আর কোন কিছুই তাঁর মত নয়
লিখেছেন লিখেছেন মধ্যমপন্থী ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:৩২:৫০ রাত
বদর যুদ্ধের আগে আবু জাহল কা’বা শরীফের গিলাফ ধরে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে বলেছিল যে, সত্যের যেন জয় হয়। সত্যের জয় হয়েওছিল – তবে তার জয় হয়নি। আবু জাহল গং কিন্তু আল্লাহকে আল্লাহ্ বলেই ডাকতো, কা’বা তাওয়াফ করতো, আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করতো। স্বয়ং আল্লাহ্ কুর’আনে বলেছেন যে, আল্লাহকে তারা সৃষ্টিকর্তা হিসেবে, রিযিকদাতা হিসেবে স্বীকার করতো – যেমনটা আমরা নীচের আয়াতে দেখতে পাই:
If thou ask them, Who created them, they will certainly say, Allah: how then are they deluded away (from the Truth)?(Qur’an, 43:87)
তাহলে তারা কেন কাফির/মুশরিক আর আমাদের নবী(সা.) কেন নবী, মু’মিন ও মুসলিম? বা তাঁর উম্মত হিসেবে আমরা কেন নিজেদের মুসলিম ভাবি? এই প্রশ্নের মূলে যে বাস্তবতা রয়েছে, তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ সম্বন্ধে আবু জাহল গং এবং রাসূল(সা.)-এঁর ধারণা ভিন্ন ছিল – অথবা আমরা বলতে পারি যে, আল্লাহ্ সম্বন্ধে তাদের আক্বীদাহ্ (বা set of beliefs) ছিল ভিন্ন। এজন্যই সত্যিকার মুসলিম হিসেবে পরিগণিত হতে হলে, আল্লাহ্ সম্বন্ধে আমাদের কি কি বিশ্বাস পোষণ করতে হবে তা “আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের” কাছ থেকে [অর্থাৎ কেবল অহীর সূত্র থেকে] জেনে নিতে হবে। তা না হলে আমরা কবরের [বা বারযাকের] জীবনের শুরুতে জিজ্ঞাসিত ৩টি প্রশ্নের প্রথমটির জবাব জানবো না এবং চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন হবার সমূহ সম্ভাবনার মুখোমুখি হবো। দুনিয়ার জীবনের ড্রয়িংরূমের শো কেসে সাজানো বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা সেদিন আমাদের কোন কাজে আসবে না এবং সে সব থেকে লব্ধ জ্ঞান অর্থহীন বলে প্রতিপন্ন হবে। নিজের ধ্যান-ধারণা, কল্পনা-বিলাস, কাব্য-প্রতিভা অথবা বিজাতীয় তত্ত্ব বা তথ্য থেকে প্রাপ্ত ইঙ্গিতের ভিত্তিতে আমরা যদি আল্লাহ্ সম্বন্ধে “নিজস্ব বা মনগড়া” ধারণা পোষণ করি, তবে তা হবে গর্হিত এক অপরাধ (কুর’আন, ৭:৩৩)। উদাহরণস্বরূপ আমাদের দেশের তথাকথিত জনপ্রিয় মরমী গানে আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়ে থাকে,”তুমি ফল, তুমি ফুল, তুমি তাতে গন্ধ” – একথার ভিত্তি কি? কুর’আন বা সুন্নাহয় এর কোন দলিল আছে? নেই! বরং এগুলো হচ্ছে কিছু সংখ্যক আউল-বাউলের শ্রেফ কল্পনা উদ্ভূত কিছু কথা। এধরনের লোক-কথা বা লোক-গাথার উপর ভিত্তি করে আমরা যদি আল্লাহ্ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা গঠন করি, তবে শিরকে লিপ্ত হয়ে চিরতরে জাহান্নামী হবার আশংকা রয়েছে। এবিষয়ে সঠিক আক্বীদাহ্ হচ্ছে,”তোমার [সৃষ্টি] ফল, তোমার [সৃষ্টি] ফুল, তাতে যে গন্ধ রয়েছে সেটাো তোমার [সৃষ্টি]“। তা না বলে “তুমি ফল, তুমি ফুল, তুমি তাতে গন্ধ” বলার অর্থ হচ্ছে, সর্বেশ্বরবাদ তথা হিন্দু দর্শনের গীত গাওয়া।
আমরা যখন আল্লাহর পরিচয় সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করবো, তখন দেখবো যে আল্লাহর পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে “তাওহীদ” বা আল্লাহর একত্ববাদ [বা অদ্বিতীয়তার] ধারণা। তাোহীদের বিস্তারিত আলোচনায় আজ আমরা যবোনা, ইনশা’আল্লাহ্ পরবর্তীতে এ নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো। তবে আজ শুধু তাোহীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা মূলনীতি বলে শেষ করবো: আর কিছুই আল্লাহর মত নয়! (কুর’আন, ৪২:১১ এবং ১১২:৪)।
যারা Karen Armstrong-এর History of God বইটি পড়েছেন বা অন্তত দেখেছেন, তারা হয়তো দেখেছেন যে, ঐ বইয়ের প্রচ্ছদে এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর আঁকা একটা চিত্র রয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে যে, শূন্যে ভাসমান বিশাল দাড়ীওয়ালা এক পক্ককেশ বৃদ্ধ এক তরুণের দিকে হাত বড়িয়ে আছেন, আর মনে হচ্ছে যে তরুণটি তাকে ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য এই ছবির ঐ বৃদ্ধকে, চিত্রকর ঈশ্বর বলে বোঝাতে চেয়েছেন, আর, তরুণটি হচ্ছে মানবসন্তান। গ্রেকো-রোমান “দর্শন” দ্বারা প্রভাবিত এবং নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া খৃষ্টধর্মের ঈশ্বরের ধারণা “নরত্ব আরোপ” বা anthropomorphism-এর সীমা ছাড়িয়ে বেশীদূর যেতে পারেনি। এছাড়া ঈশ্বরের সাথে যীশুর বাপ-ছেলে সম্পর্ক হয়তো এ ব্যাপারে সহায়ক হয়ে থাকবে। ঈশ্বরকে কল্পনা করার চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ যখনই নিজের আবেগ, ভয়, আশা, নিরাশা ইত্যাদি সহ তার অত্যন্ত সীমিত মেধার উপর নির্ভর করেছে, তখনই সে তার পরিচিত জগত থেকে কোন একটা বা একাধিক চেহারার মিশ্রনকে ইশ্বরের চেহারা বলে জ্ঞান করেছে। গ্রেকো-রোমান, মিশরীয় বা অন্যান্য পুরাতন সভ্যতা থেকে নিয়ে এপর্যন্ত ব্যাপারটা তাই থেকেছে।
এ ব্যাপারে ইসলাম প্রায় সকল ধর্মের চেয়ে আলাদা। গত লেখাটায় যেমন বলেছি, “আর কিছুই আল্লাহর মত নয়” (সুরা আশ শুরাঃ১১)– এটা হচ্ছে আল্লাহ্ সংক্রান্ত ইসলামী ধারণার এক অবিচ্ছদ্য মূলনীতি। আবু বক্বর (রা.)-এর একটা বিখ্যাত বাণী রয়েছে এই প্রসঙ্গে, যার সারমর্ম হচ্ছে এরকম যে, “তোমার মনে আল্লাহ্ সম্বন্ধে যে ধারণাই আসবে, আল্লাহ্ তার সবকয়টির চেয়ে আলাদা”। সোজা বাংলায় বলতে গেলে যে কোন মানুষ আল্লাহ্ সম্বন্ধে ভাবতে গিয়ে, আল্লাহকে যা কিছুর মত ভাববে – আল্লাহ্ তার কোনটির মতই নন। এছাড়া ইসলামী ধর্মতত্ত্ব পড়াতে গিয়ে স্কলাররা বলেন যে, Deification of humans অথবা Humanization of the Deity এ দু’টোই হচ্ছে শিরকের মত অমার্জনীয় পাপের দু’টো প্রধান উৎস। উদাহরণস্বরূপ শ্রদ্ধা করতে করতে রবীন্দ্রনাথকে কিছু মানুষ এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন যেটাকে অনায়াসে Deification of humans বলা যায় – আর তারাও তাই তাকে “গুরুদেব” বলে ডাকতে পারেন নিঃসঙ্কোচে।
যাহোক, আল্লাহর পরিচয় জানার ব্যাপারে ইসলামী ধর্মতত্ত্বের আরেকটি মূলনীতি হচ্ছে, আল্লাহ্ সংক্রান্ত আক্বীদাহ্ [বা সাধারণভাবে সকল আক্বীদাই] কেবল অহী বা প্রত্যদেশ থেকে গ্রহণ করতে হবে – তাতে নিজস্ব “মনের মাধুরী” মেশানো যাবেনা।
আক্বীদাহ্ সংক্রান্ত যে কোন তথ্যের উৎস হতে হবে কেবল এবং কেবলমাত্র “অহী” বা প্রত্যাদেশ – তা “অহী মাতলু” [অর্থাৎ কুর'আন বা যে অহী তিলাওয়াত করা হয়] অথবা “অহী গায়ের মাতলু” [অর্থাৎ হাদীস বা সুন্নাহ্ - যা তিলাোয়াত করা হয় না] যে কোনটাই হতে পারে। তবে আক্বীদাহর কোন বিষয়ে আমাদের মনগড়া কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ গ্রহণযোগ্য নয় বরং তা অত্যন্ত গর্হিত পাপ! কুর’আনে সূরা আল আরাফের ৩৩ নম্বর আয়াতে, আল্লাহ্ ৪ শ্রেণীর পাপকে পর্যায়ক্রমে উল্লেখ করেছেন – নীচের দিক থেকে শুরু করে ৩ নম্বরে স্থান পেয়েছে “শিরক”। আর তার উপরে স্থান পেয়েছে তার চেয়ে গর্হিত পাপ: “আল্লাহ্ সম্বন্ধে অনুমানবশত কথা বলা”। আল্লাহ সম্বন্ধে এবং প্রকারান্তরে, আল্লাহর দ্বীন সম্বন্ধে অনুমানবশত কথা বলাই হচ্ছে সকল পাপের উৎস। আমরা ইনশা’আল্লাহ্ চেষ্টা করবো, দ্বীন সংক্রান্ত ব্যাপারে কেবল নিশ্চিত জ্ঞনের উপর ভিত্তি করে কথা বলতে – অন্যথায় চুপ থাকাটাই শ্রেয়!
যা হোক, সবার আগে আমরা চাইবো আল্লাহর পরিচয় জানতে – যতটুকু এবং ঠিক যেভাবে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল (সা.) আমাদের জানিয়েছেন
সে ভাবে জানতে চেষ্টা করবো ইনশা’আল্লাহ্
-শায়খ এনামুল হকের প্রবন্ধ থেকে সংকলিত
বিষয়: বিবিধ
১০৬৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন