মেহেদী রাঙা হাত মুহাম্মদ মুফীজুল ইসলাম [লেখক, হৃদয় গলে সিরিজ]
লিখেছেন লিখেছেন হৃদয় গলে সিরিজ ২৫ জুন, ২০১৪, ০৭:৫৭:৪৫ সন্ধ্যা
ভূস্বর্গ কাশ্মীর। এরই সীমান্তবর্তী একটি জেলা। নাম কাপওয়ারা। উক্ত জেলার আওতাধীন কুনান গ্রামটি বেশ সুন্দর। চারদিকে সবুজ বৃলতা। মাঝে মাঝে নাম না জানা হরেক রকম ফুল গাছ। আলোছায়া ভরা প্রকৃতি। দেখতে ঠিক ছবির মতো। চোখ পড়তেই হৃদয়-মন জুড়িয়ে যায়।
রুবাইয়া সতের আঠার বছরের তরুণী। তার মনোমুগ্ধকর রূপ-লাবণ্য বাস্তবিকই ছিল অতুলনীয়। এ রূপের যেন শেষ ছিল না। এমন মনোহারিনী রূপ সত্যিই বিরল।
রুবাইয়ার মা একজন পরহেজগার মহিলা। গোটা দিন তেলাওয়াত অযীফা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কুনান গ্রামে মায়ের সাথে বসবাস করে রুবাইয়া। স্নেহময়ী পিতাকে বেশ কয়েক বছর আগে হারিয়েছে সে। ভাই বোন কেউ নেই। মুজাহিদ আলীর সাথে কিছুদিন পর বিয়ে হওয়ার কথা। সবকিছূ চূড়ান্ত। শুধু তারিখটা বাকি। আলী, সম্পর্কে তার মামাতো ভাই হয়।
একদল মুজাহিদের ইনচার্জ আলী। সে একজন সুদর্শন সাহসী যোদ্ধা। প্রখর মেধাবী ও তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন স্বাস্থ্যবান যুবক। তার মা এখনো বেঁেচ আছেন। মায়ের বয়স বেশি হলেও হাঁটাচলা করতে পারেন। দশদিন আগে তিনি তার ছেলের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন--
“বাবা আলী! আশা করি ভাল আছো। আমরা শারীরিকভাবে ভালো থাকলেও মানসিকভাবে নয়। কয়েকদিন যাবত বেশ খারাপ খবর পাচ্ছি। মনে হয় মা রুবাইয়া আর নিজেকে রা করতে পারবে না। তোমার ফুফু যার আমানত তার হাতে তুলে দিতে চাচ্ছেন। এমন ইচ্ছা আমারও। এতে আমাদের দায়িত্বের বোঝাটা কিছুটা হলেও হালকা হবে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।”
ইতি
তোমার স্নেহময়ী মা
চিঠি পাওয়ার পর আলী যেমন চিন্তিত হলো তেমনি চিন্তিত হলো অন্য মুজাহিদরাও। কমাণ্ডার সাহেব চিঠির কথা জানতে পেরে আলীকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিলেন। ডেকে এনে বললেন, আলী! মায়ের ডাকে সাড়া দাও।
আলীর বিয়ের কথা সবাই জানতো। তাই বিদায়ের সময় মুজাহিদদের চোখে আনন্দাশ্র“ চিকচিক করছিল। সেই সাথে আলীর মায়ের শংকার কথা মনে পড়ায় একটা অব্যক্ত বেদনা চিনচিন করছিল হৃদয়ের গহীন কোণে। আলী সকলকে সালাম দিয়ে বাড়ির পথে বেরিয়ে পড়ল।
কয়েক ঘন্টা হলো আলী চলে গেছে। এরই মধ্যে একটা হৃদয়বিদারক দুঃসংবাদ পাওয়া গেল। মুজাহিদরা জানতে পারল, আজ রাতে ভারতীয় হায়েনারা ইতিহাসের বর্বরোচিত কাণ্ড ঘটিয়েছে কুনান গ্রামে। মানবরূপী পশুগুলো তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটায়। এক দল গোটা গ্রামটিকে ঘিরে রাখে, যেন একটি প্রাণীও গ্রাম থেকে বের না হতে পারে। আরেক দল পুরুষদের উপর নির্যাতনের স্টীম রুলার চালায়। আর তৃতীয় দলটি কুনান গ্রামের ছোট বড় প্রতিটি মেয়ের ইজ্জত হরণ করে। গোটা সেনা দলটিই পালা বদল করে এসব কর্মকাণ্ডে অংশ নেয় এবং সবাই সব ধরনের তৎপরতায় শরীক হয়।
ভারতীয় নরপশুদের দ্বারা কাশ্মেরী মহিলাদের সম্ভ্রম লুট হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু যেভাবে চাদঁনী রাতে মা-মেয়ে, শাশুড়ী-পুত্রবধু ও নাতনী-পৌত্রীদের একত্রিত করে একই সাথে একই স্থানে শ্লীলতাহানি করা হয়েছে, এমন ঘটনা বোধ হয় ইতিহাসের কোনো অন্ধকার কোণেও খুঁেজ পাওয়া যাবে না। পাশবিকতার ইতিহাসে আবর্জনা ঘাটলেও পাওয়া যাবে না এমন কলংকজনক মর্মান্তিক অধ্যায়।
এ দুঃখজনক খবর শুনে মুজাহিদদের মুখের ভাষা ফুরিয়ে যায়। কষ্টে আর ব্যথায় কলিজা ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম হয়। আলী ও রুবাইয়ার জন্য তাদের হৃদয়-মন অস্থির হয়ে উঠে। সবাই বলতে থাকে-- আহা, রুবাইয়ার বাড়ি তো কুনান গ্রামে! না জানি রুবাইয়ার কী অবস্থা!! আলী তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ পাবে তো?
এরপর এক এক করে কেটে গেল সাতটি দিন। আলীর খবর জানার জন্য মনটা আনচান করছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে সমস্ত মুজাহিদের। এরই মধ্যে হঠাৎ আলী এসে উপস্থিত। চোখ দুটিতে কেমন অসহায় দৃষ্টি। মুখমণ্ডল বিষণœ-মলিন। এলোমেলো চুল। কাঁেধ একটি থলে।
আলীকে দেখেই মুজাহিদরা দৌড়ে এল। সে কোনো কথা বলল না। উদাস দৃষ্টি মেলে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। তারপর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে কাঁেধ রাখা থলেটি আস্তে আস্তে মাটিতে নামাল। মুজাহিদরা জিজ্ঞেস করল, এতে কী আছে আলী?
এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া গেলনা। খানিক পর আলী নিজেই থলের মুখ খুলল। থলের মধ্যে রুমালে জড়ানো কী একটা জিনিস। উৎসুক দৃষ্টিগুলো তাড়াহুড়া করছিল তা দেখার জন্য।
রুমালটি খোলা হলো। রুমালের ভেতরের জিনিসটি দেখে মুজাহিদরা নিশ্চুপ হয়ে গেল। চোখগুলো প্লাবিত হলো অশ্র“বন্যায়। বিরাট হইচইয়ের মধ্যে হঠাৎ নেমে এল কবরের নীরবতা। মনে হলো, পর্বতসম কষ্টের ভার সইতে না পেরে সবার কলিজা আর হৃৎপিণ্ড একত্রে বাইরে বেরিয়ে আসবে।
কী ছিল সেই রুমালে! যা দেখে শক্তপ্রাণ মুজাহিদরা মোমের মত গলে গিয়েছিল। হ্যাঁ, লাল বুটিদার আরবী রুমালটির ভিতর ঘুমিয়েছিল একটি মর্মান্তিক উপাখ্যান। নির্যাতন, নিপীড়ন ও বর্বরতার এক রক্তাক্ত ইতিহাস। মুক্তির ইতিহাস। স্বাধীনতার ইতিহাস। যুগে যুগে ইসলামের জন্য উৎসর্গীত প্রাণের ইতিহাস।
এবার আর আলীর কাছে জানার আর কিছুই রইল না। রুমালের ভিতরকার জিনিসটিই সবকিছু বলে দিল। রুমালে রাখা ছিল স্বপ্নীল ভবিষ্যতের ভাবনায় ডুবে থাকা এক কুমারী কন্যার মেহেদি রাঙা হাত। হাতের ঠিক মাঝখানে ছিল মেহেদি রঙে রাঙানো সুন্দর করে লেখা একটি প্রিয়তম নাম---আলী।
কুনান পলীতে সেই ভয়াবহ পাশব উলাসের রাতে যে সব মা বোন জীবন দিয়েছে, তরুণী রুবাইয়াও এদের একজন। একটি কাটা হাত ছাড়া তার গোটা দেহের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে সকল মৃতদেহের ছাইভস্ম। আলীদের ঘাঁটির সামনেই দাফন করা হবে মেহেদি রাঙা সেই হাতটি। [ হৃদয় গলে সিরিজের ১৯নং খণ্ড থেকে পোস্টকৃত]
বিষয়: বিবিধ
১৬৫১ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনি কি হৃদয় গলে সিরিজ এর লেখক?
ব্লগে আপনাকে স্বাগতম।
আপনি কি হৃদয় গলে সিরিজ এর লেখক?
ব্লগে আপনাকে স্বাগতম।
Good Luck Good Luck Good Luck Good Luck
মন্তব্য করতে লগইন করুন