"আঁধারে যখন ফুটলো আলো" (নও মুসলিমদের ইসলাম গ্রহনের চমকপ্রদ কাহীনির সিরিজ)
লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ০৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১০:১৯:৫৮ রাত
পর্ব ১
জুলিয়াস নায়ারেরে (১৯২২-১৯৯৯) ও পরিবার
স্বাধীন তানজানিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট।
বিঃদ্রঃ পোস্টটি বড় হলেও, একটু কষ্ট করে পড়লে বিরূপ হবেন না ইনশাআল্লাহ।
সংক্ষিপ্ত জীবনি: জুলিয়াস কামবারাগে নায়ারেরে ১৯২২ সালের ১৩ই এপ্রিল সাবেক তানগানিয়ার (বর্তমান তানজানিয়া) শহরে জন্মগ্রহন করেন। তিনি তার পিতা, জানাকি সম্প্রদায়ের প্রধান নায়ারেরে বুরিতোর ২৬ সন্তানের মধ্যে একজন ছিলেন। ১২ বছর বয়সে মুসোমার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবনের শুরু হয়। ছাত্র জীবনে বেশ মেধাবী জুলিয়াস ছোট বেলা থেকেই মেধার চমক লাগিয়ে বিভিন্ন বৃত্তি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি কাম্পালার মাকেরেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই শিক্ষকতার সনদ লাভ করেন। ১৪৩০ সালে সরকারী বৃত্তি পেয়ে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৫২ সালে এখান থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
নায়ারেরে ১৯৪০ সালে খ্রিষ্ট ধর্ম অনুসারে ব্যাপ্টাইজড (আনুষ্টানিক ধর্মীয় দীক্ষা গ্রহণ) হন। নায়ারেরের পরিবার কট্রক পন্থী খ্রিষ্টবাদের অনুসারী ছিলো, এর প্রভাব তার মধ্যেও সারা জীবন দেখা গেছে। তিনি রাজনৈতিক ভাবে সমাজতন্ত্রের অনুসারী হলেও খ্রিষ্টবাদের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি কখনোই।
দেশে ফিরে নায়ারেরে দারুস সালামের সেইন্ট ফ্রান্সিস’স কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই নায়ারেরে তানগাানিকা আফ্রিকান এসোসিয়েশন (ঞঅঅ) নামে একটি দলের সাথে যোগ দেন। পরবর্তীতে এই সংস্থা তানগানিকা আফ্রিকান নেশনস এসোসিয়েশন নামে পরিচিত হয় এবং তানগানিয়ার স্বাধিকার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৬১ সালে স্বাধীনতার পর নায়ারেরে দেশটির প্রথম প্রধান মন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন নায়ারের, এবং পরবর্তীতে রিপাবকিারন হিসেবে ঘোষনার পর ১৯৬৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ও ১৯৮৫ সালে অবসর গ্রহনের আগ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের পদে সমীসিন ছিলেন।
তিনি নিম্ন লিখিত পুরস্কার সমূহে ভূষিত হয়েছিলেন-
১. জাওয়াহার লাল নেহরু পুরস্কার (১৯৭৩) ২. থার্ড ওয়ার্ল্ড পুরস্কার (১৯৮২) ৩. স্যার সেরেটসে খামা এসএডিসি পদক (১৯৮৬) ৪. লেলিন শান্তি পুরস্কার (১৯৮৭) ৫. জুলিও-কুরি শান্তি পদক (১৯৮৮) ৬. আর্ন্তজাতিক সাইমন বলিভিয়ার পুরস্কার (১৯৯২) ৭. গান্ধি শান্তি পুরস্কার (১৯৯৫)
১৯৮৫ সালে তিনি সক্রিয় রাজনীতি হতে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯৯ সালের ১৪ই অক্টোবর তিনি যুক্তরাজ্যের লিউকেমিয়া শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
ষাটের দশকের গোঁড়ার দিকে পূর্ব আফ্রিকার দু’টি দেশ টাঙ্গানিকা এবং জাঙ্গিবারের সম্মিলনে তানজানিয়ার উদ্ভব ঘটে। সমাজতন্ত্রিক বিপ্লবের প্রবন্তা জুলিয়াস নায়ারের নবগঠিত এ দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হন। কিন্তু সমাজতন্ত্রের ধোঁয়া মুখে নিয়ে ক্ষমতা দখল করার পর দেখা গেল, জুলিয়াস নায়ারেরে একজন কট্ররপন্থী খ্রিষ্টানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
তানজানিয়ার মোট জনসংখ্যার মাত্র বিশভাগ খ্রিষ্টান এবং আটাত্তর ভাগই মুসলমান। এতদসত্ত্বেও সামরিক স্বৈরাচারের স্টীমরোলার চালিয়ে তানজানিয়াকে একটা খ্রিষ্টানসংখ্যাগরিষ্ট দেশে রুপান্তরিত করার এক অমানবিক প্রয়াসে তিনি অবতীর্ণ হলেন।
তানজানিয়ার রাজধানীর নাম দারুস-সালাম। সুন্দর এ শহরটির শতকরা নব্বই ভাগ অধিবাসীই মুসলমান। নায়ারেরে প্রথমে দারুল-সালামের মুসলিম নামটি পরিবর্তন করে তথাকথিত একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নাম দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু জনসাধারণ কর্তৃক তাঁর এ প্রয়াস প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর দারুল-সালাম থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে তানজানিয়ার নতুন রাজধানী শহর নির্মাণের কাজ শুরূ হয়। পরিকল্পিত এ নতুন রাজধানী শহরে পারতপক্ষে কোন মুসলমানকে জমি বরাদ্দ না দেয়ার এক অলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অপর দিকে সরকারীভাবে দারুস-সালামকে একটি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত করার সকল ব্যবস্থা পাঁকাপোঁক্ত করে রাস্তা-ঘাঁট, পয়ঃপ্রণালী, বিজলী ও পানি সরবরাহ-ব্যবস্থার সংস্কার ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করে রাখা হয়। ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই আফ্রিকার সর্বাপেক্ষা সুন্দর শহরগুলোর একটি বলে পরিচিত এককালের তিলোত্তমা দারুল-সালাম একটা পড়ো ভুতুড়ে নগরীর রুপ লাভ করে।
শুধু তাই নয়, সমাজতান্ত্রিক সংস্কারের ছদ্মাবরণে মুসলমানদের সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি রাষ্ট্র কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করে এ আয়ে পরিচালিত মাদ্রাসা ও এতিমখানাগুলো বন্ধ করে দেয়। দেশের প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত বিদেশী খ্রিষ্টান মিশনারীদের অবাধ কর্মতৎপরতা এবং বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়, কিন্তু দেশের বাইরে থেকে কোন মুসলিম প্রচারক বা বুদ্ধিজীবির তানজানিয়ায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
তানজানিয়ায় মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও মুসলিম প্রাধান্য বিলুপ্ত করে দেয়ার এক সুগভীর সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রধান আড়কাঠিরূপে কট্টর মুসলিম-বিদ্বেষী খ্রিষ্টান নায়ারেরে ব্যবহৃত হতে থাকেন। পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টান ঔপনিবেশিকতাবাদীদের যোগসাজসেই সে পার্শ্ববর্তী উগান্ডার ইদি আমিনকে উৎখাত করে। তানজানিয়ার সেনাবাহিনী উগান্ডার প্রবেশ করে কয়েক লক্ষ মুসলমানকে বাড়ী-ঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বর্গীর মত লুন্ঠন করে তানজানিয়ায়নিয়ে আসে। উগান্ডার লক্ষ লক্ষ মুসলমান খ্রিষ্টানসৈন্যদের এ অবাধ গনহত্যার কবল থেকে আত্মরক্ষা করার উদ্দেশ্যে সর্বহারা অবস্থায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে।
উগান্ডা থেকে মুসলিস প্রাধান্য উৎখাত করার পর জুলিয়াস নায়ারেরে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। তানজানিয়ায় মুসলিম মহিলাদের জন্য পর্দা করা বে-আইনী ঘোষিত হয়। ডখ্রষ্টানযুবকদের সাথে মুসলিম মেয়েদের বিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে বাধ্যতামূলক করা হয়।
উগান্ডার ইদি আমীনকে উৎখাত করে পরিপূর্ণ খ্রিষ্টানপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পর রাজধানী কাম্পালাতে খ্রিষ্টানধর্মযাজকদের একটি বিশ্ব-সম্মেলন আহবান করা হয়। এতে প্রধান অতিথিরূপে দাওয়াত করা হয় পূব আফ্রিকার খ্রিষ্টানদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক নায়রেরেকে। নিজ ভাষনে তিনি সদম্ভ ঘোষণা করেন যে, আগামী দশ বছরের মধ্যে তিনি তারনিজের দেশ তানজানিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনসংখ্যাকে একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠিতে রূপান্তরিত করে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি চার্চ পরিষদের উদার সহযোগীতাও কামনা করেন। পাশাপাশি তিনি এ স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কি কি কর্মপন্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন তার একটা মোটামুটি ব্যাখ্যা পেশ করে আগত মিশনারী নেতৃবৃন্দকে চমৎকৃত করে ফেলেন। তিনি স্পষ্টতই বলেন যে, ”আফ্রিকার বুকে এটা একটা নতুন ধর্মযুদ্ধ। এ যুদ্ধে আমাদেরকে জয়লাভ করতেই হবে।”
মুসলিম বিদ্বেষী খ্রিষ্টান শক্তির দ্বারা নতুন করে বিজিত মুসলিম উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা সম্মেলনে দাঁড়িয়ে পূর্ব-আফ্রিকার সর্বাপেক্ষা বড় মুসলিম-বিদ্বেষী একনায়ক যখন ক্রসেড যুদ্ধের অহমিকায় উদ্বেলিত দম্ভোক্তি উচ্চারণ করে আত্মশ্লাঘায় গদগদ হচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়টিতেই সুদূর দক্ষিণ-আফ্রিকার ডারবানে জুলিয়াস নায়ারেরে বিদুষী পুত্রবধু আহমদ দীদাতের এক শাগরেদের সাথে তুলানামূলক ধর্ম তত্ত্বের সময়ে অভিভূত হয়ে ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করে ফেললেন। শুধু তাই নয়, সেই প্রথম যুগের সাহাবিয়্যাগণের ন্যায় ঈমানের উত্তাপ বুকে নিয়ে তিনি ছুটে গেলেন সুদূর আমেরিকায়, যেখানে লেখাপড়া উপলক্ষ্যে অবস্থান করছিলেন জুলিয়াস নায়ারেরের গোটা পরিবার; অর্থাৎ তিন পুত্র ও দুই কন্যা।
হিজরী সপ্তম শতকে সমগ্র আলমে-ইসলামে তান্ডব সৃষ্টি করে মুসলিম উম্মাহ্র অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছিল যে তাতারী জাতি, তাদেরই এক রাজপুত্র বনবাসী জনৈক দরবেশের আযান শুনে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত ইসলামে দীক্ষিত হয়ে সমগ্র তাতারী জাতিকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসার বিস্ময়কর ইতিহাস স্মরণ করেই তো ইসলামের কবি আল্লাহা ইকবাল গেয়েছেন:
তাতারী জাতির ইতিহাসই প্রমাণ করেছে;
প্রয়োজনে দেবালয় থেকেও বের হয়ে আসবে কাবার প্রহরীরা!!
মহামতি হযরত ওমর (রাঃ)-এর সহাদরা ফাতিমা (রাঃ)-এর মত ঈমানের উত্তাপ নিয়ে জুলিয়াস নায়ারেরে- পরিবারের বিদূষী বধূয়ামাতা গিয়ে উপনীতি হলেন সুদূর আমেরিকায়। প্রথম তিনি স্বামীর সাথে আলোচনা করলেন। পবিত্র কুরআনের শিক্ষা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেন। তারপর ইসলামের প্রতি সরাসরি দাওয়াত দিলেন স্বামীকে।
যে পবিত্র আহবান হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় তা সহজেই অন্যের হৃদয় মন আদ্র করে দিতে সক্ষম হয়। মহীয়সী এ মহিলার হৃদয় নিংড়ানো আকুতি ব্যর্থ হলো না। প্রিয়তমা জীবন-সঙ্গিনীর আহবানে স্বামী সাড়া দিলেন এবং শেষ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বর্তমান আফ্রিকায় সর্বাপেক্ষা বড় ক্রসেড-যোদ্ধা জুলিয়াস নায়ারেরের গোটা পরিবার; অর্থাৎ তিন পুত্র ও দুই কন্যা ইসলামে দীক্ষিত হয়ে গেলেন।
ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করার পরপরই এই পরিবারটি আহমদ দীদাতের (রহ.) সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে তুললেন। দক্ষ যোদ্ধা শেখ আহমদ দীদাত (রহ.) কিন্তু আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ সংবাদটি কিছু দিনের জন্য গোপণ রাখতে নির্দেশ দিলেন। ইতিমধ্যে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে এলো। এরা দেশে ফিরে আসার পর থেকেই আহমদ দীদাতের বিখ্যাত তিন শিষ্য গরীবা শেখ মূসা ফুন্ডী, শেখ আহমদ কামিম্বা এবং শেখ আহমদ মাটাটা ঘনঘন দারুস-সালাম যাতায়াত শুরু করলেন। তিনজনই যুবক বয়সী এবং উচ্চ শিক্ষিত। এদের এ আসা যাওয়াটা কিন্তু দারুস-সালামের গীর্জা অধিপতিরা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারলেন না। এ ব্যাপারে তারা তাদের প্রধান মুরুব্বী দেশের মহাপরাক্রান্ত রাষ্ট্র প্রধানের নিকট অভিযোগ দায়ের করে বসলেন। কিন্তু তারা আশ্চর্যাম্বিত হয়ে লক্ষ্যে করলেন যে, তাদের সেই ক্রসেড সেনানী জুলিয়াস নায়ারেরে ‘ধর্ম যুদ্ধে’র ব্যাপারে কেমন যেন নিস্পৃহ হয়ে পড়েছেন। আসলে জুলিয়াস সাহেব ইতিমধ্যেই তাঁর গোটা পরিবারের ধর্মান্তরের বিষয়টা আঁচ করে ফেলেছিলেন। ছেলেদের চেয়ে দুই মেয়ে এবং পুত্রবধুর উৎসাহটাই তিনি বেশী লক্ষ্য করেছিলেন।
ব্যাপারটা অন্য কোন পরিবারে ঘটলে তিনি হয়তো সিংহের মত গর্জে উঠতেন। প্রয়োজনে স্বৈরাচারের তীক্ষ্ম দাঁত বসিয়ে দিয়ে হলেও এ সর্বনাশা কান্ডটি প্রতিহত করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু এখন তিনি লড়বেন কার বিরুদ্ধে? তিন ছেলে দুই মেয়ে আর পুত্রবধু সবাই উচ্চশিক্ষিত। সমাজের দৃষ্টিতে যোগ্য। এদের উপেক্ষা করবেন; তা আর সম্ভব নয়। বরং এ বৃদ্ধ বয়সে তিনিই পুত্র-কন্যাদের থেকে বিচ্ছিন্ন ও উপেক্ষিত হয়ে পড়বেন। সুতরাং বিষয়টা কিভাবে হজম করা যায়, তা নিয়েই তিনি এখন ভাবনা-চিন্তা করছেন।
প্রেসিডেন্টের ছেলেমেয়েরা কিন্তু দারুস-সালাম ফিরে এসেই শেখ মুসা ফুন্ডীর মাধ্যমে মুসলিম যুবকদের সংগঠিত করে ফেললেন। নিজেরা তখনও আত্মপ্রকাশ না করে দারুস-সালাম ও পাশ্ববর্তী জনপদগুলোতে খ্রিষ্টান মিশনারীদের চ্যালেঞ্জ করে নানা ধরনের প্রচারপত্র ছড়াতে শুরু করলেন। মিশনারীরা মুসলিম যুবকদের এ তৎপরতা লক্ষ্য করে স্তম্ভিত হলেন। কিন্তু উপায় নেই, চ্যালেঞ্জর জবাব দিতে হয়। তাঁরা প্রচারপত্রের জবাব দিলেন। এবার যুবকরা মিশনারীদেরকে প্রকাশ্য তর্কযুদ্ধে শরীক হওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ করে বসলেন। সিদ্ধান্ত হলো, দারুস-সালামের সর্বাপেক্ষ বড় ময়দান রিপাবলিক পার্কে তর্কযুদ্ধ অনুষ্ঠিত হবে। তারিখ স্থিরকৃত হলো ১৯৮৫ সনের ১৩ই ফেব্রুয়ারী থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তিন দিন। মুসলিম যুবকেরা বিপুল উৎসাহে বিতর্কসভার উদ্যোগ-আয়োজনে লেগে গেল। বিরাট আকৃতির পোষ্টার মুদ্রিত হলো। কয়েক-শো শিক্ষিত যুবক দিনরাত পোষ্টার ও প্রচারপত্র নিয়ে মেতে উঠলো।
খোদ মুসলমানদের জন্যও ব্যাপারটা ছিল রহস্যজনক। জুলিয়াস নায়ারেরের রাজত্বে কিছুসংখ্যক মুসলিম যুবক কর্তৃক খৃষ্টধর্মকে প্রকাশ্য সমালোচনা এবং শেষ পর্যন্ত সামনা-সামনি বিতর্কের প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ! খ্রিষ্টানদের পক্ষেও এ ধরণের একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপারের রহস্য উদঘাটন করা ছিলো খুবই কঠিন। তারা ভেবেই পাচ্ছিলো না, স্বল্পসংখ্যক মুসলিম যুবকের পিছনে এতবড় দুঃসাহস কে জোগাচ্ছে। নির্ধারিত দিনে রিপাবলিক পার্কে যেন জনতার ঢল নামলো। প্রায় এক লক্ষ মুসলিম ও খ্রিষ্টান জনতা এলো এ মহা তর্কযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে।
মঞ্চে আগে থেকেই অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত স্বনামধন্য পাদ্রী ও পন্ডিতেরা। কিছুক্ষন পরই ধীর পদক্ষেপে মঞ্চে আহোরণ করলেন আহমাদ দীদাতের (রহ.) তিন বিশিষ্ট শাগরেত শেখ মুসা ফুন্ডী, আহমদ কামিম্বা ও মুহাম্মাদ মাটাটা। কিন্তু এ কি!!! তাদের পিছনে এই তিনজন যুবক .......??? এরা যে জুলিয়াস নায়ারেরের তিন পুত্র। দারুস-সালামের আবেগ উদ্বেলিত জনতার আকাশ ফাটা তাকবীর ধ্বনি যেন সমুদ্রের গর্জনকেও হার মানাল। শেখ মুসা জনতাকে শান্ত করলেন এবং বির্তক উদ্বোধনের জন্য পাদ্রী সাহেবদের অনুরোধ জানালেন।
পাদ্রী সাহেবরা তাদের সেই পুরাতন তুরুপের তাস দিয়েই খেলার চেষ্ঠা করতেন। তারা জানতেন মুসলমান আলেম-উলামারা কুরআন, হাদীস, আরবী সাহিত্য ও ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র খুব ভালো জানলেও আধুনিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা কিছুটা দূর্বল। সেহেতু তারা পূর্বের অভিজ্ঞতার আলোকে বাইবেল থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্য ইত্যাদি আলোচনা করে বুঝাতে চাইলেন, এসব আধুনিক বিষয়াদি বাইবেলে বিদ্যমান। কিন্তু এবার পাশা পাল্টে গেল। পাদ্রীদের প্রতিটি যুক্তিকে কুপোকাত করতে থাকলেন আহমাদ দীদাতের তিন শাগরেদ। নিজেদের যুক্তির পক্ষে তারা বাইবেল থেকে পৃষ্ঠা নম্বর পর্যন্ত উল্লেখ করে দলীল দিতে থাকলেন। গলদঘর্ম পাদ্রীরা কিছুতেই তাদের যুক্তি খন্ডন ও পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারছিলেন না। এভাবেই অবশেষে নির্ধারিত তিন দিন পর প্রকাশ্যে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। এই বিতর্কের এক অভূতপূর্ব প্রভাব পড়লো উক্ত সভায়, এমনকি সারা দেশ জুড়ে। ঐ দিন শুধু মাত্র ময়দানে উপস্থিতদের মধ্যে ৩০০ খ্রিষ্টান ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন।
অপরদিকে নিজ সন্তান ও পুত্রবধূর কাছে এক প্রকারের প্রকাশ্য পরাজয়ের পর মনোবল হারিয়ে ফেলেন জুলিয়াস নায়ারেরে। এর মাত্র দুই সপ্তাহ পর আফ্রিকার দোর্দন্ড প্রতাপশালী শাসক মানসিকভাবে হতাশার স্বীকার হয়ে পদত্যাগ করেন। বলা হয়ে থাকে, পরিবারে অনুরোধ ও চেষ্ঠায় তিনি পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই বিষয়টির কোন নিশ্চিত সূত্র পাওয়া যায় নি। একদা আফ্রিকার সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি অবসরের পর একেবারেই নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন।
বিষয়: বিবিধ
২১২০ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এগিয়ে চলুন...
প্ররিশ্রমী পোস্টের জন্য আ্ন্তরিক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ খায়ের।
তাতারী জাতির রাজপুত্রের দরবেশের আযান শুনে ইসলামে দীক্ষিত হয়ে সমগ্র তাতারী জাতিকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসার বিস্ময়কর ইতিহাসটা জানতে চাই ।
আবারও ধন্যবাদ
আমার এই সিরিজের মূখ্য উদ্দেশ্যই হলো, স্মৃতির ধুলোর নিজে পড়ে থাকা এমন আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনাগুলোকে আবারো ছেঁকে তুলে নিয়ে আসা। ইনশাআল্লাহ তাতারীদের ঘটনাও আসবে। তবে সামনের পর্ব ভারতের বিখ্যাত ধর্মগুরু, ভ্যাটিকানের সর্বোচ্চ সম্মাননা ও.এফ.এম কাপ ভূষিত ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ড. শিবশক্তি স্বরূপজী মহারাজ ও পরিবার।
জাযাকাল্লাহু খইর।
ধন্যবাদ আপনাকে
জাযাকাল্লাহু থইর।
সময় নিয়ে পড়ার ও মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহু খইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন