিল। ফলে এই সাহায্যের ডাকে সাড়া দিয়ে কুরাইশদের সমস্ত বড় বড় নেতাগণ যুদ্ধের জন্যে তৈরি হল। এভাবে প্রায় এক হাজার যোদ্ধা রণসাজে সজ্জিত হয়ে পূর্ণ আড়ম্বর ও জাঁক-জমকের সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে রওনা হল। এদের হৃদয়ে একমাত্র সংকল্প মুসলমানদের অস্তিত্ব এবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে, যেন নিত্যকার এই ঝঞ্ঝাট চিরতরে মিটে যায়। মুসলমানদের প্রস্তুতিকুরাইশদের এই সিদ্ধান্তের পর রাসূল (সা.) মুহাজির ও আনসারগণকে একত্রিত করে তাদের সামনে বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে বললেন, “একদিকে মদীনার উত্তর প্রান্তে রয়েছে ব্যবসায়ী কাফেলা আর দক্ষিণ দিক থেকে আসছে কুরাইশদের সৈন্য-সামন্ত। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, এর যে কোনো একটি তোমরা লাভ করবে। বল, এর কোনটির মুকাবিলা করতে চাও?” জবাবে বহু সাহাবী কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কিন্তু রাসূল (সা.)-এর দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই তিনি তাঁর প্রশ্নটি পূণরাবৃত্তি করলেন। এরপর মুহাজিরদের ভেতর থেকে মিকদাদ বিন আমর (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন : “হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনাকে যে দিকে আদেশ করেছেন, সেদিকেই চলুন। অপর দিকে এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আনসারদেরও মতামত গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। এজন্যে নবী (সা.) উল্লিখিত প্রশ্নটি পূণরাবৃত্তি করলেন। সা’দ বিন মায়াজ (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন : “হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আপনাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি এবং আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সবই সত্য বলে সাক্ষ্য দিয়েছি। সর্বোপরি আমরা আপনার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছি। কাজেই হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা কাজে পরিণত করে ফেলুন। সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তাহলে আমরা আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজনও পেছনে পড়ে থাকবে না। উভয় বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ও রণ সম্ভারবাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে সৈন্যদলেরই মুকাবিলা করা হবে, এটা কোন মামুলী সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ কুরাইশদের তুলনায় মুসলমানদের অবস্থা ছিল নেহায়েত দুর্বল। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে যারা (মুসলমানরা) যুদ্ধ করতে এগিয়ে এলেন, তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। এদের মধ্যে মাত্র দু’তিন জনের কাছে ঘোড়া ছিল। আর বাকি লোকদের জন্য ৭০টির বেশি উট ছিল না। রণ সম্ভারও ছিল একে বারেই অপ্রতুল। মাত্র ৬০ জনের কাছে ছিল বর্ম।অপর দিকে কুরাইশরা আবু জাহলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য নিয়ে রওনা হল। এ বাহিনীতে ১০০টি ঘোড়া, ৬০০টি বর্ম এবং প্রত্যেকেরই তরবারী ছিল। উট সংখ্যায় এতবেশি ছিল যে, প্রতিদিন তারা ৯বা ১০টি করে উট জবেহ করে খেত। সৈন্যরা প্রত্যেকেই যোদ্ধা ও যুদ্ধে পারদর্শী ছিল। সারী গায়িকা বাঁদীদল তাদের বাদ্যযন্ত্রসহ ছিল। তদুপরী সুরাকারূপী ইবলীসকে সঙ্গে নিল। এসব কারণেই কতিপয় মুমিনদের মনে ভীতির সঞ্চার হল। যা সূরা আনফালের (৫-৮) আয়াতে আল্লাহপাক উল্লেখ করেছেন। উভয় বাহিনী বদর প্রান্তরে যুদ্ধ-সম্ভার ও রসদ-পত্রের এই দৈন্যদশা সত্ত্বেও দ্বিতীয় হিজরীর ১২ই রমযান নবী করীম (সা.) আল্লাহর ওপর ভরসা করে মুষ্টিমেয় মুসলিম সৈন্য নিয়ে মদীনা থেকে যাত্রা করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)কে মসজিদে নববীর ইমাম এবং আবু লুবাবা (রা.)কে মদীনার প্রশাসনিক আমীর নিযুক্ত করলেন। নবী করীম (সা.) মুসলিম বাহিনীকে দু’ভাগ করলেন : আনসার ও মুহাজির। মুহাজির দলের পতাকা দিলেন আলী (রা.)কে। আনসার দলের পতাকা দিলেন সা’দ বিন মু’আয (রা.)কে। ডানে, বামে এবং পশ্চাৎ ভাগেও দলপতি নিযুক্ত করলেন। আর তিনি নিজে মুজাহিদ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। ১৬ই রমাযান রাসূল (সা.) বদর প্রান্তরে পৌঁছে একটি জায়গায় শিবির স্থাপন করলেন। অপর দিকে যুদ্ধক্ষেত্রের যে অংশটি কুরাইশরা দখল করল, উপযোগিতার দিক দিয়ে তা ছিল খুবই উত্তম। তাদের জমিন ছিল অত্যন্ত মজবুত। আশেপাশে পানির ভাল ব্যবস্থা ছিল। যুদ্ধ শুরুদ্বিতীয় হিজরীর ১৭ই রমযান, শুক্রবার রাত, সবাই রোজা রেখে ক্লান্ত। ঐ রাতে বৃষ্টি হল প্রচুর। মুসলিম বাহিনী ক্লান্ত দেহে রাতে ঘুমে বিভোর আছন্ন। আর রাসূল (সা.) সারারাত নফল নামাজ পড়লেন, আল্লাহর সাহায্য চাইলেন। শুক্রবার সকাল বেলা যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহর অভয় বাণী আসলো : “তোমরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ো না এবং চিন্তিতও হয়ো না! তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমাদের অন্তরে ঈমানের তেজ থাকে।” (আল-ইমরান ১৩৯)। আল্লাহপাক আরো বললেন : “আল্লাহর ইচ্ছা এটা যে, তিনি নিজ নির্দেশ দ্বারা সত্যকে সত্যরূপে প্রকাশ করবেন এবং কাফিরদের মূল কেটে ফেলবেন।” (আনফাল ৭ শেষাংশ)। অন্যদিকে আবু জাহল ফয়সালার দু’আ করল : ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দলটি তোমার নিকট প্রিয় ঐ দলটিকে সাহায্য কর।’ উত্তরে আল্লাহ জানালেন : “তোমরা যে ফয়সালা চেয়েছিলে তা তো তোমাদের নিকট এসেছে। তোমারা যদি (কুফরী থেকে) বিরত হও তবে সেটা হবে তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। আর যদি তোমারা পুনরায় (সীমা লংঘন) কর, তবে আমিও পুনরায় তোমাদের শাস্তি দিব। আর তোমাদের দল সংখ্যায় অধিক হলেও তোমাদের কোন কাজে আসবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মুমিনদের সাথে রয়েছেন।” (আনফাল ১৯)। প্রাচীন আরব প্রথানুযায়ী প্রথমে মল্লযুদ্ধ শুরু হল। হামযা (রা.)-শাইবার বিরুদ্ধে; আলী (রা.)- ওয়ালীদ বিন উতবার এবং উবাইদা বিন হারিস-উতবার বিরুদ্ধে। মল্লযুদ্ধে কুরাইশরা পরাজিত হওয়ার পরেই উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। এ সময় রাসূল (সা.) দু’আ করতে থাকলেন : “হে আল্লাহ! তোমার এ ক্ষুদ্র দলটি যদি আজ শেষ হয়ে যায়, তবে তোমার ইবাদত করার মত কেউ থাকবে না।” “এ সময় আল্লাহ ফেরেশতাদের বললেন : আমি তোমাদের সাথে আছি। সুতরাং তোমরা মুমিনদের অবিচল রাখো, আমি এখনই কাফেরদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দিব। কাজেই তোমরা তাদের গর্দানসমূহের উপর আঘাত কর এবং তাদের আঙ্গুল সমূহের প্রত্যেক জোড়ায় আঘাত কর।”(আনফাল ১২)। “এ সময় আল্লাহপাক আরও বললেন : আমি তোমাদেরকে এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করবো, যারা একের পর এক আসবে।”(আনফাল ৯ শেষাংশ )। তখন নবী (সা.) একমুষ্টি পাথুরে মাটি নিয়ে শা-হাতিল উজূহ্ বলে কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করলেন। এরপরই মুসলমান সেনারা এক যোগে কাফিরদের উপর ঝঁপিয়ে পড়লেন। আর অল্পক্ষণের মধ্যেই কাফেরদের বড় বড় নেতারা নিহত হতে লাগল। আরাফার দুই সন্তানই বদর যুদ্ধে অংশ নিল, যাদের বয়স ৮ বা ৯ মতান্তরে ১০। বড় সন্তান মুয়াজ যে আবু জাহেলকে হত্যা করেছিল। দুই ভাই মিলে উটের উপর বসা কুরাইশ নেতা আবু জেহেলকে হত্যা করে। মৃত্যুর সাথে সাথেই কুরাইশ সেনাদল ছত্র-ভঙ্গ হয়ে পালাতে লাগলো। মুজাহিদগণ দ্বিগুণ শক্তিতে বলিয়ান হয়ে কুরাইশ সৈন্যদের ধাওয়া করে, ৭০ জনকে নিহত এবং ৭০ জনকে বন্দী করলেন। মুসলিমগণ ইচ্ছা করলে এ সুযোগে আরো বহু সৈন্যকে নিহত করতে পারতেন। কিন্তু প্রেম ও করুণার মূর্ত প্রতীক মুহাম্মাদ (সা.)-এর অন্তর হতভাগ্য মানুষের বেদনায় কেঁদে ফিরছিল। তৎক্ষণাৎ তিনি আদেশ দিলেন; ওদেরকে মেরোনা। মুসলমানদের পক্ষে মাত্র ৬ জন মুহাজির এবং ৮ জন আনসার শহীদ হলেন। যুদ্ধে মুসলমানগণ আল্লাহর রহমতে বিজয় লাভ করলেন। বিশেষ করে নবীজী (সা.)এর ঐকান্তিক প্রার্থনায় আল্লাহতায়ালা অগণিত ফেরেশতার সাহায্যে মুসলমানদের বিজয় দান করেন।কঠিন পরীক্ষা ছিল যাদেরবদর যুদ্ধ ছিল নব্য প্রতিষ্ঠিত মুসলমানদের জন্য এক পাথরের মত কঠিন পাহাড়ের সমকক্ষ পরীক্ষা। বেশির ভাগ মুসলমান ছিল গরীব ও দুঃখী অভাবী মানুষ। এ যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল মক্কার মুহাজিরদেরকে। এদের প্রতিপক্ষ ছিল আপন ভাই-চাচা, বাবা-মামা, ফুফা-দাদা সহ আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি। কারো বাপ, কারো চাচা, কারো মামা আবার কারো ভাই ছিল তার তলোয়ারের লক্ষ্যবস্তু এবং নিজ হাতে তাদের হত্যা করতে হয়েছিল এসব কলিজার ধনকে। কত কঠিন ছিল এই সময়টি। নিজ হাতে গলায় বা পেটে চালাতে হয়ছিল ধারালো তলোয়ার। এ ধরনের কঠিন পরীক্ষায় একমাত্র তারাই টিকে থাকতে পারেন যারা পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সহকারে হক ও সত্যের সাথে সম্পর্ক জুড়েছে এবং মিথ্যা ও বাতিলের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করতে পুরোপুরী প্রস্তুত হয়েছে। এ ধরনের দুঃসাহস একমাত্র তারাই করতে পারে যারা সত্য আদর্শের ওপর ঈমান এনে তার জন্য নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হতে পারে। শেষ কথা প্রতি বছর ১৭ রমজান মুসলিম উম্মাহকে গৌরবময় সে বিজয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়। খোদায়ী কুদরতের অসীমতার প্রতি নতুন করে তাদের বিশ্বাস জোগায়। নিজের সব কামনা-বাসনা মহান আল্লাহর কুদরতের সামনে বিলীন করে দেয়। এতে ঈমানের যে গভীরতা ও দৃঢ়তা অর্জিত হয়, সেই শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে জীবন ও পরিবেশের সব পর্যায়ে খোদায়ী বিধানকে প্রাধান্য দেয়ার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সিয়াম পালনের সার্থকতা। হৃদয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতে সাফল্যের প্রবল বাসনা থাকলেই আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিজেকে পুরোপুরী উৎসর্গ করা যায় এবং যে কোন কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়।কিন্তু কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালা মুসলমানদেরকে বলে দিলেন : “তাদেরকে তোমরা হত্যা করোনি, বরং তাদের হত্যা করেছেন আল্লাহ” এমন কি, তিনি নবী (সা.) কে পর্যন্ত বলে দিলেন যে, “(বালু) তুমি ছুঁড়োনি, বরং ছুড়েছেন আল্লাহ এবং মুমিনদেরকে একটি উত্তম পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ করার জন্যেই এসব কিছু করা হয়েছে।”(আনফাল ১৮)। এভাবে মুসলমানদেরকে বলে দেয়া হল যে, প্রকৃতপক্ষে সমস্ত কাজের চাবিকাঠি রয়েছে আল্লাহর হাতে এবং যা কিছু ঘটে তাঁর নির্দেশ ও ইচ্ছানুসারেই ঘটে থাকে। মুমিনদের কাজ হচ্ছে আল্লাহ তা’য়ালার ওপর পুরোপুরী নির্ভর করা এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহ ও রাসূলের পূর্ণ আনুগত্য করা। এরই ভিতর নিহিত রয়েছে তাদের জন্যে সাফল্য।
এই দিনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী:
৮ম হিজরিঃ মক্কা বিজয়
১৩ হিজরিঃ পারস্য বিজয় শুরু
৩১ হিজরিঃ উত্তর আফ্রিকা বিজয় শুরু
৫৩ হিজরিঃ রোডস দ্বীপ বিজয় যা কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের রাস্তা সুগম করে
৯১ হিজরিঃ বিন যিয়াদের নেতৃত্বে স্পেন তথা পশ্চিম ইউরোপ ও বলকান বিজয় শুরু
৯২ হিজরিঃ বিরবাত উপত্যকার যুদ্ধে বিজয়
৫৮২ হিজরিঃ সালাহদ্বীন আইয়ুবির নেতৃত্বে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জেরুজালেম বিজয়
৬৩৮ হিজরিঃ এন্টিওখ বিজয়ের মাধ্যমে ক্রুসেডারদের শায়েস্তা
৬৫৮ হিজরিঃ তাতারের বিরুদ্ধে ডিসাইসিভ বিজয়
৮৩৭ হিজরিঃ গ্রীস বিজয় শুরু
ফেসবুকে পড়ুনে এখানে
ভালো লাগলে একটা লাইক তো প্রত্যাশা করতেই পারি; তাই না!
বিষয়: বিবিধ
২১৬৮ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বারকাল্লাহু ফিহী
চমৎকার পোস্ততির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন