হজ্বে গিয়ে কেনাকাটা, একটু ভাবুন

লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৪:৩৬:২০ বিকাল



"‘আলমূল ইয়া ইখওয়ান, আলমূল মাজ্জানান ইয়া ইখওয়ান’ কয়েকজন লিমুজিন চালকের মুখ থেকে সশব্দে ভেসে আসছে বাক্য দুটি। স্থান, মসজিদে নববীর পশ্চিম দিকের রাস্তা। একই দৃশ্য দেখা গেল আসরের নামাযের পর দারুল ঈমান হোটেলের পাদদেশের গেটেও। কথাগুলোর মর্ম উদ্ধার করতে কিছু সময় লাগল। পরে বুঝা গেল এরা মানুষকে শপিংমলে যাওয়ার আহবান করছে। তাদের গাড়ীতে করে বিনা পয়সায় নিয়ে যাওয়া হবে ‘বিদেশী মুসল্লীদের’। কারো কারো হাতে রঙিন বিজ্ঞাপনও দেখা গেল, যাতে ঐসব সুপার মার্কেটের বিভিন্ন আকর্ষণীয় দিক তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাপারটা মনে হল অভূতপূর্ব। হারামে নববীর সামনে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে যিয়ারতে আসা মুসলমানদের বিনা ভাড়ায় দূরের কোনো শপিংমলে যাওয়ার আমন্ত্রণ এর আগে চোখে পড়েনি।"

কথাগুলো বলছিলেন এক স্থানীয় মুরব্বী, যিনি যুবা কালের একটা সময় কাটিয়ে এসেছেন সৌদি আরবে। নামাজান্তে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার ফাঁকে গত বছরের হজ্বের সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনার মধ্যে উঠে এলো কথা গুলো।

পুঁজিবাদের ফ্রিস্টাইল বাণিজ্যের হাওয়া হারামাইন শরীফাইনের এলাকাগুলোতেও যে জোরেশোরে বইতে শুরু করেছে এটা এর একটা ছোট উদাহরণ।

এমনিতেই পবিত্র দুই হারামের পার্শ্বে সুপার মার্কেট রয়েছে, যেগুলোতে হজ্ব-উমরার জন্য আগত মুসলমানদের অনেকেই ভিড় জমিয়ে থাকেন এবং সে সুযোগে উক্ত এলাকা দুটির ব্যবসায়ীগণ কামিয়ে থাকেন দু’হাত ভরে। এখন এর সাথে যোগ হয়েছে মুসল্লীদেরকে হারাম থেকে দূর-দূরান্তে অবস্থিত শপিংমলমুখী করার কৌশল।

বর্তমান সময়ে বিদেশ-ভ্রমণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে শপিং। কিন্তু হজ্ব-উমরার সফর তো আর দশটা সফরের মত নয়। মক্কা-মদীনায় মানুষ যায় একটিমাত্র মহৎ উদ্দেশ্যে। আর তা হচ্ছে কয়েকটি দিন দুনিয়ার সকল ঝামেলা থেকে দূরে থেকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সচেষ্ট থাকা। তাওয়াফ, সাঈ, যিয়ারত, তাসবীহ-তাহলীল, দুআ-দরূদ এবং যথাসময়ে জামাতের সাথে মসজিদে হারাম/নববীতে ফরয নামাযগুলো আদায় করা। অর্থাৎ খাওয়া-দাওয়া ও প্রয়োজনীয় বিশ্রামের অতিরিক্ত সময় যথাসম্ভব পুরোটাই ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যয় করা।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল শত শত দোকানপাট, সুপার মার্কেট ও শপিংমল এ উদ্দেশ্যের পথে একটি বাধা হিসেবে কাজ করে থাকে। দুই পবিত্র স্থানে অবস্থানকালীন অতি মূল্যবান সময়ের বেশ কিছু অংশ অনেকটা নিজেদের অজান্তেই আমরা ঐ ব্যবসায়ীদেরকে দান করে থাকি।

দুই পবিত্র মসজিদের আশপাশে কিছু দোকানপাট থাকা তো জরুরীও বটে। হজ্ব-উমরায় আগতদের খাবার-দাবার, ঔষধ-পত্রের দোকান যত বেশি থাকবে ততই ভালো। তেমনি প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান, লন্ড্রি, সেলুন ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে থাকাও যুক্তিসঙ্গত। এছাড়া সোনা-গয়না, ইলিক্ট্রনিক্স, পোশাক-আশাক ও অন্যান্য পণ্যের শত শত দোকান ও মার্কেটগুলো বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একপ্রকারের অভিশাপই বটে।

কারণ : ১. বাজেট বৃদ্ধি : এসব দোকানপাট হজ্ব-উমরার বাজেটকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ এখন মূল খরচের পাশাপাশি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কেনাকাটার জন্যও বড় একটি বরাদ্দ রাখে। ফলে অনেকের ক্ষেত্রে সফরে যেতে বিলম্ব হয়। অনেকে অহেতুক খরচের চাপে পড়ে কষ্ট ভোগ করে। এমনকি তা ফরজ হজ্ব আদায়েও বিলম্বের কারণ হয়ে থাকে।

২. এমন অনেক জিনিসপত্র কেনা হয়, যা অনেকটা অপচয়ের আওতায় পড়ে। আর অপচয়কারীগণ শয়তানের ভাই একথা তো আলকুরআনুল কারীমেই রয়েছে।

৩. একশ্রেণীর চালাক দোকানী বিক্রি করে থাকে অতি নিম্ন মানের পণ্য, যা কিনে প্রতারিত হন আল্লাহর মেহমানগণ।

৪. সবচাইতে বড় ক্ষতি হচ্ছে সেটি, যা শুরুর দিকেই বলা হয়েছে। অর্থাৎ অতি মূল্যবান সময়ের অপচয়। হাদীস শরীফে মসজিদকে সর্বোত্তম স্থান আর বাজারকে নিকৃষ্টতম স্থান বলা হয়েছে। কিন্তু হজ্ব-উমরার সফরে যে দু’টি মসজিদে মানুষ যায় সে দু’টিতো পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দু’টি মসজিদ। মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা এবং মসজিদে নববীর উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্রভাবে সফরের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে সহীহ হাদীসে। সুতরাং এ দু’টি মসজিদের উদ্দেশ্যে সফরের সৌভাগ্য হলে সেটিকে কাজে লাগাতে হবে শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।

দোকানপাট, শপিংমল তো সব দেশেই আছে। আমাদের দেশেও এসবের কোনো অভাব নেই। এমনকি আমাদের সুপারমার্কেট, শপিংমলগুলোতে গেলে এদেশকে কেউ গরীব দেশ বলে চিন্তাও করবে না। তাই বাজারে/দোকানে ঘুরাফেরা করে বা অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার পিছনে পড়ে সময় নষ্ট করা কিছুতেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

৬. সুপারমার্কেট, শপিংমলে ঘুরতে যাওয়ার আরেকটি খারাপ পরিণতি হবে ইবাদতে মনোযোগের কমতি হওয়া, খুশু, খুযু নষ্ট হওয়া। অথচ একাগ্রতার সাথে ইবাদত করার এটিই হল সর্বোত্তম সময়।

মোটকথা পুঁজিবাদ পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর মত সৌদী আরব এমনকি মক্কা-মদীনাতেও তার আগ্রাসন দৃঢ় করে চলেছে। সেখানেও তৈরি হচ্ছে বড় বড় অট্টালিকা, সুপার মার্কেট, শপিংমল ইত্যাদি। ছোট ছোট এবং কমদামী হোটেলগুলো গুড়িয়ে দিয়ে সেগুলোর জায়গা দখল করে নিচ্ছে আমীর-ধনীদের ৫ তারকা, ৪ তারকা হোটেল। আবার এসব হোটেলের সেবা ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছতে অনেক সময় দুই-তিন হাত বদল হচ্ছে। ফলে বেশি ভাড়া গুনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। আর মাঝে মধ্যস্বত্তভোগীরা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিপুল অর্থ।

জিনিসপত্রের উৎপাদন ও পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে আগের দর্শন ছিল ‘মানুষের প্রয়োজন হচ্ছে আবিষ্কারের জননী’ অর্থাৎ যা যা মানুষের প্রয়োজন তাই উৎপাদিত ও বাজারজাত হবে। কিন্তু সে ধারণা পাল্টে দিয়েছে পুঁজিবাদ ও পুঁজিপতিরা। তাদের অনেকেই আগে পণ্য ও সেবাসামগ্রী তৈরী করছে এরপর তাদেরই হাতে থাকা বিভিন্ন মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ নাগরিকদের তা গিলাচ্ছে।

আমাদের কথায় পুঁজিবাদীরা হয়ত পিছপা হবে না। সৌদি সরকারও হয়ত হারামাইন শরীফাইনের আশপাশ থেকে অপ্রয়োজনীয় দোকানপাট ও মার্কেটগুলো সরিয়ে নিবেন না, কিন্তু আমরা নিজেরা তো সচেতন হতে পারি। আসন্ন হজ্বে আল্লাহর মেহমান হাজী সাহেবগণ এ বিষয়টি স্মরণে রাখবেন বলে আশা করি। হজ্ব-উমরায় গিযে বৈধ পণ্য-সামগ্রী কেনাকাটা করা নাজায়েয কিছু নয়। কিন্তু উপরোক্ত বিষয়গুলো ভাবনায় রাখলে আপনার সফরটি আরো বেশি সফল হবে বলে আশা করা যায়।

বিষয়: বিবিধ

১৩৮৮ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

261229
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৫:৫৬
আফরা লিখেছেন : ইনশা আল্লাহ মনে রাখব ।
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:০১
205106
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইর।
261252
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৬
নজরুল ইসলাম টিপু লিখেছেন : ১৯৮৩ সালে আমার এক বন্ধুর বাবা হজ্বে গিয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তি হিসেবে স্থানীয় চেয়ারম্যানের বাবা এবং সেনাবাহিনীর একজন রিটায়াড ব্যক্তি ছিলেন। সন্তানেরা সবাই শিক্ষিত, সম্পদশালীও বটে।

নাতি-নাতনীদের আবদার হিসেবে হজ্জ থেকে আসার সময় একটি টিভি নিয়ে এসেছিলেন। তার পর থেকে টিভি হাজি হয়ে যান। বহু মেজবান দেবার পরও টিভি হাজির নাম পরিবর্তন করতে পারেন নি। হজ্জের ব্যাপারটিকে মানুষ খুব সিরিয়াসলি নেয়। একবার ভুল হলে, পুরো জীবনেও সমাধান হয় না।
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:২৬
205155
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : সহমত।এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহন করা উচিত। সর্বপরি, হজ্বের সফরের নিয়ত যদি শুধূ আল্লাহর সন্তুষ্টি হয়, তার পুরস্কার সেরূপ খাঁটি হবে। পরন্তু যদি এর সাথে হাজী টাইটেল, ভালো মানের স্বর্ণ কেনার নিয়্যত থাকে, তাহলে প্রতিদানও সেরূপ ভেজাল মার্কাই হবে।
حَدَّثَنَا الْحُمَيْدِيُّ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ الزُّبَيْرِ، قَالَ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، قَالَ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ الأَنْصَارِيُّ، قَالَ أَخْبَرَنِي مُحَمَّدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ التَّيْمِيُّ، أَنَّهُ سَمِعَ عَلْقَمَةَ بْنَ وَقَّاصٍ اللَّيْثِيَّ، يَقُولُ سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ ـ رضى الله عنه ـ عَلَى الْمِنْبَرِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ "‏ إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى دُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ إِلَى امْرَأَةٍ يَنْكِحُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ ‏"‏‏.‏


"উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযি.) বর্ণনা করেন, আমি রাসূল(সাঃ)কে ইরশাদ করতে শুনেছি "নিশ্চয়ই প্রত্যেকটি কর্ম নিয়্যতের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়্যত অনুযায়ী ফল পাবে। তাই যার হিজরত হবে দুনিয়া লাভের জন্য অথবা কোন নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে- সেই উদ্দেশ্যই হবে তার হিজরতের প্রাপ্য।" (সহীহ বুখারী, হাদীস-০১)
জাযাকাল্লাহ খইর
261338
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:১৯
বড়মামা লিখেছেন : আমি আপনার সাথে একমত নই হজ্জের সাথে ব্যবসা কোন দোস নেই ।কোরানে দেখেন নামায, হজ্জের, ফরজ ,ওয়াজিব.পালন করে যেকোন পছন্দমত জিনিস কিনবে।এবাদত ফেলে কোন যায়গাতে ব্যবসা করা ঠিক নয়।
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:২৮
205184
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : ভাই, হয়তো আপনি আমার মূল উদ্দেশ্য টা এড়িয়ে গেলেন। আমি কিন্তু একবারও বলিনি এটা হারাম, নাজায়েজ ই্ত্যাদি। আমার বলার উদ্দেশ্য, একজন ব্যক্তি এত টাকা ব্যায়ে এতদূর যাচ্ছে। উদ্দেশ্য যদি একটাই হয় যে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করা, তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়া এবং রাসূল (সাঃ)-এর রাওযা যিয়ারত, তাহলে এই খালেস নিয়্যতের জন্য অবশ্যই সে সর্বোচ্চ প্রতিদানের আশাবাদী হতে পারে। সব কাজ শেষে হাতে সময় থাকলে কেনাকাটা কেন মন্দ হবে! তবে উদ্দেশ্যটা যেন হজ্বেরই থাকে।
261348
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:৪৮
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : হজ্জের সফরে কেনাকাটায় বাধা না থাকলেও মার্কেটে অতিরিক্ত ঘোরা ফেরার কারণে মনোযোগে একটু ব্যঘাত ঘটতে পারে। তারপরও এটি নির্ভর করবে ব্যক্তির মানসিক দৃঢ়তার উপর।
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১০:০০
205209
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : হুম, সহমত।
261391
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১১:০৮
আজিম বিন মামুন লিখেছেন : খুবই সময়োপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট।ধন্যবাদ আপনাকে।
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১১:২৪
205246
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : আপনাকেও ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহু খইর।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File