ইয়াওমে আশুরার প্রকৃত শিক্ষা জাগরিত হোক সকল মুসলমানের অন্তরে
লিখেছেন লিখেছেন চিরবিদ্রোহী ১৩ নভেম্বর, ২০১৩, ০৬:৫১:৫০ সন্ধ্যা
সমাগত আশুরা। স্বাগতম ইয়াওমে আশুরা। চলমান মুহাররাম। মুহাররাম হিজরী সনের প্রথম মহিনা। যার বাংলা অর্থ সম্মানিত। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে “তিনিই সে সত্তা যিনি সূর্যকে আলোকময় আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলোক বিতরণ কারি রূপে তৈরী করেছেন যাতে তোমরা বছরের সংখ্যা ও হিসাব চিনতে পারো (সূরা-ইউনুস)”।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে মানবতার মুক্তি দূত বিশ্বনবী সা. বলেছেন একাধারে তিনটি মাস (জিলক্বায়দা,জিলহজ্ব ও মহররাম) তোমাদের (মুসলমানদের) জন্য সম্মানিত। ইয়াওমে আশুরা বা কারবালা দিবস নিয়ে বিশেষ বিশেষ উলামায়ে কেরামগণের ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। তবে দু’টি বিষয়ে সবাই ঐক্যমত যে, আশুরার গুরুত্ব অনেক বেশী আর এগুরুত্বপূর্ণ দিবসটি মুহাররাম মাসের ১০ম তারিখে পালন করতে হয়। সেই সুবাদে চঁন্দ্রের হিসাব মতে এবছর আশুরা ঈসায়ী সনের ২৫ নভেম্বর তারিখে পালন করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে যেভাবে আশুরাকে কারবালা দিবস সাইনবোর্ডে, অতি ভক্তির স্টাইলে যে সব কর্ম কান্ড করা হয়,তা সম্পূর্ন বিদআত বা ভন্ডামী।
আশুরা এলে দেখাযায় নামধারী মুসলমানেরা ইয়াওমে আশুরার মর্যাদা বুঝাতে যেয়ে মর্সিরা ক্রন্দন, জুসনে জুলুশ, তাজকিয়া মিছিল, অথবা উধল গায়ে হায়... হুসাইন হায় হুসাইন... বলে বলে যে সব অসংগতিপূর্ণ কাজ-কর্মের সুচিত করেন তা নিতান্তই ইসলাম বহির্ভূত। কুরআন-হাদীসের আলোকে সৃষ্ট ইতিহাসের কোথাও এসব অপকর্মের কথা উল্লেখ নেই। সাধারণত আমাদের নিকট আশুরার ইতিহাস ৬১ হিজরীতে সংঘটিত হওয়া ইয়াজিদ কর্তৃক মহানবী সা. এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন রাযি. কে শহীদ করার কাহিনী (কারবালা দিবস) হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু ইতিহাস পাঠে জানা যায়। আশুরা দিবসের ফযিলত ও গুরুত্ব অপরিসীম। এ দিনে সংগঠিত হয়েছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
এ দিনেই অভ্যূদ্বয় ঘটে এ ধরিত্রীর। আবার এদিনেই মহা প্রলয়ের মাধ্যমে লয়প্রাপ্ত হবে এ পৃথিবীর। এ দিনেই জন্মগ্রহণ করেছেন অসংখ্য নবী-রাসূলগণ। মোদ্দাকথা ঐতিহাসিক ঘটনায় ভরপুর এ দিবসকে শুধু কারবালার ঘটনা হিসেবেই উল্লেখ করা হয়ে থাকে। অথচ এ দিবস সংগঠিত হওয়ার অনেক পূর্ব থেকেই আশুরা বিদ্যমান। যেমন এদিনে আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আ. পৃথিবীতে আগমনের পর তাওবাহ কবুল করা হয়। হযরত নূহ আ. মহাপ্লাবন থেকে মুক্তি লাভ করেন। হযরত ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে বের হয়ে আসেন। এ দিনেই হযরত ইব্রাহীম আ. নমরূদের অগ্নিকুন্ড থেকে নিস্কৃতি পান। হযরত আইয়ূব আ. কঠিন দুরারোগ্য থেকে আরোগ্য লাভ করেন। এদিনেই ফেরাউনের হিংস্র ছোবল থেকে পরিত্রাণ পান হযরত মুসা আ. ও তার স¤প্রদায়।
জালিম ফেরাউনের দম্ভ ও তার কাওম সলিল সমাধির মাধ্যমে ছুঁড়মার হয়ে যায়। অভিশপ্ত ইহুদী জাতির আক্রমণ থেকে রেহাই পেয়ে এদিনেই হযরত ঈসা আ. আসমানে গমন করেন আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ সা. এ দিবসে সর্বদা রোযা রাখতেন। আবার হযরত ইমাম হুসাইন রা. কারবালার প্রান্তরে সত্য ও ন্যায়ের পে জিহাদ করে শাহাদত বরণ করেন এদিনেই। আদিকাল থেকে ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বলিত এ আশুরা দিবসটি অত্যন্ত গাম্ভীর্যতার সহিত পালিত হয়ে আসছে। শুধু মক্কার কুরাইশ জাতিই নয়, মদীনার ইহুদীরাও এ দিনকে বিশেষভাবে উদযাপন করত। ইতিহাসের পাতায় হাদীসের ভাষ্যমতে আশুরার নিæরূপ বিবরণ রয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হযরত রাসূল আকরাম সা. হিজরত করে মদীনায় দেখতে পান ইহুদীরা আশুরা দিবসে রোযা পালন করছে। তখন নবীজি সা. তাদেরকে রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তারা বলল, এদিন অত্যন্ত সম্মানিত। এ দিনে হযরত মুসা আ. ও তার স¤প্রদায়কে জালিম ফেরাউনের হাত থেকে নিস্কৃতি দান করা হয় এবং ফেরাউন ও তার কাওমকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মারা হয়। এর শুকরিয়া স্বরূপ হযরত মুসা আ. এ দিনে রোযা রাখতেন। তার অনুকরণে আমরাও রোযা রাখি। হুজুর সা. বললেন, মুসা আ. এর সাথে তোমাদের অপো আমাদের সম্পর্ক অগ্রাধিকার ও নিকটতম। অত:পর নবিজী এ দিনে নিজে রোযা রাখেন এবং উম্মতকেও রোযা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। উল্লেখ্য যে, ইহুদীরা শুধু আশুরা দিবসে একদিন রোযা রাখত। তাদের বিরোধিতা স্বরূপ হুজুর সা. আশুরা দিবসে দু’দিন রোযা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন।
নবম ও দশম তারিখ অথবা দশম ও একাদশ তারিখে দু’দিন রোযা পালন করার বিধান রয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে আশুরার রোযা ওয়াজিব ছিল। পরবর্তীতে রমযানুল মুবারকের রোযা ফরয হওয়ায় তা মুস্তাহাব বা ঐচ্ছিক হয়ে যায়।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বড় চমৎকারভাবেই বলেছিলেন-“ফিরে এলো আজ সেই মুহাররাম মহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা”। জাতীয় কবির কন্ঠে স্বর মিলিয়ে বলছি। পৃথিবীতে মুসলিম জাতির অস্তিত্ব আজ বহুমূখি আগ্রাসন, নির্যাতন ও ভয়াবহ বিপদের সম্মোখিন। পশ্চিমাবাদ, পুঁজিবাদ, ও সাম্রাজবাদ একে একে মুসলিম দেশগুলোকে গিলে ফেলার চেষ্টা করছে। কাশ্মীর, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মধ্যপ্রাচ্য আজ পদনত, লুন্ঠিত অথবা নিষ্পেষিত। মুসলিম নিধনে সময়ে সময়ে শুধু অযুহাতই তৈরী হচ্ছে।
আমাদের প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে লাখ লাখ ‘রোহিঙ্গা’ শত শত বছর ধরে সেখানে বসবাসকারী সত্তে¡ও সে দেশের জান্তা সরকার তাদের নাগরিক বলে শিকারই করছে না। দাঙ্গাবাঁজ বর্মিজ ও সরকারী সৈন্য একত্র হয়ে ঘর-বাড়ী, দোকান-পাট আগুনে পুড়িয়ে তাদেরকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করছে। প্রাণ বাঁচাতে বহু মানুষ পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে চাইছে। কিন্তু আমাদের সরকার এই আশ্রয় প্রার্থী মজলুম মানুষদেরকে অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে আটক করছে। এবং ফেরত পাটাচ্ছে সেখানেই, যেখানে তাদের জন্য উদ্যত হয়ে আছে বন্দুক, যেখানে মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু তাদের জন্য অপো করছে না। অসহায় নারী শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে গৃহহারা-দেশহারা-নিরাশ্রয় মানুষগুলো সমুদ্রে ভাসছে। তাদের খাবার, পানীয়, আশ্রয় কিছুই নেই। এ যেন মৃত্যুপুরিতে জীবন-যাপন।
গণতন্ত্রপন্থি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত মিয়ানমারের বিরুধী দলীয় নেত্রী আং সাং সুচি ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন রোহিঙ্গাদের সাথে তিনি নেই। সুচি আরো বলেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা বলতে কোন জাতির হদিস নেই (সূত্র জাতীয় দৈনিক)। সুতরাং প্রতিবেশির ঘরে আগুন লাগলে যেমন এগিয়ে আসা সবার দায়িত্ব, ইয়াওমে আশুরা বা কারবালা দিবসের শিাকে কাজে লাগিয়ে এ মুহুর্তে বিশ্বমুসলিমকে ‘রোহিঙ্গা’ শরণার্থী মুসলমানদেরসহ বিশ্বের সকল মজলুমদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের জন্য নিতান্তই গুরুত্বপূর্ণ।
আসুন! আমরা এদিবসটিকে ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে উদযাপন করি। ঘোষণা করি ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা। ইমাম হুসাইন রাযি. যেভাবে জালিম শাসকের সামনে মাতা নথ করেন নি, আমরাও যেন দেশ-জাতি, মা-মাটি, মানবতা ও সত্যের পে সংগ্রাম করতে পারি। মহিমাময় যেন আমাদেরকে বিজয় দান করেন।
বিষয়: বিবিধ
২০৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন