মিসওয়াক নিয়ে কিছু কথা।
লিখেছেন লিখেছেন ইমরান ভাই ২৮ আগস্ট, ২০১৩, ১২:৩৪:২২ দুপুর
মিসওয়াক করার ফযীলত ৭০ গুণ:
শরী‘আতে মিসওয়াক করার গুরুত্ব অনেক। তবে মিসওয়াক করার ফযীলত সম্পর্কে বর্ণিত উক্ত প্রসিদ্ধ কথাটি জাল। যেমন:
আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ছালাত মিসওয়াক করে আদায় করা হয় সেই ছালাত মিসওয়াক করা বিহীন ছালাতের চেয়ে ৭০ গুণ বেশী নেকী হয়। (বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/১৫৯, ১ম খন্ড, পৃঃ ৬১-৬২; হাকেম হা/৫১৫; ইবনু খুযায়মাহ হা/১৩৭; মিশকাত হা/৩৮৯।)
তাহক্বীক্ব: ইমাম বায়হাক্বী উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন,
মু‘আবিয়া ইবনু ইয়াহইয়া যুহরী থেকে বর্ণনা করেছে। সে নির্ভরযোগ্য নয়। অন্য সূত্রে উরওয়া আয়েশা থেকে বর্ণনা করেছে। কিন্তু তারা উভয়েই যঈফ। অন্য সূত্রে উরওয়া আক্বেদী থেকে বর্ণনা করেছে কিন্তু সে মিথ্যুক। (আলবানী, মিশকাত হা/৩৮৯-এর টীকা দ্রঃ।)
মিসওয়াক করে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করা মিসওয়াক বিহীন সত্তর রাক‘আত ছালাত পড়ার সমান। (মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হা/১৮০৩; মুসনাদে বাযযার ১/২৪৪ পৃঃ।)
উল্লেখ্য, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অন্যতম প্রবক্তা মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ কান্দালভী প্রণীত ‘মুন্তাখাবে হাদীস’ গ্রন্থে ফযীলত সংক্রান্ত অনেক জাল বা মিথ্যা হাদীছ উল্লেখ করেছেন। উক্ত বর্ণনাটি তার অন্যতম। (ঐ, মুন্তাখাব হাদীস, অনুবাদ: মাওলানা মুহাম্মাদ সা‘আদ ছাহেব (ঢাকা: দারুল কুতুব, দ্বিতীয় প্রকাশ: আগস্ট ২০১০), পৃঃ ২৯৯।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। ইমাম বাযযার বলেন, মু‘আবিয়া নামে একজন রাবী রয়েছে সে ছাড়া আর কেউ এই হাদীছ বর্ণনা করেনি। ইবনু হাজার আসক্বালানী তাকে যঈফ বলেছেন। এছাড়া মুহাম্মাদ ইবনু ওমর নামে আরেকজন রাবী রয়েছে সে মিথ্যুক। (সিলসিলা যঈফাহ হা/১৫০৩-এর ভাষ্য দ্রঃ; যঈফুল জামে‘ আছ-ছাগীর হা/৩১২৭।)
যায়েদ ইবনু খালেদ আল-জুহানী (রাঃ) বলেন, মিসওয়াক না করে রাসূল (ছাঃ) ছালাত সমূহের জন্য বাড়ী থেকে বের হতেন না। (দারাকুৎনী হা/১৫২৫; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ৩০০।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। (যঈফ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১৪৩।)
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, মিসওয়াকের ১০টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। (১) মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি (২) শয়তানের অসন্তুষ্টি (৩) ফেরেশতাদের জন্য আনন্দ (৪) আলজিভের সৌন্দর্য (৫) দাঁতের আবরণ দূরে করে (৬) চোখকে জ্যোতিময় করে (৭) মুখকে পবিত্র করে (৮) কফ কম করে (৯) এটি সুন্নাত (১০) নেকী বৃদ্ধি করে। (দারাকুৎনী ১/৫৮; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪০১৬, ৯/২১ পৃঃ।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি নিতান্তই যঈফ। ইমাম দারাকুৎনী হাদীছটি বর্ণনা করে বলেন, মু‘আল্লা ইবনু মাঈন দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী। (দারাকুৎনী ১/৫৮; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪০১৬, ৯/২১ পৃঃ।)
ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মিসওয়াক মুখ পরিষ্কারকারী, প্রতিপালকের সন্তুষ্টির কারণ ও চোখের জন্য জ্যোতিময়। (তাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৭৪৯৬।)
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। ইমাম তাবারাণী বলেন, হারিছ বিন মুসলিম ছাড়া বাহরে সিক্বা থেকে অন্য কেউ এই হাদীছ বর্ণনা করেনি। (আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৭৪৯৬; সিলসিলা যঈফাহ হা/৫২৭৬।)
আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা মিসওয়াক কর। নিশ্চয়ই মিসওয়াক মুখ পরিষ্কারকারী ও আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ। যখনই জিবরীল আমার নিকট আসেন তখনই আমাকে মিসওয়াক করার জন্য বলেন। এমনকি আমি ভয় করি যে, আমার ও আমার উম্মতের উপর তা ফরয করা হয় কি-না। আমার উম্মতের উপর কঠিন হয়ে যাওয়ার ভয় না করলে মিসওয়াক করা আমি উম্মতের উপর ফরয করে দিতাম। আমি মিসওয়াক করতেই থাকি এমনকি আশংকা করি যে, আমি হয়ত আমার মুখের সামনের দিক ক্ষয় করে ফেলব। (যঈফ ইবনু মাজাহ হা/২৮৯, পৃঃ ২৫; আহমাদ হা/২২৩২৩; তাবরানী, কবীর হা/৭৭৯৬; মিশকাত হা/৩৮৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৫৬, ২/৭৫ পৃঃ; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯৮।)
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। উক্ত বর্ণনার সনদে অনেক ত্রুটি রয়েছে। ওছমান ইবনু আবীল আতেকা নামক একজন রাবী রয়েছে। ইমাম আহমাদ, ইবনু মাঈন, নাসাঈ তাকে যঈফ বলেছেন। এছাড়াও আলী ইবনু যায়েদ আবু আব্দিল মালেক নামের রাবী রয়েছে। ইমাম বুখারী তাকে মুনকার বলেছেন। ইবনু হাতেম এই হাদীছকে যঈফ বলেছেন। (মুগাল্লাত্বঈ, শরহে সুনানে ইবনে মাজাহ (সঊদী আরব: মাকতাবাহ নিযার মুছত্বফা আল-বায, ১৪১৯ হিঃ), ১/৬২ পৃঃ।)
আবু আইয়ুব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, চারটি বিষয় নবীদের সুন্নাত। (ক) লজ্জা করা। অন্য বর্ণনায় খাতনা করার কথা রয়েছে (খ) সুগন্ধি ব্যবহার করা (গ) মিসওয়াক করা ও (ঘ) বিবাহ করা। (যঈফ তিরমিযী হা/১০৮০, ১/২০৬; মিশকাত হা/৩৮২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৫২, ২/৭৪ পৃঃ, ‘মিসওয়াক করা’ অনুচ্ছেদ; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯৭।)
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। উক্ত বর্ণনায় কয়েকটি ত্রুটি রয়েছে। আইয়ূব ও মাকহূলের মাঝে রাবী বাদ পড়েছে। হাজ্জাজ বিন আরত্বাহ নামক রাবীর দোষ রয়েছে। এছাড়াও এর সনদে আবু শিমাল রয়েছে। তাকে আবু যুর‘আহ ও ইবনু হাজার আসক্বালানী অপরিচিত বলেছেন। (মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ফী তাখরীজে আহাদীছি মানারিস সাবীল (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪০৫/১৯৮৫), হা/৭৫, ১ম খন্ড, পৃঃ ১১৭।)
(২) যায়তুন দ্বারা মিসওয়াক করা ফযীলতপূর্ণ:
যায়তুন দ্বারা মিসওয়াক করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয় এবং বিশেষ গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়। অথচ এর পক্ষে শারঈ কোন বিধান নেই। এ মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা জাল।
মু‘আয বিন জাবাল বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, উত্তম মিসওয়াক হ’ল বরকতপূর্ণ যায়তুন গাছ, যা মুখকে পবিত্র করে, দাঁতের আবরণ দূর করে। এটা আমার মিসওয়াক ও আমার পূর্বের নবীগণের মিসওয়াক। (তাবারাণী, আল-আওসাত, হা/৬৮৯।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি জাল। উক্ত বর্ণনার সনদে মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব আল-উকাশী নামে একজন মিথ্যুক রাবী আছে। ইমাম যাহাবী, দারাকুৎনী, ইবনু হাজার আসক্বালানী সহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ তাকে মিথ্যুক বলে অভিহিত করেছেন। (আহমাদ ইবনু আলী ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব (বৈরুত: দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪১৫/১৯৯৪), ৯/৩৭১ পৃঃ।) ইমাম হায়ছামী বলেন, এর সনদে মুহাম্মাদ ইবনু মুহছিন উকাশীও আছে, সে চরম মিথ্যাবাদী। (সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৩৬০ ও ৫৫৭০।)
আবু খায়রাহ ছববাহী (রাঃ) বলেন, আমি আব্দুল ক্বায়স প্রতিনিধি দলের সাথে ছিলাম যারা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে গিয়েছিল। তিনি পাথেয় বাবদ মিসওয়াক করার জন্য তিনি আমাদেরকে আরাক গাছের ডাল দিলেন, যাতে আমরা তার দ্বারা মিসওয়াক করি। আমরা বললাম, আমাদের নিকট মিসওয়াক করার জন্য খেজুরের ডাল রয়েছে। তবে আমরা আপনার সম্মানজনক দান আমরা গ্রহণ করছি। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! আব্দুল ক্বায়েসের প্রতিনিধি দলকে ক্ষমা করুন। কারণ তারা আনুগত্য স্বীকার করে ইসলাম গ্রহণ করেছে অসন্তুষ্টিতে নয়। আর আমার সম্প্রদায় অপমানিত ও তীর-ধনুকের কবলে না পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেনি। (তাবারাণী কবীর হা/১৮৩৫৯; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ৩০০।)
তাহক্বীক্ব: হাদীছটি যঈফ। এর সনদে দাউদ ইবনু মাসাওয়ার নামক রাবী রয়েছে। সে অপরিচিত, কেউ তাকে নির্ভরযোগ্য বলেননি। তার শিক্ষক মুকাতিল বিন হুমামও অপরিচিত। (ইমাম বুখারী, তারীখুল কাবীর ৩/২৪৭ পৃঃ।)
(৩) আঙ্গুল দিয়ে মিসওয়াক করাই যথেষ্ট:
মিসওয়াক দ্বারাই মুখ পরিষ্কার করা সুন্নাত। মিসওয়াক না থাকলে আঙ্গুল দ্বারা মিসওয়াক করা যায়। কিন্তু শুধু আঙ্গুল দ্বারা মিসওয়াক করাই যথেষ্ট একথা ঠিক নয়। এর পক্ষে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা জাল।
আনাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, আঙ্গুল দ্বারা মিসওয়াক করাই যথেষ্ট। (বায়হাক্বী ১/৪০, ইবনু আদী ৫/৩৩৪।)
তাহক্বীক্ব: বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে আবু গাযিয়া নামক একজন রাবী রয়েছে। সে মুহাদ্দিছগণের ঐকমত্যে দুর্বল। বরং দারাকুৎনী তাকে হাদীছ জালকারী বলে অভিযুক্ত করেছেন। এছাড়াও কাছীর ইবনু আব্দুল্লাহ আল-মুযানী নামক রাবীকেও মুহাদ্দিছগণ মিথ্যুক বলেছেন। আরো অনেক ত্রুটি রয়েছে। ( সিলসিলা যঈফাহ হা/২৪৭১; ইরওয়াউল গালীল হা/৬৯; যঈফুল জামে হা/৬৪১৫।)
(৪) ছিয়াম অবস্থায় কাঁচা ডাল দিয়ে মিসওয়াক না করা:
উক্ত ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। বরং কাঁচা হোক শুকনা হোক যেকোন ডাল দ্বারা মিসওয়াক করা যাবে। (ছহীহ বুখারী হা/১৯৩৪, ১/২৫৯ পৃঃ, ‘ছিয়াম’ অধ্যায়-৩৬, অনুচ্ছেদ-২৭।)
[u]মিসওয়াক সম্পর্কে ছহীহ হাদীছ :[/u]
আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মিসওয়াক হ’ল মুখ পরিষ্কারকারী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণ’।(ছহীহ নাসাঈ হা/৫, ১/৩ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৮১; বঙ্গানুবাদ হা/৩৫১, ২/৭৪ পৃঃ; ইরওয়া হা/৬৬।)
আলী (রাঃ) মিসওয়াক করার নির্দেশ দান করতেন এবং বলতেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয় বান্দা যখন মিসওয়াক করে ছালাত আদায়ের জন্য দাঁড়ায় তখন ফেরেশতা তার পিছনে দাঁড়ায়। অতঃপর তার ক্বিরাআত শুনতে থাকে এবং তার কিংবা কথার নিকটবর্তী হয়। এমনকি ফেরেশতার মুখ তার মুখের উপর রাখে। তার মুখ থেকে কুরআনের যা বের হয় তা ফেরেশতার পেটের মাঝে প্রবেশ করে। সুতরাং তোমরা কুরআন তেলাওয়াতের জন্য মুখ পরিষ্কার রাখ’।(আবুবাকর আহমাদ ইবনু আমর আল-বাছরী আল-বাযযার, মুসনাদুল বাযযার হা/৬০৩, ১/১২১ পৃঃ; সনদ জাইয়িদ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১২১৩, ৩/২৮৭ পৃঃ।) উল্লেখ্য, মিসওয়াকের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক হাদীছ রয়েছে।
আশাকরি মেসওয়াক করে নবী (সা) এর সন্নতকে আকড়ে ধরবেন এবং যইফ ও জাল হাদিসকে বর্জন করে সহিহ সুন্নতকে প্রতিস্থাপন করবেন।
আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন আ’মিন।
সুবহানাকাল্লাহুম্মা অবিহামদিকা। আশহাদুআল্লা ইলাহা ইল্লাআনতা আসতাগফিরুকা । অতুবু ইলাইক।
বিষয়: বিবিধ
২২৬৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন