আমার ফ্যামিলি-১
লিখেছেন লিখেছেন সুমাইয়া হাবীবা ২২ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৮:০০:৪৫ রাত
আজ আমি আর আম্মা শপিংয়ে বের হয়েছিলাম। শপিং মানে অতি জরুরি কিছু জিনিস কেনা। মালয়শিয়া পাঠাতে হবে। আমার বড় বাপজানের(বড় ভাগ্নে) সারা গায়ে না লাগলেও পায়ে ঠান্ডা লাগে, টাইটস লাগবে। ছোট বাপজানের(ছোট ভাগ্নে) গায়ে একটু গোশত হয়েছে, জামা ছোট হয়, বোতাম লাগানো যায়না, এক সাইজ বড় লাগবে। আর আমার বড় দুলাভাই মি.আইনসটাইনের পাঞ্জাবী বদলাতে হবে। আল্লাহর বান্দাহ একজন! কোন পাঞ্জাবী ই উনার মাথা দিয়ে ঢুকেনা! বডি, হাত, লম্বা সব ঠিক বাট নট মাথা! মি.আইনসটাইন কি আর সাধে বলি! মাপফিতা নিয়ে শপিং করতে কেউ কখনো না গেলেও আমরা যাই। সেলসম্যান সাইজ কত জানতে চাওয়ার আগেই আমরা জানতে চাই, দেখুনতো মাথার মাপটা কত? আল্লাহর অশেষ করুনায় দুই ভাই ই বাপের যোগ্য উত্তরাধিকারি হয়েছে বিগ সাইজের দুটো মাথা নিয়ে। বড়পুর ভাষায় ওর পুত্রদের ইন্টারন্যাশনাল রাজকীয় মাথা। আমাদের নজর দেয়া মানা!
আর আমার বড়বোনের কি লাগবে? আমাদের কি কি লাগবে তার লম্বা লিস্ট। ছোট হলে কিন্তু চলবেনা! প্রতিদিন ফোন করে এক কথা “সুমাইয়া লিস্টটা মেইল করলানা এখনো!” ওরা কি পারে, তোমার এই একটাই সমস্যা। এত ঢিলা না…আমি হাসি। ও প্রান্তে ও বলে যায় আর এ প্রান্তে আমি অনুভব করি আমার ছুঁতে না পারা বোনটাকে, আমি দেখতে পাই ফেলে আসা অতীত….
বড়পু কোন মাছ খায়না। গন্ধ সহ্য করতে পারেনা। বাসায় মাছ রান্না হলে ওর জন্য ইলিশ বা চিংড়ি রান্না সবসময় সম্ভব হতোনা টানাটানির সংসারে। আম্মা ডিম ভেজে দিত। আমার মাছ খাওয়া হয়ে গেলে বড়পু বলতো আম্মা এত ভাত দিসেন! বলেই আমার মুখে ডিম ভাজার ভাত তুলে দিত। না বললেও কিভাবে যেন ঠিকই টের পেত আমার ডিম খাওয়ার লুকানো বাসনা…
বরাবরই আমার জেদ বেশী। একটা অন্যায় করেছিলাম হোষ্টেলে। বড়পু একটু গম্ভীরভাবে বলতেই আমার শয়তান আচ্ছন্ন করা মন বিদ্রোহ করে উঠলো। চরম রেগে উঠলাম। যা নয় তাই বলে ফেললাম। বড়পু প্রথমে একটু শাসন করতে চাইলেও আমার রণমূর্তির সামনে চুপসে গেল। শুধু বললো "আমার সাথে কথা বলবেনা তুমি।” আমিও পাল্টা জবাব দিয়ে দিলাম সাথে সাথেই। একটুও দেরি হলোনা। "তুমি না বললে আমার কোন প্রয়োজন নেই কথা বলার!” একটুপর রাতের খাবারের ডাক এলো। খেতে না ডাকলেও শোওয়ার আগে দুধটা ঠিকই পাঠালো আমার বান্ধবীকে দিয়ে। ফাতেমা দুধের গ্লাসটা আমার সামনে ধরে একটা চড় মারলো আমার পচে যাওয়া গালে। না ভুল বললাম, ও যা বললো তা চড়ের চেয়েও বেশী কিছু। তবে আমার জন্য পারফেক্ট! বললো “খেয়ে নাও। আমি দেখি। আমিতো বড়, আমারো জানার দরকার আছে কিভাবে ধৈয রাখতে হয় আর ছোটগুলা কতটা নিমকহারাম হয়! কষ্ট কম পাবো!”
(আজ শত ইচ্ছাতেও ওই চেহারা আর যখন তখন দেখতে পাইনা। আজ বুঝি ওই চোখ ওই মুখ ওই হাতের স্পর্শের আমার কত প্রয়োজন..অথচ বাস্তবতা কত নিষ্ঠুর!)
ঈদের দিন ভোরবেলা। সবাই নিজেরা সাজগোজ করছে। আর বড়পু আমার চুল বাধঁছে। কিছুতেই সামলাতে পারছেনা। সিল্কী চুলগুলো ওর ছোট হাতের ফাঁক দিয়ে বারবার বেরিয়ে যাচ্ছে আর ও চেষ্টা করেই যাচ্ছে। যেন পণ করেছে "একবার না পারিলে দেখ শতবার”! একসময় আম্মা এসে তাগাদা দিচ্ছে “অনেক হইছে এবার থাম না! এক ঈদে ঝুটি না বাধঁলে কি হয়!" বাট চেষ্টাকারি চেষ্টা করেই যাচ্ছে। অবশেষে একসময় সফল হয়ে আমাকে পরীর বেশে বেড়াতে পাঠিয়ে ওনার মিশন তখনকার মত শেষ হত। আমাদের মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে একটার বেশী ঈদের জামা চরম বিলাসিতা বলেই আমাদের শেখানো হয়েছিলো, এবং এখনো সেটাই মানা হয়। কখনো কখনো সেটাও অনিশ্চিত হয়ে যেত আব্বা সংসারের বড় ছেলে হওয়ার কারনে। তবে জামা জুটতো। একটা বড়বোন থাকলে তো জুটবেই। নিজের নাস্তার পয়সা একটু একটু করে জমিয়ে কেনা হতো কাপড়। আর হরেক রঙের সুতা, পুতি, চুমকি…আর সারাদিন সারারাত ধরে চলতো সেলাই। হলফ করে বলতে পারি আমাদের রোডের বান্ধবীদের ড্রেসের মধ্যে আমারটাই সেরা হতো। দেখতে ওদের হাজার টাকার জামার চেয়ে কোন অংশে কম হতোনা, বরং অনেক সময় বেশীই হতো। সবাই প্রশংসা করলে খুব ভাব নিয়ে বলতাম এটা নিজে হাতে করসে বড়পু! আমি সুই সুতা লাগায় দিসি! বেড়াতে বেড়িয়ে বিদায় জানাতে পেছন ফিরলে দেখতাম ওর রাতজাগা দুটো লাল চোখে ক্লান্তির বদলে কেবলই মায়া।।
খুব জানতে ইচ্ছে করে রহমানুর রাহীম কতটা রহম ঢেলে দিয়েছেন ওই চোখে……………!
বিষয়: বিবিধ
২৭৬৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন