সত্যিকার মুসলিম হতে চাইলে সস্তা আবেগ অবশ্যই বর্জনীয়
লিখেছেন লিখেছেন মধ্যমপন্থী ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:৫৮:১৬ বিকাল
লেখালেখির বয়স যত বাড়ছিল, আমার ততই মনে হচ্ছিল যে, আগের আবেগী লেখাগুলো না লিখলেই বোধহয় ভালো ছিল। যদিও এটা ঠিক যে, ইসলামকে ভালোবেসেই আমার প্রথম কলম ধরা। ইসলামের বা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সকল অন্যায়ের প্রতিকারের দায়-দায়িত্ব বুঝি আমার একার ঘাড়েই বর্তায় – এমন একটা সুপ্ত অনুভূতিও হয়তো বা মনের কোন গোপন কোণে বাসা বেঁধে থাকবে। জ্ঞান ছাড়া ঈমান বা ঈমান ছাড়া জ্ঞান – স্কলাররা বলে থাকেন যে, দু’টোই খুব বিপজ্জনক। আমার জীবনের প্রথম দিকের লেখা-লেখিগুলি একাধারে আবেগী ও “বিপ্লবী”ও বলা যায় – না, রাজনীতির ভাষায় “বিপ্লবী” বলতে যা বোঝায় তা নয় – আমি বলবো অনুভবের দিক থেকে “বিপ্লবী”। “সঠিক জ্ঞান” আর “নানান দোষে দুষ্ট জ্ঞানের” ভিতর তফাৎ করার মত জ্ঞান আমার তখন ছিল না! আমরা সবাই হয়তো জীবনে এরকম একটা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাই।
একটা সময় যাদের লেখা পড়ে মনে হয়েছে – বাহ্ কি দারুণ! এরাই ইসলামের সত্যিকার মুখপাত্র!! পরে মনে হয়েছে, এদের লেখা-লেখিতে সত্য যেমন রয়েছে, তেমনি অগণিত conjecture based বা “অনুমান নির্ভর” নিজস্ব মতামতও রয়েছে – যেগুলোর সূত্র অনুসন্ধান করে পেছনে চলতে থাকলে সুন্নাহয় গিয়ে পৌঁছানোর কোন সম্ভাবনাই নেই! রাফিদী শিয়া আয়াতুল্লাহ্ খোমেনীর* কথায় ও কাজে কত অগণিত মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে – কারণ, মূলধারা সাধারণ মুসলিমরা জানেনই না যে, নবী (সা.) এবং সাহাবীরা যে পথের উপর ছিলেন, সেই পথের অনুসারী কেউ, কখনোই কোন রাফিদী শিয়ার অনুসারী হতে পারে না! অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, জ্ঞানবিহীন ধর্মীয় আবেগের কারণে মানুষ এমন করে থাকবে/থাকে! সালমান রুশদীর “স্যাটানিক ভার্সেস” বের হবার পর, আয়াতুল্লাহ্ খোমেনী সালমান রুশদীর মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেছিলেন এবং যে তা কার্যকর করবে (অর্থাৎ যে তাকে হত্যা করবে) তার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন! সারা মুসলিম বিশ্বে তখন আয়াতুল্লাহ্ খোমেনী খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং গণমানুষের মাঝে এমন একটা অনুভূতি আসে যে, গোটা মুসলিম জাহানে, সাহসী নেতা থাকলে ঐ একজনই আছেন, আর ‘আলেম থাকলেও ঐ একজনই আছেন – যিনি ইসলামের সত্যিকার “সুবিচার” তুলে ধরে কথা বলতে পেরেছেন। কিন্তু আসলে কি তাই? যারা ফিকহ ও সুন্নাহ্ সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞান রাখেন, তারাই জেনে থাকবেন যে, সালমান রুশদী যদিও খুব খারাপ একটা কাজ করেছিলেন এবং ইসলামী রাষ্ট্রে ঐ কাজের সুন্নাহসম্মত বিচার হলেও হয়তো ঠিকই তার মৃত্যুদন্ডই হতো – তবু তার (আয়াতুল্লাহ্ খোমেনীর) ঐ ফতোয়া সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী ছিল। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, সালমান রুশদীর উপর রিদ্দার হুজ্জত (প্রমাণ বা evidence) কায়েম করা হয় নি – অর্থাৎ তাকে ডেকে এরকম বোঝানো হয় নি যে, দেখ এই কাজটা করলে কেউ যে ইসলাম থেকে বেরিয়ে “মুরতাদ” হয়ে যাবে – তুমি কি সেটা জানো/বোঝো? না জানলেও এখন তো জানলে – এখন তোমাকে তওবা করার সুযোগ দেয়া হলো ইত্যাদি ইত্যাদি…….। হতে পারে আয়াতুল্লাহ্ খোমেনীর পদক্ষেপটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ছিল – সহজ একটা জনপ্রিয়তা লাভের জন্য অথবা নিজের দ্বীন-না-জানা নির্বোধ সাধারণ মুসলিমদের কাছে নিজেকে মুসলিম জাহানের অবিসংবাদিত ও অপরিহার্য নেতা প্রতীয়মান করার জন্য। কিন্তু সাধারণ মানুষ জ্ঞানের অভাবে সেটাকেই সঠিক ও সময়োপযোগী মনে করেছেন। অথচ, OIC-ভুক্ত ৪৮টি দেশের বড় বড় ‘আলেমগণ ঐ ফতোয়াকে ভুল মনে করেছেন! জীবনের তথা সময়ের ঐ প্রস্থচ্ছেদে ব্যাপারটা না বুঝলেও, বিবর্তনের একটা পর্যায়ে বুঝেছি: যে কোন ‘আলেম, লেখক, নেতা বা চিন্তাবিদ – তিনি যত বড় মাপেরই হোন না কেন, তার আনুগত্য বা অনুসরণ হবে শর্ত-সাপেক্ষ – যতক্ষণ তার কথা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের (সা.) সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ – আমরা তা শুনবো বা মানবো! আর তা না হলে তা মানবো না!! এই ব্যাপারে কুর’আনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়াতটি হচ্ছে ৪:৫৯ – যার উপর ভিত্তি করে “যে কোন ‘আলেম, নেতা বা মুরুব্বীর আনুগত্যই “শর্ত সাপেক্ষ”” – এই শিরোনামে আর একটা লেখা আছে। সুপ্রিয় পাঠক চাইলে তা এখানে দেখতে পাবেন ইনশা’আল্লাহ্:
আয়াতুল্লাহ্ খোমেনীর ব্যাপারে আমার বোধোদয় সম্বন্ধে তো বেশ বিস্তারিত বললাম। কিন্তু অপর দু’জন, যাদের নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তাঁরা হচ্ছেন: সায়্যিদ কুতুব ও মৌলানা মৌদুদী – তাদের সম্বন্ধে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে, তারা সত্যি খুব বিশ্বস্ততার সাথে ইসলামের পুনর্জাগরণ চেয়েছিলেন, তারা বহু বিষয়ে কলম ধরেছিলেন, বিপ্লবী চিত্তের মানুষদের কাছে তারা খুবই জনপ্রিয় ছিলেন এবং এখনো আছেন – কিন্তু তাদের প্রচেষ্টায় কিছু আক্বীদাহ্গত ও পদ্ধতিগত ত্রুটি যেমন ছিল, তেমনি অগ্রাধিকার ঠিক করাতেও ভুল-ভ্রান্তি ছিল। তাঁদের নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা কোনটাই এই লেখার অবকাশের আওতায় আসে না। তাঁদের জন্য মুসলিম হিসাবে আমরা দোয়া করবো ইনশা’আল্লাহ্: আল্লাহ্ যেন তাদের ভুল-ভ্রান্তিগুলো ক্ষমা করে দেন এবং অন্যকে বিভ্রান্ত করার দায়-দায়িত্ব থেকেও যেন তাদের অব্যাহতি দেন – যেটা যে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির জন্য খুব ভয়ের একটা ব্যাপার। তবে এটাও ঠিক যে, তাদের পাঠক, অনুরাগী বা অনুগামীরা যদি তাদেরকে proper perspective-এ দেখতে/ভাবতে পারতেন – অর্থাৎ, এটা ভাবতে পারতেন যে, তারা নবী-পয়গাম্বর কিছুই নন, সাহাবীও নন, চার ইমামদের মত বিশেষ কেউ নন, এমন কি গত ১৪০০+ বছরে ইসলামের যত স্কলার গত হয়েছেন, তার ভিতর হয়তো এমন ১০০০ জন পাওয়া যাবে, জ্ঞানী হিসাবে যাদের মর্যাদা তাদের উপরে; সুতরাং তাদের ভুল-ভ্রান্তি থাকতেই পারে – তাহলে কোন সমস্যাই ছিল না। সমস্যা হচ্ছে: শ্রদ্ধা করতে করতে এক সময় আমরা মানুষকে নির্ভুল বা infallible মনে করতে শুরু করি, ভাবতে শুরু করি যে, তাদের সকল judgement-ই সঠিক। অথচ, “আহলুস সুন্নাহ্ ওয়া আল জামা’আ”র মতে, আমাদের জন্য একমাত্র রাসূল (সা.)-ই হচ্ছেন নির্ভুল বা infallible। আর সবাই ভুল করতেই পারেন – তাদের শুদ্ধটুকু আমরা নেব, ভুলটুকু আমরা পরিত্যাগ করবো, ইনশা’আল্লাহ্! তা না করে যদি শ্রদ্ধাভাজন কারো কথায় আমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সা.) বেঁধে দেয়া কোন নিয়মের বাইরে চলে যাই – তবে “আনুগত্যে শিরক” নামক ভয়াবহ শিরকে পতিত হয়ে চির জাহান্নামী হবার সম্ভাবনার সম্মুখীন হতে পারি। আমি নিজে সায়্যিদ কুতুব ও মৌলানা মৌদুদীর লেখা থেকে অনেক কিছু শিখেছি এবং আমি সেজন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ এবং তাদের প্রতি thankful। In fact আমার জীবনে দ্বীন ইসলামের উপর প্রথম পড়া সিরিয়াস বইগুলোর একটা ছিল UK Islamic Foundation থেকে প্রকাশিত মৌলানা মৌদুদীর “Let us be Muslims” – যা আমার পরবর্তী জীবনঘটনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে! কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁকে আমি অন্ধভাবে অনুসরণ করবো। ব্লগে দেখেছি তাঁর পক্ষে এবং বিপক্ষে কথা বলা বেশীরভাগ ব্লগার প্রায় সব সময়ই চূড়ান্ত একটা অবস্থান গ্রহণ করেন!
যাহোক, ভবিষ্যতের জন্য বলছি, আমি যদি কারো রেফারেন্স দিই – তার মানে এই নয় যে, ঐ লেখক বা চিন্তাবিদ নিশ্চিতই আমার কাছে “চূড়ান্ত আদর্শ “ কোন ব্যক্তি – যার কোন দোষ-ত্রুটি নেই! মোটেই তা নয়, বরং ঐ লেখক বা চিন্তাবিদের যতটুকু শুদ্ধ – যতটুকু কুর’আন ও সুন্নাহ্র সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, আমরা শুধু তাই নেব, যতটুকু কুর’আন ও সুন্নাহ্র সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ – আমরা তা প্রত্যাখ্যান করবো, ইনশা’আল্লাহ্!
ইসলাম কি, ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো কি, অগ্রাধিকারগুলো কি কি ইত্যাদি না জেনেই – ইসলামের জন্য “কিছু একটা করার” ব্যাপারে মনের ভিতর এক অদম্য বাসনা জাগ্রত হওয়া – যেটাকে আমাদের সিলেটি ভাষার স্থানীয় প্রবাদে “ঘোড়ার আগে গাড়ী” পরিস্থিতি বলা হয় – এরকম একটা অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তি, সমষ্টি/সমাজ এমন কি ইসলামের জন্যও বিপজ্জনক! হঠাৎ একদিন বোধোদয় হবার পর, ইসলামের মহাসমুদ্রের দিকে ধাবমান কোন একটা ধারার সন্ধানে, অনেক তরুণ প্রাণকেই দেখেছি যেন-তেন কোন একটা ধারায় ঝাঁপ দিতে – পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত কোথাও আর যাওয়া হয়নি। “রবিন হুড” মানসিকতার দুর্বল ধারা – শেষ পর্যন্ত মূল ধারার সাথে একাত্ম হতে পারে নি বরং বালুচরে মুখ থুবড়ে আটকে গেছে সকল প্রচেষ্টা। আমার উচিত আল্লাহ্র কাছে অশেষ শুকরিয়া জানানো – আল্লাহ্ যে আমাকে ঐ রকম সম্ভাব্য কোন পরিণতি থেকে রক্ষা করছেন সেজন্য – আলহামদুলিল্লাহ্!
“রবিন হুড” মানসিকতা কেন বললাম, সেটা আপনাদের একটু খুলে বলি। ছেলেবেলায় আমরা যখন প্রথম অন্যের বাসায় গিয়ে টেলিভিশন দেখতে শুরু করি, তখন Richard Green অভিনীত “রবিনহুড” আমাদের খুব প্রিয় একটা সিরিজ ছিল (নাউযুবিল্লাহ্ – এখান থেকে কেউ যেন টেলিভিশনে হারাম বিষয় দেখতে উদ্বুদ্ধ না হন – আল্লাহ্ যেন আমার অজ্ঞতাবশত করা গুনাহসমূহ সহ সকল গুনাহ মাফ করে দেন)। গরীবের বন্ধু রবিনহুড, “অত্যাচারী” শাসক বা ধনী মানুষদের থেকে গরীব বা অবহেলিত মানুষদের “অধিকার” ছিনিয়ে নিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেয় – আমার বালক হৃদয়ে ধারণাটা সাংঘাতিক আলোড়ন সৃষ্টি করতো। যা সহজে achieve করা যায় না, তা শর্ট-কাট কোন উপায়ে দৈবাৎ যদি লাভ করা যেতো!!! – এধরনের একটা romanticism মানুষের সহজাত কি না – বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করেছি। অথচ, দ্রুত ফলাফল লাভ করার চিন্তাটাই essentially অনৈসলামিক! একটা রাফ সার্চ করলেও patient, patiently, patience ইত্যাদি রূপে পবিত্র কুর’আনে “ধৈর্য্য” শব্দটি অন্তত ৬৯ বার ব্যবহৃত হতে দেখা যায়! ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার প্রক্রিয়ায় আমি এটাও বুঝলাম যে, অনেক সংবেদনশীল, কোমল ও আবেগী হৃদয়ই হয়তো, প্রাথমিকভাবে, একটা অন্যায়ের প্রতিকার করতে কোন বিপ্লবী দলের সাথে সম্পৃক্ত হয় – “রবিন হুড” মানসিকতাবশত। যেমন ধরুন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাম্যবাদী বা সর্বহারাদের কথা! গরীবদের, মহাজনেরা বা ধনীরা শোষণ করছে দেখে অন্তরে একধরনের ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক। এই শোষণের প্রতিকার কি?? এটা ভাবতে ভাবতেই হয়তো “আবেগবশতই” একজন কিশোর, মুহূর্তের ডিসিশনে কোন চরমপন্থী দলে যোগ দেয়। তারপর দলের অন্যান্যদের মতই সেও ভাবতে শুরু করে যে, এই অন্যায় বা বৈষম্যের প্রতিকার কি করে করা যায় এবং কত তাড়াতাড়ি করা যায়! পৃথিবীর ইতিহাসে কোন ভালো কাজে “শর্টকাট” নেবার উপায় নেই। “শর্টকাট” নিতে গেলেই হয় সেই ভালো কাজ ভেস্তে যাবে, নতুবা সেটা অন্য কিছুতে পরিণত হবে। এক্ষেত্রেও হয়তো তাড়াতাড়ি “বৈষম্য” দূর করতে গিয়ে, ধনীর কাছ থেকে সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে গরীবকে দেয়ার কোন অপারেশনে “রবিন হুড মানসিকতাবশত” “বড়দের” সাথে একদিন যোগ দেয় কিশোরটি। সেই প্রক্রিয়ায় হয়তো “শ্রেণী-শত্রু” খতম করার মত “মহৎ” কাজটি করতে গিয়ে একটি “বিপ্লবী হত্যাকান্ডের” সাথে জড়িয়ে পড়ে সে। এমনিতেই, সাধারণত এসব গুপ্ত সংগঠনে যোগদান করাটা অনেকটা one way journey, ফিরে আসার কোন পথ থাকে না! তারপর হত্যাকান্ডের সাথে নাম জড়িয়ে পড়লে তো আর কথাই নাই – খুন, জখম আর extortion তখন তার একমাত্র way of life হয়ে দাঁড়ায় – পরিণতিতে সর্বহারাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হৃদয়সম্পন্ন মানুষটি হয়ে ওঠে “ডাকাত”! ঐ জীবন থেকে মুক্তির কেবল মাত্র একটা দরজাই উন্মুক্ত থাকে – যা হচ্ছে “মৃত্যু”: সুজানগরের কামরুল মাস্টার আর ঝুনু মেকারের মত করুণ পরিণতি। জীবনের শুরুটা হয় জনদরদী বিপ্লবী হিসেবে পরিচিত হবার মাধ্যমে, শেষটা হয় “ডাকাত” হিসেবে র্যাব বা পুলিশের সাথে “বন্দুকযুদ্ধে” নিহত হবার মাধ্যমে!
এত কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য: অনেককেই – বিশেষত বয়সে যারা তরুণ – তাদেরকে দেখা যায়, হঠাৎ যখন ভিন্ন কোন পথে চলতে চলতে আল্লাহ্, তাঁর রাসূল (সা.) ও তাঁর দ্বীনে সিরিয়াসলী বিশ্বাস করতে শুরু করেন – তখন আবেগ ও উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে অনেক সময়ই ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেন এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তার নিজেরই শুদ্ধ দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়। সাধারণত দেখা যায়, দ্বীন শিখতে শুরু করেই, অন্যের দোষ ও অপূর্ণতা চোখে পড়তে শুরু করে – শুরুর দিকেই হয়তো বাসায় গিয়ে, নিজের বাবা, মা বা ভাই-বোনকে বলতে শুরু করলেন: “তোমরা এসব কি নামায পড় – তোমাদের এসব নামায তো হচ্ছেই না!” বা “তোমরা তো কুফর ও শিরকে নিমজ্জিত” ইত্যাদি। এরপরের দশা হচ্ছে কোন ইমামের পেছনে নামায হবে, আর কোন ইমামের পেছনে নামায হবে না – এসব নিয়ে গবেষণা এবং প্রচলিত মসজিদের ইমামদের পেছনে সালাত আদায় না করা (নামায না পড়া)। তারুণ্যের এসব প্রাণশক্তি, আবেগ বা অনুভূতিকে harness করতে না পারলে, বা লাগাম টেনে ধরতে না পারলে – সে সব বিপথে প্রবাহিত হতেই পারে। আমরা রাসূলের (সা.) জীবনী ঘাঁটলে দেখবো যে, মক্কার জীবনে, এরকম কত উচ্ছ্বাসকে তিনি প্রশমিত করেছেন – যখন বয়সে তরুণ সাহাবীরা “কিছু একটা” করতে চেয়েছেন।
যারা ইসলামকে ভালোবাসেন, ইসলামের প্রচার ও প্রসার নিয়ে কাজ করতে চান, অনুশীলনরত মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করতে চান, তাদের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ও ধৈর্য্য সহকারে জীবন যাপন এবং জীবনধারণ করা উচিত – আর সেই প্রক্রিয়ায় তাদের আবেগের লাগাম টেনে ধরা উচিত এবং অগ্রাধিকার ঠিক করে নিজের দ্বীন শিখে নেয়া উচিত। প্রথমত, নিজের ঈমান বা আক্বীদাহকে নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে শুদ্ধ করে নেয়া উচিত। আক্বীদাহ্ বলতে আমরা বোঝাতে চাচ্ছি: একজন মুসলিম আল্লাহ্, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, ক্বিয়ামত ও অদৃষ্ট বা ভাগ্যের নির্ধারণ সম্বন্ধে কি কি বিশ্বাস রাখবেন আর কি কি বিশ্বাস রাখবেন না! বলা বাহুল্য, এই বিশ্বাসগুলোর সব আসতে হবে “অহী” বা “নস্” (text)থেকে: হয় কুর’আন, নয়, সহীহ সুন্নাহ্ থেকে। শুদ্ধ আক্বীদাহকে আমরা কম্পিউটারের “সফ্টওয়ারের” সাথে তুলনা করতে পারি। “সফ্টওয়ার” ছাড়া একটা কম্পিউটার যেমন কেবলই “কোন-কাজে-না-লাগা” একটা বাক্স বা “খোল”, তেমনি, শুদ্ধ বিশ্বাস বা আক্বীদাহ্ ছাড়া একটা মানব জীবন একদিকে যেমন নিতান্তই নিষ্ফল, তেমনি অপরদিকে এই মানব দেহ পাথরের মতই তুচ্ছ – কেবলই জাহান্নামের জ্বালানী হবার যোগ্য (কুর’আন, ৬৬:৬)। তাছাড়া যে কারো এটা অনুধাবন করা উচিত যে, সারা পৃথিবীতে আজ যদি আবারও ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়, তবু তার নিজের কোন লাভ নাই – যদি তিনি (বড়) শিরক বা (বড়) কুফরের উপর মৃত্যুবরণ করেন। একবার ঈমান/আক্বীদাহ্ মোটামুটি শুদ্ধ ও কুফর/শিরক বিবর্জিত হলে, তখন যে কেউ সর্ব প্রথম নিজের জীবনে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায়, ইবাদতের কাজগুলো (অন্তত ফরজ ইবাদতগুলো) সঠিকভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করবেন – পর্যায়ক্রমে সালাত (৫ ওয়াক্ত নামায), যাকাত, সিয়াম (রমাদানে ১ মাস রোজা), হজ্জ এবং তারপর অন্যান্য ইবাদতের ব্যাপারগুলো: দোয়া, কুরবানী, মানত, কসম ইত্যাদি ইত্যাদি! মনে রাখতে হবে যে, ঈমানের পরে ইবাদত কবুলের বা গ্রহণযোগ্য হবার দু’টি প্রধান শর্ত হচ্ছে:
১) বিশ্বস্ততা সহকারে একমাত্র আল্লাহর এবং আল্লাহর জন্যই সকল ইবাদতের কাজ নিবেদন করা।
২) রাসূলের (সা.) নির্দেশ, অনুমোদন বা দেখিয়ে দেওয়া পন্থায় সেগুলো সম্পাদন করা!
এখানে প্রথম ব্যাপারটা হচ্ছে অন্তরের সাথে সম্পৃক্ত – আর দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে কাজের ও প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত। এখান থেকেই ইসলামের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মূলনীতি বেরিয়ে আসে – কোন একটা কাজে কেবল “বিশ্বস্ততাই” পর্যাপ্ত নয়, বরং কাজটা সম্বন্ধে জ্ঞান বা সেটা কিভাবে করতে হবে সে সম্বন্ধে জ্ঞান থাকাটা অপরিহার্য – অন্যভাবে বললে কার্য সম্পাদনের প্রক্রিয়াটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ – আর বলা বাহুল্য দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত যে কোন কাজের সঠিক প্রক্রিয়া খুঁজতে হবে সুন্নাহর মাঝে!!
আবু আমীনাহ্ বিলাল ফিলিপ্সের একটা বক্তৃতায় শুনেছিলাম, তিনি আমেরিকার জেলে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত একজন অন্ধ ‘আলেমের কথা বলছিলেন – যিনি নাকি ওখানকার ধর্মান্তরিত মুসলিমদের ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, আমেরিকা যেহেতু তাদের জন্য শত্রু-ভূমি, সেহেতু, ওখানকার জুয়েলারী দোকান-পাট ইত্যাদি লুটপাট করে অর্থ সংগ্রহ করাটা জায়েয। ফলে কিছু ধর্মান্তরিত যুবক আবেগতাড়িত হয়ে চুরি-ডাকাতিতে আত্ম-নিয়োগ করেন এবং ধরা পড়ার পর একেক জনের ৪৫ বছরের কারাদন্ড হয়। এখানেই ঐ “রবিনহুড” মানসিকতার কথা এসে গেল – শর্টকাট নেয়ার ব্যাপার এসে গেল – এখনকার সমাজব্যবস্থায় হয়তো যেটাকে “নিজের হাতে আইন” তুলে নেয়ার মত কিছু বলা হবে। অথচ, আমরা যদি রাসূলের (সা.) জীবন বা সুন্নাহ থেকে শিক্ষা নিতাম, তাহলে দেখতাম যে নবুয়ত পরবর্তী মক্কার ১৩ বছরের জীবনে মুসলিমরা কাফির-মুশরিক শাসিত জগতে বাস করতেন চরম প্রতিকূল অবস্থায় – যার একটা পর্যায়ে, এমন কি ৩ বছরের মত সময় তাঁরা অবরুদ্ধ অবস্থায় কাটান – তাঁদের বয়কট করা হয়েছিল, তাঁরা literally ঘাস-পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করেছেন – কই একটা লুট-পাটের ঘটনাও তো আমরা শুনি না! এভাবেই আমরা যদি প্রতিটি সমস্যা বা প্রতিকূল অবস্থায় রাসূল (সা.) বা তাঁর সাহাবীরা (রা.) কি করেছেন তা খুঁজে দেখতাম – তবে হয়তো আজকের আবেগ-ভিত্তিক বিভ্রান্তির অনেকটুকুই এড়িয়ে চলা সম্ভব হতো।
ইতিহাসে সুন্নাহ্ বিবর্জিত এই বিভ্রান্তির প্রথম মুখ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটে খারেজীদের উত্থানের মধ্য দিয়ে – কি সাংঘাতিক “ইখলাস” বা “বিশ্বস্ততা” ছিল তাদের, অথচ গভীর জ্ঞান না থাকা তথা রাসূলের (সা.) সুন্নাহ্ না জানার কারণে, হযরত আলী (রা.) সহ কত প্রথম শ্রেণীর মুসলিমকে হত্যা করেছে তারা! আলী (রা.) ও ইবন আব্বাস (রা.)-এঁর মত সাহাবীদেরও তারা “কাফির” ঘোষণা করে। আজও সেই trend অব্যাহত রয়েছে পৃথিবীতে এবং দুঃখজনক হলেও এমন কি বাংলাদেশেও। বাংলাদেশেও এমন সমষ্টি বা গোষ্ঠী রয়েছে, যারা নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে মুসলিম মনে করে না – সাধারণ মসজিদে নামায পড়ে না এবং সর্বক্ষণ অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায় – অথচ রাসূলের (সা.) মসজিদে মুনাফিক্বরাও নামায পড়তো বিনা বাধায়।
আলী (রা.)-কে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, “নাহরাওয়ানের লোকেরা (অর্থাৎ খারেজীরা) কাফির কি না?” তিনি বলেছিলেন, “তারা কুফর থেকে পালিয়েছে”। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো তারা মুনাফিক্ব কি না? তখন তিনি বললেন, “মুনাফিক্বরা কদাচিৎ আল্লাহ্কে স্মরণ করে, কিন্তু এরা সকাল বিকাল আল্লাহ্কে স্মরণ করে থাকে; এরা হচ্ছে আমাদের ভাই যারা আমাদের বিরুদ্ধে (যেতে গিয়ে) সীমা লঙ্ঘন করেছে।” [১] দেখুন তাঁর সাথে যুদ্ধরত ও তাঁকে “কাফির” জ্ঞান করা বিদ্রোহীদের ব্যাপারেও, একজন খলিফার তথা সাহাবীর কত সহনশীল মনোভাব ছিল!!
গত কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশে ধর্মীয় চরমপন্থার যতটুকু বিস্তার দেখা যায়, তার মূলেও আরো অনেক কিছুর পাশাপাশি রয়েছে একধরনের “রবিনহুড” মানসিকতা। তাড়াতাড়ি সবকিছু বদলে দেয়ার জন্য শর্ট-কাট রাস্তা খোঁজা। অথচ এসব করে ইসলাম প্রচার, ইসলাম শিক্ষা এবং ইসলাম অনুযায়ী জীবন যাপন করাকে যে প্রকারান্তরে ব্যাহত ও বিপর্যস্ত করা হলো – তার দায়-দায়িত্ব কে নেবে। এসব করে লাভ হয়েছে কাদের? আর ক্ষতিই বা হয়েছে কাদের?? ইসলামের প্রচার প্রসার কি এগিয়ে গেছে না শতবর্ষ পিছিয়ে গেছে?? তাছাড়া বোমাবাজি অথবা অন্যান্য নাশকতামূলক কান্ডের ফলশ্রুতিতে যদি একজন মুসলিমেরও (আমরা বলছি না যে, এমনি এমনি একজন অমুসলিমের ক্ষতি করা যাবে, তবু তর্কের খাতিরে আমরা শুধু মুসলিমদের ব্যাপারটাই consider করবো) অহেতুক প্রাণহানি ঘটে থাকে (বহু ঘটনায় যা নিশ্চিতভাবেই ঘটেছে), তাহলে ব্যাপারটা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয় হবার কথা – কারণ, একজন মুসলিমের জীবন আল্লাহ্র কাছে এই পৃথিবী এবং এতে যা কিছু রয়েছে তার চেয়ে প্রিয় – যে কারণে একজন মুসলিম বেঁচে থাকতেও আল্লাহ্ পৃথিবী ধ্বংস করবেন না (অর্থাৎ ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না)! আমাদের উচিত গত কয়েক বছরের ঘটনাবলী নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা এবং প্রত্যেকটি পরিস্থিতিতে রাসূল (সা.), খুলাফায়ে রাশেদীন বা সাহাবীরা কি করেছেন বা করতেন তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করা! বড় স্কলাররা সবাই বলে থাকেন, “সুন্নাহ্ মানেই হচ্ছে দ্বীন ইসলাম, আর দ্বীন ইসলাম মানেই হচ্ছে সুন্নাহ্”! অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হবে যে, “সুন্নাহ্ ছাড়া দ্বীন ইসলামের কোন অস্তিত্বই নেই”!! তাই কোন “এক্টিভিজম”-এ ঝাঁপ দেয়ার আগে, আমাদের উচিত ভালো করে রাসূল (সা.) ও তাঁর কাছের প্রধান প্রধান সাহাবীদের জীবনী পড়ে নেয়া এবং সুন্নাহর সংজ্ঞা, শ্রেণীবিভাগ, অপরিহাযর্তা, আইনী মর্যাদাসহ বাস্তব প্রায়োগিক দিকগুলো জেনে নেয়া।আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে তাঁর রাসূলের (সা.) সুন্নাহ্ জানার, বোঝার ও মানার তৌফিক্ব দিন – আমীন!!
ফুটনোট:
[১] দেখুন: পৃষ্ঠা#১৭৩, ভল্যুম#৮, আস-সুনান আল-কুবরা – আল-বাইহাকি।
লিখেছেন- এনামুল হক,
কৃতঞ্জতায়: shorolpoth.com
বিষয়: বিবিধ
১২৩৯ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন