ফরগটেন হিরোস- এ ট্রিবিউট টু দ্যা গ্রেটেস্ট মেন অন আর্থ- Forgotten Heroes- A tribute to the greatest men on earth ( পর্ব-০৪)
লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ০৭ নভেম্বর, ২০১৪, ০৭:৫১:৪২ সন্ধ্যা
মাওলানা গাজী ইমামুদ্দিন বাঙ্গালী (রহ.)
"হার লেহযা হ্যায় মোমিন কি ন্যায়ি শান, ন্যায়ি আন
গুফতার মে, কিরদার মে, আল্লাহ কি বুরহান!
ক্বাহহারি ও গুফতারি ও কুদ্দুসি ও যাবরোত
ইয়ে চার আনাসির হো তো বানতা হ্যায় মুসালমান।"
কতই না চমৎকার বলেছেন ড. ইকবাল (রহ.)! এটা যে শুধু কবি মনের কল্পনা নয়, এটাই প্রকৃত মুসলমানের পরিচয়, যা যুগে যুগে প্রমান করে গিয়েছেন আল্লাহর প্রকৃত মু'মিন বান্দারা, তাদের কর্মের মাধ্যমে।
**********************************************************
৬ই মে ১৮৩১ সাল।
ভোরের আলো ফুটতে থাকার সাথে সমান তালে বাড়ছে শত্রুপক্ষের এলোপাথাড়ি আক্রমনের গতি। ব্রিটিশদের অনুগত ও পোষ্য প্রায় ২০,০০০ শিখ সৈন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে ৭০০ মুজাহিদ সৈনিকের উপর। আল্লাহর উপর অদম্য ভরসা রেখেই লড়ে যাচ্ছে মুজাহিদ সৈন্য। কিন্তু কতক্ষণ? পঙ্গপালের মত শত্রুপক্ষ চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। মুসলমানদের শক্তিশালি প্রতিরোধ যেন কোন কাজেই আসছিলো না। মনে হচ্ছিলো, আল্লাহও বোধ হয় চাইছিলেন তার এই প্রিয় বান্দাগুলো অচিরেই জান্নাতের মেহমানদারী গ্রহন করুক।
এরই মাঝে একজন বীর সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে শত্র“দলের উপর, হানছে উপর্যুপুরী আক্রমন। পাশে পড়ে আছে সহযোদ্ধার ছিন্নভিন্ন লাশ, কিন্তু সেদিকে তাকানোর সময় এখন নয়। হঠাৎই চোখ পড়ল আমিরুল মুজাহিদীন সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভীর (রহ.) উপর। প্রচন্ড মুহুর্তে সিজদায় পড়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা করছিলেন, এমনি সময় কয়েকজন শত্র“ একত্রে হামলা কওে তার মাথাটি ছিন্ন করে দিলো। আঁতকে ওঠার আগেই টের পেলেন পিছন থেকে একে একে কয়েকটি বর্শা এসে বিদ্ধ হলো শরীরে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো, টের পেলেন রুধিরপাতের ফলে শক্তি পড়ে যাচ্ছেন। মাটিতে পড়ে আবছা দৃষ্টিতে দেখলেন আপন ভাইয়ের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। চারিদিকে শুধু মুজাহিদদের লাশ। আর পারলেন না, জ্ঞান হারালেন মুজাহিদ।
বালাকোটের এই বেদনাদায়ক স্মৃতি চিরকাল তাড়া করে বেড়াত তাঁকে। সেই সাথে বুকের ভেতর শুনতে পেতেন পরম শ্রদ্ধেয় শায়খ আমিরুল মুজাহিদীন সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভীর (রহ.) শেষ খুতবার শব্দ গুলো, ”আমার যদি মৃত্যু হয়ে যায়, আমার পরেও তোমরা অত্যাচারি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ জারি রেখো।” সেই প্রেরণা থেকেই ভাবতে থাকতেন কিভাবে শায়খের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করা যায়। এই মর্দে মুজাহিদ আর কেউ নন, ইনি বাংলার সিংহপুরুষ, বাংলাদেশীদের গর্ব, মুজাহিদ কমান্ডার মাওলানা গাজী ইমামুদ্দিন বাঙালি (রহ.)। ব্রিটিশকবলিত বাংলা-ভারত উপমহাদেশজুড়ে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রাম বা জিহাদ আন্দোলনে, বিশেষ করে সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভী শহীদ (রহ.) পরিচালিত আন্দোলনে মাওলানা গাজী ইমামুদ্দিন বাঙালি (রহ.) ছিলেন প্রথমসারির একজন কান্ডারি। ১৮২০ সাল থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত তিনি সে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে; নিবেদন, সমর্পণ, সংগঠন ও নেতৃত্ব নিয়ে।
কালজয়ী এই মহান পুরুষের জন্ম ১৭৮৮ সালে। গোলাম রসুর মোহর তাঁর জন্ম স্থান উল্লেখ করেছেন সুধারাম, হাজীপুর আর সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী লিখেছেন হাজীপুর, বাংলাদেশ। উভয়মত থেকে এবং অন্যান্য সূত্র থেকে বোঝা যায় তিনি নোয়াখালির হাজীপুওে জন্ম গ্রহন করেছিলেন। মাত্র ৩ বছর বয়সেই তিনি পিতৃহারা হন। তাঁর আম্মাজান আবারো পাণিগ্রহন করেন। কিন্তু সৎ বাবার ঘরে তিনি উপযুক্ত যতœ পাননি। একেপ্রকার অবহেলা আর বঞ্চনায় কাটে তার শৈশব।
দুঃখের বিষয়, বরং লজ্জার বিষয় যে এই মহান পুরুষের শৈশব, কৈশর ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানার কোন অবলম্বন নেই। সবচেয়ে লজ্জাজনক হলো, আমাদের বাংলাদেশের কোন মাধ্যম থেকেই বাংলার এ সিংহপুরুষ সম্পর্কে জানার কোন উপায় নেই। ভারত, পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের লেখকদের লেখা থেকে তাঁর প্রারম্ভিব জীবনের যে তথ্য পাওয়া যায়, তার ভিত্তি খুব শক্ত নয়। সেই সব সূত্র থেকেই যতটুকু জানা যায় যে, তাঁর আম্মা তাকে দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের জন্য জন্মভিটা ত্যাগের অনুমতি দেন। নোয়াখালির একটি মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। অতঃপর ঢাকায় পাড়ি জমান, সেখান থেকে কোলকাতায়। এভাবেই একসময় হাজির হন দিল্লির মাদরাসায়ে রহিমিয়ায়। শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন উপমহাদেশের মুসলিম চিন্তানায়ক মনীষী-আলেম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর সুযোগ্য সন্তান, শীর্ষ আলেম শাহ আব্দুল আজিজ (রহ.)-এর। বাংলাদেশে একমাত্র তিনিই শাহ আব্দুল আজীজ (রহ.)-এর সরাসরি শিষ্য।
শাহ সাহেবের দরবার থেকেই পরিচয় হয় সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভী শহীদ (রহ.)-এর সাথে। সম্পর্কে তিনি ও গাজী সাহেব পীর ভাই। সাইয়্যেদ আহমাদ শহীদের (রহ.) ব্যক্তিত্ব, গাম্ভির্য্য, ইলমি গভীরতা ও তাওয়াক্কুল বিস্মিত করে গাজী সাহেবকে। এমনি সময়ে শাহ আব্দুল আজিজ ব্রিটিশকবলিত ভাতরবর্ষকে 'দারুল হরব' বা শত্রুকবলিত দেশ হিসেবে ফতোয়া দেন এবং তার ফাতওয়া ও প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা সাইয়্যেদ আহমদ শহীদকে ভারতবর্ষ মুক্ত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন। একই পথের পথিক হন গাজী ইমামুদ্দীন (রহ.)।
দিল্লিতে থাকাকালে প্রায় ত্রিশ বছর বয়সী যুবক ইমাদুদ্দীন যখন সাইয়্যেদ আহমদ শহীদের সঙ্গে দেখা করেন তখন অনেকেই তার কাছে মুরিদ হচ্ছিলেন। ইমামুদ্দীন সে সময়ে মুরিদ হননি। তিনি তার মুরিদ হন লক্ষ্মৌর এক বাইয়াতের মজলিসে, আকস্মিক সিদ্ধান্তে। এরপর ৩ দিন কাটে তার প্রায় বেহুঁশের মতো মজযুব অবস্থায়। তখন থেকেই তার মুর্শিদ সাইয়্যেদ আহমদ শহীদের সঙ্গে তিনি সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। সব সফর, সব অভিযান ও সংগ্রামে তিনি তার সঙ্গেই ছিলেন, একদম ১৮৩১ সালের বালাকোট পর্যন্ত। ১৮২২ সালের কলকাতা সফর এবং সেখান থেকে হজের সফরেও তার উপস্থিতির বর্ণনা রয়েছে। সে সময় কলকাতা থেকে অনুমতি নিয়ে নোয়াখালী আসেন তার আম্মার সঙ্গে দেখা করতে। সাইয়্যেদ সাহেব হজের সফরে তার আম্মাকে নিয়ে আসতে বললেও বিশেষ অপারগতায় তার আম্মা যেতে পারেননি। তিনি তখন নোয়াখালী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ৪০ জন বিপ্লবীকে নিয়ে কলকাতায় ফেরেন। তারপর কাফেলার সঙ্গে হজে যান। তার অবস্থান বেশির ভাগ সময়েই থাকত সাইয়্যেদ সাহেবের কাছাকাছি। সাহস, আনুগত্য, আস্থা আর নিবেদনের যোগ্যতার কারণে দায়িত্বপূর্ণ বহু কাজে তাকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় রাখা হতো। ১৮২৯ সালের পাঞ্জতারের যুদ্ধকালে নির্মিত দুর্গে তার কামরা আর সাইয়্যেদ সাহেবের কামরার মাঝে ছিল আরেকটি কামরা। মাঝের কামরাটি ছিল ঠিকানা ও সূত্র না জানা আরেক বাঙালি সাধক-বিপ্লবী ওয়ারেস আলী বাঙালির। গোলাম রসুল মেহের তার গ্রন্থে পাঞ্জতার দুর্গের যে নকশাটি দিয়েছেন তাতে অবস্থান ও নামের তালিকায় এ বিষয়টি দেখা গেছে বাংলা-ভারত সর্বব্যাপী ওই আন্দোলনে অন্য অঞ্চলের মতো বাংলা অঞ্চলের বিপ্লবী মুজাহিদদের নামরে সঙ্গে 'বাঙালি' শব্দটি যুক্ত করেছেন ঐতিহাসিকরা। পরিচয়ের সুবিধার্থে ব্যবহৃত বাঙালি শব্দটি তাদের নামের অংশ হয়ে গিয়েছিল।
১৮৩১ সালের মে মাসে বালাকোটের অসম সমরেও এই বীরপুরুষ সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভীর সহযোদ্ধা ছিলেন। তাঁকে একটা দলের নেতৃত্বও দেওয়া হয়েছিলো। ৬ মে ভোরে চতুর ব্রিটিশদের টোপ গেলা শিখ রাজা রনজিৎ সিংহের প্রেরিত ২০,০০০ সৈন্য আকস্মিত চারদিক থেকে ঘিরে ধরে মুজাহিদ বাহীনিকে। অমিত বিক্রমে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। এক পর্যায়ে আহত হন মারাত্মক ভাবে। সঙ্গীদের বেশিরভাগই শহীদ হন, ধৃত হন, এবং বাকিরা পশ্চাদপরণে বাধ্য হন। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে ভারতের ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের।
বালাকোটে শহীদ মুজাহিদদের তালিকায় বেশ কয়েকজন বাঙালির নাম রয়েছে। এদের বেশিরভাগই ছিলেন গাজী ইমামুদ্দীনের রিক্রুট। এদেরই একজন ছিলেন তার আপন ভাই-আলীমুদ্দীন শহীদ (রহ.)। হাজীপুরের এই আলীমুদ্দীন ছিলেন তার বৈপিতৃয় ভাই।
বালাকোটের পর তিনি নোয়াখালী ফিরে আসেন। গোলাম রসুল মেহের লিখেছেন, গাজী ইমামুদ্দীন শেষ জীবন কাটিয়েছেন রাজস্থানের টোঁকের নবাব ওয়াযিরুদ্দৌলার মেহমানদারিতে। কিন্তু বালাকোট পূর্বাপর তথ্য সমন্বয় করে দেখলে মনে হয় টোকে গাজী সাহেবের অবস্থানের ঘটনাটি ঘটেছে বালাকোটের পর পর। এরপর তিনি দেশে ফিরে এসেছেন এবং এখানেই সংসার গেড়ে হেদায়েতের কাজ করেছেন। তখনও তিনি ছিলেন 'নিঃস্ব'। অর্থ ছিল না, গোত্র-সংসার, পরিবারের কোনো উচ্চ পরিচিতি ছিল না। তৎকালীন এক দ্বীনদার দারোগা (ভূস্বামী) সাবের খাঁ স্বেচ্ছায় তার বহু খেদমত করেছেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরির জন্য তাকে কিছু জায়গা জমি দিতে চেয়েছেন। তিনি তাতে সম্মত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওই দারোগা তার স্ত্রীকে সাদুল্যাপুরের জায়গাটুকু দান করেন। ছিলেন অন্তরালের মহান বিপ্লবী ও অনেক উঁচু পর্যায়ের আল্লাহওয়ালা দরবেশ। তার স্বরূপ যখন কিছু কিছু প্রকাশ হতে থাকে তখন ধীরে ধীরে অনেক দ্বীনদার সুজন-সুহৃদ চারপাশে ভিড় করেন। স্থানীয়ভাবে তার প্রত্যক্ষ সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার লিখিত কোনো বর্ণনা দেয়া যায় না। কিন্তু মৌখিকভাবে জানা যায়, ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে বৃহত্তর নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলে ধর্মপ্রাণ মানুষকে উদ্দীপ্ত ও সংগঠিত করার পেছনে তিনি আজীবন ভূমিকা রেখে গেছেন। তার প্রকাশ্য তৎপরতা ছিল ইসলামি শিক্ষা বিস্তার ও শুদ্ধ, সুস্থ দ্বীনী জীবনে মানুষকে দীক্ষাদান। একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সাধক দরবেশ হিসেবে তার নাম এখনও বৃহত্তর নোয়াখালীর ধর্মপ্রাণ মানুষের ঘরে ঘরে উচ্চারিত হয়। সাইয়্যেদ আহমদ শহীদের আরেক খলিফা কারামত আলী জৌনপুরী বাংলা অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াতের কাজে এলে পরবর্তী সময়ে সিনিয়র এই পীর ভাইয়ের কাছে উপদেশ ও সংস্রব গ্রহণ করতেন। তার কাছে 'সিরাতুল মুস্তাকিম' গ্রন্থের পাঠও গ্রহণ করতেন। নৌকায় চড়ে সাদুল্লাপুরে এসে উঠতেন। ১৮৫০ সালের দিকে নোয়াখালী অঞ্চলে গাজী ইমামুদ্দীনের বহু মুরিদ-অনুসারী, খলিফা গড়ে উঠেন। এদের একজন ছিলেন এ দেশের বরেণ্য বুজুর্গ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) এর দাদা, লক্ষ্মীপুরের লুধুয়া নিবাসী মাওলানা আকরামুদ্দীন মিয়াজী।
১৮৫৮ সালে তিনি নিজ উদ্যোগে সংগঠিত কাফেলা নিয়ে দ্বিতীয়বার হজে গিয়েছেন এবং ফেরার পথে ১৮৫৯ সালে এডেনের কাছে হাজাজে তার ইন্তেকাল হয়। জাহাজের মধ্যে সফরসঙ্গী হাজ্বীরা জানাজা পড়ে ইহরামের কাপড়ের কাফনে পেঁচিয়ে পাথর বেঁধে তার লাশ সমুদ্রে নামিয়ে দেন। জিহাদ আন্দোলনে পূর্ববঙ্গের প্রধান কান্ডারি এই বিপ্লবী দরবেশের সলিলসমাধি হয় আরব সাগরের এক অজ্ঞাত জায়গায়। তার কবর খুঁজে বের করার এবং কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাধ্য আর কারো নেই। লোক পরস্পরায় শোনা যায়, শেষ জীবনে তিনি প্রকাশ্যে দোয়া করেছেন ও আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন তার কবর যেন লোকেরা খুঁজে না পায়। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেছেন। জানা যায়, একই দোয়া করেছিলেন তার মুর্শিদ সাইয়্যেদ আহমদ শহীদ (রহ.)। এ জন্য বালাকোটে শহীদ হওয়ার পর তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। একদল মানুষ বহুদিন পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, তিনি বেঁচে আছেন, আত্মগোপন করে আছেন, সময় হলেই প্রকাশ হবেন।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
গাজী সাহেবের সম্পর্কে কিছুটা জানার পর, বিশেষ করে যখন Forgotten Heroes সিরিজটা লেখার চিন্তা মাথায় আসে, তখন থেকেই ভাবছিলাম একবার প্রত্যক্ষ ভাবে গাজী সাহেবের জন্মস্থান ও বাসভূমি দেখে আসি, পাশাপাশি অপ্রকাশিত কোন ঘটনা যদি জানতে পারা যায়। সৌভাগ্যক্রমে আমার মাতুলালয় নোয়াখালিতে। সেখানেই এক মামা, যিনি ওখানকার একটি মাদরাসায় শিক্ষকতার দায়িত্বে আছেন, তার সাথে যোগাযোগ করলাম। দিন তারিখ ঠিক করে রওনা দিলাম নোয়াখালির উদ্দেশ্যে, সেখান থেকে মামাকে নিয়ে সাদুল্লাপুর। স্থানীয় মিফতাহুল জান্নাহ মাদরাসার একজন শিক্ষক, মামার সহপাঠি, তিনি রাহবার হিসেবে যোগ দিলেন। পড়ন্ত বিকেলে এসে দাঁড়ালাম গাজী ইমামুদ্দীনের প্রাচীন মসজিদের সামনে। সামনে ছোট মাঠ ও পুকুর। দক্ষিণ পাশে ঘন গাছ-গাছালিতে ঢাকা অপ্রশস্ত কবরস্থান। সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করা। এই কবরস্থানে শুয়ে আছেন তার স্ত্রী, মেয়েরা। শুয়ে আছেন শত বছর আগে চলে যাওয়া তার পরিবারের আরো কজন মুরব্বি। কিন্তু তিনি এখানে নেই। এ মসজিদ তার আমলে তাকে কেন্দ্র করেই নির্মিত। এই ভিটা তাকে ঘিরেই এখন জনবসতি। তার জীবনও জীবনের ঘটনা নিয়ে বহু কিংবদন্তি এই দহলিজে বিচরণ করছে। এর সবকিছুর সঙ্গেই তার স্মৃতি পরশ আছে, কেবল তার কবরটি এখানে নেই।
মামার সহপাঠি আমাদের দাঁড় করিয়ে একটু সামনে গেলেন। কিছুক্ষন পর ষাটোর্ধ্ব একজন মুরুব্বীকে সাথে নিয়ে ফিরলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন গাজী ইমামুদ্দীন বাঙালি (রহ.)-এর পঞ্চম প্রজন্মের একজন শাহাবুদ্দীন মাহমুদের সাথে। তিনি আমাদের নিয়ে মসজিদের সামনে বসলেন। তার সঙ্গে তার ভাগ্নে ফিরোজউদ্দীন এবং ফিরোজউদ্দীনের ছেলে মাদররসায় কাফিয়া জামাতে অধ্যয়নরত হাফেজ ইজহারুদ্দীন। পরিবারের পক্ষ থেকে দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ শাহাবুদ্দীন এখন এই মসজিরেদ মোতোয়াল্লি। গাজী সাহেবের স্মৃতিমূলক কোনো কিছু দেখতে চাওয়ায় আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী তিনি বাড়ির ভেতরে থেকে নিয়ে এলেন দুটি ছিন্ন পুরনো পোশাক। গাজী সাহেব গায়ে দিতেন। একটি পিতলের বদনা এবং যুদ্ধে ব্যবহৃত তলোয়ারের একটি অংশ।মরীচা ধরে ক্ষয় হতে হতে এটি ছোট হয়ে গেছে; এখন দেখায় চাকুর মতো। এসবই গাজী সাহেব ব্যবহার করতেন। প্রচন্ড কৌতূহল নিয়ে আমরা জিনিসগুলো দেখলাম। দুঃখের বিষয়, গাজী সাহেবের জীবনী রচনায় কাজে লাগবে অপ্রাপ্ত এমন কোনো তথ্য তার কাছেও পেলাম না। তিনি জানালেন, গাজী সাহেব শারীরিক গঠনের দিক থেকে ছিলেন দীর্ঘদেহী।
মাগরিবের আজান হতে দশ মিনিট বাকি, পথে এসে দাঁড়ালাম। সামনেই শুকিয়ে যাওয়া সরু নদী। এটাকে বলা হয় নোয়াখালী খাল। এ খালই ছিল এক সময় চলাচলের পথ। একশ ষাট সত্তর বছর আগে নিশ্চয়ই গাজী ইমামুদ্দীন বাঙালি এ খাল দিয়েই দাওয়াত, সংস্কার ও সংগ্রামের কাজে এদিক ওদিক যেতেন। মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী নৌকায় চড়ে এ পথেই সাদুল্লাপুর আসতেন। তখন নদী কেমন ছিল, দিন কেমন ছিল, মানুষ ও মানুষের মন কেমন ছিল? ঈমান, সাহস ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উজ্জীবিত সেসব অধ্যায়ের কথা আমরা কি ফিরে দেখার চেষ্টা করব না? নাকি বিস্মৃতির ময়লা চাদর দিয়ে স্বাধীনতা ও মানবিকতার সেই শুভ্র আকাশটা ঢেকে রাখার চেষ্টাই বরাবর করে যাব? আমাদের মনে হয় আরেকবার ভেবে দেখা দরকার।
ঐতিহাসিক বালাকোট ময়দান, বর্তমান অবস্থা
গাজী সাহেবের বর্তমান উত্তরসূরী
গাজি সাহেবের ব্যবহারিত দুটি তরবারী
তথ্যসূত্রঃ
১.শাহ শফিউদ্দিন মিয়াজী, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের ভূমিকা
২.বৈরি বসতি, শফিউদ্দিন সরদার
৩.ওয়াহিদ আহমাদ মাসুদ, সাইয়্যেদ আহমাদ শহীদ কি সহীহ তাসবির
৪.গোলাম রসূল মেহের, সৈয়দ আহমাদ শহীদ
৫.নবাব মুহাম্মার ওয়াজীর খান, মুকাদ্দামা ওয়াক্ব ই সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহ)
৬.মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী , সীরাত ই সাইয়েদ আহমাদ শহীদ
৭.মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী তা’রিখে দাওয়াত ওয়া আজিমাত, খন্ড-৪
৮.ইসলামী ফাউন্ডেশন, অমর বালাকোট
৯.মদীনা পাবলিকেশন্স, উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও রাজনীতিতে আলেম সমাজের ভূমিকা
১০. হাফেজ মাওলানা হাবীবুর রহমান, আমরা যাদের উত্তরসূরী
১১.Sayyed Abul Hasan Ali Nadvi, A misunderstood reformer.
১২.স্থানীয় ও অনলাইন ম্যাগাজিন
১৩.অন্যান্য
এই সিরিজের প্রথম ২টি লেখা আমিরুল মুজাহিদীন সাইয়্যেদ আহমাদ বেরলভী শহীদে বালাকোট (রহ.) ও শাহ সুফি নুরউদ্দিন মুজাহিদ বাঙালী (রহ.) টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে আপাতত এই ব্লগে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অন্যান্য মাধ্যমে পড়তে পারেন ইনশাআল্লাহ। তৃতীয় পর্বটি এই ব্লগ থেকে পড়া যাবে।
১. ফরগটেন হিরোস- এ ট্রিবিউট টু দ্যা গ্রেটেস্ট মেন অন আর্থ প্রথম পর্ব শাহ সৈয়দ আহমাদ বেরলভী শহীদে বালাকোট (রহ.)
২. ফরগটেন হিরোস- এ ট্রিবিউট টু দ্যা গ্রেটেস্ট মেন অন আর্থ দ্বিতীয় পর্ব শাহ সূফী নুর মুহাম্মাদ নিজামপূরী (রহ.)।
ফরগটেন হিরোস- এ ট্রিবিউট টু দ্যা গ্রেটেস্ট মেন অন আর্থ দ্বিতীয় পর্ব শাহ সূফী নুর মুহাম্মাদ নিজামপূরী (রহ.)।
৩. ফরগটেন হিরোস- এ ট্রিবিউট টু দ্যা গ্রেটেস্ট মেন অন আর্থ তৃতীয় পর্ব সাইয়্যেদ মীর নিসার আলী (তীতুমীর)
বিষয়: বিবিধ
১৪৬৫ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লেগেছে। ভালো লাগা রেখে গেলাম। ধন্যবাদ।
অনুপ্রেরণামূলক মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
জাযাকাল্লাহু খইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন