রমাদ্বান মাস ব্যপি কুরআন-হাদীস আলোচনা সিডিউল আলোচনা সূরা লাহাব

লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ১৭ জুলাই, ২০১৪, ১২:০০:০৯ রাত

(আমাদের প্রিয় সিনিয়র ব্লগার ভিশু ভাইয়ের প্রস্তাবিত রমাদ্বান উপলক্ষ্যে মাসব্যপি কুরআন হাদিস ও ইসলামী আলোচনারর সিডিউল অনুযায়ী আমার অংশ)

সূরা লাহাব






পরিচিতি:

সূরা লাহাব (সূরা মাসাদ নামেও পরিচিত) কুরআন শরীফের ১১১ নং সূরা। সূরাটি কুরআনের সর্বশেষ অর্থাৎ ৩০তম পারার সূরা। এই ৫ আয়াত বিশিষ্ট সূরাটি মক্কায় নব্যুয়তের ৭ম বর্ষে নাজিল হয়।

শানে নুযুল (প্রেক্ষাপট):

বুখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী (ইবনে আব্বাস রাযি.-এর রাওয়ায়েতে), যখন ”فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ (অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের পরওয়া করবেন না)” (সূরা হিজর, আয়াত-৯৪) নাজিল হয়, তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কার সাফা পাহাড়ে আরোহন করেন এবং কুরাইশ গোত্রের বিভিন্ন বংশকে ”ইয়া আবদে মানাফ” ”ইয়া আবদে মুত্তালিব” ইত্যাদি নাম সহকারে ডাকতে আরম্ভ করেন। অন্যত্র বর্ণনা হয়েছে তিনি সকলকে ”ইয়া সাব’হা’হ, ইয়া সাবা’হা’হ (হে ভোরের বিপদ, হে ভোরের বিপদ)” বলে ডাক দিতে শুরু করেন। এভাবে ডাক দেয়া তৎকালীন কুরাইশদের কাছে বিপদাশংকার লক্ষনরূপে বিবেচিত হতো। অল্পক্ষণের মধ্যেই কুরাইশের প্রায় সমস্ত গোত্রের নেতা সেখানে উপস্থিত হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ”আমি যদি বলি এই পর্বতমালার পিছন থেকে শত্র“দল ক্রমশ এগিয়ে আসছে এবং সকালে বা বিকালে যে কোন সময়ে তোমাদের উপর আক্রমন করবে, তোমরা কি তা বিশ্বাস করবে?” সমবেত সকলে সমস্বরে বললো, “হ্যাঁ। আমরা অবশ্যই বিশ্বাস করবো।” তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “শোনো, আমি তোমাদের আল্লাহর ভয়াবহ শাস্তির আগমন সংবাদ দিচ্ছি”। হযরতের কথা শেষ হতে না হতেই আবু লাহাব বলে উঠলো, “তোমার সর্বনাশ হোক, এ কথা বলার জন্যই কি তুমি আমাদের ডাক দিয়েছো!” অন্যত্র বর্ণনায় এসেছে, আবু লাহাব তার হাত ঝেড়ে বললো “তোমার প্রতি সারাদিন অভিশাপ বর্ষিত হোক।” তার এই কথা শুনে উপস্থিত সকলেই সে স্থান ত্যাগ করলো এবং রাসূল (সাঃ)-এর দাওয়াত অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। আবু লাহাবের অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে পাথর মারতে উদ্যত হল। এহেন রূঢ় আচরনের প্রেক্ষিতে সূরা লাহাব নাজিল হয়।

আবু লাহাবের পরিচিতি ও রাসূল (সাঃ)-সাথে তার ও তার পরিবারের কৃত দূর্ব্যবহারের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:

আবু লাহাবের আসল নাম ছিলো আব্দুল উজ্জা। গাঢ় রক্তিম শ্বেতবর্ণের শরীর ও অসম্ভব বদমেজাজের কারণে তার উপাধি দেয়া হয় আবু লাহাব (অগ্নিশিখার পিতা), যা পরবর্তীতে তার আসল নামকেই আড়াল করে ফেলে। ৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল মুত্তালিবের ঘরে তার জন্ম। সেদিক থেকে আবু লাহাব রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আপন চাচা।

পরিণত বয়সে আবু লাহাব আবু সুফিয়ানের বোন উম্মে জামিলা বিনতে হারবকে বিয়ে করে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কষ্ট দেয়া, অপমান করা ও লাঞ্ছিত করার ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানীয় ছিলো। তাদের দুই ছেলে উতবা ও উতাইবার সাথে রাসূলুল্লাহর দুই মেয়ে রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুম (রাযি.)-এর সাথে নব্যুয়তের পূর্বে বিয়ে হয় (প্রসঙ্গত, তাদের শুধু আকদ হয়েছিলো, রুখসাতী হয়নি)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নব্যুয়তের ঘোষনা দেয়া মাত্র আবু লাহাব ও উম্মে জামিলা তাদের ছেলেদের রাসূলের (সাঃ) মেয়েদের তালাক দিতে বাধ্য করে।

নব্যুয়তের প্রথম দিক থেকেই আবু লাহাব ইসলামের পরিপূর্ণ বিরোধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এ কাজে সে তার সমস্ত সম্পদ ও শক্তি নিয়ে নিয়োজিত ছিলো। ইসলামের প্রথম প্রকাশ্য দাওয়াতের ঘটনা থেকেই (যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে) তার এই ভূমিকা প্রত্যক্ষ হয়।

হযরত রবীআহ ইবনে ইবাদ দাইলি (রাযি.) ইসলাম গ্রহনের পর ইসলাম গ্রহনের পূর্বের ঘটনার বর্ণনাক্রমে বলেন, “আমি নবী পাক (সাঃ) কে একবার যুল মাজায এর বাজারে দেখেছিলাম, সে সময় তিনি বলছিলেন ‘হে লোক সকল!’ আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল রূপে প্রেরিত হয়েছি। আমি তোমাদেরকে বলছি যে, তোমরা এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত করবে, তাল সাথে কাউকেও শরীক করবে না। তোমরা আমাকে সত্যবাদী বলে বিশ্বাস করো এবং আমাকে শত্র“দের কবল থেকে রক্ষা করো, তাহলে আল্লাহ তাআ’লা আমাকে যে কাজের জন্য প্রেরণ করেছেন সে কাজ আমি করতে পারবো।” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যেখানেই এ পয়গাম পৌছাতেন, পরক্ষনেই গৌরকান্তি ও ট্যারা চোখ বিশিষ্ট এক লোক, যার মাথার চুল দুপাশে সিথি করা, সে সেখানে পৌছে বলতো, “হে অমুক গোত্রের লোকেরা! এ ব্যক্তি তোমাদেরকে লাত, উয্যা থেকে দূরে সরাতে চায় এবং বানু মালিক ইবনে আকইয়াসের ধর্ম থেকে তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়াই তার উদ্দেশ্য। সে নিজের আনীত গুমরাহীর প্রতি তোমাদেরকেও টেনে নিতে চায়। সাবধান। তার কথায় বিশ্বাস করো না।”

ইসলামের বাণিকে প্রসারিত হওয়ার থেকে রোধ করতে বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে আবু তালিবের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রেও আবু লাহাবের ভূমিকা ছিলো। এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করার ক্ষেত্রেও সে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এ সকল বিষয়গুলো সীরাতের কিতাবে বিস্তারিত আলোচনা করা আছে। আগ্রহী পাঠকবৃন্দকে সুযোগ মতো পড়ে দেখার অনুরোধ করছি।

আবু লাহাব কুরাইশদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় সম্পত্তিবান ছিলো। আর এই অর্থ-সম্পদের উপর তার বড়ই অহংকার ছিলে। তার সম্পদের একটা বিরাট অংশ সে ব্যায় করেছে ইসলামের বিরুদ্ধে। বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে সে তার পক্ষ থেকে বিশাল পরিমানের অর্থ যুদ্ধের জন্য দান করে।

তার স্ত্রী উম্মে জামিলাও এক্ষেত্রে কোন অংশে কম ছিলো না। যেহেতু রাসূল (সাঃ) তাদের প্রতিবেশী ছিলেন, তারা নানা অজুহাতে রাসূল (সাঃ)-কে কষ্ঠ দিতে কুন্ঠা বোধ করতো না। কখনো ময়লা-আবর্জনা রাসূলের (সাঃ) বাড়ির সামনে ফেলে রাখতো, কখনো তার (সাঃ) চলার পথে কষ্টদায়ক দ্রব্যাদি ছিটিয়ে রাখতো। এভাবে রাসূলের (সাঃ) বিরোধীতায় তারা সর্বত্র লিপ্ত ছিলো।

বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে কুরাইশ কাফির বাহীনির শোচনীয় পরাজয়ের মাত্র ১০ দিন পর আবু লাহাব মৃত্যু বরণ করে। বদর যুদ্ধে কুরাইশদের পরাজয়ের খবর সর্বপ্রথম মক্কায় নিয়ে আসে আল-হাইসুমান এবং আবদুল্লাহ ইবনুল খুজাই। তাদের মুখে কুরাইশদের পরিণতির কথা শোনার পর আবু লাহাব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জমজম কুপের নিকট গমন করে। ততক্ষণে সেখানে একটা ছোটখাটো ভিড় জমা হয়ে যায়। সেখানে আবু সুফিয়ানের সাথে তার সাক্ষাত হয় এবং সে আবু লাহাবকে যুদ্ধের বিবরণ শোনাতে থাতে। সে বলে ”আল্লাহর কসম। আমরা যুদ্ধের ময়দানে দেখেছি আসমান ও জমিনের মাঝে কিছু অশ্বারোহী মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তার বাহীনিকে রক্ষা করছিলো।”

আব্বস (রাযি.)-এর এক গোলাম আবু রাফি বর্ণনা করে “আমি সেখানে বসা ছিলাম। আমি আমার হাত উঠিয়ে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করলাম এবং বললাম সেখানে ফেরেশতারা ছিলো। এ কথা শুনে আবু লাহাব এতটাই ক্ষুব্ধ হয় যে সে প্রচন্ড জোরে আমার চেহারায় আঘাত করে এবং আমাকে তুলে আছাড় মারে।” এবং সে তাকে মারতেই থাকে। ইতোমধ্যে উম্মুল ফযল (আব্বাস রাযি. এর স্ত্রী) সেখানে উপস্থিত হন। তিনি অবস্থা দ্রষ্টে একটা লাঠি নিয়ে আবু লাহাবের মাথায় আঘাত করে এবং বলে “তুমি কি তাকে দূর্বল ও একা ভেবেছ?”

আঘাতটি এতো গুরুতব ছিলো যে আবু লাহাবের মাথা ফেটে যায়। ক্ষতস্থান থেকে অনবরত তরল নির্গত হতে থাকে। পরের দিন থেকে তার শরীরে একপ্রকার ক্ষত দেখা যায় যা পরবর্তীতে পচনে রূপ নেয়। তার শরীর থেকে এমন দূর্গন্ধ বের হতে থাকে যে তার কাছে কেউ যেতে পারে না। তাকে বাড়ি থেকে দূরে একটি কামরায় রাখা হয়, সেবাযতেœর জন্যও কেউ ছিলো না এমনকি খাবারও জানালা থেকে ছুঁড়ে দেয়া হতো। এভাবেই ঘটনার ৭ দিন মতান্তরে ১০দিন পর তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর দূর্গন্ধের জন্য কেউ তাকে কবর দিতে যাচ্ছিলো না। অতঃপর লোক লজ্জার ভয়ে তার ছেলেরা কবর দেয়ার জন্য হাবশি মজুর নিয়োগ দেয়। তারা বাঁশের লাঠির মাধ্যমে ধাক্কা দিয়ে মৃতদেহটি গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে আসে। এভাবেই আবু লাহাবের গর্ব ও অহংকারের করুণ পরিণতি প্রাপ্ত হয়।

সূরা লাহাবের আনুসাঙ্গিক বিষয়:

আল্লাহ তা’আলা এই সূরার শুরুতে বলেছেনঃ আবু লাহাবের দুই হাত ধ্বংস হোক এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক।

ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, “আবু লাহাব একদিন বলতে লাগলো “মুহাম্মাদ (সাঃ) বলে যে, মৃত্যুর পর অমুক অমুক কাজ হবে। এরপর সে তার হাতের দিকে ইশারা করে বললো, এই হাতে সেগুলোর মধ্য থেকে একটিও আসেনি। অতঃপর সে নিজের হাতকে লক্ষ্য করে বলল: ধ্বংস হও তোমরা। মুহাম্মদ (সাঃ) যেসব বিষয় সংঘটিত হওয়ার কথা বলে আমি সেগুলোর মধ্যে একটিও তোমাদের মধ্যে দেখিনা। উক্ত আয়াত দ্বারা এদিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে।

অতঃপর আল্লাহ বলেনঃ তার ধন-সম্পদ এবং যা সে অর্জন করেছে (ব্যবসায়িক মুনাফা ও সন্তান সন্ততি) তার কোন কাজেই আসবে না।

ইবনে মাসউদ (রাযি.) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ যখন তার স্বজাতিকে আল্লাহর পথে আহবান জানালেন তখন আবু লাহাব বলতে লাগলো “যদি আমার ভাতিজার কথা সত্য হয় তবে আমি কিয়ামতের দিন আমার ধন সম্পদ আল্লাহকে ফিদিয়া হিসেবে দিয়ে তার আযাব থেকে আত্মরক্ষা করবো। প্রয়োজনে আমার সকল পুত্রকে ফিদিয়া দিয়ে নিজেকে রক্ষা করবো। এ প্রেক্ষিতেই আয়াতটি নাজিল হয়।

এরপর মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেন, “অচিরে সে দগ্ধ হবে লেলিহান অগ্নিতে এবং তার স্ত্রীও”

এখানে মূলত আবু লাহাবের দম্ভ, অহংকার ও ইসলাম বিদ্বেষের ভয়াবহ পরিণামের কথা বলা হচ্ছে। যেহেতু তার স্ত্রী উম্মে জামিলাও এসব ক্ষেত্রে স্বামীর পূর্ণ সহায়িকা ছিলো, মক্কার নারী সমাজের মধ্যে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানোর মূল ভূমিকা সেই পালন করতো, তাই স্বামীর সাথে তাকেও এই কঠোর আযাব ভোগ করতে হবে।

পরবর্তীতে মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, “ সে (উম্মে জামিলা) লাকড়ী (ইন্ধন) বহনকারী। ”

حَمَّالَةَ الْحَطَبِ-এর অর্থ ‘গীবতকারিণী’ অর্থও করা হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর (রহ.) এই অর্থই পছন্দ করেছেন। ইবনে আব্বাস (রাযি.) বর্ণনা করেছেন যে, আবূ লাহাবের স্ত্রী জঙ্গল থেকে কাঁটাযুক্ত কাঠ কুড়িয়ে এনে তা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চলার পথে বিছিয়ে রাখতো। এটাও বলা হয়েছে যে, এ নারী রাসূল (সাঃ)-কে ভিক্ষুক বলে তিরস্কার করতো। এ কারণে তাকে কাষ্ঠ বহনের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রথমোক্ত কথাই বেশি গ্রহনযোগ্য। বাকী আল্লাহ ভালো জানেন।

সর্বশেষ সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন- “ তার (উম্মে জামিলার) গলদেশে পাকানো রশি।”

সাঈদ ইবনে মুসাইব (রহ.) বলেন যে, আবু লাহাবের স্ত্রীর কাছে একটি সুন্দর গলার মালা ছিলো। সে বলতো, “আমি এ মালা বিক্রি করে তা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বিরোধীতায় ব্যয় করবো। এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেন, তার গলদেশে থাকবে পাকানো রশি। অর্থাৎ তার গলদেশে আগুনের বেড়ী পরিয়ে দেয়া হবে।

হযরত আয়িশা (রাযি.) বলেন যে, “এ সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর ধাঙ্গড় নারী উম্মে জামিলা নিজের হাতে কারুকার্য খচিত, রং করা পাথর নিয়ে কবিতা আবৃত্তির সূরে নিম্নলিখিত কথাগুলো বলতে বলতে রাসূলুল্লাহর নিকট আগমন করে-

“আমি মুযাম্মামের অস্বীকারকারিণী, তার দ্বীনের দুশমন এবং তার হুকুম অমান্যকারীনি।”

রাসূল (সাঃ) ঐ সময় কা’বা গৃহে বসে ছিলেন। সাথে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাযি.)ও ছিলেন। তিনি উম্মে জামিলাকে আসতে দেখে রাসূল (সাঃ)-কে বলেন “হে আল্লাহর রাসূল। সে আসছে, আপনাকে আবার দেখে না ফেলে!” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন বললেন, “হে আবু বকর। নিশ্চিন্ত থাকো, সে আমাকে দেখতে পাবেই না।” অতঃপর রাসূল (সাঃ) কুরআন তিলাওয়াত করতে থাকলেন। অতঃপর উম্মে জামিলা আবু বরক (রাযি.) কে বললো, “তোমার সাথী (কবিতার ভাষায়) আমার দূর্নাম রটাচ্ছে।” আবু বকর (রাযি.) কসম করে বললেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাব্য চর্চা করতে জানেন না এবং তিনি কবিতা কখনো বলেননি।” তখন এই দুষ্টা নারী এই বলতে বলতে চলে গেলো যে, “কুরাইশরা জানে যে আমি তাদের সর্দারের মেয়ে।” সে চলে যাওয়ার পর আবু বকর (রাযি.) রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসূল। সে কি আপনাকে দেখতে পায়নি?” রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উত্তর দিলেন, “তার চলে না যাওয়া পর্যন্ত ফেরেশতা আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলো।”

সূরা লাহাবের শিক্ষা:

এ সূরার সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, ধন-সম্পত্তি, ক্ষমতা, মর্যাদা, সন্তান-সন্ততি এমনকি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে আত্মিয়তাও আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে না, যতক্ষন না ঈমান আনা হবে এবং ইসলামের পথে জীবন পরিচালনা করা হবে। আবূ লাহাবকে কুরআনে একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে, এর তার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে যে- মক্কার শীর্ষস্থানিয় নেতা, অগাধ সম্পদের মালিক ও রাসূলের (সাঃ) আপন চাচা হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম ও রাসূলের (সাঃ) বিরোধীতা ও শত্র“তা করার কারণে তাকে এক চরম পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। তার দুনিয়ার পরিণতি কতই না ভয়াবহ, পরকালে তার জন্য অপেক্ষা করছে অনন্ত আযাব আর যন্ত্রনা। এর মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হলো যে, “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক মুত্তাকি (পরহেযগার)” (সূরা আল-হুজরাত, আয়াত-১৩)

সূরা লাহাব- কুরআনের আরেকটি জ্বলন্ত মু’জিজা:

সূরা লাহাবারে মাধ্যমে আল্লাহ তার কালাম পবিত্র কুরআনের আরেকট্ িমুজিজা প্রকাশ করেছেন। লক্ষ্যনীয় যে, মক্কা ও অন্যান্য স্থানের কাফির-মুশরিকরা বহুবার বহুভাবে রাসূল (সাঃ)-কে কষ্ট দিয়েছে; এমনকি তাঁর (সাঃ) প্রাণ নাশেরও চেষ্ঠা করেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে নাম ধরে কুরআনে কখনো অভিশাপ করা হয়নি। এর ব্যাখ্যা হলো রাসূলের (সাঃ) সেই বাণী, যা তায়েফের কালে তিনি বলেছিলেন, “...হতে পারে এরা পরবর্তীতে মুসলমান হয়ে যাবে, অথবা এদের বংশ থেকে কেউ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিবে।” কিন্তু ব্যতিক্রম আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর ক্ষেত্রে।

তাদের মৃত্যুর ১০ বছর পূর্বেই কুরআন তাদের কুফরের পরিণতির কথা স্পষ্ট করেছে, পাশাপাশি পরকালে তাদের আযাবের কথাও ঘোষণা করেছে। যে আবু লাহাব সারাজীবন রাসূল (সাঃ) ও ইসলামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্ঠায় লিপ্ত ছিলো, তার কাছে এর চেয়ে মোক্ষম সুযোগ আর কি ছিলো, রাসূল (সাঃ) ও কুরআনকে মিথ্যা প্রমাণ করার! তাকে শুধু ইসলাম গ্রহণের অভিণয় করতে হতো, তাতেই সে বলার সুযোগ পেত, দেখ মুহাম্মাদ (সাঃ) বলে আমি নাকি আমার কৃতকর্মের দরুন অবশ্যই জাহান্নামের আযাব ভোগ করবো, এখন তো আমি মুসলমান হয়ে গেলাম। কাজেই এই সব কিছু মিথ্যা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এ চিন্তা তার মাথায় একবারও আসেনি। শেষ পর্যন্ত সে ইসলামের বিরোধিতা করে গেলো এবং এ অবস্থাতেই মৃত্যু বরণ করলো। এর সাথেই আল্লাহর কালাম ও তার রাসূলের (সাঃ) সত্যতা প্রমাণ হয়ে গেল।

মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের কুরআনের প্রতিটি শিক্ষা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।

তথ্যসূত্র:

১. তাফসিরে মাআরিফুল কুরআন- মুফতি মুহাম্মাদ শাফি উসমানি রহ.

২. তাফসিরে বয়ানুল কুরআন- হাকিমুল উম্মাত আশরাফ আলি থানভী রহ.

৩. তাফসিরে ইবনে কাসির- ইসমাঈল ইবনে কাসির রহ.

৪. আহকামুল কুরআন- আবু বকর আল জাসসাস রহ.

৫. ফি যিলালিল কুরআন- শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব রহ.

৬. তাফসিরে ইবনে আব্বাস- আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. (ইফা)

৭. তাওযিহুল কুরআন- মুফতি মুহাম্মাদ ত্বকি উসমানি দা.বা

৮. তাফসিরে জালালাইন -আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতী রহ. ও জালালুদ্দিন মাহাল্লি রহ.

৯. তাফসিরে বাইযাভি- কাযী নাসিরউদ্দিন আবদুল্লাহ ইবনে উমর বাইযাভি রহ.

১০. অন্যান্য

(সবগুলো থেকে নির্যাস সংগ্রহ করে সংক্ষিপ্ত রূপে কৃত)

একবার দেখে আসুন আমার অন্যান্য লেখাগুলো

বিষয়: বিবিধ

৩৩৫৯ বার পঠিত, ৩৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

245305
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১২:৫৪
মাটিরলাঠি লিখেছেন :
Rose Rose Rose @};
জাজাকাল্লাহু খাইরান। সুন্দর আলোচনা করেছেন। এই সূরা এক জলন্ত মুজিজা আল্লাহ্‌পাকের পক্ষ থেকে। এই সূরা অবিশ্বাসী কাফেরের কুফুরী বাড়িয়ে দেয়, আবার ঈমানদার মুমীনের ঈমানকে আরো বৃদ্ধি করে দেয়। সূরা লাহাব নিয়ে আরেকটি লিঙ্ক শেয়ার দিলাম, আশাকরি যারা পড়েননি তাদের ভালো লাগবেঃ সুরা আবু লাহাব- কঠোর শাস্তির আড়ালে লুকানো বেদনা গুলো


১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৪২
190680
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
245308
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ০১:০৩
সন্ধাতারা লিখেছেন : What a wonderful discussion and presentation alhamdulillah. We have to take a great lesson from this topic. Jajakalla khair for your hard work.
১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৩
190681
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : Thank you very much for your kind comment. Jazakallahu Khair.
245336
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ০৩:৪২
ভিশু লিখেছেন : আলহামদুলিল্লাহ! সুম্মা আলহামদুলিল্লাহ! অনেক কষ্ট করে, পড়াশোনা করে তৈরি করেছেন অসাধারণ এই দারসটি! শিক্ষাগুলোও ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে! রমযান-আলোচনা-সমগ্রে যোগ করা রইলো! অবসর সময়ে মন দিয়ে বারবার পড়া যাবে, ইনশাআল্লাহ! মহান রব আপনার পরিশ্রম এবং সময় ব্যয়কে কবুল করুন, পুরস্কৃত করুন! আমীন!
১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৩
190682
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : আমিন......জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ ভাই।
১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৭
190688
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : ভাই, রমাদ্বানের সবগুলো লেখা একত্রিত করে একটি স্মরণিকা টাইপের বের করা যায় কি? এতে আমাদের মাঝে যারা অনলাইনে আসতে পারেন না, তারাও পড়ার সুযোগ পাবেন। অপরদিকে সকলেরই মানসম্মত লেখার আগ্রহ আরো বেড়ে যাব।ে একটু ভেবে দেখুন।
245337
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ০৩:৪৬
শারমিন হক লিখেছেন : মাশাল্লাহ!খুব সুন্দর হয়ছে।
১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৪
190683
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
245356
১৭ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৫:৩৩
শেখের পোলা লিখেছেন : বর্ণনা বেশ সুন্দর হয়েছে৷ এর থেকে শিক্ষা গ্রহন করাই উচিৎ৷
১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৬
190687
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
245364
১৭ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৫:৪৬
বাজলবী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ খায়ের।
১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৪
190684
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
245371
১৭ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৫:৫৮
রাইয়ান লিখেছেন : এত্ত সুন্দর হয়েছে আপনার তাফসীর উপস্থাপনা , যে কি বলব ! হিংসা ই হচ্ছে আমার। ( নেক কাজের ব্যাপারে হিংসা করা যায় বলেই করছি ভাইয়া ! ) ছোট্ট একটি সুরা , কিন্তু কি বিশাল তার শিক্ষা ! আল্লাহ এবং তার রাসুল (স) কে অমান্যের শাস্তি যে কি ভয়াবহ , সুরাটি পড়তে গিয়ে ভেবে গা শিউরে উঠেছে ....
১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৪
190685
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : সকল প্রশংসা একমাত্র মহান আল্লাহ তা'আলার জন্য।
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহু খইর।
245469
১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৪:২০
মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন লিখেছেন : জাজাকাল্লাহু খাইরান। খুবই চমৎকার একটি লেখা। যদি এ লেখা পড়ে একজন মানুষও দ্বীনের ছায়াতলে আসে তবেই আপনার চেষ্টা ও কষ্ট এবং ভীষু ভাইয়ের উদ্যোগ আর আমাদের সহযোগিতা সার্খক হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে কবুল করু্ন। আমীন।
১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৪৫
190686
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : সুম্মা আমীন ভাই.
জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
245492
১৭ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৫১
ইবনে আহমাদ লিখেছেন : আপনাকে মোবারকবাদ। এবং আপনাদের সিনিয়র ভাইকেও সমান মোবারকবাদ।সুন্দর একটি আয়োজন হয়েছে। চেষ্টা পড়ার।
১৭ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৯
190693
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
১০
245499
১৭ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২৩
প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন লিখেছেন : মাশা আল্লাহ দারুন প্রচেষ্টা। আল্লাহ আপনার এই লিখা যেন কবুল করেন।
১৭ জুলাই ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৮
190692
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : সুম্মা আমীন ভাই.
জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
১১
245535
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:০২
আবু তাহের মিয়াজী লিখেছেন : আলহামদু লিল্লাহ পড়ে খুব ভাল লাগলো। মহান আল্লাহ আপনাকে এবং ভিশু ভাইকে উত্তম জাজা দিন। আমীন।
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:২৬
190716
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : সুম্মা আমীন ভাই.
জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
১২
245556
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:৩৯
মোহাম্মদ লোকমান লিখেছেন : মাশা আল্লাহ্! বেশ সুন্দর আলোচনা হয়েছে। আপনার কষ্ট স্বার্থক হোক।
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১১:২৪
190727
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
১৩
245560
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:৪৩
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : আবু লাহাবেরা এখনও বিলিন হয়ে যায়নি, কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। ছোট্ট এই সূরা থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। মূল্যবান তথ্য দিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই আপনাকে।
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১১:২৫
190728
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : সে জন্যেই তো কুরআনে আবু লাহাবকে একটি বাস্তব উদাহরণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে, যাতে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল আবু লাহাব এখেকে শিক্ষা নিতে পারে।
জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
১৪
245571
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১১:০৪
জোনাকি লিখেছেন : ভাল্লেগেছে। জাযাকাল্লাহু খাইরান।
১৭ জুলাই ২০১৪ রাত ১১:২৫
190729
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
১৫
246284
২০ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৪:২৪
বুড়া মিয়া লিখেছেন : খুবই সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন; অনেক ধন্যবাদ।
২০ জুলাই ২০১৪ বিকাল ০৫:৫৬
191217
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহু খইর। অনেক ধন্যবাদ।
১৬
246464
২০ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:৩৩
egypt12 লিখেছেন : প্রিয়তে রইল Love Struck
২০ জুলাই ২০১৪ রাত ১০:৩৫
191339
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : Rose Rose Rose
জাযাকাল্লাহ খইর

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File