লোকমূখে প্রচলিত হাদীস, যেগুলো আসলে হাদীস নয়।

লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ২৮ এপ্রিল, ২০১৪, ০১:১৬:৫৯ দুপুর

১. ‘‘মসজিদে কেউ প্রথমবার দুনিয়াবী কথা বললে ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর বন্ধু ‘আপনি’ চুপ করুন। আবার দুনিয়াবী কথা বললে ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর বান্দা ‘তুমি’ চুপ কর। তৃতীয়বার কথা বললে ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর দুশমন ‘তুই’ চুপ কর।’’

মনে রাখতে হবে, মসজিদ নামায ও আল্লাহ তাআলার যিকিরের জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মসজিদকে দুনিয়াবী কথাবার্তা ও কাজকর্মের স্থান বানানো অথবা এ উদ্দেশ্যে মসজিদে জমায়েত হওয়া নাজায়েয।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে বেচা-কেনা বা হারানো বস্ত্ত খুঁজে পাওয়ার এলান করতে নিষেধ করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৭৯)।

আরেক হাদীসে এ বিষয়ে কঠিন ধমকি এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কাউকে মসজিদে বেচা-কেনা করতে দেখলে বল, তোমার বেচা-কেনা লাভজনক না হোক। তেমনিভাবে কাউকে যদি মসজিদে হারানো বস্ত্তর এলান করতে দেখ তাহলে বল, আল্লাহ তোমার হারানো বস্ত্ত ফিরিয়ে না দিন (অর্থাৎ এ কাজটি খুবই নিন্দনীয়)। (জামে তিরমিযী, হাদীস ১৩৩৬; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৩০৫)। তবে কোনো দ্বীনী কাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার পর প্রসঙ্গক্রমে দুনিয়াবী কোনো বৈধ কথাবার্তা বলা জায়েয। এর বৈধতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। (দ্রষ্টব্য সহীহ বুখারী ১/৬৩,৬৪, ও ৬৫; রদ্দুল মুহতার (শামী) ১/৬৬২; আললু’লুউল মারসূ ৭৮)

২. লোকমুখে মেরাজ সম্পর্কে একটি কথা প্রসিদ্ধ আছে যে, মেরাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরশে মুআল্লায় প্রবেশের পূর্বে জুতা খুলতে চাইলে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

يا محمد! لا تخلع نعليك، فإن العرش يتشرف بقدومك متنعلا ويفتخر على غيره متبركا.

হে মুহাম্মাদ! আপনি জুতা খুলবেন না। (জুতা নিয়েই আরোহন করুন) কেননা, আপনার জুতা নিয়ে আগমনে আরশ ধন্য হবে। এটি বরকত লাভের কারণে অন্যের উপর গর্ববোধ করবে।

কথাগুলো সাধারণ মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধ তো আছেই, কোন কোন বক্তার মুখেও শোনা যায়। কিন্তু তা প্রমাণিত নয়। সবগুলোই মনগড়া ও বানানো কথা।

ইমাম রযীউদ্দীন আল-কায্ভীনী (রহ.)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জুতা নিয়ে আরশ গমন এবং আল্লাহ তাআলার সম্বোধন (হে মুহাম্মাদ! আপনার জুতায় আরশ ধন্য হয়েছে) ইত্যাদি প্রমাণিত কি না। তিনি উত্তরে বলেছিলেন-

أما حديث وطئ النبي صلى الله عليه وسلم العرش بنعله فليس بصحيح ولا ثابت، بل وصوله إلى ذروة العرش لم يثبت في خبر صحيح ولا حسن ولا ثابت أصلا، إنما صح في الأخبار انتهاؤه إلى سدرة المنتهى فحسب.

জুতা পায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আরশ গমনের হাদীস প্রমাণিত নয়। এমনকিক তিনি (খালি পায়ে) আরশে পৌঁছেছেন এমন কথাও কোন নির্ভরযোগ্যসূত্রে বর্ণিত নেই। সহীহ বর্ণনা মতে তিনি শুধু সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমন করেছেন।-সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ-শরহুল মাওয়াহেব ৮/২২৩

অপর এক মুহাদ্দিসের ভাষ্য-

আল্লাহ তাআলা তাকে ধ্বংস করুন, যে বলে তিনি জুতা নিয়ে আরশে আরোহণ করেছেন। কত ঔদ্ধত্য! কত বড় স্পর্ধা!! যিনি শিষ্টাচারীদের সরদার, যিনি আরেফবিল্লাহগণের মধ্যমণি, তাঁর ব্যাপারে এমন কথা! তিনি আরো বলেন যে, রযীউদ্দীন আল-কাযভীনীর উত্তরই সঠিক। প্রায় চল্লিশজন সাহাবী থেকে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মেরাজ তথা উর্ধ্ব জগতে গমনের ঘটনা বর্ণিত আছে। এঁদের কারো হাদীসে এ কথা উল্লেখ নেই যে, সে রাতে তাঁর পায়ে জুতা ছিল। এ কথা কতক গন্ডমূর্খ কিসসা-কাহিনীকারদের কাব্যে এসেছে। ... কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীসে বা দুর্বলসূত্রে বর্ণিত হাদীসেও এ কথা নেই যে, তিনি আরশে আরোহন করেছেন। এটি কারো বানানো কথা, এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা যায় না।-শরহুল মাওয়াহেব ৮/২২৩

আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ মাক্কারী (রহ.) স্বরচিত গ্রন্থ ফাতহুল মুতাআল ফী মাদহি খাইরিন নিআল-এ উপরোক্ত কথাটিকে জাল বলে জানিয়েছেন।-আল আসারুল মারফুআ ৩৭

আরো দ্রষ্টব্য : গায়াতুল মাকাল ফীমা ইয়াতাআল্লাকু বিন্নিআল : আল্লামা লাখনোভী (রহ.)

৩. ‘‘জ্ঞান-সাধকের দোয়াতের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে মূল্যবান’

এ কথাটি হাদীস হিসেবে জনশ্রুতি থাকলেও হাদীস বিশারদগণের নির্ভরযোগ্য মতানুসারে এটি হাদীস নয়; বরং পরবর্তী কারো বাণী। ইমাম সাখাবী রাহ. ‘আল মাকাসিদুল হাসানাতে’ ( পৃ. ৪৪২, বর্ণনা: ১০০৫ ) এটিকে হাসান বসরী রাহ.-এর বাণী বলে উল্লেখ করেছেন।

শাওকানী রাহ.,যারকাশী রাহ.,তাহের পাটনী রাহ.-সহ আরো অনেক হাদীস বিশারদ এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।

(দেখুন: আল ফাওয়াইদুল মাজমূআ, খ. ১ পৃ. ২৮৭, বর্ণনা: ৫৩; আললাআলিল মানছূরাহ, পৃ. ১০১, বর্ণনা: ১০; আল আসারুল মারফূআ ২০৭; কাশফুল খাফা, খ.২ পৃ.২০০; তাযকিরাতুল মাওযূআত খ. ২ পৃ. ৩৬৯; মিযানুল ইতিদাল খ.৩ পৃ. ৪৯৮।)

সুতরাং এটিকে হাদীস হিসেবে বলা উচিত নয়।

(সংগৃহীত)

বিষয়: বিবিধ

১৩৮৮ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

214325
২৮ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০১:৫৪
মোঃ ওহিদুল ইসলাম লিখেছেন : ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর লিখিত এ চমৎকার গ্র্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আছে। লিংক হতে ডাউনলোড করতে পারবেন।

হাদীসের নামে জালিয়াতি-ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
214345
২৮ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:১৪
সুমাইয়া হাবীবা লিখেছেন : ভালো পোষ্ট। তবে প্রথম হাদসিটি নিয়ে দ্বিমত আছে ভাই। কারন মসজিদই হবে ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু। এখান থেকেই সমস্ত কাজ পরিচালিত হবে। তাই বোধহয় আপনার কোথাও বুঝতে ভুল হচ্ছে। আপনি একটু স্টাডি করে দেখুন, আল্লাহর রাসুল(সা) মসজিদে বসেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতেন। আর এর ভেতর তো সবই পরে যায়। আর এর সপক্ষে অনেক সহীহ হাদীস আছে। তাই বলছিলাম হয়তো কোথাও বুঝতে ভুল হয়েছে।
২৮ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:১৯
162616
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : ভাই, আমি বলেছি "দুনিয়াবি কথাবার্তা ও কাজকর্মের স্থান"। রাষ্ট্র পরিচালনা কিন্তু দুনিয়াবী কাজ নয়, দ্বীনি কাজ। কারণ ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান ইসলামি শরীআ কর্তৃক আবদ্ধ এবং সে ইসলামের হুকুমের বাহিরে কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না। এটাতো এক প্রকার ইবাদত।
214353
২৮ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০২:২১
মোবারক লিখেছেন : ভালো লাগলো
২৮ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:১২
162772
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : ধন্যবাদ
214511
২৮ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:০৯
প্রেসিডেন্ট লিখেছেন : প্রথম হাদীসটি সম্ভবত সহীহ নয়, যয়ীফ বা হাসান হতে পারে।
চেক করে নিবেন। সুনানে আবু দাউদ এর সকল হাদীস সহীহ নয়। শুধুমাত্র বুখারী ও মুসলিম এর সকল হাদীস সহীহ। এজন্য এ দুটি হাদীস গ্রন্থের শুরুতে সহীহ বলা হয়।
২৮ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:২২
162798
চিরবিদ্রোহী লিখেছেন : ধন্যবাদ। ভাই আমার লেখার শিরোনামটা কিন্তু লোকমূখে প্রচলিত হাদীস, যেগুলো আসলে হাদীস নয়। অর্থাৎ এমন কিছু কথা যেগুলোকে সাধারণ মানুষ হাদীস হিসেবে জানলেও সেগুলো আসলে হাদীসই না। সুতরাং, সহীহ-হাসান-সরীহ-মাজরুহ-যয়ীফ ইত্যাদির প্রশ্নই আসে না।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File