তুর্কী এরদোগান পশ্চিমা দৃষ্টিতে দানব কেন?
লিখেছেন লিখেছেন সুমাইয়া হাবীবা ২৮ জুলাই, ২০১৬, ০২:৪১:৫৫ দুপুর
মূল-সুমাইয়া ঘানুশি। ( ব্রিটিশ তিউনিসিয়ান লেখক, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক)
অনুবাদ-সুমাইয়া হাবীবা।
প্রকাশকাল- ২৭ জুলাই,২০১৬। দৈনিক নয়া দিগন্ত।
এরদোগান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আর কোন নেতাকেই এমন দানবরূপে দেখানো হয়নি পশ্চিমে। মধ্যপ্রাচ্যের সামান্য কয়জন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে তিনিই একমাত্র প্রকৃতভাবেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত।
গত শুক্রবার তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সময় অনেক মুখোশই খুলে পড়েছে। এর বড় অংশ যেমন ডানপন্থী শিবির থেকে, তেমনি একইভাবে বামপন্থী শিবির থেকেও। এরা কখনোই গণতন্ত্রের পক্ষে, মানবাধিকারের পক্ষে, স্মারণিকা লিখতে বসবে না। এই জনগণ এবং জনতার ক্ষমতা এটা প্রমাণ করেছে যে ভণ্ড গণতন্ত্রী ও ছদ্মবেশী উদারপন্থীরা খুবই তুচ্ছ এদের তুলনায়।
হাস্যকরভাবে, সেই পশ্চিমা ‘বিশেষজ্ঞ’, ‘বিশ্লেষক’ এবং ‘টকশো আলোচক’, যারা যৌথভাবে তুর্কির গত নির্বাচনে খুব উল্লসিত ধারণাপ্রসূত পূর্বাভাস করেছিল একেপির ভরাডুবি সম্পর্কে। কিন্তু নির্বাচনের পর একেপির জয়ে মারাত্মক হতাশ হয়েছিল এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল বর্তমানের মতো এমনি চক্রাকার সময়ে তাদের আরো বড় ভ্রান্তিকর বিচার বিশ্লেষণ উগড়ে দেয়ার।
সামরিক অভ্যুত্থানের বিপক্ষে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে, জনগণের ইচ্ছার পক্ষে একটি স্পষ্ট নীতিগত অবস্থান প্রকাশের পরিবর্তে এরা পছন্দ করছে সেসব রাষ্ট্রদ্রোহীকে (বিদ্রোহীদের) পক্ষ নেয়ার, যারা তুর্কির সংসদ ভবনে ‘এফওয়ান সিক্স,এস’ বিমান দিয়ে বোমা হামলা করেছে এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের গুলি করে হত্যা করেছে।
এরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত এবং যখন এটি ক্রিয়াশীলও, সে সরকার উৎখাতের চক্রান্তের সাফাইগীত গাইছে। সেসব জেনারেল আর সৈনিক প্রেসিডেন্টকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেছে, তাদের জমানো সব ক্ষোভ, অশ্রদ্ধা উগড়ে দিচ্ছে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ওপর।
আর যখন সব মতভেদ জয় করে অভ্যুত্থান ব্যর্থ করা হলো, তখন সুর পরিণত হলো গণতন্ত্রের ওপর খড়গহস্তের বিলাপে। উদ্ধত ও স্বৈরাচারী এরদোগানের অধীনে তা ভয়ঙ্কর দুর্দশায় পড়বে এ হাহাকারে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও দমনপীড়নের পথে অবধারিতভাবে পা হড়কানোর বিষন্ন সতর্কবার্তায়।
সানডে টাইমসের একজন ভাষ্যকার অভ্যুত্থানের চক্রান্তকারীদের তীব্র ভর্ৎসনা করেছেন, যা তিনি উল্লেখ করেছেন সুমহান বিবরণ দিয়ে! যেমন তাদের উপস্থাপন করেছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষবাদের অভিভাবক’ হিসেবে এবং ‘অগ্রগতির লক্ষ্যের শক্তি’ হিসেবে! তার নিজেরই এমন আধুনিকত্ব, যে পরামর্শ দিয়েছেন জুলাইয়ে মঞ্চস্থ এই অভ্যুত্থান প্রলম্বিত করার জন্য তাতে সবাই উত্তপ্ত থাকতে থাকতে নিদ্রাতুর হয়ে যাবে। ফলে সেপ্টেম্বরেই হয়ে হবে নতিস্বীকার এবং কাক্সিক্ষত ফলাফল আসবে।
একই রাগভৈরবী বাজাচ্ছে বামপন্থী গণমাধ্যমগুলো। অভ্যুত্থানের চক্রান্তকারীদের পুনর্বাসন নিয়ে ও এরদোগানকে রাক্ষুসে দানব হিসেবে রূপায়ণ করে। অভ্যুত্থান ঘটার কয়েক ঘণ্টা পরে, উদার বামপক্ষপাতী ‘গার্ডিয়ান’ নিউজ দিতে শুরু করে এরকম বিরক্তিকর পরাবাস্তব শিরোনাম দিয়ে-’তুর্কি ইতোমধ্যে ধীরগতির স্বৈর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তবে সেটা সেনাদের নয়, এরদোগানের।’
পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর কোনো একটি থেকেও কোনোরকম নীতিনৈতিকতা সম্পন্ন প্রতিক্রিয়া আসেনি। কূটনৈতিক কূটতর্কের পথ অবলম্বন করে, তারা প্রাথমিকভাবে অভ্যুত্থানের অভিশাপ এড়িয়েছে, সাবধানতা ও সংযম দেখিয়ে নিজেদের ফাঁকা আওয়াজেই আবদ্ধ রেখেছে।
যখন লক্ষাধিক সাধারণ তুর্কি কারফিউ অমান্য করে এবং নিরস্ত্র অবস্থায়ই তাদের দেশকে আবার সেই সামরিক একনায়কত্বের অন্ধকার যুগে পৌঁছানোর মাধ্যমে পেছনে ঠেলে নেয়ার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে বিদ্রোহী সেনাদের পরাজিত করেছে, শুধু তখন তাদের ফাঁপা বুলিগুলো সামান্য স্থান পরিবর্তন করে ‘গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন’ জাতীয় ঈষদুষ্ণ বিবৃতিতে এবং সব রাষ্ট্রদ্রোহীর জন্য ও তাদের কৃতকর্মের অবশ্যম্ভাবী পরিণতির জন্য উদ্বেগের দীর্ঘ প্রতিক্রিয়ায় রূপ নেয়।
এরদোগানের অসংখ্য ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতেই পারে। তিনি তার কর্মকাণ্ডে স্থানীয় জটিলতা ও আঞ্চলিক অনুষঙ্গেও পড়তে পারেন; কিন্তু তাই বলে এটা কি অনস্বীকার্য নয়, তার ক্ষমতার ভিত্তি হলো নির্বাচনী পদ্ধতি ও জনপ্রিয়তার সংখ্যাধিক্যের বৈধতা এবং তাকে পছন্দ করুন অথবা ঘৃণা করুন, তুর্কির আধুনিক ইতিহাসে এই তুর্কি প্রেসিডেন্টই অতীতের অন্য সব শাসকের চেয়ে তার দেশকে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক রূপ দান করেছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করেছেন। জনগণের কর্তৃত্বকে দৃঢ় করেছেন সেনাবাহিনীর বিপরীতে, যা তুর্কির রাজনৈতিক বিভাগটাকেই কামারপেটা করে মরুভূমি করে দিয়েছিল।
একেপি যুগ দেখেছে জেনারেলদের কর্তৃত্ব থেকে বেসামরিক শাসনের স্বাধীনতা। দেখেছে সেনাবাহিনীর সংস্কারসাধন, নিরাপত্তাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিশেষ বাহিনীর পুনর্গঠন। শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে উদারীকরণ করার সাথে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যগুলোকে সঞ্চয় করা, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ও সুশীলসমাজের ভূমিকাকে প্রশস্ত করার ফলেই তুর্কি জনগণ পূর্ণ স্বাধীন ও সাহসী হতে পেরেছে এবং জেনারেল ও বিদ্রোহীদের আদেশ অমান্য করার স্পর্ধা দেখাতে আরো বেশি সক্ষম হয়েছে।
আপাতবিরোধী হলেও সত্য, এরদোগান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আর কোনো নেতাই তার চেয়ে বেশি দানবীয় রূপ পায়নি; যখন খুবই সামান্য কিছু রাষ্ট্রের ভেতর তিনিই একমাত্র প্রকৃতই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। মনে হচ্ছে ‘আমরা’ (পশ্চিমারা) চাইছি বিশ্বের ওই অংশটি অনিশ্চিত অন্ধকূপ (ব্ল্যাক হোল) হিসেবেই বজায় থাকুক। এটাই ‘আমাদের’ (পশ্চিমাদের) কার্যকলাপের বৈপরীত্য।
এমনটা প্রযোজ্য আমাদের মিত্রদের জন্যও, যাদের পরিসীমা পাকাপোক্ত স্বৈরশাসক ও রক্তপিপাসু জেনারেলদের মধ্যে। তারা আমাদের ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, সমালোচনা থেকে নিরাপদেই নিষ্কৃতি পেয়ে যায়। মূলত তারা আমাদের জন্য আমাদের খারাপ কাজগুলো করে দেয়। যেমনটা আমাদের তেলসমৃদ্ধ কিছু উপসাগরীয় বন্ধুরা মিসরে করেছে এবং এখনো ক্রমাগত করে যাচ্ছে লিবিয়া ও ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে।
চুক্তির স্বরূপ হলো, আমাদের (মিত্রদের) ইচ্ছার কাছে গণতন্ত্র হার মেনে যায়। যারা এমন করবে যে, ‘আমরা বলব এবং আমাদের স্বার্থকে বিসর্জন দেবো, এবং আমাদের (মিত্রদের) অগ্রাহ্য করবে তাদের আমরা (মিত্ররা) অপসারণ করব। আমাদের জন্য এটাই আদর্শ চিত্রনাট্য! অন্যথায়, এ চিত্রনাট্য থেকে পরিত্রাণ চাইলে আমাদের অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে পুরো অঞ্চলজুড়ে সঞ্চিত বিদ্রোহী ও জেনারেলদের দিকে। খুব দ্রুত ক্ষত নিরাময়ের প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের জন্য।
সত্য বিবর্জিত বিশ্লেষণ ও ধারাবিবরণীর মাধ্যমে আমাদের কৈফিয়তদাতাদের অর্কেস্ট্রা খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে কুৎসিত দৃশ্যটিকে সুশোভিত করার জন্য। অভ্যুত্থানের চক্রান্তকারীদের ‘আধুনিকতার জনক’ ও ‘অগ্রগতির কর্মী’ হিসেবে এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের স্বৈরশাসকরূপে রূপায়ণ করার জন্য।
যে নাগরিকেরা তাদের নির্বাচনী পছন্দগুলোকে রক্ষা করার সাহস দেখিয়েছে, তারা চিত্রিত হবে ধর্মান্ধ এবং ধর্মীয় উন্মাদনাসম্পন্ন চরমপন্থী হিসেবে। অথবা তুর্কির ক্ষেত্রে হবে ‘এরদোগানের ইসলামি জনতা’! যেমনটা এক ব্রিটিশ পত্রিকা ইতোমধ্যে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভকারীদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছে।
এটা অবশ্যই সত্য যে, পশ্চিমারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে গাছাড়া ভাব নিয়ে থাকতে পারে না। তারা শুধু সেখানেই অপ্রাসঙ্গিক যেখানে তাদের বন্ধু ও মিত্রদের ওপর এগুলো এসে পড়ে এবং এটা তখনই মহামূল্যবান রুপোর কাঠি যখন এটি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রুদের পিটিয়ে তাড়াতে পারে। আজকে যদি এরদোগান অপমানিত, নিন্দিত হন, তবে এটা এ কারণে নয় যে এরদোগান গণতন্ত্রী নন অথবা তিনি একজন অত্যাচারী শাসক। এটা এই কারণে হবে যে, তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যের নির্দেশনার প্রতি নমনীয় নন এবং তার রাজ্যে পশ্চিমা প্যারামিটার ও পশ্চিমা কানুনকে দমিয়ে রাখতে ইচ্ছুক।
অতঃপর, সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ হলো, পশ্চিমা শক্তিগুলো সক্ষম হবে কি মেনে নিতে এবং সুষ্ঠু আচরণ করবে কি একজন নেতার সাথে? যে তার দেশের স্বার্থগুলো এবং জনগণের ইচ্ছাকে প্রকাশ করে দেখিয়েছে। আর যেটা সম্ভবত অবধারিতভাবেই তাদের ইচ্ছা ও স্বার্থের সাথে মিলবে না।
বিষয়: বিবিধ
১১৮১ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে টার্কিকে ঘাটাতে গেলে রাশিয়া - ইরান এসে যাবে , ন্যাটো - ওয়ারশ , ইইউ - বরেক্সিট , সাথে চায়নাও ----- এজন্য ফুলপ্রুফ ফন্দি ফিকির করে যাচ্ছে চুপিচাপি ।
হিলারী-ট্রাম্প খেলার ফলাফলের উপর নির্ভর করছে তেনাদের একশন প্ল্যান।
চমৎকার বিশ্লেষণ। ভালো লাগলো ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন