মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদের বিষয় দায়িত্বশীলদের উপর ছাড়ুন-৩
লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ২৬ জুন, ২০১৪, ০৮:৫০:২৭ রাত
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আগের পর্বগুলো পড়ুন এখানে
(পোস্টটা তূলনামূলক বেশ বড়ো। কিন্তু তথ্যবহুল। তাই একটু কষ্ট করে পড়ার অনুরোধ করছি)
তাবেয়ী-যুগ
কিছু আগে ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ.-এর বরাতে বলা হয়েছে, তাবেয়ীদের মাঝে ইকরিমা, কাসিম ও সালিম রাহ.-এর মাযহাব তা-ই ছিল, যা ছিল সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর মাযহাব। ‘আততামহীদ’ ছাড়া মুয়াত্তার দ্বিতীয় শরহ (ভাষ্যগ্রন্থ) ‘আলইসতিযকারে’ও তিনি ঐ তাবেয়ীগণের মাযহাব উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্যের আরবী পাঠ এই-
وبه قال عكرمة، والقاسم بن محمد، وسالم بن عبد الله، وإليه ذهب ابن المبارك، وإسحاق بن راهوية، وطائفة.
‘‘এটিই ইকরিমা, কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ ও সালিম ইবনে আবদুল্লাহর বক্তব্য। ইবনুল মুবারক ও ইসহাক ইবনে রাহূয়াহসহ একটি জামাতের মাযহাবও এটিই।’’ (আলইসতিযকার ১০/২৯)
ইকরিমা (২৫-১০৫ হি.) তো আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর খাস শাগরিদ, বড় মুহাদ্দিস ও ফকীহ।
কাসিম ইবনে মুহাম্মাদ (৩৭-১০৭ হি.) আবু বকর সিদ্দীক রা.-এর পৌত্র। আর সালিম ইবনে আবদুল্লাহ (১০৬ হি.) ওমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর পৌত্র। কাসিম ও সালিম এই দুইজন তাবেয়ী-যুগের ঐ সরতাজ সাত ফকীহগণের অন্যতম, যাদের ‘‘আলফুকাহাউস সাবআ’’ বলে স্মরণ করা হয়।
কাসিম রাহ. যে ‘সাত ফকীহ’র একজন এ বিষয়ে তো সবাই একমত। আর সালিম রাহ.ও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ইবনুল মুবারক রাহ.-এর মতে। ফিকহ-ফতোয়ায় ‘‘সাত ফকীহ’’র মতামতের যে বিশেষ মর্যাদা ও বিশেষত্ব সে সম্পর্কে উসূলে ফিকহ ও তারীখে ফিকহের পারদর্শী ব্যক্তিগণ অবগত।
তো এই দুই মনীষীর মাযহাবও এটাই ছিল যে, প্রত্যেক অঞ্চলের অধিবাসীগণ নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করবে, দূরবর্তী অঞ্চলের চাঁদ দেখা তাদের জন্য আবশ্যকীয় নয়। এঁদের সাথে তৃতীয় তাবেয়ী ইকরিমা রাহ.-এরও মাযহাব এটাই ছিল।
এই তিন তাবেয়ীর মাযহাব সম্পর্কে একথা আরো অনেক আগে বলেছেন ইবনুল মুনযির রাহ. (৩১৮ হি.) ‘‘ইশরাফ’’ গ্রন্থে (৩/১১২) এবং খাত্তাবী (৩৮৮ হি.) ও বাগাভী (৫১৬ হি.) সহ অন্যান্য গ্রন্থকারগণ।
(দ্র. মাআলিমুস সুনান ২/৮৪, শরহুস সুন্নাহ ৪/১৪৫, আরো দেখা যেতে পারে : আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ৬/২৮০ আছার : ৯৬৫৮
في القوم يرون الإهلال ولا يرونه الآخرون)
আমাদের জানা মতে তাবেয়ী-যুগের এই তিন বিশিষ্ট মনীষীর বিপরীতে অন্য কোনো তাবেয়ীর ফতোয়া বিদ্যমান নেই। শুধু হাসান বসরী (২১ হি.-১১০ হি.) রাহ. থেকে এমন একটি রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, যা এই মাযহাবের বিপরীত ধারণা করা হতে পারে। সুনানে আবু দাউদের কোনো কোনো নুসখায় (আবুল হাসান ইবনুল আবদ ও ইবনে দাছার বর্ণনাকৃত মাখতূতায়) আছরটি আছে-
عن الحسن، في رجل كان بمصر من الأمصار، فصام يوم الإثنين، وشهد رجلان أنهما رأيا الهلالَ ليلة الأحد، فقال : لا يقضي ذلك اليومَ الرجل ولا أهلُ مصره، إلا أن يعلموا أن أهل مصر من أمصار المسلمين قد صاموا يوم الأحد فيقضوه.
হাসান বসরী রাহ. থেকে বর্ণিত, কোনো ব্যক্তি কোনো শহরে ছিল এবং (সেই শহরবাসীদের সাথে) সোমবার রোযা শুরু করল। এরপর দুই ব্যক্তি এসে সাক্ষ্য দিল যে, তারা দুজন রবিবার রাতে (শনিবার দিবাগত রাতে) চাঁদ দেখেছে। (সুতরাং রবিবার থেকেই রোযা শুরু হওয়া উচিত ছিল) এ ক্ষেত্রে হাসান রাহ. বলেছেন, শুধু এটুকুর ভিত্তিতে ঐ ব্যক্তি ও শহরবাসী একটি রোযা কাযা করবে না। তবে তারা যদি জানতে পারে যে, কোনো মুসলিম শহরের অধিবাসীগণ বাস্তবেই রবিবার রোযা রেখেছে তাহলে তারা ঐ দিনের রোযা কাযা করবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৩৩৩; তুহফাতুল আশরাফ, হাদীস : ১৮৪৯২)
শব্দের ব্যাপকতা থেকে হাসান বসরী রাহ.-এর ফতোয়ার যদি এ অর্থ করা হয় যে, দূর-দূরান্তের কোনো শহরের অধিবাসীদের বিষয়েও তারা একদিন আগে রোযা রেখেছিল বলে প্রমাণিত হলে এ শহরের অধিবাসীগণকে এক দিনের রোযা কাযা করতে হবে, তাহলে বলা যায়, হাসান বসরী রাহ.-এর মাযহাব ছিল, এক অঞ্চলের চাঁদ দেখা অন্য অঞ্চলের জন্য (যদি প্রমাণিত হয়) অবশ্যগ্রহণীয়।
সারসংক্ষেপ
এ পর্যন্ত আলোচনার সারসংক্ষেপ এই যে, দূর-দূরান্তের অঞ্চলের চাঁদ দেখা ওয়াজিবুল আমল (অবশ্যগ্রহণীয়) না হওয়ার বিষয়ে সাহাবা-যুগে আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর মাযহাব পাওয়া গেল, এর বিপরীত কিছু কারো থেকে পাওয়া যায়নি। তাবেয়ী-যুগে তিন বড় মনীষী ইকরিমা রাহ., কাসিম রাহ. ও সালিম রাহ. থেকেও এই মাযহাবই পাওয়া গেল। এর বিপরীত বিবরণ শুধু এক হাসান বসরী রাহ. থেকে পাওয়া যায় যদি তাঁর ফতোয়াকে শব্দের ব্যাপকতার উপর রাখা হয়। নতুবা শক্তিশালী সম্ভাবনা আছে, তাঁর উদ্দেশ্য, নিকটবর্তী কোনো শহরে চাঁদ দেখা ও রোযা রাখা প্রমাণিত হলে কাযা আসবে, অন্যথায় নয়।
চার মাযহাবের মুজতাহিদ ও অন্যান্য ফকীহগণের সিদ্ধান্ত
ইমাম তিরমিযী রাহ. (২৭৯ হি.) তার ‘জামি’ গ্রন্থে কিতাবুস সিয়াম (সিয়াম-অধ্যায়)-এর নবম বাব (পরিচ্ছেদের) শিরোনাম দিয়েছেন-
باب ما جاء لكل أهل بلد رؤيتهم
(প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য নিজ নিজ চাঁদ দেখা অনুসরণীয় সংক্রান্ত হাদীস) এই শিরোনামের অধীনে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর ঐ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, যা ‘সাহাবা-যুগ’ শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখিত হয়েছে। এই হাদীস বর্ণনার পর ইমাম তিরমিযী রাহ. লেখেন-
حديث ابن عباس حديث حسن صحيح غريب. والعمل على هذا الحديث عند أهل العلم، أن لكل أهل بلد رؤيتهم.
ইবনে আববাস রা.-এর উপরোক্ত হাদীস ‘সহীহ’। (ইমাম তিরমিযীর বিশেষ পরিভাষায় ‘‘হাসানুন সহীহুন গরীবুন’’) এবং আহলে ইলমের (ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের) আমলও এটাই যে, প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য নিজেদের দেখাই গ্রহণযোগ্য। (জামে তিরমিযী ২/২৩২, হাদীস : ৭০২-এর অধীনে)।
ইমাম তিরমিযী রাহ. বিধান সংক্রান্ত হাদীসের অধীনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হাদীসের ইমাম ও মুজতাহিদ ফকীহগণের মাযহাব বর্ণনা করে থাকেন। সাহাবা, তাবেয়ীনের মাযহাবের সাথে চার ইমাম, সুফিয়ান ছাওরী ও ইসহাক ইবনে রাহূয়াহ রাহ.-এর মাযহাব বিশেষভাবে বর্ণনা করেন। অথচ আলোচ্য বিষয়ে তিনি কোনো ইখতিলাফই বর্ণনা করেননি। সাধারণভাবে ‘আহলে ইলমে’র মাযহাব বর্ণনা করেছেন যে, ‘প্রত্যেকে নিজ অঞ্চলের চাঁদ দেখা অনুসারে আমল করবে।’ (অর্থাৎ দূর-দূরান্তের শহর-নগরের চাঁদ দেখা অবশ্যগ্রহণীয় নয়) বোঝা গেল, ইমাম তিরমিযী রাহ.-এর দৃষ্টিতে অধিকাংশ ফকীহ ও মুহাদ্দিসের মাসলাক সেটাই, যা তিনি উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত এ কারণেই এ বিষয়ে কোনো ইখতিলাফ বর্ণনার প্রয়োজন বোধ করেননি।
ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. সাহাবা-তাবেয়ীনের মাযহাব বর্ণনার পর পরবর্তী ফকীহগণের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হি.) ও ইমাম ইসহাক ইবনে রাহূয়াহ রহা. (১৬১-২৩৮ হি.) এর নাম উচ্চারণ করে বলেছেন যে, এঁদেরও মাসলাক এটাই ছিল। (অর্থাৎ প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য নিজ নিজ চাঁদ দেখাই ধর্তব্য) (আলইসতিযকার ১০/২৯)
ইসহাক ইবনে রাহূয়াহ রাহ.-এর মাসলাক সম্পর্কে আরো দেখুন : আলইশরাফ, ইবনুল মুনযির ৩/১১২; মাআলিমুস সুনান, খাত্তাবী ২/৮৪; শরহুস সুন্নাহ, বাগাভী ৪/১৪৫
এবার চার মাযহাবের ইমাম ও তাঁদের অনুসারী ফকীহগণের মাযহাব সম্পর্কে প্রয়োজনীয় আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
হানাফী মাযহাব
হানাফী মাযহাব সম্পর্কে মশহূর হয়েছে যে, এই মাযহাবের ‘‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’’ হল, ‘ইখতিলাফুল মাতালি’ (চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা) ধর্তব্য নয়। অর্থাৎ যেকোনো জায়গার চাঁদ দেখা সব জায়গার জন্য ‘ওয়াজিবুল আমল’ অবশ্যপ্রযোজ্য। এমনকি পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে চাঁদ দেখা গেলেও পূবের লোকদের জন্য তা অবশ্যগ্রহণীয়।
‘‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’’ শব্দবন্ধ থেকে মনে করা হয়েছে, এ মাসআলা সরাসরি ইমাম আবু হানীফা রা. থেকে বর্ণিত। অতপর এ ধারণাও করা হয়েছে যে, এটি যখন ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ তখন এর বিপরীতে মাযহাবের অন্যান্য ফকীহ ও মাশাইখের কথা গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। কারণ ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ তো সব কিছুর উপরে!!
পর্যালোচনা :
এ কথা স্বীকৃত যে, হানাফী মাযহাবের একাধিক কিতাবে চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়াকেই মুফতা বিহী বলা হয়েছে। কেউ কেউ আরো বলেছেন যে, এটিই মাযহাবের অধিকাংশ মাশাইখের মাসলাক। কিন্তু ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ কথাটির বিষয়ে বিনীত নিবেদন এই যে, হানাফী মাযহাবে ঐ সিদ্ধান্ত ‘জাহিরুর রিওয়াহ’ হওয়ার বিষয়টি সঠিক নয় এবং এ কথাও ঠিক নয় যে, এ মাসআলা (উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয় এবং পশ্চিমের চাঁদ পূবের জন্যও অবশ্যগ্রহণীয়) ইমাম আবু হানীফা রাহ. থেকে সরাসরি বর্ণিত। তদ্রূপ এ ধারণাও ঠিক নয় যে, হানাফী মাযহাবে যায়লায়ী বা আলাউদ্দীন কাসানী ছাড়া এ সিদ্ধান্তের বিরোধী কেউ নেই। বরং হানাফী মাযহাবের অনেক ফকীহ, যারা মাযহাবের মনীষী ব্যক্তিত্ব এবং ফিকহ ও হাদীসে যাঁদের মাকাম যথেষ্ট উঁচু তাঁরা যায়লায়ী ও কাসানীর আগেই ঐ সিদ্ধান্তের বিপরীতে ফতোয়া দিয়েছেন।
আর বাস্তবে হানাফী মাযহাবের অনুসারীদের আমলও তাঁদেরই ফতোয়ার উপর, ঐ প্রসিদ্ধ মাসলাকের উপর নয়, যাকে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ মনে করা হয়েছে।
কেন এটি ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ নয়
ফিকহ-ফতোয়ার সাথে সামান্য সম্পর্ক রাখে এমন তালিবে ইলমেরও জানা আছে যে, কোনো মাসআলাকে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলার অর্থ হয়, মাসআলাটি ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ.-এর ছয় কিতাবের এক কিতাবে আছে। কিতাবুল আসল (যার আরেক নাম ‘আলমাবসূত) আলজামিউস সগীর, আলজামিউল কাবীর, আসসিয়ারুস সগীর, আসসিয়ারুল কাবীর ও আযযিয়াদাত-এই ছয় কিতাবের কোনো কিতাবে আছে। যেহেতু এই কিতাবগুলো ইমাম মুহাম্মদ রাহ. থেকে ‘শুহরাত’ ও ‘ইস্তিফাযা’ সূত্রে বর্ণিত এবং মাযহাবের সকল ফকীহ্র কাছে ‘মুতালাক্কা বিলকবুল’ এবং সাদরে বরণীয় তাই এই কিতাবের মাসআলাসমূহের নাম ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’। অর্থাৎ এই সকল মাসআলা যে বর্ণনা-ধারায় এসেছে, তা শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত এবং ইমাম মুহাম্মাদ (হানাফী মাযহাবের মাসাইলের সংকলক ও আবু হানীফা -আবু ইউসুফের শাগরিদ) থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত।
পক্ষান্তরে নাদির রেওয়ায়েত (বহুবচন : নাওয়াদির) বলা হয়, যে মাসআলাগুলো এক দুই সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। সেই সূত্রগুলো বর্ণনাকারীর বিচারে সহীহ হলেও তা মাশহুরের পর্যায়ে পৌঁছেনি এবং জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র মতো ‘মুতালাক্কা বিল কবুল’ও হয়নি। এ ধরনের মাসআলাগুলো সাধারণত ‘‘নাওয়াদির’’ এবং ‘‘আমালী’’ শিরোণামের কিতাবসমূহে পাওয়া যায়।
যাই হোক এখন আমাদের দেখার বিষয় এই যে, আলোচিত মাসআলা (চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়, পশ্চিমের চাঁদ পূবের লোকদের নিকট প্রমাণিত হলে তা অবশ্যগ্রহণীয়) উপরোক্ত ছয় কিতাবে আছে কি না।
আলহামদুলিল্লাহ ‘কিতাবুল আসল’ তো এখন বারো খন্ডে ছাপা হয়েছে। ‘আলজামিউস সগীর’ ও ‘আলজামিউল কাবীর’ আগে থেকেই ছাপা আছে। ‘আসসিয়ারুল কাবীর’, যা জিহাদের মাসাইল বিষয়ে, আলাদাভাবে আমাদের সামনে নেই, তবে ইমাম সারাখসী রাহ.-এর শরহের মধ্যে একীভূত হয়ে ‘শরহুস সিয়ালি কাবীর’ নামে মুদ্রিত হয়েছে। তেমনি আযযিয়াদাত’ কাযী খানের শরহের মধ্যে একীভূত হয়ে ‘শরহু যিয়াদাত’ নামে ছেপেছে। থাকল ‘আসসিয়ারুস সগীর’ (জিহাদের মাসাইলের উপর ছোট কিতাবটি) তো এ কিতাবের মাসাইল ‘কিতাবুল আসল’ ইমাম মুহাম্মাদ রাহ., ও ‘আররাদ্দু আলা সিয়ারিল আওযায়ী’, ইমাম আবু ইউসুফ এ বিদ্যমান আছে। সুতরাং এখন যে কোনো আলিম এ মাসআলা উপরোক্ত কিতাবসমূহে তালাশ করতে পারেন। আমরা সবগুলোতেই তালাশ করেছি, কোনো কিতাবে এমন কেনো মাসআলা পাইনি। কোনো ভাই যদি ঐ কিতাবসমূহ থেকে এ মাসআলা বের করে দেন তবে আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
শুধু এই নয় যে, ঐ সকল কিতাবে এ মাসআলা আমরা পাইনি। শুধু এটুকু হলে নিশ্চিতভাবে বলতাম না যে, এ মাসআলা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ নয়। কারণ হতে পারে, উপরোক্ত কিতাবসমূহের কোনো মাখতূতা (হস্তলিখিত পান্ডুলিপিতে) এ মাসআলা আছে, যা মুদ্রিত নুসখাসমূহে আসেনি। হতে পারে সেই নির্ভরযোগ্য মাখতূতার ভিত্তিতেই আমাদের পরবর্তী কোনো কোনো ফকীহ এ মাসআলাকে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলেছেন।
এই সম্ভাবনার উপর অনেক চিন্তা-ভাবনা করা হয়েছে। এ কারণে এ মাসআলা ফিকহে হানাফীর প্রাচীন সূত্রগুলোতে তালাশ করা হয়েছে, বিশেষভাবে ঐ কিতাবগুলো বারবার মুতালাআ করা হয়েছে, যা জাহিরুর রিওয়ায়াহর মাসাইল গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করে কিংবা মূলত যা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর মাসাইল সংকলনের জন্য লেখা হয়েছে। কিন্তু ঐ সকল কিতাবেও এ মাসআলা পাওয়া যায়নি। এবং আবু হানীফা রাহ. আবু ইউসুফ রাহ. মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. কারো যবানীতেই এমন কোনো কথা আমরা পাইনি যে
لا عبرة لاختلاف المطالع
(উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়)।
আর না তাঁদের কারো উদ্ধৃতিতে এ কথা পেয়েছি যে-
لو رأى أهل المغرب هلال رمضان يجب الصوم على أهل المشرق
(পশ্চিম প্রান্তে চাঁদ দেখা গেলে পুবের লোকদের উপরও রোযা ফরয হয়ে যাবে।) এ ধরনের কোনো কিছুই এসব কিতাবে মাযহাবের মূল ইমামদের বা পূর্ববর্তী কোনো ফকীহর উদ্ধৃতিতে পাওয়া যায়নি।
উদাহরণস্বরূপ : ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর মাসাইলের জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কিতাব হাকিম শহীদ রাহ. (৩৩৪ হি.)-এর ‘মুখতাসারুল কাফী’ যার ভাষ্য লিখেছেন ইমাম সারাখসী রাহ. ‘আলমাবসূতে’ যা ত্রিশ খন্ডে প্রকাশিত। আমরা এ মাসআলা সারাখসীর আলমাবসূতেও পাইনি।
‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র মাসাইলের এক নির্ভরযোগ্য সংকলন ইমাম বুরহানুদ্দীন মাহমুদ বিন সদরুস শরীয়া (৫৫১-৬১৬ হি.)-এর ‘আলমুহীতুল বুরহানী’’। যা কয়েক বছর আগে বৈরুত থেকে ইদারাতুল কুরআন করাচীর পক্ষ থেকে ২৫ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এ কিতাবের প্রত্যেক পরিচ্ছেদে লেখক প্রথমে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর মাসাইল উল্লেখ করেছেন, এরপর ‘নাদির রিওয়ায়াত’ ও ‘ফাতাওয়া মাশাইখ’ উল্লেখ করেছেন। ভূমিকায় তিনি বলেছেন-
وجمعت مسائل المبسوط، والجامعين والسير، والزيادات، وألحقت مسائل النوادر والفتاوى والواقعات ... .
আমি এতে মাবসূত (কিতাবুল আসল) দুই জামি (অর্থৎ আলজামিউল কাবীর আলজামিউস সগীর), সিয়ার ও যিয়াদাতের মাসআলাসমূহ একত্র করেছি। এরপর এর সাথে নাওয়াদির, ফাতাওয়া ও ওয়াকিয়াত (ঐ সময়ের নতুন মাসাইল) শ্রেনীর মাসাইল যোগ করেছি ...।’ (আলমুহীতুল বুরহানী ১/১৫৯)
তো এ কিতাবেও ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র বরাতে এ মাসআলা উল্লেখিত হয়নি; বরং এ কিতাবের তৃতীয় খন্ডে (পৃষ্ঠা : ৩৪১) এ বিষয়ের আলোচনাই শুরু হয়েছে এভাবে-
أهل بلدة إذا رأوا الهلال هل يلزم ذلك في حق أهل بلدة أخرى؟ اختلف المشايخ فيه.
কোনো শহরের অধিবাসীরা যখন চাঁদ দেখবে তখন কি তাদের চাঁদ দেখা অন্য শহরের অধিবাসীদের জন্যও অবশ্যগ্রহণীয় হবে? এ বিষয়ে মাশাইখের ইখতিলাফ আছে ...।’ তো কথা শুরুই হচ্ছে মাশাইখের বরাতে। এরপর তিনি ইখতিলাফ উল্লেখ করেন, যা সামনে তাঁরই ভাষায় উল্লেখ করা হবে ইনশাআল্লাহ।
এখন শুধু এটুকু বলা উদ্দেশ্য যে, এ কিতাবে ইমাম মুহাম্মাদের ছয় কিতাবের বরাতে বা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ শিরোণামে ঐ মাসআলার নাম-নিশানাও নেই, যা হানাফী মাযহাবের ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলে মশহূর হয়ে গেছে।
মুখতাসারুত তহাবী (৩২১ হি.), মুখতাসারুল কারখী (৩৪০ হি.) মুখতাসারুল কুদুরী (৪২৮ হি.), বিদায়াতুল মুবতাদী (৫৯৩ হি.) (হেদায়া যার শরহ-ভাষ্যগ্রন্থ), তুহফাতুল ফুকাহা, আলাউদ্দীন সমরকন্দী (৫০৮ হি.)-এ কিতাবগুলোও জাহিরুর রিওয়ায়াহর মাসাইলের বিশেষ সূত্র হিসেবে গণ্য। কিন্তু এসব কিতাবেও এ মাসআলা আমরা পাইনি।
আলমুহীতুল বুরহানীর মতো জাহির রেওয়ায়েতের মাসআলার জন্য রযীউদ্দীন সারাখসী রাহ. (৫৪৪ হি.)-এর কিতাব ‘আলমুহীতুর রাযাভী’ এবং ইউসুফ ইবনে আলী আল জুরজানী রাহ.-এর কিতাব ‘খিযানাতুল আকমাল’ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জানামতে, এই দুই কিতাব এখনো ছাপেনি। তবে আল্লাহর শোকর, এগুলোর মাখতূতা থেকে এই মাসআলা তাহকীক করার তাওফীক আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। তাহকীক দ্বারা জানা গেছে যে, এগুলোতেও এই মাসআলা জাহির রেওয়ায়েতের শিরোণামে বা ইমাম মুহাম্মাদের ঐ ছয় কিতাবের বরাতে নেই।
‘খিযানাতুল আকমাল’ ফিকহে হানাফীর মাসাইলের গুরুত্বপূর্ণ সংকলন। এর ‘মাখতূতা’ (হস্তলিখিত পান্ডুলিপি) ইস্তাম্বুলের ‘মাকতাবায়ে ফয়যুল্লাহ’য় সংরক্ষিত আছে। ফটোকপি আছে জামেয়া উম্মুল কুরা মক্কা মুকাররমার কুতুবখানায়। আমাকে এ নুসখা সম্পর্কে জানিয়েছেন আমার শাগরিদ মাওলানা তাহমীদুল মাওলা। এরপর আমি শায়খ ত্বহা হোসাইন ইবনে দানিশকে (মুকীম, মক্কা মুকাররমা) অনুরোধ করি, তিনি যেন এ নুসখা থেকে অন্তত কিতাবুস সওমের অংশ কপি করে পাঠান। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জাযায়ে খায়ের দান করুন, তিনি তা পাঠিয়েছেন।
খিযানাতুল আকমালের ভূমিকায় লেখক নিজে এর ধারাবাহিক বিন্যাস উল্লেখ করেছেন যে, প্রথমে তিনি মুখতাসারুল হাকিম শহীদ এর মাসাইল (যা মূলত ইমাম মুহাম্মাদ রহ.-এর ‘কিতাবুল আসলে’র মাসাইলের সংকলন) উল্লেখ করবেন। অতপর ‘আলজামিউল কাবীর’ ও ‘আল জামিউস সগীর’-এর মাসাইল উল্লেখ করবেন। এরপর হাসান বিন যিয়াদ এর ‘আল মুজাররাদ’, ‘আল মুনতাকা’, ‘আল কারখী’ ‘শরহুত তহাবী’, উয়ূনুল মাসাইল, আবুল লাইছের ‘মুখতালিফ’ আল খাস্সাফের ‘আদাবুল কাযী’ আন নাতিফির ‘আল আজনাস’, ‘আররওযা’ ও ‘আল ফাতাওয়া’, ফাতাওয়াল বাক্কালী, ফাতাওয়া আবিল লাইছ ও ফাতাওয়াল কাযী সায়িদ-এর মাসাইল উল্লেখ করবেন।
ভূমিকার শেষে এ-ও লিখেছেন যে, এ কিতাব লেখা শুরু হয়েছে ৫২২ হি. ঈদুল আযহার দিন।
এই সমৃদ্ধ ও বরকতপূর্ণ কিতাব থেকে সাওমের অংশ পাঠ করলাম কিন্তু এতে ঐ দুটি কথা (উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয় বা পশ্চিমের চাঁদ দেখা পূর্বের অধিবাসীদের জন্য অবশ্য অনুসরণীয়) না জাহিরুর রিওয়ায়াহর কোনো কিতাবের উদ্ধৃতিতে, না নাদির রেওয়ায়েতের কোনো কিতাবের উদ্ধৃতিতে আছে, না উল্লেখিত অন্য কোনো কিতাবের বরাতে।
এই বাস্তবতা সামনে রেখে চিন্তা করলে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, ‘উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ বা ‘পশ্চিমের চাঁদ দেখা পূর্বের অধিবাসীদের জন্য অবশ্যঅনুসরণীয়’ এই দুই কথার কোনোটি না জাহির রেওয়ায়েতের কিতাবসমূহে আছে, না নাদির রেওয়ায়েতের কিতবাসমূহে,আর না খিযানাতুল আকমালের ভূমিকায় উল্লেখিত বুনিয়াদী কিতাবসমূহে। তদ্রূপ না তা আছে তহাবীর আলমুখতাসার’ বা তার শরাহ-গ্রন্থে,আর না কারখীর কিতাবে।
‘‘খিযানাতুল আকমলে’র একটি নুসখা হিন্দুস্তানের মাকতাবায়ে রেযা রামপুরেও আছে। দারুল উলূম দেওবন্দের তালিবে ইলম মাওলানা মোশতাক আহমাদ আমার অনুরোধে রামপুর সফর করে এ মাখতূতা দেখেছেন এবং সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠাগুলো আমার জন্য সংগ্রহ করেছেন। তাতেও এ ধরণের কোনো কথা নেই।
এবার ‘আলমুহীতুর রাযাভী’র কথা শুনুন। এ কিতাবের আরেক নাম ‘মুহীতুস সারাখসী’। এর একটি মাখতূতা করাচীর প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা আহসানুল উলূম গুলশান ইকাবলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক হযরত মাওলানা যারওয়ালী খান ছাহেবের কুতুবখানায় আছে। জামেয়াতুর রশীদ করাচীর উস্তাজ মাওলানা জহীরুদ্দীন বাবর ছাহেব আমার অনুরোধে এ মাখতূতার সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠাগুলোর নকল আমার জন্য পাঠিয়েছেন। এতেও একই অবস্থা। ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য না হওয়া’ বা পশ্চিমের চাঁদ পূবের লোকদের জন্যও অবশ্যঅনুসরণীয় হওয়া’ কোনো কথাই না জাহিরুর রিওয়ায়াহর বরাতে আছে, না নাদির রেওয়ায়েতের বরাতে।
সারকথা দাড়াচ্ছে, জাহির রেওয়ায়েতের ছয় কিতাবে বা পরের যে সকল কিতাবে জাহির রেওয়ায়েতের মাসাইল সংকলন হয়েছে, তার কোনোটিতেই আমার জানা মতে ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’, বা পশ্চিমের চাঁদের কারণে পূবের লোকদের উপর রোযা ওয়াজিব হবে, এ ধরণের কোনো কথা নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ কথাগুলোকে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর মাসআলা কে বলেছেন, কীভাবে বলেছেন -এ বিষয়টিই আগামী শিরোণামগুলোর বিষয়বস্ত্ত।
‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ প্রসঙ্গ কীভাবে এল
অনুসন্ধানে যদ্দূর জানা গেছে, এ কথা সর্বপ্রথম (আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন) আল্লামা তাহির ইবনে আহমদ ইবনে আবদুর রশীদ আলবুখারী রাহ.-এর কিতাব ‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’ থেকে শুরু হয়েছে। ওখান থেকে আল্লামা হাসান বিন মানসূর কাযী খান রাহ. তাঁর ‘ফাতাওয়া’য় নিয়েছেন (যা খানিয়া নামে প্রসিদ্ধ)। এরপর এ দুজনের উপর নির্ভর করে পরের অনেক মুসান্নিফ এ কথা লিখেছেন। কেউ তাদের বরাত দিয়েছেন, কেউ দেননি। এভাবেই কথাটি মশহূর হয়ে গেছে।
তাহির বিন আহমদ বিন আবদুর রশীদ রাহ.-এর জন্ম ও মৃত্যুসন ‘আততাবাকাতুছ ছানিয়্যা’ এবং এর বরাতে ‘আলজাওয়াহিরুল মুযিয়্যাহর’ (২/২৭৬) হাশিয়ায় উল্লেখিত হয়েছে। তাঁর জন্ম ৪৮১ বা ৪৮২ হিজরীতে আর মৃত্যু ৫৪২ হিজরীতে। কাশফুয যুনূনে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৭০৩) তাঁর কিতাব ‘খিযানাতুল ওয়াকিয়াত’’ এর আলোচনায় তাঁর মৃত্যুসন ৫৪২ হিজরীই লেখা হয়েছে।
কাযী খান রাহ. ছিলেন ছাহিবে হিদায়ার সমসাময়িক। ছাহিবে হিদায়ার জন্ম ৫১১ হিজরীতে, মৃত্যু ৫৯৩ হিজরীতে। কাযী খান রা.-এর মৃত্যুসন তো ঐতিহাসিকগণ ৫৯২ হিজরী লিখেছেন, কিন্তু জন্মসন উল্লেখ করেননি। অনুমান করা যায়, তার জন্মও ৫১০ হি. থেকে ৫২০ হিজরীর মধ্যেই হবে।
আলফাওয়াইদুল বাহিয়্যা (পৃষ্ঠা : ৮৪) অনুযায়ী কাফাভী রাহ. ‘কাতাইবু আলামিল আখবার’’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, তাহির ইবনে আহমদ ইবনে আবদুর রশীদ রাহ. কাযী খান থেকে ইলম হাসিল করেছেন। এটা অসম্ভব নয়। বড় ছোটর থেকে, সমবয়সী সমবয়সী থেকেও ইলম গ্রহণ করে থাকে, কিন্তু উপরোক্ত সন-তারিখ সামনে রাখলে এই ধারণা সমর্থন করা কঠিন হয় যে, কাযী খান ‘খুলাসা’ লেখকের উস্তাজ! ‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’ ও ফাতাওয়া কাযী খান মিলিয়ে পড়লে অনুমিত হয়, কাযী খানের সামনে ‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’ ছিল এবং তিনি ঐ কিতাবের বিন্যাস ও উপস্থাপনা থেকেও ফায়দা হাসিল করেছেন। যাই হোক, তাঁদের মধ্যে যেই-যার থেকে গ্রহণ করে থাকুন, ইখতিলাফে মাতালি (উদয়স্থলের বিভিন্নতা) ধর্তব্য না হওয়াকে যে হানাফী মাযহাবের ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলা হয়েছে সেটা একজন অপরজনের উপর নির্ভর করেই লিখেছেন। আর পরের অনেক লেখক এই দুজনের উপর বা তাদের কোনো একজনের উপর নির্ভর করে লিখেছেন। উপরের কিতাবসমূহ খুলে এবং সরাসরি ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’র ছয় কিতাব দেখে বরাত পরীক্ষা করার সুযোগ হয়নি বা তার প্রয়োজন বোধ করেননি। মোটকথা, এ এক ‘তাসামুহ’ (ভ্রম)। প্রকৃত অবস্থা জানার পর একে বুনিয়াদ বানানো মুনাসিব নয়।
‘খুলাসাতুল ফাতাওয়া’র আরবী পাঠ এই-
ولو صام أهل بلدة ثلثين يوما للرؤية، وأهل بلدة أخرى تسعة وعشرين يوما للرؤية، فعليهم قضاء يوم، ولا عبرة لاختلاف المطالع في ظاهر الرواية، وعليه فتوى الفقيه أبي الليث، وبه كان يفتي شمس الأئمة الحلواني، قال : لو رأى أهل المغرب هلالَ رمضان يجب الصوم على أهل المشرق، وفي التجريد : اعتبر اختلاف المطالع.
কোনো শহরের অধিবাসীগণ যদি চাঁদ দেখে ত্রিশদিন রোযা রাখে আর অপর শহরের অধিবাসীগণ চাঁদ দেখে উনত্রিশ রোযা রাখে তাহলে তাদেরকে একটি রোযা কাযা করতে হবে, আর চাঁদের উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়, জাহিরুর রিওয়ায়াহ অনুসারে। এরই উপর ফকীহ আবুল লাইছের ফতোয়া। আর এরই ফতোয়া দিতেন শামসুল আইম্মা হালওয়ানী। তিনি বলেন, পশ্চিমের অধিবাসীগণ যদি রমযানের চাঁদ দেখে তাহলে পূবের অধিবাসীদের উপর রোযা ওয়াজিব হয়। আর তাজরীদে আছে, উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য হবে। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৪৯)
আর খানিয়ায় এভাবে লেখা
ولو صام أهل بلدة ثلاثين يوما للرؤية، وأهل بدلة أخرى تسعة وعشرين يوما للرؤية، فعلم من صام تسعة وعشرين يوما فعليهم قضاء يوم، ولا عبرة لاختلاف المطالع في ظاهر الرواية، وكذا ذكر شمس الأئمة الحلواني رحمه الله تعالى.
(আলখানিয়া ১/১৯৮, ফাতাওয়া আলমগীরীর সাথে মুদ্রিত নুসখা)
উভয় ইবারতে ভালোভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে:
ক. খুলাসা, খানিয়া দুই কিতাবেই কথা শুরু হয়েছে এই মাসআলা থেকে যে, যে শহরের অধিবাসীরা ২৯ রোযা রেখেছেন তাদের কাছে যদি প্রমাণিত হয় যে, অন্য শহরের অধিবাসীরা চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ৩০ রোযা রেখেছেন তাহলে ২৯ রোযাওয়ালাদের উপর এক রোযা কাযা করা জরুরি হবে। যারা ইবারতের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে ত্বরা করেন তারা খুলাসা-খানিয়ার ইবারত থেকে এ ধারণাও করতে পারেন যে, লেখকদ্বয় এ মাসআলাকেও ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ -এর মাসআলা বলেছেন। অথচ তা নয়। ঐ ইবারতে في ظاهر الرواية কথাটিকে এ মাসআলার সাথে যুক্ত মনে করা ভিত্তিহীন। আর বাস্তবতাও এই যে, মাসআলাটি ‘নাওয়াদির’ (নাদির রেওয়ায়েত)-এর, ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ -এর নয়। বিষয়টি সামনে বরাতসহ আসছে।
খ. নাদির রেওয়ায়েতের এ মাসআলায় এ কথার উল্লেখ নেই যে, দূরে দূরের দুই শহরের ক্ষেত্রে এই বিধান, না কাছাকাছি দুই শহরের ক্ষেত্রে। ফিকহে হানাফীর একাধিক নির্ভরযোগ্য কিতাবে ও বড় বড় অনেক ফকীহের বক্তব্যে একথার উল্লেখ আছে যে, এ বিধান কাছাকাছি অঞ্চলসমূহের ক্ষেত্রে, দূরে দূরের শহর-নগরের ক্ষেত্রে নয়। সামনে পাঠক তাদের ঐ উদ্ধৃতিগুলো দেখতে পাবেন ইনশাআল্লাহ।
গ.ولا عبرة لاختلاف المطالع
(উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়)-এ বাক্য নাদির রেওয়ায়েতের এ মাসআলায়ও নেই। এটি খুলাসা-খানিয়ার লেখকদ্বয়ের নিজস্ব বাক্য যা তাঁরা ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ -এর দিকে সম্বন্ধ করেছেন। তারা যেন বলতে চাচ্ছেন, এ বাক্য ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. -এর ছয় কিতাবের কোনো কিতাবে আছে। অথচ বাস্তবতা এই যে, এ বাক্যের সম্বন্ধ ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর দিকে করা একান্তই ‘তাসামুহ’ (ভ্রম)। ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. এর ছয় কিতাবের কোনো কিতাবেই এর খোঁজ পাওয়া যায় না। আর এই মূলনীতি শ্রেণীর বাক্য
ولا عبرة لاختلاف المطالع
(উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়) তো দূরের কথা, উপরের মাসআলাটিই (২৯ রোযাওয়ালাদের উপর ৩০ রোযাওয়ালাদের কারণে এক রোযা কাযা করার বিধান) ‘নাওয়াদির’ শ্রেণীর। ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’য় এরো কোনো অস্তিত্ব নেই।
ঘ. খুলাসায় যে বলা হল-
وعليه فتوى الفقيه ابي الليث
এ বাক্যের স্বাভাবিক অর্থ, ত্রিশ ওয়ালাদের কারণে উনত্রিশ ওয়ালাদের এক রোযা কাযা করার ফতোয়া ফকীহ আবুল লাইছও দিয়েছেন। খুলাসা লেখক আবুল লাইছ রাহ.-এর দিকে এ ফতোয়ার সন্বন্ধ হয়ত এই জন্য করেছেন যে, তিনি ‘‘উয়ূনুল মাসায়িল’’ কিতাবে নাদির রেওয়ায়েতের ঐ মাসআলা নকল করে মৌনতা অবলম্বন করেছেন, কোনো বিপরীত মন্তব্য করেননি। ‘‘উয়ুনুল মাসাইলে’’ আছে
وقال أبو يوسف في الأمالي : لو أن أهل بلدة صاموا للرؤية تسعة وعشرين يوما، وأهل بلد ثلاثين يوما للرؤية، فعلى من صام تسعة وعشرين يوما قضاء يوم.
আবু ইউসুফ রাহ. ‘আল-আমালী’ গ্রন্থে বলেছেন, কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি চাঁদ দেখে ২৯ রোযা রাখে, আর অন্য শহরের অধিবাসীরা চাঁদ দেখেই ত্রিশ রোযা রাখে তাহলে ২৯ ওয়ালাদেরকে একটি রোযা কাযা করতে হবে। (উয়ূনুল মাসাইল পৃ.৩৮)
‘আল-আমালী’ কিতাবটি নাদির রেওয়ায়েতের কিতাবসমূহের মধ্যে গণ্য। আবুল লাইছ রহ. নাদির রেওয়ায়েতের এ মাসআলাটি বর্ণনা করেছেনমাত্র। তার আরো দুইটি কিতাব ‘খিযানাতুর রিওয়ায়াহ’ ও ‘মুখতালিফুর রিওয়ায়াহ’ ও মুদ্রিত। সেগুলোতে তো এ মাসালাটিও নেই, (উদয়স্থলের ভিন্নতা ধর্তব্য নয়)-শীর্ষক বাক্য তো দূরের কথা।
ঙ. শামসুল আইম্মা হালওয়ানী (৪৪৮ হি.) -এর ফতোয়ার প্রকৃত পাঠ সম্ভবত সেটাই যা ‘আলমুহীতুল বুরহানী’র বরাতে সামনে আসছে। তাঁর উদ্ধৃতিতে ‘‘খুলাসায়’’ আলোচ্যস্থানে একথাও আছে যে, ‘পশ্চিমের লোক রমযানের চাঁদ দেখলে পূবের লোকদের উপর রোযা ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ খুলাসার এ বর্ণনা দ্বারা জানা গেলো, এই বাক্য শামসুল আইম্মা হালওয়ানী-এর নিজের। এটি না জাহির রেওয়ায়েতের, না নাদির রেওয়ায়েতের আর না তাঁর আগের কোনো হানাফী আলিমের বরাতে তিনি একথা বলেছেন। সুতরাং ফাতহুল কাদীরে (২/২৪৩) যে একথাকেই ‘জাহিরুল মাযহাব’ (হানাফী মাযহাবের জাহির রেওয়ায়েত) লেখা হয়েছে তা ‘তাসামুহ’।
চ. খানিয়ার ইবারত
وكذا ذكر شمس الائمة الحلواني
(শামসুল আইম্মা হালওয়ানী রাহ. এমনটাই বলেছেন) এর অর্থ তিনি এক শহরের চাঁদ দেখাকে অন্য শহরের লোকদের জন্য অবশ্যঅনুসরণীয় বলেছেন। তাঁর বিস্তারিত ইবারতের উদ্ধৃতি ‘আলমুহীতুল বুরহানী’র বরাতে সামনে আসছে। খানিয়ার উপরে উদ্ধৃত অংশটুকুর অর্থ কখনো এই নয় যে, শামসুল আইম্মা হালওয়ানীও ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ বক্তব্যকে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ বলেছেন। যিনি আরবী ইবারত সঠিকভাবে বোঝেন তিনি কখনো এমনটা বলবেন না। তথাপি যেন ত্বরাপ্রিয় কোনো পাঠকেরও বিভ্রান্তি না হয় এ জন্য বিষয়টি পরিষ্কার করলাম যে, এ না খানিয়ার এবারতের মর্ম, আর না বাস্তবের সাথে এর মিল আছে। যা বাস্তব তা ‘আলমুহীতুল বুরহানী’র বরাতে স্বয়ং শামসুল আইম্মা হালওয়ানীর জবানীতে আসছে।
এ পর্যন্ত যে কথাগুলো আরজ করা হল তার সারসংক্ষেপ এই:
ক. ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ বা পশ্চিমের চাঁদ দেখা পূর্বের অধিবাসীদের জন্য অবশ্যঅনুসরণীয়’ এ কথাগুলো ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. কারো থেকেই বর্ণিত নয়।
খ. এ কথাগুলো না জাহির রেওয়ায়েত-এর কিতাবসমূহে আছে, না নাদির রেওয়ায়েত-এর কিতাবসমূহে।
গ. নাদির রেওয়ায়েতে ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি চাঁদ দেখে ত্রিশ রোযা রাখে তাহলে যে শহরের অধিবাসীরা উনত্রিশ রোযা রেখেছেন তারা একটি রোযা কাযা করবেন।
এ মাসআলা সাহেবাইন (আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ) থেকে বর্ণিত। ইমাম আবু হানিফা থেকে নয়। এবং সাহেবাইন থেকেও ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’য় না ‘নাদিরুর রিওয়ায়াহ’তে বর্ণিত। এ মাসআলাটিই ঐ ফকীহগণের বক্তব্যের ভিত্তি, যারা বলেছেন, হানাফী মাযহাবে উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়। অথচ হানাফী মুতাকাদ্দিমীন (পূর্বসূরী) ফকীহগণ এ মাসআলার এ অর্থ বুঝেছেন যে, এ বিধান কাছাকাছি অঞ্চলসমূহের ক্ষেত্রে, দূরে দূরের শহর-নগরের ক্ষেত্রে নয়। দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক শহরের চাঁদ দেখা অন্য শহরের জন্য অবশ্যঅনুসরনীয় নয়। এ বিষয়টির আরো বিশদ আলোচনা আগামী শিরোনামগুলোর অধীনে আসছে ইনশাআল্লাহ।
হানাফী ইমামগণ থেকে বর্ণিত মাসআলা কী
আলহামদুলিল্লাহ, এটুকু তো প্রমাণিত হল যে, ‘উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়’ শীর্ষক মাসআলা ফিকহে হানাফীর ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’ নয় এমনকি নাদির রেওয়ায়েতও নয়। এখন দেখার বিষয় এই যে, হানাফী ইমামদের থেকে বর্ণিত মাসআলা কী, যা থেকে পরবর্তীরা এই মাসআলা বের করেছেন যে, ‘উদয়স্থলের ভিন্নতার কোনো ইতিবার নেই।’ তো ঐ মাসআলা সেটিই যা খানিয়া, খুলাসা উভয় কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মাসআলাটি আমরা এখানে হাওয়ালাসহ উল্লেখ করছি।
মাসআলাটি হাকিম শহীদ রাহ. (৩৩৪ হি.)-এর ‘‘আলমুনতাকা’’ এর বরাতে ‘আলমুহীতুল বুরহানী’ তে বর্ণিত হয়েছে। ‘আলমুনতাকা’র বিষয়বস্ত্ত হচ্ছে ‘জাহিরুর রিওয়ায়াহ’-এর বাইরের মাসাইল, যা তিনি নাওয়াদির ও আমালী থেকে জমা করেছেন। (কাশফুয যুনূন ২/১৮৫১-১৮৫২)
আর জাহিরুর রিওয়ায়া-এর মাসাইল তিনি সংকলন করেছেন ‘আলমুখতাসারুল কাফী’ তে।
আলমুহীতুল বুরহানীর ইবারত এই-
أهل بلدة إذا رأوا الهلالَ هل يلزم ذلك في حق أهل بلدة أخرى؟ اختلف المشايخ فيه، بعضهم قالوا : لا يلزم ذلك به، وإنما المعتبر في حق كل بلدة رؤيتهم، وبنحوه ورد الأثر عن ابن عباس رضي الله عنهما.
وفي المنتقى : بشر عن أبي يوسف، وإبراهيم عن محمد : إذا صام أهل بلدة ثلاثين يوما للرؤية، وصام أهل بلدة تسعة وعشرين للرؤية فعليهم قضاء يوم.
وفي القدوري : إذا كان بين البلدتين تفاوت لا تختلف المطالع، لزم إحدى البلدتين حكم البلدة الأخرى، فأما إذا كان تفاوت تختلف المطالع فيه لم يلزم حكم إحدى البلدتين حكم البلدة الأخرى.
وذكر شمس الأئمة الحلواني : أن الصحيح من مذهب أصحابنا رحمهم الله : أن الخبر إذا استفاض وتحقق فيما بين أهل البلدة الأخرى يلزمهم حكم أهل هذه البلدة.
অর্থ : কোনো শহরের অধিবাসীরা চাঁদ দেখল। এ দেখা কি অন্য শহরের অধীবাসীদের জন্যও আবশ্যঅনুসরণীয়? এ বিষয়ে মাশাইখের ইখতিলাফ আছে। কেউ বলেন, অবশ্যঅনুসরণীয় নয়। প্রত্যেক শহরের অধিবাসীদের জন্য শুধু তাদের চাঁদ দেখাই ধর্তব্য। এ অর্থে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. এর আছর বর্ণিত হয়েছে। আলমুনতাকায় আছে: বিশ্র আবু ইউসুফ রাহ. থেকে এবং ইবরাহীম মুহাম্মাদ রাহ. থেকে বর্ণনা করেছেন, যখন কোনো শহরের অধিবাসী চাঁদ দেখে ত্রিশ রোযা রাখে আর অন্য শহরের লোকেরা চাঁদ দেখে ২৯ রোযা রাখে তাহলে এদের একদিনের রোযা কাযা করা জরুরি।
কুদুরীতে আছে: যখন দুই শহরের মাঝে দূরত্ব এ পরিমাণ না হয় যদ্বারা তাদের উদয়স্থল আলাদা হয়ে যায় তখন এক শহরের বিধান অন্য শহরের জন্যও প্রযোজ্য হবে। পক্ষান্তরে দূরত্ব যদি এমন হয় যে, দুই শহরের উদয়স্থল আলাদা হয়ে যায় তাহলে একের বিধান অন্যের জন্য প্রযোজ্য হবে না।
শামসুল আইম্মা হালওয়ানী রাহ. উল্লেখ করেছেন, আমাদের আসহাবের (ফকীহগণের) মাযহাবে সঠিক কথা এই যে, (এক শহরের সংবাদ) যদি ‘মুস্তাফীয’ (চারদিক থেকে ব্যাপকভাবে আসা) হয়ে যায় এবং অন্য শহরের অধিবাসীদের কাছে তা প্রমাণিত হয় তখন তাদের জন্য ঐ শহরের বিধান প্রযোজ্য হবে। (আলমুহীতুল বুরহানী খন্ড:৩, পৃষ্ঠা:৩৪১-৩৪২, ইদারাতুল কুরআন করাচী কর্তৃক মুদ্রিত ১৪২৪ হি
আলমুহীতুল বুরহানীর এ আলোচনার উপর চিন্তা করুন:
১. এতে ‘জাহির রিওয়ায়াহ’ বা ‘নাদির রিওয়ায়াহ’-এর বরাতে لا عبرة لاختلاف المطالع বাক্য উল্লেখিত হয়নি।
২. এতে খানিয়া ও খুলাসায় বর্ণিত মাসআলা (২৯ রোযা আদায়কারীদের ১ রোযা কাযা করার বিধান) হাকিম শহীদ রাহ. এর (৩৩৪ হি.) আলমুনতাকা-এর বরাতে এসেছে। ‘‘খিযানাতুল আকমালে’’ও এ মাসআলা ‘‘আলমুনতাকা’’ এর বরাতে আছে (পৃষ্ঠা : ১১৬, মাখতূতা, জামেয়া উম্মুল কুরা)। ‘‘আলমুনতাকা’’র বিষয়বস্ত্ত হচ্ছে নাদির রেওয়ায়েতের মাসাইল সংকলন করা। খোদ হাকীম শহীদ রাহ. ‘‘আলমুনতাকা’’র ভূমিকায় একথা স্পষ্টভাবে বলেছেন। ‘‘কাশফুয যুনূনে’’ (খ. ২ পৃ.১৮৫১-১৮৫২) হাজী-খলীফা তাঁর ইবারতও তুলে দিয়েছেন। ‘‘আলমুনতাকা’’য় মাসআলার সনদও উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম আবু ইউসুফ থেকে এ মাসআলার বর্ণনাকারী হচ্ছেন বিশ্র (অর্থাৎ বিশ্র ইবনুল ওয়ালিদ) আর ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. থেকে এর বর্ণনাকারী, ইবরাহীম (অর্থাৎ ইবরাহীম ইবনে রুস্তম)। দুজনই নাদির রেওয়ায়েতের রাবী, জাহির রেওয়ায়েতের নয়। জাহির রেওয়ায়েতের কিতাবসমূহের রাবী তো আবু হাফস কাবীর রাহ. (ইমাম বুখারী রহ. এর উস্তাজ) এবং আবু সুলায়মান মুসা ইবনে সুলায়মান আল জুযাযানী রহ.। (আলমাবসূত সারাখসী খ.৩০ পৃ ২৪৪)
অতপর এ মাসআলাটি বর্ণনা করেছেন আবুল লাইছ সমরকন্দী রহ. ‘‘উয়ূনুল মাসাইল’’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা : ৩৮) ইমাম আবু ইউসুফ রাহ.-এর ‘‘আলআমালী’’ থেকে। আর এ তো জানা কথা যে, ‘‘আলআমালী’’ নাদির রেওয়ায়েতেরই সূত্র। (রদ্দুল মুহতার খ. : ১, পৃ. : ৬৯)
এবং আল মুহীতুর রাযাভীতে (পৃ ১৯১-১৯২ আহসানুল উলূম করাচীর মাখতুতা) এ মাসআলা আছে ذكر هشام فى نوادره عن محمد رحمه الله শিরোণামে। অর্থাৎ হিশাম ইবনে উবায়দুল্লাহ রাযী একে নাওয়াদিরে (নাদির এর বহু বচন) ইমাম মুহাম্মাদ-এর বরাতে উল্লেখ করেছেন।
সুতরাং এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ মাসআলা নাদির রেওয়ায়েতের, জাহির রেওয়ায়েতের নয়।
৩. নাদির রেওয়ায়েতের এ মাসআলার সারকথা হচ্ছে, কোনো শহরের অধিবাসীরা চাঁদ দেখে রোযা শুরু করেছে এবং ত্রিশ রোযা পুরা করার পর শাওয়ালের চাঁদ দেখেছে পক্ষান্তরে অন্য কোনো শহরের অধিবাসীরা রমযানের চাঁদ দেখে উনত্রিশ রোযা রেখেছে এরপর শাওয়ালের চাঁদ দেখেছে তাহলে এদেরকে একটি রোযা কাযা করতে হবে।
৪. এ মাসআলা সম্পর্কে চিন্তা করার বিষয় এই যে, এ বিধান কি এত ব্যাপক যে, পৃথিবীর যে কোনো শহরে চাঁদ দেখে ত্রিশ রোযা রাখা হলে পৃথিবীর অন্য যে কোনো শহরে যারা চাঁদ দেখে উনত্রিশ রোযা রেখেছে তাদেরকে এক রোযা কাযা করতে হবে? না এ বিধান শুধু কাছাকাছি শহরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে নয়?
ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহ. যাঁদের থেকে (নাদির রেওয়ায়েতে) এ মাসআলা বর্ণিত, তাঁদের ও তাঁদের শাগরিদ ইমামদের তরফ থেকে এ প্রশ্নের কোনো জবাব আমাদের জানা মতে নেই। পরের হানাফী ফকীহদের মাঝে এ বিষয়ে দুটি মত সৃষ্টি হয়েছে। একটি সাহেবে হেদায়া ও তাঁর পূর্বের অনেক ফকীহদের মত। তাঁরা এ বিধানকে শুধু কাছাকাছি শহর-নগরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করেন। দ্বিতীয় মত ‘খুলাসা’ ও ‘খানিয়া’ লেখকদ্বয়ের। তাঁরা বাহ্যত একে আম ও ব্যাপক মনে করেন। তাঁদের মতে, এ বিধান দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আলমুহীতুল বুরহানীর লেখক ইমাম বুরহানুদ্দীন মাহমূদ (৬১৬ হি.) এর কাছে সম্ভবত প্রথম মতই অগ্রগণ্য। এ কারণে তিনি এ মাসআলা উল্লেখ করার পরই কুদুরী রহ. (৪২৮ হি.)-এর ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন, যা এ মতকে সমর্থন করে। ‘পশ্চিমে চাঁদ দেখা গেলে পূবের লোকদের জন্যও তা প্রযোজ্য হওয়ার কথা, যা খুলাসা-লেখক উল্লেখ করেছেন সেটি বা তার কাছাকাছি কোনো কথা তিনি বর্ণনা করেন নি। যা দ্বারা দ্বিতীয় মতের সমর্থন হতে পারত।
৫. এ মাসআলার ইবারত (আরবী পাঠ) থেকে কারো এ ধারণা হতে পারত যে, অন্য শহরে চাঁদ দেখার যে কোনো প্রকার সংবাদ এলেই তা অবশ্যঅনুসরণীয়। অথচ বাস্তবতা এমন নয়। একারণে এ ধারণার সংশোধনের জন্য তিনি শামসুল আইম্মা হালওয়ানীর বক্তব্য বর্ণনা করেছেন, যাতে এ কথার উল্লেখ আছে যে, শুধু সংবাদ পৌঁছা যথেষ্ট নয়। তা মুস্তাফীয (চারদিক থেকে ব্যাপকভাবে আসা) ও মুতাহাক্কিক (প্রমাণিত) হওয়া জরুরী। আর তখনই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ এর ভিত্তিতে ফায়সালা করতে পারবেন।
নাদির রেওয়ায়েতের এ মাসআলার ব্যাখ্যা
হানাফী ফকীহগণের সিদ্ধান্ত
যেমনটা ইতিপূর্বে বলেছি অনেক ফকীহ নাদির রেওয়ায়েতের এ মাসআলার অর্থ এই বুঝেছেন যে, এই বিধান কাছাকাছি শহর-নগরের ক্ষেত্রে। এখানে তাঁদের ইবারত নকল করা হচ্ছে:
1. ইমাম আবুল হুসাইন আলকুদুরী রাহ. (৪২৮ হি.)
তিনি শরহু মুখতাসারিল কারখীতে নাদির রেওয়ায়েতের মাসআলাটি উল্লেখ করার পর বলেন-
وهذا إذا كان بين البلدتين تفاوت لا تختلف فيه مطلع الهلال، فأما إذا بعد أهل البلدين من الآخر بعدا كثيرا لم يلزم أهل أحد البلدين حكم الآخر، لأن مطالع البلاد تختلف.
যার সারকথা হল, দুই শহরের মাঝে দূরত্ব বেশি হলে অপর শহরের অধিবাসীদের জন্য এক রোযা কাযা করার বিধান প্রযোজ্য নয়।
(শরহু মুখতাসারিল কারখী, সওম অধ্যায়ে, বাবুল ইতিকাফের দুই পৃষ্ঠা আগে। মাখতূতা, জামেয়া উম্মুল কুরা-এটির কপিও সংগ্রহ করেছেন শায়েখ ত্বহা হুসাইন দানিশ, জাযাহুল্লাহ খাইরান।)
২. ইমাম হুসামুদ্দীন শহীদ রাহ. (৫৩৬ হি
হিদায়া গ্রন্থকারের বিশেষ উস্তাদগণের অন্যতম। ৫৩৬ হিজরীতে তার শাহাদাতের ঘটনা ঘটে। তিনি ‘‘আলফাতাওয়াল কুবরা’’ নামে ফিকহ ও ফতোয়ার একটি সংকলন প্রস্ত্তত করেছেন। যার বিন্যাসের কাজ করেছেন ইমাম নাজমুদ্দীন ইউসুফ ইবনে আহমদ আলখাসী। এর একটি মাখতূতা রিয়াসত রামপুরের মাকতাবায়ে রেযা’তে সংরক্ষিত আছে। এর সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠাগুলোর ফটোকপি দেওবন্দের মাওলানা মোশতাক আহমাদ আমার জন্য পাঠিয়েছেন।
এর ‘আলফাতাওয়াল কুবরা’র (পৃ. ১৬) ‘‘কিতাবুস সাওমে’র ‘‘আলফাসলুল খামিস’’-এ লেখেন
ولو صام أهل بلدة الرؤية ثلثين يوما وبلدة أخرى تسعة وعشرين يوما فعلم من صام تسعة وعشرين يوما فعليهم قضاء يوم، لأن الذين صاموا ثلثين يوما رأوا هلال رمضان قبلهم بليلة والعمل بقول من رأى لا بقول من لم ير، هذا إذا كان بين البلدتبين تقارب بحيث لا تختلف المطالع، وإن كانت تختلف لا يلزم أهل أحد من البلدتين حكم الآخر.
অর্থ : কোনো শহরের অধিবাসীরা যদি চাঁদ দেখে ত্রিশ দিন রোযা রাখে আর অন্য শহরের অধিবাসীরা উনত্রিশ দিন রোযা রাখে অতপর উনত্রিশ রোযা আদায়কারীগণ তা জানতে পারে তাহলে তাদেরকে একটি রোযা কাযা করতে হবে। কারণ যারা ত্রিশ রোযা রেখেছে তারা একরাত আগে চাঁদ দেখেছে। আর আমল তো তাদের কথা অনুসারেই হওয়া চাই যারা (চাঁদ) দেখেছে। তাদের কথা অনুসারে নয় যারা দেখেনি।
এ (বিধান) ঐ ক্ষেত্রে যখন দুই শহর কাছাকাছি হয়, এদের উদয়স্থল আলাদা না হয়। উদয়স্থল আলাদা হলে কোনো শহরের বিধান অন্য শহরের জন্য অবশ্যঅনুসরণীয় হবে না। (আলফাতাওয়াল কুবরা পৃ. ১৬, মাখতুতা মাকতাবায়ে রেযা, রামপুর, হিন্দুস্তান)
3. ইমাম আব্দুর রশীদ আলওয়ালওয়ালিজী (৪৬৭ হি.-৫৪০ হি.-এর পর)
তিনি ‘আলফাতাওয়াল ওয়ালওয়ালিজিয়্যাহ’ তে আলোচিত মাসআলা লিখে সাথে সাথে তাম্বীহ করেছেন যে,
وهذا إذا كان بين البلدتين تفاوت بحيث لا تختلف المطالع، فإن كانت تختلف لا يلزم أحد البلدين حكم الآخر.
অর্থাৎ, এ বিধান ঐ সময় প্রযোজ্য যখন দুই শহর কাছাকাছি হয় যার কারণে এদের উদয়স্থল আলাদা হয় না। পক্ষান্তরে উদয়স্থল আলাদা হলে এক শহরের হুকুম অন্য শহরের জন্য অবশ্যঅনুসরণীয় হবে না। (আলফাতাওয়াল ওয়ালওয়ালিজিয়্যাহ খ. ১ পৃ.২৩৬, মুদ্রন, দারুল ঈমান, সাহারানপুর, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ বৈরুতের সংস্করণের ফটো সংস্করণ)
৪. ইমাম রযিউদ্দীন আসসারাখসী (৫৪৪ হি.)
তাঁর নাম মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ, উপাধী রযিউদ্দীন, নিসবত, সারাখসী ইনি শামসুল আইম্মা সারাখসী মুহাম্মাদ ইবনে আহমদ, ‘মাবসূত’-লেখক (৪৮৩ হি.)-এর কিছু পরের। ইবনে আবেদীন শামী রাহ. ‘রদ্দুল মুহতার’ (খ.১, পৃ. : ৬৯)-এ তাঁর কিতাব ‘আলমুহিত’ (যাকে আলমুহীতুর রাযাভী ও ‘মুহীতুস সারাখসী’ বলা হয়)-এর প্রশংসা করেছেন যে, তিনি জাহির রিওয়ায়াহ, নাদির রিওয়ায়াহ ও ফাতাওয়া মাসাইলকে আলাদা আলাদা বর্ণনা করেছেন।
ইমাম রযীউদ্দীন ‘আলমুহীত’ গ্রন্থে ‘নাওয়াদিরে হিশাম’-এর বরাতে উপরোক্ত মাসআলা বর্ণনা করার পর লেখেন-
وهذا إذا كان (بينهما تقارب) بحيث لا يختلف فيه مطلع الهلال، لأن الرؤية لا تفاوت ولا يختلف، فيلزم أحدهما حكم الآخر، وإن كان بينهما مسافة مزيدة بحيث يختلف فيها المطالع لم يلزم أحدهما حكم الآخر.
অর্থাৎ এ বিধান ঐ সময় প্রযোজ্য, যখন দুই শহর কাছাকাছি হয়, যদ্বারা চাঁদের উদয়স্থল অভিন্ন থাকে। কারণ এ অবস্থায় তো চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে
(বাস্তবের বিচারে) কোনো বিভিন্নতা নেই। তাই এক শহরের বিধান অপর শহরের জন্য প্রযোজ্য হবে। পক্ষান্তরে যদি দুই শহরের মাঝে দূরত্ব বেশি হয় যদ্বারা এদের উদয়স্থল আলাদা হয়ে যায়, তাহলে এক শহরের উপর অন্য শহরের বিধান প্রযোজ্য হবে না। (মুহীতুস সারাখসী পৃ ১৯১-১৯২, মাখতূতা, আহসানুল উলূম, গুলশান ইকবাল, করাচী)
৫. কাযিল কুযাত ইমাম জামালুদ্দীন আলমুতাহহির ইবনে হুসাইন আলইয়াযদী
ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রশীদ রুকনুদ্দীন আলকিরমানী (৫৬৫ হি.)-এর খাস উস্তাজ। ‘জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’ -গ্রন্থের প্রতি অধ্যায়ের (কিতাবের) দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে (বাব) তিনি শুধু তাঁর ফতোয়াগুলো সংকলন করেছেন। ভূমিকায় তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন যে, তিনি ইলম ও ফিকহের ক্ষেত্রে এ যামানার (হিজরী ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধের) ইমাম।
... فإنه إمام هذا العصر في العلم والفقه واستنباط المعاني وحل المشكلات وكشف المعضلات.
‘জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’র মাখতূতা শাবাকায় (ইন্টারনেটে) আছে। জামেয়াতুল মালিক সাউদ রিয়াদের মাখতূতা শাবাকায় পড়া যায়। এতে ইমাম জামালুদ্দীন আলইয়াযদী থেকে যখন উপরোক্ত মাসআলা বর্ণনা করেছেন তখন সাথে সাথে পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, এ বিধান কাছাকাছি শহর-নগরের ক্ষেত্রে। আরবী পাঠ এই
لو صام أهل بلد تسعة وعشرين وأهل بلدة ثلثين إن كان يختلف المطالع لا يلزم أحدهما حكم الآخر، وإن كان لا يختلف المطالع يلزم.
(জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া : ৩২-৩৩, মাখতূতা, জামেয়া মালিক সাউদ রিয়ায)
৬. ইমাম রুকনুদ্দীন আলকিরমানী রাহ. (৫৬৫ হি.)
তিনি ‘জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া’র বিভন্ন জায়গায় এ মতই উল্লেখ করেছেন। এবং এর বিপরীতে কোনো কথা বর্ণনা করেননি।
৭. ইমাম বুরহানুদ্দীন আলী ইবনে আবু বকর আল মারগীনানী (৫৯৩ হি.) হিদায়া গ্রন্থকার।
তাঁর কিতাব ‘আততাজনীছু ওয়াল মাযীদ’ অনেক দিন আগেই ছাপা হয়েছে। এতে তিনি এ মাসআলা উল্লেখ করে ঐ নোট দিয়েছেন যে, এ বিধান কাছাকাছি অঞ্চলসমূহের ক্ষেত্রে। দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক শহরের হুকুম অন্য শহরের জন্য অবশ্য-প্রযোজ্য নয়। আরবী পাঠ এই
وهذا إذا كان بين البلدين تقارب، بحيث لا تختلف المطالع، فإن كان يختلف لا يلزم أحد البلدين حكم الآخر.
(আততাজনীছু ওয়াল মাযীদ খ. ২ পৃ. ৪২৩, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত)
সারকথা এই যে, নাদির রেওয়ায়েতের এ মাসআলার ব্যাখ্যা তৃতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বড় বড় ফকীহগণ এ-ই করেছেন যে, এ বিধান কাছাকাছি অঞ্চলসমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দূর-দরূান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের বিধান অন্য অঞ্চলের জন্য অবশ্য পালনীয় নয়।
এখানে তো শুধু আকাবিরের ব্যাখ্যা ও বক্তব্য উদ্ধৃত করা হল, যারা নাদির রেওয়ায়েতের এ মাসআলার ব্যাখ্যা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন। আর যাঁরা এ মাসআলা উল্লেখ করা ছাড়া মূল বিধানটি বলেছেন যে, দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের জন্য অন্য অঞ্চলের চাঁদ দেখা অবশ্য প্রযোজ্য নয়, তাদের তালিকা অনেক দীর্ঘ। তাঁদের উদ্ধৃতি সামনে আসছে। ইনশাআল্লাহ। এখন শুধু এইটুকু নিবেদন যে, নাদির রেওয়ায়েতের যে মাসআলা খুলাসা খানিয়ার লেখক ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য মনে করেছেন, তাঁদের আগের ও তাদের সমসাময়িক বড় বড় ফকীহ এ বিধানকে শুধু কাছাকাছি শহর-নগরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করেন।
এক আবু বকর জাসসাস আররাযী (৩৭০হি.) যাঁর কিতাব ‘আহকামুল কুরআন’ (খ. ১ পৃ. ২২০-২২২) এর বিবরণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি এ বিধানকে ব্যাপকভাবে প্রযোজ্য মনে করেন। দ্বিতীয় ব্যাক্তিত্ব শামসুল আইম্মাহ হালওয়ানী (৪৪৮ হি.), তাঁর বরাতে খুলাসা গ্রন্থকার যে ইবারত উদ্ধৃত করেছেন বর্ণনায় কোনো তাসামুহ না হয়ে থাকলে তিনিও সম্ভবত এ বিধানকে আম ও ব্যাপক মনে করেন। এ দুজন ছাড়া ষষ্ঠ হিজরী শতক পর্যন্ত কোনো বড় ফকীহ সম্পর্কে আমার জানা নেই যে, তিনি এ বিধানকে আম ও ব্যাপক মনে করেছেন।
এ পর্যন্ত যা কিছু নিবেদন করা হল তার সারসংক্ষেপ এই -
১. لاعبرة لاختلاف المطالع (উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়) এ কথার উল্লেখ হানাফী মাযহাবের জাহির রিওয়ায়াহ ও নাদির রেওয়ায়াহ কোথাও নেই। এবং তা মাযহাবের প্রথম তিন ইমামের কারো থেকেই বর্ণিত নয়।
২. নাদির রিওয়ায়েতের ঐ মাসআলাটি শুধু সাহেবাইন (আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ.) থেকে বর্ণিত।
৩. এ মাসআলাকে হানাফী মাযহাবের অধিকাংশ বড় বড় ফকীহ শুধু কাছাকাছি অঞ্চলসমূহের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করেন। দূর-দূরান্তের শহর-নগরের ক্ষেত্রে তারা এ মাসআলা প্রযোজ্য মনে করেন না।
৪. لاعبرة لاختلاف المطالع (চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়) এ বাক্য আমাদের জানামতে সর্বপ্রথম খুলাসা ও খানিয়ার লেখকদ্বয় ব্যবহার করেছেন।
[জাহিরুর রিওয়ায়াহ ও হানাফী মাযহাবের বাকি আলোচনা আগামী সংখ্যায় পড়ুন]
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
১৮০৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে করি - ইসলাম মুসলিমদের জন্য টেকনোলোজী ব্যবহার হারাম করেনি। বরং আমরা সিরাত হতে জানি আমাদের নেতা মোহাম্মদ সঃ তৎকালীন আমলের সেরা টেকনোলজী প্রয়োজনে সংগ্রহ যেমন করেছেন তেমনি এডপ্ট ও করেছেন। আর কোরআন মজীদে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন বিজ্ঞান (টেকনোলজী) ও বিজ্ঞতাকে পজিটিভলী উপস্থাপন করেছেন।
যেহেতু আমরা টেকনোলোজী ব্যবহারের মাধ্যমে নামাজের সময় নির্নয় করছি ও নামাজ আদায় করছি। স্বভাবতঃই টেকনোলজী ব্যবহারের মাধ্যমে রোজা শুরুর দিন, ক্ষন যেমন নির্নয় করতে পারি ঈদের দিন ও ঠিক করতে পারি - এবং সে অনুযায়ী আমল করতে আমি কোন বাধাঁ দেখিনা।
সর্বোপরী, বাংলাদেশের সরকার ও ইসলামিক ফাউন্ডেশান - ইসলামকে কোনভাবেই প্রতিনিধিত্ব করেনা, স্যেকুলার মন্ত্রীর সভাপতিত্বে চাঁদ দেখার সিদ্ধান্ত - বরাবরই মানুষকে সত্যিকার চাঁদ দেখার দিনকে ভুল বলে প্রতীয়মান করেছে। বরাবরই আমাদেরকে হিজরী ক্যালেন্ডারের সংশোধনী আনতে হয়েছে এবং এর মাধ্যমে আমাদের দেশের মুসলমানের জীবনে ইদানীংকালে একটি রোজা কম রাখতে হয়েছে কিংবা কাজা করতে হয়েছে।
এ কারনে আমি মনে করি আমাদের কে টেকনোলজীর মাধ্যমে সাব্যস্থ চাঁদ উঠার দিন হতে রোজা রাখা এবং ঈদ করা উচিত।
মন্তব্য করতে লগইন করুন