নাস্তিকদের মরোনোত্তর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও সংরক্ষনে রাষ্ট্রীয় আইন দরকার
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মিজানুর রহমান সোহেল ০৩ অক্টোবর, ২০১৪, ০৬:৪৫:০০ সকাল
প্রত্যেক মানুষের যে কোন বিষয়ে মুক্ত চিন্তার, মুক্তভাবে ভাবার বা বিশ্বাস,অবিশ্বাস করার অধিকার রয়েছে। এবং এটা থাকাও উচিত। আর এই অধিকার বলে ব্যক্তি যে কোন বিষয়কে সরাসরি বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস করতে পারেন।
নাস্তিক ! হ্যাঁ, নাস্তিক শব্দটি দিয়ে প্রচলিত অর্থে আমরা একটি বিশেষ ক্ষুদ্র বা সংখ্যালগু শ্রেনীর মানুষের পরিচয় প্রকাশ করে থাকি। যারা মূলত কোন ধর্মে বিশ্বাসী নন। যাদের বিবেচনায় সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব শুন্য অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা বলতে কেহ নেই আর ধর্মের তো প্রশ্নই ওঠেনা। ব্যক্তি স্বাধীনতার ভিত্তিতে যে কেউ এমন ধারনা পোষন করতে পারেন এবং তা সরাসরি ব্যক্তও করতে পারেন। ব্যক্তি স্বাধীনতার ভিত্তিতে যেমনটি পারেন একজন ধার্মিক মানুষ তাঁর নিজ ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বাস স্থাপন করতে এবং তা সরাসরি প্রকাশ করতে। ব্যক্তি যদি সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাস করেন অথবা কোন ধর্মকে অস্বীকার করেন, সেটা তাঁর সম্পূর্ন নিজস্ব ব্যাপার। এখানে দুশমনি কিংবা সংঘাতের কিছু নেই। প্রচলিত একটি ভূল ধারনা আমাদের মাঝে বিদ্যমান আছে, আর তা হল নাস্তিকরা ইসলামের শত্রু। মোটেই নন। একজন নাস্তিক, সেতো কোন ধর্মেই বিশ্বাস করেন না। এটা যদি দোষর কিছু হয়ে থাকে অথবা এই দৃষ্টিভঙ্গির কারনে যদি নাস্তিকদের ধর্মের শত্রু মনে করা হয়, তাহলে শুধুমাত্র ইসলামের নয় নাস্তিকরা তো বিশ্বের সকল ধর্মের দুশমন। যা মোটেও কাম্য নয়। ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস রাখতে পারেন আবার নাও পারেন, যে কোন ধর্মের অনুসরন করতে পারেন। ধর্মান্তরিত হতে পারেন। এক ধর্মের অনুসরী হয়ে অন্য সকল ধর্মকে অস্বীকারও করতে পারেন। ধর্মগ্রন্থ থেকে হুবহু বর্ননাও করতে পারেন যে কোন বিষয়। এটা ব্যক্তি স্বাধীনতা। এখানে কারো কিছু করার নেই। নাস্তিকরা তখনই কোন ধর্মের শত্রুতে পরিনত হতে পারে যদি তাঁরা সে ধর্মের ব্যাপারে কোন কটুক্তি করে। কারন, ব্যক্তি কোন অবস্থায়ই কোন ধর্মের ব্যাপারে কটুক্তি, অবমাননাকর বা ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হেনে কোন মন্তব্য প্রকাশ করার অধিকার রাখেনা। যা রাষ্ট্রীয় আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর আমি মনে করি একজন আদর্শ নাস্তিক সেটা কখনই করেন না। একজন আদর্শ চিন্তাবিধ নিজস্ব বিবেচনায় অটল থাকবেন অথবা সেখান থেকে সরেও আসতে পারেন। অন্য কারো বিবেচনাকে হেয় করার হীন মানসিকতকা কখনই পোষন করেন না।
নাস্তিকদের প্রতি ধর্মীয় আহবান অবিরত থাকতে পারে কিন্তু জবরদস্তি মোটেই কাম্য নয়। ধর্ম জোর জবরদস্তির বিষয় নয়। পৃথিবীতে প্রায় সকল ধর্মেরই প্রচার ও আহবান অব্যাহত রয়েছে। এতদসত্বেও যারা কোন ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন না করে নিজের বিবেচনায় অনড় থাকেন, তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ মোটেও সমীচীন নয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, সমাজ ও পরিবার কর্তৃক জোর করে একজন নাস্তিক বা ধর্মে অবিশ্বাসীর উপর ধর্মকে চাপিয়ে দেয়া হয় তার বিদায় বেলা। অর্থাৎ কোন নাস্তিক বা অবিশ্বাসী ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার পারিবারিক উদ্যোগে মৃত ব্যক্তির উপর নিজস্ব ধর্মের পরিচয় চাপিয়ে দিয়ে সেই ধর্মের রীতিতে সামাজিক সহযোগীতায় মৃতদেহটি হয় কফিনে ঢুকিয়ে কবর দেয়া হয় নয়তো চিতায় পুড়িয়ে সৎকার করা হয় অথবা জানাজা পড়িয়ে দাফন করা হয়। যেটা আমি মনে করি সম্পূর্ন বেআইনী ও অপমানজনক। ব্যক্তির বিশ্বাসের পরিপন্থী যা রীতিমত অসম্মানজনক।
এর জন্য দায়ী পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের অমনোযোগ এবং নাস্তিকদের নিজস্ব উদ্যোগে উদাসীনতা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট দেখি, নাস্তিক বা অবিশ্বাসী বা বস্তুবাদীদের মৃত্যুর পরে কি করা হয় ? উদাহরন স্বরুপ ইদানিংকালে বাংলাদেশে আমরা যা দেখেছি, মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া বেশ কয়েক জন স্ব-ঘোষিত নাস্তিক বা ধর্ম বিদ্বেষীর জীবনাবসানের পরে তাদের পরিবার মৃতদেহ কে জোর করে মুসলিম বানিয়ে (মুসলমান হিসেবে) কিছু লোভী ভন্ড মৌলভীদের ভাড়া করে এনে সমাজের কতিপয় মূর্খ লোকের সহযোগীতায় মুসলিম রীতিতে জানাজা পড়িয়ে কবর দেয়া হয়েছে। মৃতদেহকে গোসল করানো থেকে শুরু করে জানাজা অতঃপর কবর দেয়া পর্যন্ত, সম্পূর্ন পদ্ধতি সম্পন্ন করতে কখন কখন ব্যবহার করা হয়েছে ধর্মীয় গ্রন্থ আল-কুরআন থেকে আয়াত সমুহ। অথচ ব্যক্তি তাঁর জীবদ্দশায় এই কুরআনের কতটা ঘোরতর বিরোধী ছিল, কুরআন বিরোধী আন্দোলনে যে লোকটি ছিল আজীবন সক্রিয়, আপোষহীন, তারই শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে সেই কুরআনেরই ব্যবহার (!) এর চেয়ে তাঁর জন্য অসম্মান তথা দূর্ভাগ্যের ব্যাপার আর কি হতে পারে ? ধর্মেরও অবমাননা। উদাহরন স্বরুপ, তসলিমা নাসরিনের মত ব্যক্তির, যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কুরআন তথা ধর্ম বিরোধী আন্দোলনে জীবন যৌবন বিলীন করে দিচ্ছেন, নির্বাসিত পর্যন্ত হয়েছেন, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লতিফ সাহেবের মত একজন মুক্ত চিন্তার আধুনিক মানুষের জীবনাবসানের পরে যদি সেই ধর্মকেই তাঁর উপর চাপিয়ে দেয়া হয় সেটা তাদের জন্য কতটা অপমানজনক হতে পারে, ধর্মেরও অবমাননা।ভেবে দেখুন। কিন্তু কেন এই আয়োজন ? কেন এই টানা হেচড়া ? কেন ব্যক্তি স্বাধীনতায় এই অবৈধ হস্তক্ষেপ ? আমি আগেই বলেছি এই সমস্যার জন্য সকলেই দায়ী। যেমনঃ পরিবারের খামখেয়ালী, সমাজের অসচেতনতা, রাষ্ট্রের অমনোযোগ এবং নাস্তিকদের নিজস্ব উদ্যোগ ও পরিকল্পনার অভাব।
আমি অবাক হয়ে যাই, নাস্তিকদের কেউই কেন এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেন না? ভাবলেও কেন তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিজেদের নাগরিক অধিকার ও মরোনোত্তর অধিকার আদায়ের নিমিত্তে দাবী তুলছেনা ? তারা কি দেখেনা, তাদের দলের বা সমাজের কেউ মারা গেলে বাইরের সমাজের সবাই মিলে মৃত দেহটাকে সেই ধর্মের জলেই গোসল করিয়ে কেমন প্রতিশোধ নেয় ? অথচ যে ধর্মের রীতিনিতির ব্যাপারে ব্যক্তির ছিল চরম আপত্তি ! এরপরেও কেন একজন বিশিষ্ট নাস্তিকও প্রকাশ্যে নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করে ঘোষনা করেন না যে, আমি একজন নাস্তিক, আমি কোন ধর্মে বিশ্বাস করিনা, সুতরাং আমার মৃত্যুর পরে আমার অসহায় মৃতদেহটিতে আমারই বিশ্বাসের পরিপন্থী কোন ধর্মীয় রীতিনিতি যেন প্রায়োগ করা না হয় ? এবং এর থেকে রক্ষা পেতে কেন রাষ্ট্রের কাছে আগাম সহযোগীতা কামনা করেন না ??? মাঝে মাঝে সকল নাস্তিকদের কাপুরুষ মনে হয়।
উত্তরনের উপায়ঃ আমি মনে করি, সর্ব প্রথম নিজেদের ধারনা (বিশ্বাস) ও পরিচয় সম্পর্কে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে পরিষ্কারভাবে অবহিত করা উচিত। মরোনোত্তর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষনে রাষ্ট্রকে আইন প্রনয়নে অনুরোধ করা এবং এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকেও আন্তরিক হতে হবে। আইন হয়ে গেলে নিজেদের বিজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে শেষকৃত্য সম্পাদনের একটি বিশেষ পদ্বতি উদ্ভাবন করে রাষ্ট্রকে অবহিত করতে হবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে নিজস্ব পচন্দসই ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিও হতে পারে। কিন্তু অবশ্যই তা পরিবার ও প্রশাসনকে জানাতে হবে। যাতে করে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের অধিকার ও শেষ ইচ্ছাকে সম্মানের সহিত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আদায় করতে পারে।
নাস্তিকদের মরোনোত্তর অধিকার সংরক্ষনে রাষ্ট্রীয় একটি আইন বা নীতিমালা থাকলে নাস্তিকদের মৃতদেহ নিয়ে কেউ আর নাস্তিকদের নিজস্ব চিন্তা বা বিশ্বাসের পরিপন্থী যা খুশি তা করতে পারবে না। এমনকি পরিবারও নয়। যেমনঃ কেউ যদি আত্মহত্যা করে, পরিবার তার লাশ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া নিজেদের খেয়াল খুশিমত দাফন বা পুড়িয়ে ফেলতে পারেনা। অবশ্যই প্রশাসনের নির্দেশনা অনুসরন করতে হয়। আমি মনে করি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নাস্তিকদের সম্মিলিত বা নিজ নিজ পছন্দনীয় পন্থায় তাদের মৃতদেহের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার রীতি চালু হলেই নাস্তিকদের আপনসত্ত্বা টানাহেচড়া থেকে রক্ষা পেতে পারে।
তাই নাস্তিকদের নিজস্ব উদ্যোগের পাশাপাশি নাস্তিকদের মরোনোত্তর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও সংরক্ষনে রাষ্ট্রীয় আইন বা নীতিমালা একান্ত প্রয়োজন!
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন