মায়ের লাশ সন্তানের কাঁধে !!!
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মিজানুর রহমান সোহেল ১০ নভেম্বর, ২০১৩, ০৪:০০:৪০ রাত
মা অসুস্থ, পকেটে টাকা নেই। আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। চিকিৎসায় ভিটে মাটি বিক্রি করে ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে অনেক টাকা। ঋনের বোঝাও ভারী হয়ে উঠছে। অসুস্থ্ মা হঠাৎ করেই একটু বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। স্থানীয় ডাক্তারেরা বিভাগীয় বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। বিভাগীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। হাসপাতাল থেকে কোন প্রকার ঔষধ না দিয়ে ডাক্তার একটা কাগজে একটা ঔষধের নাম লিখে বাহির থেকে কিনে আনার পরামর্শ দিলেন। সাথে থাকা শেষ সম্বলটুকু দিয়ে কোন মতে ঔষধ কিনে আনা হল। সে ঔষধ খেয়ে মা আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দেখা দিল প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট। ডাক্তার বলল অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হবে। আর এ জন্য টাকা লাগবে। কিন্তু কোথায় টাকা ? টাকা যে নেই। পাষানের হৃদয় গলেনি। অক্সিজেনের অভাবে সারা রাত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে মা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সকাল বেলা মায়ের লাশ বের করার জন্য খুনীদের (হাসপাতাল কতৃপক্ষ) কাছে একটা ষ্ট্রেচার চাওয়া হল। হাসপাতাল কতৃপক্ষ বিনিময় ১০০ টাকা চাইলেন। টাকা !!! টাকা থাকলে তো গতরাতে মাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টাটুকু করা হত। টাকা ছাড়া স্ট্রেচার দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। সকলের কাছে লাশ হলেও নিজের কাছে তো “মা”, নিজের কাঁধে তুলে নিলেন মা’য়ের লাশ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে, হাসপাতালের সামনে মায়ের লাশ নিয়ে ভিক্ষা করলেন সারাদিন। অতঃপর ভিক্ষার টাকা দিয়ে গাড়ী ভাড়া করে মায়ের লাশ বাড়ী নিয়ে গেলেন। (সূত্র: অনলাইন নিউজ) এটা কোন স্যাড সিনেমার কাহিনী নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের রংপুর বিভাগীয় হাসপাতালে গত সপ্তাহে এমন ই এক মর্মান্তিক ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেল। নিয়মিত যারা পত্রিকা পড়েন, তারা হয়ত নিউজটি পড়েছেন।
ঘটনাটির প্রথম অংশ শুনে মর্মাহত হলেও হয়ত এতটা অবাক হন নি। কারন টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের বারান্দায় মারা যাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে বিরল নয় বরং নিয়মিত। কিন্তু বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও , লাশ নামানোর জন্য একটা স্ট্রেচার পেতেও টাকা চাওয়ার ঘটনায় হয়ত সকলেই বেশি মর্মাহত হয়েছেন এবং সেই সাথে অবাক হয়েছেন। নাহ্ অবাক হওয়ার এখানে কিছু নেই। এটাও নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার, সে খবর হয়ত চাপাই রয়ে যায়। লাশ নিয়ে বানিজ্য, নতুন কিছু নয়।
২০০২ ইং সনে আমি পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার পথে রাজনৈতিক প্রতি পক্ষ সন্ত্রাসী দ্বারা হামলার শিকার হয়ে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। কিছু দিন পর সুস্থ হয়ে উঠলাম, হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়ে আসার ঠিক আগের দিনের ঘটনা, সকাল বেলা আমি বেডে শুয়ে আছি। হঠাৎ এক মহিলার চিৎকার করে কাঁদার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি নার্সের অনুমতি নিয়ে নিচে গেলাম। দেখলাম অফিসের সামনে এক মধ্য বয়সী মহিলা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। জড়ো হওয়া উৎসুক মানুষেরা প্রশ্ন করলে, মহিলা প্রলাপ করতে করতে বলল, গতকাল আমার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়লে এখানে নিয়ে আসি। ডাক্তারের ঔষধ খেয়ে ছেলেটা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে। শেষ রাতে মারা যায়। তারা লাশ নিয়ে রেখে দেয়, বলে সকালে নিয়ে যাবে। এখন ওরা আমার ছেলের লাশ দিচ্ছেনা।
আমার ক্লাসমেট এক বন্ধুর বোন ওখানের নার্স ছিলেন। অনেক কষ্টে তাঁকে খুঁজে বের করলাম। তাঁর কাছ থেকে গোঁপনে বিষয়টি জানার চেষ্টা করলাম। তিনি বল্লেন এসব কথা এখানে বলা যাবেনা। একদিন বাসায় এস বলব। আমিও বিপদের মধ্যে ছিলাম তাই আর এত ঘাটাঘাটি করলাম না। অনেক দিন পরে একদিন তাঁর বাসায় গেলাম। ও আমাকে অনেক অজানা কথা জানাল। হাসপাতালের একটা হিংস্র চক্রের নানা অপরাধের কথা জানাল। জানাল সে দিনের কথা। মহিলা ছিল বস্তি থেকে আসা এক অসহায় মা। তাঁর সাথে কোন অভিবাবক ছিলনা। সে সুযোগে ঐ চক্রটি তাঁর ছেলের লাশ নিয়ে লাশ ঘরে রেখে দেয়। সকালে ঐ মহিলা কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করলে সবাই তার ছেলের লাশের কথা অস্বীকার করে। ঐ নার্স জানান হাসপাতালে এই চক্রটি প্রায়ই এই ধরনের দূর্বল, গরীব অভিবাবক দের লাশকে তারা গুম করে ফেলে। রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে এমন রেকর্ডই রাখেনা। এমনকি এই নিষ্ঠুর চক্রের ডাক্তারগন উল্টো পাল্টা চিকিৎসা দিয়ে রোগীদের কে হত্যা পর্যন্ত করে থাকেন। এই চক্র টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার, নার্স, স্থানীয় সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ প্রশাসন ও কতিপয় অসৎ সাংবাদিকদের সমন্বয় গঠিত। সব চলে সু-পরিকল্পিত ভাবে। লাশ গুম করে কখনও নানা ভয় দেখিয়ে অভিবাবকদের কে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কখনও এই চক্রের সদস্যরা লাশ গুম করে নানান বাহানার পরে তাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের কে বোঝায়, যে মরে গেছে, সে তো আর আসবেনা, লাশটা নিয়ে কি হবে ? লাশ নিতে গাড়ী ভাড়া লাগবে অনেক টাকা, তাঁর চেয়ে কিছু টাকা দেই নিয়ে বাড়ী চলে যা, তাতে লাভ হবে। অসহায় অনুপায় গরীব দুস্থ অভিবাবকদের বাদ্য হতে হয় তাঁদের প্রস্তাবে। এই ভাবে বিভিন্ন পদ্ধতিতে এরা লাশ গুলো দখলে নিয়ে পরে তারা এ গুলোকে অনেক বেশি টাকায় বিভিন্ন ভাবে বিক্রি করে দেয়। বেশির ভাগ সময় এগুলো মেডিকেল শিক্ষার্থীরা কিনে নেয়। এই চক্রের হাত থেকে বাদ যায়না কোন কিছুই। হাসপাতালে আসা ঔষধ বিক্রি করে দেয় এরা। রোগীদের কে বাহির থেকে কিনতে হয়। রোগীদের খাবার, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় বরাদ্ধ টাকার প্রায় সবটাই চলে যায় তাদের পকেটে। চলে নামে মাত্র সেবা। এসব টাকা বিভিন্ন হাত ঘুরে চলে যায় রাজনৈতিক নেতা, এমপি, মন্ত্রীদের পকেটে। কখনও কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁর উপরে অপরাধের মুলহোতা এই নেতাদের পক্ষ থেকে নেমে আসে বিভিন্ন করুন নির্যাতন। তাই ভয়ে কেউ কখনও মুখ খোলেনা। মাঝে মধ্যে কোন সাহসী সাংবাদিক বন্ধু কোন রিপোর্ট করলে এই চক্রটি কিছু দিন নিষ্ক্রীয় থাকে। আর তখন এই সাংবাদিক কে ম্যানেজ করার জন্য শুরু হয় নানা প্রক্রিয়া।
হয়ত সাংবাদিক বন্ধু আর এই খবরের ফলো আপ দেন না। আর দেবেনই বা কিভাবে ? এক মানুষের পক্ষে তো জঙ্গলের জানোয়ারদের সাথে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। হয়ত মাটির গর্ত থেকে সাপ বেড়িয়ে পায়ে আঘাত করবে, উপর থেকে বানর লাফিয়ে পড়বে, সামনে দিয়ে বাঘ, পিছনে সিংহ, ডানে বামে হায়েনা কুকুর কত কি।
নার্সের কাছ থেকে জানা তথ্য নিয়ে একটি কলাম লিখে ছিলাম সেই সময় স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা কীর্তনখোলা’র চিঠি পত্র কলামে, আর তা প্রকাশ করে কতইনা ভোগান্তি পেয়েছিল বেচারা সম্পাদক। আমি তো ছদ্ম নাম ব্যবহার করে বেঁচে গিয়েছিলাম।
আজ দেশের কোন হাসপাতাল, ক্লিনিক এই অপরাধী চক্রের কালো থাবার বাহিরে নয়। এই ব্যাপারে মাঝে মধ্যে হলেও দু একটি খবর, প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। খোদ সরকার প্রধানরাও সে খবর পৃষ্ঠা উল্টে এড়িয়ে যায় বলেই নেই কোন পদক্ষেপ। কারন লাভের অংশটাতো তাদের দলের পকেটেই যায়।
বিষয়: বিবিধ
১৬৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন