গল্প: আমার প্রতিবেশি, একজন কাজল ভাই। (৯১ শতাংশ বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষিতে)
লিখেছেন লিখেছেন লাবিব ইত্তিহাদুল ২৯ আগস্ট, ২০১৩, ০৪:২১:৩৫ রাত
(যদিও এই গল্পের ৯১ শতাংশ বাস্তব, তবুও কারো জীবনের সাথে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে মিলে গেলে লেখক তথা আমি কোনভাবে দায়ী নই)
আমার বাসা ঝিকরগাছা জেলার একটি কম পরিচিত এলাকায়। এখানেই আমি বড় হয়েছি। আমার শৈশব কৈশোর সব পার করেছি এখানেই। আমার নিকটতম প্রতিবেশি কাজল। আমার থেকে ২ কি ৩ বছরের বড়। তাই তাকে সম্মানের সাথে কাজল ভাই বলে ডাকি। আমাদের পাড়ার আদর্শ ছেলে সে। মা প্রায়ই আমাকে কাজলের মত হতে বলে। আমারও কাজলের মত মেধাবী হবার ইচ্ছা। যাহোক, মনের ইচ্ছা মনে পোষণ করে ক্লাস ফোরে উঠলাম। কাজল ভাই তখন ঝিকরগাছা জেলা হাই স্কুলে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছেন। তার রোল নং এক।
মাঝে একটু বলে নেই, জেলা স্কুল হওয়ায় এই স্কুলের মান এখানকার অন্য যে কোন স্কুল থেকে ভালো। তৎকালীন সময়ে ক্লাস সিক্সে সীট ছিল মাত্র ১৮০ টি। সীটের জন্য পুরো জেলা থেকে সব মেধাবী মেধাবী ছাত্ররা ইন্টার্ভিউ দিতে আসত। এক সীটের জন্য লড়াই করত অন্ততপক্ষে ৮/৯ জন যা এখন ২০ জন এর উপরে। হেডমাস্টার অনেক কড়া বলে কোন ধরণের তদবীর কাজে আসত না। সেখানে ক্লাস সিক্সে ইন্টার্ভিউ এর মাধ্যমে ক্লাস সিক্সে ক শাখায় রোল ১ চাট্টিখানি ব্যাপার নয়।
ক্লাস সিক্সে কাজল ভাই রোল ১ হওয়ায় আমার উপর পড়াশুনার চাপ দ্বিগুন ভাবে বেড়ে গেল। যেভাবেই হোক আমাকে সেই স্কুলে রোল এক হতেই হবে। বাবা মায়ের বড় ছেলে তার উপর কিন্ডারগার্টেন স্কুলে আমার রোল একাধারে ১ থাকায় আমার প্রতি মা/বাবা আত্নীয় প্রতিবেশির আকাংক্ষা একটু বেশিই ছিল।
দেখতে দেখতে আমারও হাই স্কুলে ভর্তির সময় এসে গেল। ইন্টার্ভিউ দিলাম, টিকেও গেলাম। রোল হলো ক শাখার ২০ এর কোঠায়। জীবনের প্রথম ধাক্কাটা এখানেই খেলাম। বাসায় এসে বুঝতে পারলাম, কত্ত বড় অপরাধ করে ফেলেছি। আমার ভবিষ্যৎ যে এক্কেবারে শেষ। কিচ্ছু হবে না আমাকে দিয়ে। তাদের সব আশা গুরেবালি প্রমাণ করে দিয়েছি আমি। মায়ের কান্নাকাটি, বাবার সান্তনা, প্রতিবেশির নাক ছিটকানো। সে এক বিরাট ইতিহাস।
যাই হোক, কাজল ভাই তখন ক্লাস এইট এর ক বিভাগের রোল ১। ভবিষ্যৎ উজ্জল। আর আমিতো শেষই। চার ভাই বোনের মধ্যে কাজল ভাই সবার ছোট। সবার বড় বোন, তারপর ভাই, আরেক বোন সবার শেষে কাজল ভাই। সবাই মেধাবী ছাত্র। সংসারের একনাত্র উপার্জক উনার বাবা সরকারী চাকুরী করেন। মা গ্রিহিনী। বর ভাই বোনের বিবাহ হয়ে গেছে। তারা আলাদা থাকেন। বাকি আছেন ছোট দুই ভাই-বোন।
কাজল ভাই তখন ক্লাস নাইন এ। বিজ্ঞান বিভাগের ফাস্টবয়। যেনতেন কথা নয়। পুরো স্কুল শুধু নয়, পুরো এলাকা তাকে চিনেন। তিনি আমাদের জন্য এক আদর্শ ছাত্র। সবাই তাকে দিয়ে উদাহরণ দেয়। তিনি বড় হয়ে অবশ্যই বিরাট কিছু হবেন, তা চোখ বন্ধ করেই বলে দিতে পারে সবাই।
[গল্পটা এখানে শেষ হলেই ভালো হতো। কারণ এর পরের অংশ আপনাকে ব্যাথিত করতে পারে]
এমনই এক সোনালী সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতমুখী সময়ে কাজল ভাই এর বাবা ইহকাল ত্যাগ করে, সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন পরপারে। মাইকিং, গোছল, জানাজা সবকিছুই নিয়ম মত হলো। এলাকার মুরুব্বী, বড় ভাইরা কাজল ভাইকে এসে সান্তনা দিলেন। কাজলকে দেখে রাখার দ্বায়ীত্ব নিয়ে ও বিপদে আপদে আসময়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিলেন। কাজল ভাই অল্প হলেও আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন তাদের কথায়।
একসময় সব স্বাভাবিক হয়ে আসল। স্কুলের বেতন ছিল মাত্র ১৫ টাকা। সম্ভবত এখনো ১৫ টাকাই আছে। তাই স্কুলের বেতন নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না কারো। ক্লাস নাইন থেকে কাজল ভাই এর জীবনে নেমে আসলো এক আঁধার ঘণ সময়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যাক্তি চলে যাওয়ায় কি কি পরিবর্তন হয়েছিল তা সম্ভবত ব্যাক্ষ্যা করে বলার দরকার নেই।
তবে এতটুকু সত্য, এলাকার সেই মুরুব্বী ও বড় ভাইদের আর কখনো কাজলের খোজ নিতে দেখিনি। এ ব্যাপারে কাজল ভাই ওর নিজেরও কোন অভিযোগ নেই। ভেংগে পরেন নি তিনি। একে একে হাইস্কুল, কলেজ শেষ করেছেন। দুটোতেই ডাবল গোল্ডেন পেয়েছেন। তাকে ঘীরে সকলের স্বপ্ন ও সেই সোনালী ভবিষ্যৎ ধীরে ধীরে সত্যি হতে লাগলো।
কিন্তু "কোন এক অজানা" কারণে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা দেয়া হলো না কাজল ভাইএর। বেসরকারি মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সাধ্য তার নেই। সময় নষ্ট না করে, বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে দিয়ে বিবিএ পড়া শুরু করলেন এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিজিপিএ ৩ দশমিক ৫ এর বেশি নিয়ে শেষ করেছেন বিবিএ। নিজেই খরচ যুগিয়েছেন পড়াশুনার। টাকা থাকলে এমবিএ পড়তেন। কাজল ভাই এর বয়স হয়েছে। তার ২ বছরের বড় বোনটির বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। উনার বড় ভাই বোন যারা নিজের পায়ে দাড়িয়ে আছেন, তারা কোন রকম মায়ের দিকে একটু দ্বায় সারা গোছের খেয়াল রেখেই দ্বায়ীত্ব শেষ বলে মনে করেন।
তাই সব ঝামেলার সমাধান হিসেবে কাজল ভাই এর দ্রুত একটি চাকরী দরকার। পরিবারের উপর তার দ্বায়ীত্ব আছে। ফ্যামিলি থেকেও চাপ দেয়া হচ্ছে নিজের পায়ে দাড়াবার জন্য। টিউশনি করে আর কত? কাজল ভাই প্রতিদিন সকালে উঠেন। চকচকে সচ্ছ ফাইলে তার সিভির কতগুলো কপি আর পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিয়ে বেড়িয়ে পরেন। সাথে স্কুল,কলেজে বিভিন্য প্রতিযোগীতায় জয়ী হয়ে পাওয়া কিছু সার্টিফিকেট। ভাবেন এগুলোর কারণে অগ্রাধিকার পাবেন। পত্রিকায় চাকুরির সার্কুলার দেখেন নিয়মিত। ব্যাংক ড্রাফট করে প্রয়োজনীয় কাগজ এটাস্ট করে জমা দেন। বেশিরভাগেরই কোন উত্তর আসে না। যেগুলো আসে, খুব গুরুত্ব নিয়ে ইইন্টার্ভিউ দেন। লিখিত পরীক্ষায় টিকে গেলে ভাইবা বোর্ডএর প্রশ্নকারীদের খুশি করায় চেষ্টার কোন কমতি করেন না। তার পরেও চাকুরী হয়না তার।
বেকার জীবন আর ভালো লাগেনা। টাকা খুবই দরকার। অনেকেই ব্যাবসা করার পরামর্শ দেন। কিন্তু ব্যাবসা করার টাকা কোথায়? টাকা ধার দেবার মতও কেউ নেই তার। অনেক বন্ধু বান্ধব, আত্নীয়, বড় ভাই, মুরুব্বীকে চাকুরির ব্যাবস্তা করে দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। সবাই বলে "সিভি পাঠাও ইমেইল করে। দেখি কি করা যায়"। প্রায়ই আমার পিসি থেকে সিভি মেইল করেন কাজল ভাই। আমাকে এড্রেস দিলে আমিই পাঠিয়ে দেই সেই ঠিকানায়। অত্যান্ত দুক্ষভরা কন্ঠে তার এই সমস্যাগুলোর কথা আমাকে বলেন কাজল ভাই।
আমি জানি কাজল ভাই এর চাকুরির কোন ব্যাবস্থা হবে না। কারণ তার পরিবারে তদবীর করার মত কেউ নেই। তদবীর এর বদলে যে পরিমান টাকা দিতে হয়, সে পরিমান টাকা এই অবস্তায় দেয়া একদমই সম্ভব না তার পক্ষে। এত টাকা পেলে নিজে নিজেই ব্যাবসা শুরু করা যেত।
এটা শুধু আমার কথা নয়। কাজল ভাই নিজেও বোঝেন। সমস্যার কারণ ও সমাধানের স্বপ্নও দেখেন তিনি। রাজনিতী শুরু করবেন বলে পরিকল্পনা নিয়েছেন। যেই মানুষটাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি, যে কিনা রাজনিতীর 'র' শব্দটা শুনতেও নারাজ, তার মুখে রাজনিতী শুরুর পরিকল্পনার কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পরল। কারণ জিজ্ঞাসা করতেই চটপট বলে দিলেন, রাজনিতী করে অনেক টাকা কামাতে চান তিনি। এত এত টাকা যে তার ছেলে/মেয়ে, নাতি/নাতনী কারোরই যেন কোনদিন চাকরির পেছনে ছুটতে না হয়। তিনি নিজেই তখন তার মত ছেলেদের জন্য তদবীর করবেন। পারলে কিছু প্রতিষ্ঠানও খুলবেন বলেছেন। যেখানে শুধু মেধাবী আর যোগ্য লোকদের তিনি নিজে চাকুরী দেবেন। কোন তদবীর দরকার হবে না।
আমি অবাক হয়ে যাই তার কথা শুনে। নিজের প্রতি ঘ্রিণা জন্ম নেয়। কোন দেশে বাস করি আমরা? দেশে কি এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে কাজল ভাইদের মত লোকেরা চাকরি করতে পারে? এমন কোন ব্যাংক নেই, যারা কাজল ভাইদের মত লোকদের ব্যাবসা করার জন্য টাকা দেয়? এই চাকুরি বানিজ্য, ঘুষ, তদবীর আর কত? এসব কবে বন্ধ হবে এই দেশ থেকে? সেই দিন কি কখনো আসবে না, যেদিন বাংলাদেশের মানুষ ঘুষ,তদবীর শব্দ গুলোই ভুলে যাবে?
কাজল ভাইদের মত মানুষদের ভবিষ্যৎ কি তা আমি জানি না। আমি জানি না, তাদের এই সমস্যা কোনদিন সমাধান হবে কিনা। তবে আমি এতটুকু ১০০% নিশ্চিত যে, এই গল্পের মূল কথা সকল পাঠকের পরিচিত অন্তত একজন মানুষের সাথে পুরোপুরি মিলে যাবে।
************************************
বি:দ্র: গল্পের ৯১ শতাংশ বাস্তবতার কথাটি অনুমান ভিত্তিক। অনেক আক্ষেপ নিয়ে লিখলাম। কাজল নামে কেউ এখনো পর্যন্ত আমার প্রতিবেশি নয়। তবে এমন হাজারো কাজল আছেন যারা আমার আপনার প্রতিবেশি।
- লাবিব ইত্তিহাদুল,
৩ জুন, ২০১৩
একই সাথে ফেসবুক, সামু ও ব্যাক্তিগত ব্লগে প্রকাশিত।
বিষয়: সাহিত্য
১৯২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন