শিশুর প্রথম পাঠশালা
লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ১১ আগস্ট, ২০১৪, ১০:২৯:২৯ রাত
একটি শিশু জন্মের পর থেকেই সাধারণত মায়ের কাছে থাকে। মা-ই তার প্রথম পাঠশালা। তাই সন্তান আদর্শ ও সৎ হওয়ার পিছনে মায়ের ভূমিকাই বেশি। একটি সন্তান পৃথিবীতে কত বড় হবে, কত ভালো হবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে মায়ের উপর। সেজন্য সর্বাগ্রে মা-কে সচেতন হতে হবে। সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং তা যথার্থভাবে বাস্তবায়নের প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সন্তান মা-বাবার হাতে আল্লাহর আমানত, তাঁর দেয়া নেয়ামত। এদেরকে সুশিক্ষা দেয়া হল কি না সে বিষয়ে কিয়ামতের দিন পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। কোনো কোনো মা-তো নিজের অজান্তেই সন্তানের মন্দ স্বভাবের কারণ বনে যান। অন্যের খেত থেকে মরিচ, মূলা, আলু ইত্যাদি আনার জন্যে শিশুকে বলেন। এতে করে সন্তান ধীরে ধীরে চুরির পথে পা বাড়ায়। তাই একজন দায়িত্ববান ও সচেতন মা হিসাবে প্রতিটি পদক্ষেপে সজাগ থাকা অত্যন্ত জরুরি। মনে রাখতে হবে সন্তানের প্রথম বয়সই তার সংশোধনের উপযুক্ত সময়। একটি শিশু জন্মের পরই মা-বাবার উপর শরীয়তের বিধান অনুযায়ী কিছু দায়িত্ব এসে পড়ে। যেমন শিশুর ডান কানে আযান বাম কানে ইকামত দেয়া। ভাল নাম রাখা। যথাসম্ভব সাত দিনের দিনে আকীকা দেয়া ইত্যাদি। এগুলো হল সন্তান জন্মের পর প্রাথমিক কিছু বিষয়। এরপর আসে সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালন ও আদব শিক্ষা দেয়ার পর্ব। আর সন্তানকে আদব কায়দা শিক্ষা দানের গুরুত্বপূর্ণ সময় হল তারা যখন কথা বলতে শিখে। ঐ সময় তাকে যেটা শিক্ষা দেওয়া হয় সেটাই সে শিখে নিবে।
তাবেয়ী ইবরাহীম আততাইমী রাহ. বলেন, তাঁরা (সাহাবীগণ) শিশু কথা বলা শিখলে তাকে কালিমার তালকীন করতেন (মুখে মুখে বলা শিখাতেন)। যাতে শিশুর প্রথম কথা হয় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৩৫১৯) দ্বিতীয়ত সাত বছর হলে শিশুকে নামাযের আদেশ দেয়া। দশ বছর হলে নামায না পড়লে প্রয়োজনে প্রহার করা, যা হাদীস দ্বারাই প্রমাণিত। এরপর তাকে কুরআন শিক্ষা দেয়া। সাত বছর বয়সেই কুরআন শিক্ষা দেওয়া উচিত। হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নামাযের জন্য যখন সাত বছর বয়সকে নির্ধারণ করা হয়েছে, এর থেকে আমার মনে হয় এই বয়সটাই নিয়মতান্ত্রিক লেখাপড়া শুরু করার উপযুক্ত সময়।
আর কুরআন শিক্ষাকারী ব্যক্তিকে আল্লাহর রাসূল সর্বোত্তম ব্যক্তি বলেছেন। এমন কোনো মা-বাবা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে তার সন্তান সর্বোত্তম হোক এটা চায় না। তাই উত্তম হওয়ার যে মাপকাঠি তথা কুরআন শিক্ষা করা তা না করে তো কেউই উত্তম হতে পারবে না। কুরআন মাজীদ না শিখে দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান শিখে ফেললেও সেই ব্যক্তিকে সর্বোত্তম বলা যাবে না। তাই সর্বাগ্রে সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দেওয়া জরুরি।
সন্তানকে যদি মা-বাবা কুরআন শিক্ষা দেন তাহলে আখিরাতে তারা অশেষ মর্যাদার অধিকারী হবেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত মুআয জুহানী রাদি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কুরআন শরীফ পড়বে এবং এর উপর আমল করবে তার পিতা-মাতাকে কিয়ামতের দিন এমন এক মুকুট পরানো হবে যার আলো সূর্যের আলো হতেও উজ্জ্বল হবে; যদি সে সূর্য তোমাদের ঘরের ভিতর হয়। (তবে তা যে পরিমাণ আলো ছড়াবে সে মুকুটের আলো উহা হতেও অধিক হবে।) তাহলে সে ব্যক্তি সম্পর্কে কী ধারণা যে স্বয়ং কুরআনের উপর আমল করেছে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৪৮)
সন্তানকে সুসন্তান ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার আরেক উত্তম পদ্ধতির নাম হল সৎসঙ্গ। এজন্য প্রথমেই সন্তানকে ভাল সংশ্রবে রাখা দরকার। কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘তোমরা সত্যবাদীদের সাথে থাক।’’ এর রহস্য হল, সত্যবাদীদের সাথে থাকলে সত্যবাদী হওয়া যায়, আর মিথ্যাবাদীদের সাথে থাকলে মিথ্যাবাদী হওয়ার আশংকা রয়েছে। এটা কুরআন-হাদীস, বিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারাই প্রমাণিত ও অতি বাস্তব কথা। দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে মেয়েদের সাথে কখনো নিজ সন্তানকে মিশতে দেয়া ঠিক নয়। সেজন্য সংশ্রবের ব্যপারে সতর্ক থাকা জরুরি। মন্দ সংশ্রবের কারণে বাচ্চাদের মধ্যে মন্দ স্বভাবের প্রভাব পড়ে।
বর্তমান যুগের মায়েরা আরেকটি কথা বলেন যে, ছেলে-মেয়েরা ঘরে থাকে না শুধু বাইরে চলে যায়, তাই টিভি কিনে দিয়েছি। জেনে রাখা উচিত, টিভি, ভিসিডি এগুলো চরিত্র ও ঈমান বিধ্বংসী হাতিয়ার। এসব জিনিস দিয়ে সন্তান ধ্বংস হওয়ার অসংখ্য ঘটনা চোখের সামনেই বিদ্যমান। সুতরাং আমাদের নিজেদেরই উপায় বের করতে হবে কীভাবে আমরা সন্তানদের এগুলো থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি।
উপরোল্লিখিত বিষয়গুলি সন্তান আদর্শবান হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উপায়। এ ছাড়া মা যদি সন্তানকে প্রকৃত আদর্শবান করে গড়ে তুলতে চান তাহলে তার উচিত ছোট থাকতেই সন্তানকে প্রতিটি কাজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নতে অভ্যস্ত
করে তোলা। এর একটি উপায় হল, তার সামনে নিজে সুন্নতের আমল করা। জায়গায় জায়গায় মাসনূন দুআগুলি পাঠ করা। এতে নিজেরও উপকার হবে সন্তানেরও ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবে।
এ কাজটি আমরা এভাবে করতে পারি:
* যখন বাচ্চা ঘুম থেকে জাগ্রত হয় তখন মা তার সামনে ঘুম থেকে উঠার দুআ পড়ে নিবেন। যদিও বাচ্চা পড়তে না পারে কিন্তু এ থেকেই তার মাঝে অভ্যাস গড়ে উঠবে।
* বাচ্চা বাথরুমে গেলে খেয়াল রাখা সে জুতা পায়ে দিল কি না। মাথায় টুপি বা রূমাল-ওড়না না থাকলে তা পরিয়ে দেয়া। বাথরুমে যাওয়া-আসার দুআ এবং অন্যন্য আদবগুলি মা জোরে জোরে বলে দিবেন তখন সে শুনতে শুনতেই মুখস্থ করে ফেলবে।
* পোশাকাদির ক্ষেত্রে ডান-পা ডান-হাত আগে পরিয়ে দেয়া। অনুরূপ জুতার ক্ষেত্রেও। নতুন কাপড় হলে তার দুআও শিখিয়ে দেয়া।
* বাচ্চাদের খাওয়ানোর সময় বলা, এক জায়গায় বসে খেতে হয়, মাটিতে পড়ে গেলে উঠিয়ে পরিষ্কার করে খেতে হয় এবং খাওয়ার অন্যান্য আদব যেমন বিসমিল্লাহ বলা, দুআ পড়া, দস্তরখান বিছানো এগুলো শেখানো।
* কাউকে কিছু দিতে হলে কিংবা নিতে হলে যেন ডান হাতে নেয় সেদিকে খোয়াল রাখা।
অনেক বাচ্চাদেরই অভ্যাস কাউকে কিছু দিতে চায় না। তাই কাউকে কিছু দিতে চাইলে বাচ্চার মাধ্যমেই দেয়ার চেষ্টা করা। মাঝেমধ্যে তার সঙ্গী-সাথী বাচ্চাদেরকেও কিছু দেয়ার অভ্যাস করানো। এতে করে তার মধ্যে অন্যকে দেয়ার গুণ সৃষ্টি হবে।
* বাসায় মেহমান আসলে নিজে যেমন সালাম দিবে, মুসাফাহা করবে তেমনি বাচ্চাকে দিয়েও করাবে।
* কোনো কাজ বাচ্চার মাধ্যমে করালে সাথে সাথে মাশাআল্লাহ বলবে। কোনো কিছু হারিয়ে গেলে ইন্নালিল্লাহ বলা শেখাবে। হোক সেটা অতি তুচ্ছ জিনিস। এমনিভাবে যেখানে যা বলতে হয় যেমন জাযাকাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ ইত্যাদি গুরুত্বের সাথে শেখানো। দুআগুলি যেন জায়গায় জায়গায় অটোমেটিক বলতে পারে এ চেষ্টা করা। এর দ্বারা বাচ্চার যিকিরের অভ্যাস হয়ে যাবে।
* ছবিযুক্ত পোশাক পরাবে না। ভুলেও পশ্চিম দিকে পেশাব করাবে না।
* কাউকে গালি দিলে কিংবা কোনো আঘাত করলে সাথে সাথে তার থেকে মাফ চাইয়ে নেয়া। যাতে সে অন্যায়টা বুঝতে পারে এবং মাফ চাওয়ার গুণ তৈরি হয়। কাজের মানুষের সাথে যেন খারাপ আচরণ না করে সেদিকেও খেয়াল রাখা।
* যথাসম্ভব নম্রতার দ্বারা আদব কায়দা শিক্ষা দেয়া। নম্রতার দ্বারা যা হয় কঠোরতার দ্বারা তা হয় না। এজন্য কঠোরতা বাদ দিয়ে নম্রতার দ্বারাই শেখানো উচিত।
উপরোক্ত আদব কায়দাগুলি শেখানো মা-বাবা উভয়ের দায়িত্ব। ইতিহাসের পাতায় আমরা যত মহান ব্যক্তিদের দেখতে পাই তাদের এই সফলতার পিছনে দেখা যায় মায়ের অবদান বেশি। আর মা হলেন সন্তানের জন্যে প্রথম পাঠশালার প্রথম শিক্ষক। তাই মাকে হতে হবে সন্তানের প্রতিটি ক্ষেত্রে সজাগ ও দায়িত্ববান। ইসলামী কবি আল্লামা ইকবাল বলতেন যে, বিলেত থেকে ফেরত আসার পরও যখন আল্লাহকে ভুলিনি তখন আশা করা যায় আর ভুলবো না। যখন লোকেরা বলত, ইকবাল! বিলেতের ঐ চাকচিক্য দেখেও তুমি কী করে আল্লাহকে স্মরণ রাখতে পারলে? উত্তরে বলতেন, সেই ছোটকালে আমার মা আমার চোখে যে মুহাম্মাদী সুরমা-ইসলামী শিক্ষা লাগিয়ে দিয়েছেন তার বরকতে এত কিছু স্বত্ত্বেও আমি আল্লাহকে ভুলিনি।
শিশুর মনমানসিকতা, ধ্যান-ধারণা, বোধ-বিশ্বাস, রুচি-শিক্ষা, স্বভাব-সভ্যতা, ভদ্রতা তথা সদগুণ একজন মা যত সহজে তার সন্তানের মধ্যে প্রবেশ করাতে পারেন অন্য কারো দ্বারা তা ততটা সহজে সম্ভব নয়।
আল্লাহ তাআলা প্রতিটি নারীকে সচেতন ও দায়িত্ববান মা হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।
(লেখাটির কনসেপ্ট ও আইডিয়া গুলি আমার আম্মুর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। উনার জন্য দুআর দরখাস্ত রইলো।)
বিষয়: বিবিধ
১৪৯২ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক সুন্দর লেখা ।
আল্লাহ আপনার আম্মুকে হায়াতে ত্যায়েবা দান করুন ।আমীন ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন