আমার ছোট হওয়া এবং বড় হবার বাসনা...
লিখেছেন লিখেছেন সুমাইয়া হাবীবা ২৫ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৪:৫৫:৫৯ বিকাল
টিভিতে পন্ডসের এ্যাড হচ্ছে। বয়স ১০ বছর কম দেখানোর ক্রিমের। আগেও কয়েকটা এমন এ্যাড দেখেছি। আর ভেবেছি.. কপাল!! কেউ হাজার টাকা খরচ করছে বয়স কমাতে আর আমি সারাবেলা পার করলাম বড় হওয়ার আশায়..!
আমি দেখতে খুবই ছোটখাট মানুষ। সাইজে তো বটেই ভাবে এবং সাবেও(দাখিল পর্যন্ত)। ক্রিকেটই ছিলো আমার ধ্যানজ্ঞান। আর পাকিস্তান টীম। আলিমে উঠেতো ছোট ভাব থাকার প্রশ্নই উঠেনা। হঠাৎ করেই বেশ বড় হয়ে গেলাম। দুটোর জায়গায় চারটে পাখা গজালো। যাইহোক, যেটা বলছিলাম..আমার ক্লাসে আমিই ছিলাম বয়সে এবং সাইজে সবথেকে কনিষ্ঠতম স্টুডেন্ট। লম্বায় আমার থেকে খাটো দুতিনজন থাকলেও তাদের কেউ ছোট্ট বলতোনা। তাদের দেখতে বেশ বড়সড়ই লাগতো। তো ছোট হওয়ার সুবাদে সবার নয়নের মনি আমি। কড়া মেজাজী ওয়ার্ডেন আপা থেকে শুরু করে হোষ্টেলের সবার। আমার নিচের ক্লাসেও আমার থেকে বড় মেয়েরা পড়াশোনা করতো। তাদের অনেককেই আমি আপু বলতাম। আমার ক্লাসের বেশি বড় কয়েকজনকেও। নাম ধরে ডাকতে সংকোচ হতো। আর তারাও একই ক্লাসে পড়লেও আমাকে ছোট বোনের মতই ট্রিট করতো। তাদের ভেতর মেয়েলী এবং বড়দের ব্যাপার স্যাপার অনেক ছিল। সেসব কর্মকান্ডে এবং আলোচনায় আমার এন্ট্রি নেয়া বারন ছিলো। আমার আগ্রহতো ছিলোইনা এবং যদি কখনো অজান্তেই ঢুকে পড়ার উপক্রম হতো, তো তারাই আমাকে বের করে দিতো মমতার সাথে। আমার মনে আছে আসমা নামে একজন ক্লাসফ্রেন্ড ছিলো যাকে আমি আপু বলতাম। যে সবসময় মেয়েদের বলতো তোমরা যাই করো সুমাইয়া ছোট মানুষ ওকে কখনো এসবে জড়াবেনা এবং এসব আলোচনায়ও রাখবেনা। এবং আমি যেন কোনরকম ঝামেলায় না জড়াই সেদিকে খেয়াল রাখতেন। আর কিছু অতি ফিচেল টাইপ মেয়ে ছিলো যারা আমাকে মুরগী বানিয়ে বেশ মজা পেতো। সুযোগ পেলেই এটা ওটা প্রশ্ন করতো যেসব সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়াই ছিলোনা। বা আমি প্রশ্নের ভেতরের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতামনা। আমার সরলতায় তারা একজন আরেকজনের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়তো। যেমন ক্লাস এইটে থাকতে গল্পের মধ্যে কোন একদিন আমি বলেছিলাম আমার খালু খুব বড় ব্যাংকার। তিনি সাউদিয়াতে থাকেন। আমার খালাত ভাইকে তিনি জন্মের পর দ্যাখেননি। অনেক বছর পর এসে যখন দেখলেন তখন সারাদিন কোলে নিয়ে ঘুরতেন। আমার তখন জন্ম রহস্য সম্পর্কে কোন জ্ঞান ছিলোনা। আর আমার মনেও ছিলোনা বা আমি জানতাম না খালু মাঝে এসেছিলেন কি না। কিন্তু যাদের পিক করার তারা ঠিকই পিক করলো! আমি সরল মনে বললাম নাহ খালু প্রায় পাঁচ বছর পর এলেন। তাদের প্রথম দফা হাসাহাসি শুরু হলো। আমাকে ২য় প্রশ্ন-তাইলে তোর ভাই আসলো কোত্থেকে! বাপ লাগেনাই! আমি বুঝলাম আমাকে বোকা বানাতে চাইছে। খুবই বিরক্ত হলেও বুদ্ধি করে জবাব দিলাম- ওতো আন্টির পেটে ছিলো। অপারেশন করে বের হইসে! খালু এসে কি করবে! আর যায় কোথায়! পুরো হোষ্টেল কাঁপিয়ে হাসাহাসি। এবং একবেলার মধ্যেই দেখা গেল পুরো হোষ্টেল জানে আমার জ্ঞানগর্ভ উত্তর! আমাকে যেখানেই যে গ্রুপ পেতো সেই মজা নেয়ার চেষ্টা করতো। সিঁড়ি দিয়ে নামছি ছোট ক্লাসের মেয়েরা পড়িমড়ি করে ছুটে এলো। সুমুআপু দাঁড়ান, দাঁড়ান! আপনার খালাত ভাই নাকি ঈসা(আ) মত জন্মাইসে! খালু ছাড়া! এরকম নানান ক্যাচালে দিনাতিপাত হতো আমার। তবে আমার বড় বোন থাকায় এবং হোষ্টেলের আর সবার থেকে ষ্ট্যাটাসটা একেবারেই আলাদা হওয়ায় এসব খুব কমই ঘটতো। আর প্রিন্সিপাল হুজুর প্লাস ওয়ার্ডেন আপার সাথে সম্পর্কটা অতি ঘনিষ্ঠ হওয়ায় আমাদের সমঝে চলতো সবাই। কিন্তু কিছু কিছু মেয়ে আমার ভালোমানুষির সুযোগ ঠিকই নিতো।
ক্লাস নাইনের শেষের দিকে আমার এপেন্ডিক্স অপারেশন হয়। বলে রাখা ভালো নাইন পর্যন্ত আমার চুল বয়কাট ছিলো। এবং আমি মারাত্মক ফ্যাশন সচেতন ছিলাম।( ক্লাস টেনে সংগঠনে এসে আমার আমূল পরিবর্তন ঘটে) আফ্রিদির অনুকরনে আমি চুলে হাত বোলাতে বোলাতে ওটি ড্রেস পড়তে ভেতরে ঢুকতেই ডাক্তার নার্স সব হইহই করে উঠলো। আরে আরে বাচ্চা ঢুকে গেসে ওটিতে!! বের হও! আমি শান্তভাবে বললাম আমি পেশেন্ট। আমার অপারেশন হবে। রুমটা যেন হঠাৎই পিনড্রপ সাইলেন্ট হয়ে গেল!
দাখিল পরীক্ষার সময় একদিন আমার লেট হয়ে যায়। দাড়োয়ান কিছুতেই আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেবেনা। পরীক্ষার্থী ছাড়া কেউ ঢুকবেনা। অনেকেই নকল সাপ্লাই দেয় পরীক্ষার্থী সেজে। তাই এই কড়াকড়ি। দাড়োয়ানের এক কথা তুমি ছোট মানুষ দাখিল পরীক্ষা কেমনে দাও! নিশ্চই নকল সাপ্লাই দিবা! অবশেষে রেজিষ্ট্রেশন কার্ড দেখিয়ে ছবি মিলিয়ে ভেতরে ঢুকতে পেরেছিলাম।
স্কুল কলেজে থাকতে খুব রাগ হতো! একেকজনের উদাহরন দিতাম আর বলতাম অমুক তো আমার চেয়েও খাটো! কই ওকে তো কেউ ছোট বলেনা!! বড়পুরা শান্তনা দিত অমুকের চেহারায় তো মায়া নাই, তোমার চেহারায় আছে। কিংবা অমুকের চেয়ে তোমাকে বেশি আদর করে সবাই, তাই। আমিও ঠান্ডা হতাম। সময়ের সাথে রাগ পানি হয়ে গেছে। এরকম পরিস্থিতি আসলে আর বিড়ম্বিত হইনা। সহজভাবেই হ্যান্ডেল করি।
অনার্স ফাইনালে পড়ার সময় একটা স্কুল পর্যায়ের প্রোগ্রামে চীফ গেষ্ট হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলাম। সবাইতো আর আমাকে চেনেনা, আমিও দুএকজন ছাড়া কাউকে চিনিনা। অডিটোরিয়ামটা কোথায় জিজ্ঞেস করতেই এক ভলান্টিয়ার অতি আন্তরিকতায় প্রায় টেনে হিচঁড়ে নিয়ে গিয়ে সিটে বসিয়ে দিল। আমি কিংকর্তব্য বিমূঢ়! আমি বললাম আমি অফিসে যেতে চাই। তার হাসিমাখা উত্তর- অফিসে তো এখন যাওয়া যাবেনা আপু। এখনি অনুষ্ঠান শুরু হবে। অনুষ্ঠান শেষে তোমাকে নিয়ে যাবো। অগত্যা ফোন লাগালাম। ও প্রান্তের সশব্যস্ত উত্তর-আপু আপনি কোথায়? কতক্ষন লাগবে আর পৌঁছতে? মেইনরোডেই আমাদের ভলান্টিয়ার দাড়ানো আছে। আপনার কোন অসুবিধা হবেনা। আমি সব বললাম। ফোন রেখে পড়িমড়ি করে দৌড়ে এলো। কমনরুমে প্রায় ছয়সাতজন ভলান্টিয়ার কাচুমাচু অবস্থায় সরি বলতে এলো। যারা আমায় রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছিল এবং যাদের চোখের সামনে দিয়েই আমি এলাম। যারা চীফ গেষ্টের অপেক্ষায় আমায় পাত্তাই দেয়নি!! আর যে সিটে বসিয়েছিলো সে সামনেই এলো না!!
এরকম হাজারো অভিজ্ঞায় ভরপুর আমার ঝুলি। আমার আর বড় হওয়া হলোনা! নাদের আলী কে পেলে বড় ভালো হতো….
বাসা ছাড়ছি আগামী মাসে। আম্মার বাসার পাশেই বাসা নেবো। দুপুরে এক ভদ্রমহিলা বাসা দেখতে এলেন। বাসা ঘুরিয়ে দেখালাম। বললো বাসা তো খুবই সুন্দর তোমরা ছেড়ে দিচ্ছো কেন? বললাম-
-মিরপুর চলে যাচ্ছি।
-ও। তুমি বাসায় একা?
-জ্বি, একাই থাকি।
-ও। তোমার আব্বা আম্মা দুজনেই কি চাকরী করে? আর ভাইবোন নাই? কোথায় পড়ো?
- না আম্মা হোম মেকার। উনারা মিরপুরে থাকেন। আমরা হাজবেন্ড ওয়াইফ দুজনে থাকি। গতবছর মাষ্টার্স কমপ্লিট করলাম।
ভদ্রমহিলা আর দাড়ালোনা। চলে গেলেন। আমি আনন্দিত। যাক, বিয়ের পর একটু মুটিয়ে যাওয়াতে এইটুকু উন্নতি তো হয়েছে। কোথায় পড়ো বলেছে। কোন ক্লাস তো বলেনাই!
বিষয়: বিবিধ
১৭৩৩ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এই মাত্র ফেসবুকে এক বন্ধুর একটা কেীতুক পেলাম।
Best Sign-Board, in-front of a Beauty Parlour:
"Dont whistle at the girl going out from here.
Because she may be your Grandmother."
বয়স কমান যায় কিন্তু বাড়ান যায় কি উপায়ে!!!
বর্ণনার সাবলীলতায় কিছু খুজে পেলাম যেন!
জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েও বড় আর হওয়া হল না আমারও!!!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন