আমার দায় এড়াবার কার্যফল
লিখেছেন লিখেছেন সুমাইয়া হাবীবা ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১২:৩৩:১৩ দুপুর
ছোটবেলা থেকে একটা জিনিস দেখে দেখে বড় হয়েছি। এবং দেখতে দেখতে ওইরকমই ধারনা বা বিশ্বাস নিয়েই বড় হয়েছি। সেটা হলো ঘোমটার ভেতর খ্যামটা নাচানো হয়। মানে যেখানে দাড়ি সেখানে শয়তানের বাড়ি। যেখানে টুপি সেখানেই ইবলিশের ঝুঁটি। যার লেবাস হিজাব উনিই তো আনকালচার্ড। অর্থাত নতুন প্রজন্ম একটা বাণী ধারন করেই বড় হয়েছে। ইসলাম হইতে সাবধান! আর আমাদের নীতি নির্ধারকরা হয় বোঝেনইনি কিংবা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বুঝেও বুঝেননি। কারন প্রকৃত ইসলাম মানেই উনাদের গাত্রদাহ।
মাওলানা হুজুর টাইপ লোক রাজাকার হবে স্বাধীনতা বিরোধী হবে এটা পুরান ক্যাচাল। আমি এই যুগের লিলিপুট প্রত্যক্ষদর্শী। আমাদের নাটক সিনেমার চটক এবং চমক বাড়াতে এর বহু বহু ব্যবহারের পর যখন এই থিম পচে গলে আঁশটে গন্ধময় হলো তখন এলো ফতোয়া থিম। মানে চিত্রনাট্যে একজন এজেবল ক্যারেকটার থাকবেন যিনি হতে পারেন এলাকার মুরুব্বি, হতে পারেন এলাকার চেয়ারম্যান কিংবা মসজিদের ইমাম। এবং অতি অবশ্যই চরিত্রটি নেগেটিভ। ধর্মের দোহাই দিয়ে উনি নানানভাবে ভালোবাসাকে অপবিত্র অপমান করবেন! এবং অন্যায় অত্যাচার চালাবেন।আমি এই যুগটার দর্শক প্রত্যক্ষদর্শী। আমার ছোটবেলায় আমি বিনোদন বলতে এগুলোই বুঝতাম। এর কুফল যে কতটা প্রসারণময় সেটা আমার নিজ চোখে দেখা অভিজ্ঞতা। একটু শেয়ার করি-
আমি কলোনীতে মানুষ। আমাদের কলোনীর একটা রেওয়াজ ছিলো ছোট ছেলেমেয়েরা মসজিদের মক্তবে দলবেধে কায়দা পড়তে যেত। মেয়েরা একদিকে আর ছেলেদের আরেকদিকে বসানো হতো। কোন কারনে হুজুরের আসতে দেরী হলে নিয়ম ছিল ডাকতে যা্ওয়া। ছেলেমেয়ে যে কেউ যেত। এমনই একদিন আমার দুতিন বছরের বড় এক মেয়ে কে বললাম চলো আজকে আমরা যাই। ও সাথে সাথে না বললো। আমিতো অবাক। আমি ভাবলাম ও বোধহয় আজকে পড়া করেনি। আমি হাসলাম। ও বললো এ কারনে না আম্মা মানা করসে। কেন! আমিতো বড় হইতেসি তাই। হুজুরদের কাছে একা যাওয়া যাবেনা। তুই বুঝবিনা! যাক, বাসায় এসে আপুদের বলে হাসাহাসি করতে চাইলাম। ওরা হাসলো ঠিকই তবে ওকে নিয়ে নয় আমাকে নিয়ে! পরদিন ওদের বাসায় কি একটা কাজে গেলাম। গিয়ে দেখি আন্টি বাসায় নেই। কেউই নেই। ও স্যারের কাছে পড়ছে। একা। পুরো ঘরে ও আর ওর স্যার ইমন ভাইয়া। যিনি তিতুমীরে পড়তেন। বয়স কত হতে পারে অনুমান আপনারাই করতে পারবেন। আর হুজুর ছিলো মধ্যবয়স্ক। উনার ছেলেও হিফজ পড়তো। ইমন ভাইয়ের কাছে মেয়েকে একা যেতে দেয়া যায় বাট হুজুরের কাছে যায়না! অসাধারন!
আমার কথায় ফিরি…ফতোয়ার পর এলো হুমায়ুন থিম। এ যুগে আমি বুঝদার প্রত্যক্ষদর্শী। "অসম্ভব আবেগস্পর্শী মায়াভরা একটি গল্প। অনেক চরিত্রের ভীড়ে একজন ধার্মিক মানুষ। সহজ সরল। বুক ভরা মায়া। তবে হাস্যকর তার কান্ড কারখানা। তাদেরই মধ্যে একজন শহুরে, চুপচাপ প্রকৃতির, কিন্তু বিদ্বান। মারাত্মক তার পারসোনালিটি!” কিংবা ধার্মিক মানুষটির কপালে সিজদার চিহ্ন দেখা যায়। কথায় কথায় আলহামদুলিল্লাহ সুবাহানআল্লাহ বলেন। এবং আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষ খুন করতে পারেন! অপরদিকে একজন ঈশ্বরে নয় প্রকৃতিতে বিশ্বাস করেন। স্বংসকৃতিমনা। শৈল্পিক তার চিন্তাভাবনা। পুরোটা সময় না বোঝা গেলেও ফিনিশিংয়ে কোন একটি ঘটনায় উনি হিরো। এমন কোন আবেগী কাজ করলেন যে আমার চোখের পানি গড়াতে বাধ্য।
এ থিম বহুদিন পাবলিক খেলো। এখনও খায়। সাথে আমরাও। এমন অনেক আর্দশিক ফ্যামিলিকে দেখেছি যারা বেশ আগ্রহ নিয়েই এগুলো দেখতেন এবং প্রশংসা করতেন! চটুল বিনোদনে মত্ত হয়ে নিজেদের ধ্বংশ নিজেরাই ডেকে আনলাম। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরিয়ে ফেললাম বাট বুঝতেও পারলাম না হাসির আড়ালে আমাদের কবর আমরাই খুড়ছি। তার ফল হলো হুমায়ুন থিমের শেষ যুগে নতুন সংযোজন লজ্জাবতী বুয়া! এখানে দেখা যেত বাড়ির বুয়ারা মাথায় কাপড় দেন, ছেলেমানুষ দেখলে লজ্জা পান এবং হাস্যকরভাবে ইসলামী বিধান পালন করে থাকেন। এ সময়ে কিছু গুণী নির্মাতা ব্যপারটাকে একটু ভিন্ন রুপ দিলেন। নায়িকা আনস্মার্ট হওয়ায় নায়ক তাকে পাত্তা দেননা। তাই তিনি স্মার্ট হয়ে নতুনরুপে হাযির হন। যে রুপে তিনি নাচে গানে রুপে অনন্যা। কিন্তু তিনি নামিয়ে ফেলেছেন তার আঁচল, ভুলে গেছেন সালাম, নামায। সালোয়ার কামিয ছেড়ে পড়ছেন টি শার্ট, ফতুয়া। এতে নায়ক তার পিছে ঘুরঘুর করতে শুরু করে। এটা বেশ গ্রহনযোগ্যতা পেলো। আর আমরা শিখলাম যারা আধুনিক, সভ্য, শিক্ষিত তারা আঁচল মাথায় তুলেননা। যারা আনস্মার্ট, মূর্খ তারা মাথায় কাপড় দেন।
আর এখন? এখনতো কার্যফল যুগ! কলিকাল! আমাদের সভ্যতা, স্বংস্কৃতি, আদর্শ সবই এখন হিমাগারে! বীজ যেই রোপন করুক আমরা কেবল দেখেছি। চারাটাকে বড় হতে দিয়েছি, যত্ন নিতে দিয়েছি, বটবৃক্ষ হতে দিয়েছি। শুধু তাই নয় সেই বৃক্ষের ছায়ায় প্রাণও জুড়িয়েছি! এখনতো আমরা আমাদের কার্যফল ভোগ করছি। আমাদের যুগের পর যুগ নীরব থাকার কার্যফল। যুগের পর যুগ হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার কার্যফল। দায়িত্ব এড়াবার কার্যফল।দিনের পর দিন বিনোদনে মত্ত হবার কার্যফল। প্রাণ জুড়ানোর কার্যফল। বিচক্ষণতার ব্যপারে অযোগ্যতার কার্যফল।।
আমার সাথে অনেকের দ্বীমত থাকতেই পারে। কারো খারাপ লেগে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বাট একজন স্বাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে আমার এত বছরের অভিজ্ঞতায় এমনটাই মনে হয়েছে। দায় সকলের। এমনকি আমারও।
বিষয়: বিবিধ
১৯৮৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন