৩০ লক্ষ শহীদের তেলেছমাতি, খালেদার বোধোদয় ও সরকারের গোস্বা, অতঃপর
লিখেছেন লিখেছেন জিসান গাজি ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৭:৫৮:৫৪ সন্ধ্যা
৩০ লক্ষ শহীদের তেলেছমাতি, খালেদার বোধোদয় ও সরকারের গোস্বা, অতঃপর
====================================
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে আজও ধুম্রজালের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে সারা দেশ। সুদীর্ঘ ৪৪ বছরেও এই নিয়ে আমাদের গৃহবিবাদ থেমে নেই। বিষয়টি নিয়ে সারা জাতী বিশেষ করে তরুন প্রজন্ম সম্পূর্ণই অন্ধকারে। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি গুলিতে শিখানো হচ্ছে ভুল ইতিহাস। যা একটি দেশের জন্য কখনো সুখকর নয়। ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলবে এটাই স্বাভাবিক। সংখ্যাটা যা-ই হউক আমাদেরকে প্রমানিত ইতিহাস হজম করতে হবে। রাজনীতির দাবাখেলার ঢাল হিসেবে যে যার মত করে আপন বন্দনা গাওয়া, আর তিতো কুইনালের ন্যায় আমাদেরকে গেলানো হচ্ছে ভ্রান্ত ইতিহাস। আমরা ও দিব্যি তা হজম করেই চলেছি। তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষে দাঁড়িয়ে আমরা চাইলেও এই মিথ্যাকে হজম করতে পারিনা। কালের আবর্তেইতিহাস বিকৃতির জন্য আমাদের শাসক গুষ্ঠিকে আসামীর কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে। সত্যিকার ভাবে আমাদের শাসক মহল আন্তরিক হলে এই ভ্রান্তি দূর করা মোটেই অসম্ভব নয়। আজকে ৪৪ বছর পর আমরা যদি যুদ্ধাপরাধের তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করে বিচারের আয়োজন করতে পারি, তাহলে প্রতিটি থানার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ডাটা সংগ্রহ করা মোটেই কঠিন নয়। এখনো প্রত্যক্ষদর্শী ১৯৭১ সালের হাজার হাজার মানুস বেঁচে আছে। আছে পাড়া মহল্লায় শহীদের অসংখ্য সৃতি। তাছাড়া প্রতিটি থানায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংরক্ষিত থাকার-ই কথা। যেহেতু তাদের স্বজনেরা বেতন ভাতা পেয়ে থাকে। সরকার ইচ্ছে করলে এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই এই সংখ্যা জাতীর সামনে পেশ করতে পারে। আজকে যারা বেগম খালেদা জিয়ার মন্তব্যকে রাস্ট্রদ্রোহী বলছেন তারা এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিতে বা আপত্তি কোথায়।যদিও বেগম জিয়ার দল বিএনপিক্ষমতাসীন থেকেও অজ্ঞাত কারনে এই বিষয়টির সুরাহা করেন নাই। আমরা যারা আম-জনতা এই গোলক ধাঁধাঁয় ঘুরপাক খাচ্ছি আমাদেরও সংশয় অমুলক নয়। শহীদের সংখ্যাটা রাউন্ড-ফিগার ত্রিশ লক্ষ হতে হবে কেন? হয়ত কম-বেশী হতে পারত। যুদ্ধকালীন বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দীদশায়। এমন এক বেক্তি মৌখিক ভাবে বলেছেন বলেইত আর সেটা অহির বানী হয়ে যায়নি। তিনি যেই ঘোষণা দিয়েছেন তা নিয়েও আছে নানা বিতর্ক। বিবেকের মানদণ্ডে রয়েছে বিশাল হেরফের এবং গানিতিক হিসাব রিতিমত অবাক হওয়ার মতই। আমাদের বুদ্ধিজীবি হত্যা নিয়েও রয়েছে পরস্পর বিরুধী বক্তব্য। সেই সব বুদ্ধিজীবিরা পাক সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করেই ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। তারা একদিনের জন্যও ভারতে যান নাই। ১৪ ডিসেম্বর যখন তাদেরকে হত্যা করা হয় তখন ঢাকা শহর ইন্ডিয়ান মিত্র বাহিনীর দখলে। পাক বাহিনী ১১ই ডিসেম্বরের পরে গর্তে লুকানো বা আত্মসমর্পণ নিয়ে ছিল বেস্থ। যেহেতু তারা অস্ত্র সমর্পণ করেছে তাদের পক্ষে কি করে বাসা বাড়িতে গিয়ে বুদ্ধিজীবি হত্যা করা সম্ভব। আজকে যারা জাতীয়তাবাদি ও ইসলামী নেতাদের নানাভাবে খতম করার পাঁয়তারা করছে, সেইদিন তারাই এইসব আকাম করেছে বলেই অনেকে মনে করে। একটি মারাত্মক দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের অক্টোপাসে আমরা বন্দি হয়ে শুধুই কাঁদা ছোঁড়াছুড়িতেই বিভোর হয়ে আছি। আমাদেরকে সুস্থ রাজনীতিতে ফিরে গিয়ে স্বাধীন জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। উম্মুক্ত করতে হবে আমাদের প্রকৃত ইতিহাসের দরজা-জানালা। আর এতেই এইসব বিতর্কের অবসান ঘটতে পারে।
আমরা যারা যুদ্ধের আগে পরে স্বাধীনতা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলাম, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে নির্দ্বিধায় একটি সরল অংক কষে দেখতে পারি। মুলত পাক হানাদারের আক্রমণ ২৫শে মার্চ রাতে শুরু হলেও দ্বিপক্ষীয় যুদ্ধটা আরও ২-৩ মাস সময় ক্ষেপণ হয়।মেজর (অব) জিয়ার কালুর ঘাটের স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে দেশের মানুস প্রথম জানতে পারে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। সারাদেশের মত আমরাও প্রথম আমাদের স্কুলের মাঠেই প্যারেড প্রশিক্ষন শুরু করি। এরপর যখন ভারতে প্রশিক্ষনের বেবস্থাহয় সেখানে পৌছাতে জুন-জুলাই মাস লেগে যায়। সেই হিসাবে দ্বিপক্ষীয় মুল যুদ্ধের স্থায়ীত্ত হল মে মাস টু ডিসেম্বর অর্থাৎ ৭ মাস বা ২১০ দিন। যদি ৩০ লক্ষ মানুস শহীদ হয়ে থাকে তাতে দৈনিক ১৪ হাজারের বেশী মানুস নিহত হওয়ার কথা। এমনকি প্রতিটি থানায় শহীদের গড় সংখ্যা ৬ হাজারের উপর। এর সাথে রয়েছে তাদের দাফন কাফনের সংশ্লিষ্ট ব্যাপার। দেশের কোন থানায় এত প্রচুর পরিমান মানুসের নিহত হওয়ার বিষয়টি অবিশ্বাস্য, উদ্ভট ও অনাকাঙ্ক্ষিত বটে। যা এই যাবত কাল রাজনৈতিক ঢাল হিসেবেই ব্যাবহার হয়ে আসছে।
এবার নজর দেয়া যাক, আমাদের দুই লক্ষ মা-বোন ধর্ষিতাবা বিরঙ্গনা হয়েছেন। নিশ্চয় এই গ্লানি শুধু তাদের একার নয় বরং আমাদের সকলের। অবশ্যই এই হতভাগা মা-বোন দের পরিবার পরিজনের রক্ষনা বেক্ষন রাস্ট্র এবং সরকারের-ই দায়িত্ব। কোথায় কিভাবে আছেন তার খোঁজ নেয়া ও তাদের তালিকা তৈরী করা অপরিহার্য। এখানেও প্রচলিত সংখ্যা (দুই লক্ষ) অনুযায়ী গড়ে প্রতিটি থানায় ৪০০ শতাধিক বিরঙ্গনার হিসেব থাকার কথা কিন্তু সেই তথ্য ও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আলোচিত দুইটি সংখ্যা-তত্ত্ব নিরূপণে বঙ্গবন্ধু সরকার শহীদের তালিকার কাজ রাস্ট্রিয় ভাবে শুরু করেও তা এক পর্যায়ে বন্ধ করে দেন। যেখানে মাত্র ৯৫ হাজার শহীদের হদিছ মেলে। অপরদিকে বিরঙ্গনাদের জন্য ক্যাম্প খুলেও কোন সাড়া না পেয়ে তাও বন্ধ করে দেয়। হয়তবা তাদের সংখ্যা নেহায়েত হাতেগনা, যারা লজ্জা শরমে জন-সমক্ষে আসতে চায়নি। তখনকার উদ্যোগে ভাটা পড়ার কারন হয়তবা বঙ্গবন্ধুর তিন মিলিয়ন তেলেসমাতির মুখোশ উম্মচিত হওয়ার আশংকায় সরকারের ইঙ্গিতেই সকল নথিপত্র গায়েব করা হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাছিনার সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের বেতন-ভাতা চালুর বিষয়টি সময়ের দাবী। তাতে ৩০ লক্ষ শহীদ পরিবার এর অন্তর্ভুক্ত থাকার কথা।পাশাপাশি বিরঙ্গনাদের জন্যও যদি কোন কর্মসূচী নিয়ে থাকেন, তা নিশ্চয় সরকারী গেজেট অনুযায়ী হওয়ার কথা। সেই সব তালিকা জাতীর সামনে পেশ করলেই সকল বিতর্কের অবসান হয়ে যায়। নতুন প্রজন্মের যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তারাও আমাদের গৌরবময় ইতিহাস ও শহীদদের কৃতিত্ব গভীর স্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, এই বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে অতীতেও কম লেখালেখি হয়নি। যুদ্ধকালীন ভারতের সেনা প্রধান জেনারেল মানেক-শাহ বিবিসির সাংবাদিকের প্রস্নের জবাবে বলেছিলেন এই সংখ্যা সব মিলিয়ে ১০ লক্ষ হতে পারে। বিগত জোট সরকারের মন্ত্রী কর্নেল আকবর হোসেন (মুক্তিযোদ্ধা) বলেছিলেনশহীদের সংখ্যা ৩ লক্ষ হতে পারে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত রাজনিতিক বাবু সুবাস চন্দ্র বসুর নাত্নী আন্তর্জাতিক গবেষক শরমিলা বসু তার গবেষণায় ১৯৭১ সালে আমাদের শহীদের সংখ্যা এক লক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন। ৮০ দশকে যশোরের একজন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ খন্দকার আবুল খায়ের তার বেক্তিগত উদ্যোগে সারাদেশে জরিপ চালিয়ে এই সংখ্যা ১ লক্ষ ৬৫ হাজার উল্লেখ করেছেন। যদিও এই জরিপের ফলাফলে কেউ আপত্তি তোলেন নাই। বঙ্গবন্ধুর এক-কালের ঘনিষ্ঠ সহচর বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমান তার স্রিতিচারনে বলেছেন, লাহোর থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে এলেন।আমাদের মুখ থেকে তিনি প্রথম দেশ স্বাধীন হওয়ার সংবাদ জেনেছেন। ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তিনি জানতেচাইলে আমরা তাঁকে ৩ লক্ষ মানুস নিহতের ধারনা দিয়েছিলাম। কিন্তু শেখ মুজিব আবেগ তাড়িত হয়েইদেশী বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে সংখ্যাটা ৩ মিলিয়ন ঘোষণা দেন। যা ছিল সম্পূর্ণ আকাশ পাতাল।সত্যিকার অর্থে আমাদের যুদ্ধটাই ছিল গেরিলা পদ্দতিতে এবং আকাশ যুদ্ধ হয়েছিল সপ্তাহ খানেক। তাও ভারত পাকিস্তানের মধ্যকার লড়াই। আর এটাই বাস্তব সত্য কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক কালচার হল কেউ দ্বিমত পোষণ করলে তাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। এমনকি তাকে দেশদ্রোহী রাজাকার বলে চেঁচামেচি করা।
নিকট অতীত যুদ্ধে নিহতের বা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে আমরা যদি অন্যান্য দেশের দিকে দৃষ্টি ফেরাই তাতেও আমাদের সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে অবাক হতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি জরিপ সংস্থার রিপোর্ট মতে ইরাকে সম্মিলিত বাহিনীর প্রায় ৮-৯ বছরের যুদ্ধে আধুনিক অস্ত্র আর হাজার হাজার টন বোমা হামলায় নিহতের পরিমান দুই লক্ষ বাসট্ট্রি হাজার মাত্র। অনুরুপ আফগান যুদ্ধে গত একযুগে ও পাঁচ লক্ষ অতিক্রম করেনি। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল নাগাদ ইরান-ইরাক যুদ্ধে মারা যায় ৩ লক্ষ মানুস। সিরিয়ার চলমান যুদ্ধে দুই পরাশক্তির লড়াইয়ে এ যাবতকাল তিন লক্ষের মত মানুস নিহত হয়েছে। অথচ ১৯৭১ সালে দুই পক্ষের লড়াই ছিল অনেকটা গাদাবন্দুক আর হেন্ড গ্রেনেড পরিচালিত গেরিলা যুদ্ধ। তাতেই যাদু মন্ত্রের মত ৩ মিলিয়ন মানুসের আত্মদান সত্যি অসম্ভব। দুনিয়ার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখা যায় অধিকাংশ যুদ্ধে বিজিতদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বিজয়ীদের চাইতে অনেক বেশী। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নিহতের সংখ্যা ৩০ লক্ষ হলে শত্রুপক্ষের সংখ্যা কত? যদি উভয় পক্ষে সমান সংখ্যক মানুস নিহত হয় অর্থাৎ ৩০লক্ষ + ৩০লক্ষ= ৬০লক্ষ। তাহলে তৎকালীন সাড়ে সাত কোটি জনগনের মধ্যে প্রতি ১৪/১৫ জনে একজন মারা যাওয়ার কথা। যার বাস্তবতা কোনদিন প্রমান করা সম্ভব হবেনা। যেহেতু যারা নিহত হয়েছে তারা উভয় পক্ষ-ই এইদেশের সন্তান। হউক তারা নিন্দিত, সেই বিজিতদের তালিকাও আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে স্থান পাওয়ার দাবী রাখে । এই দাবীর মুল প্রতিপাদ্য বিষয় অতৃপ্ত ইতিহাসের শূন্যতা পুরন,নিশ্চয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে খাট করার অপচেস্টা অবশ্যইনয় বরং প্রকৃত ইতিহাসের মূলোৎপাটন করে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে অবহিত করা মাত্র।--------------- প্রবাসী মিয়াজী। (লেখক ও গবেষক)
বিষয়: বিবিধ
১৭৬৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন