যে কারনে আমি শফি আহমেদ সাহেবের বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত নই
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মিজানুর রহমান সোহেল ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৬:০৯:২২ সন্ধ্যা
হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফি আহমেদ সাহেবের সম্প্রতি মাহফিলে দেয়া একটি বক্তব্য নিয়ে সারা দেশে বিভিন্ন মহলে আজও আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। তাঁর কথা নিয়ে এ রকম সমালোচনার ঝড় বয়ে যাওয়াটা একটি অতি সাধারন ব্যাপার। কারন, তিনি হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনের নেতা। আর এই আন্দোলনের উপর সরকারের বিতর্কিত আক্রমন বা প্রতিহতের ঘটনা নিয়ে দেশে বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সেই আলোড়নের সুবাদে সকলের দৃষ্টি যায় তাঁর দিকে। যে কোন বিষয়ে এই ধরনের আলোচিত মানুষের প্রতি মানুষের যেমন থাকে আগ্রহ তেমনি মিডিয়ার থাকে সজাগ দৃষ্টি। তাই তাঁর প্রতিটি পাঁ হিসেব করে ফেলতে হয়। আহমেদ শফি সাহেবের বেলায় যেটি ঘটেছে, সেটি হল অসাবধানতা, অ-পূর্নতা ও প্রাচীন অজ্ঞ আমলের আদলে ইসলামের ব্যাখ্যা।
নিশ্চই আহমেদ শফি সাহেব অনেক জ্ঞানী। তাঁর সমালোচনা করার মত ইসলামের বিশেষ এত জ্ঞান আমার নেই। কিন্তু তাঁর প্রদত্ত বক্তব্যের যে কটি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সমাজে আজ আলোচনা হচ্ছে, সে বিষয় কয়েকটি কথা না বল্লেই নয়। কারন তাঁর কয়েকটি কথার সাথে আমি মোটেও একমত হতে পারিনা।
প্রথমেই আসি নারী শিক্ষার ব্যাপারে, তিনি বল্লেন মেয়েদেরকে তৃতীয়/চতূর্থ শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশুনা করিয়ে বন্ধ করে দিবেন। আমি তারঁ এই কথার সাথে মোটেও একমত নই। এবং তাঁর এই কথা সম্পূর্ন ইসলাম পরিপন্থী। কারন, ইসলামে শিক্ষার যথেষ্ট গুরত্ব দেয়া হয়েছে। আমি সাধারন শিক্ষার কথা বাদই দিলাম। আমি তারঁ দাবী মতই দ্বীন শিক্ষার ব্যাপারেই বলছি, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন-“ দ্বীন শিক্ষা অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরজ” আর সে শিক্ষার জন্য প্রয়োজনে বিদেশেও পাড়ি দেওয়ার কথা বলেছেন, সময় নির্ধারন করা হয়েছে কবর পর্যন্ত। এই হাদিসে নারী-পুরুষের কথা আলাদা করে বলা হয়নি। আমার প্রশ্ন, তৃতীয় / চতূর্থ শ্রেনী পাশের মাধ্যমে দ্বীন ইলম অর্জন করা কি আদৌ সম্ভব ? মোটেও নয়। আপনার এই কথা সম্পুর্ন রাসুল (সাঃ) এর হাদিস বিরোধী। আপনি কয়টি ক্লাশ পড়ে আল্লামা শফি আহমেদ হয়েছেন ? ঠিক ততখানি অথবা তার চেঁয়েও বেশি শিক্ষা অর্জন করার অধিকার আপনার মায়ের ছিল, আপনার বোনের ছিল, এবং আপনার মেয়ের আছে(উক্ত হাদিসের ভিত্তিতে) একটি শিক্ষিত সমাজ বা জাতি গঠনে একজন শিক্ষিত মায়ের ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত। হযরত নবী করিম (সাঃ) হাদিস বর্ননার মজলিসে স্ত্রী হযরত আয়েশা (রাঃ)কে উপস্থিত রাখতেন। এবং হযরত আয়েশা (রাঃ)’র মাধ্যমে অসংখ্য হাদিস বর্নিত হয়েছে। নারী শিক্ষার বিকল্প নেই। নারীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কোন মানুষের নেই। ইসলামিক দৃষ্টিতেও তা কোন মুমিন বা মুসলমানের নেই। কারন নারীদের কে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে রাখা ইসলাম পরিপন্থী। আমি পর্দা বিরোধী বা ইসলাম বিরোধী কোন কথা বলছিনা অথবা ব্যক্তিগত আক্রমন থেকে বলছিনা, আপনাদের দেওয়া থিওরী থেকেই প্রাসঙ্গিকভাবে তুলে ধরছি, পর্দা মানে হচ্ছে নারীকে ঘরে আটকে রাখা, তাদের কন্ঠকে চেঁপে ধরা, তাদের শিক্ষাদান অপ্রয়োজনীয় মনে করা, তাদের কাজ হচ্ছে শুধু মাত্র সন্তান লালন পালন, এ রকম পর্দার অপ ব্যাখ্যা যারা দিচ্ছেন আর সেই পর্দার দোহাই দিয়ে যারা মেয়েদেরকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে রাখছেন, এমনকি শিক্ষাগ্রহনেরও সুযোগ দিচ্ছেন না, এই রকম চরমপন্থী, উগ্রবাদীদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, তোমাদের মায়ের কিংবা বোনের অথবা মেয়ের যখন কোন জটিল অসুখ হয় এবং সেটা যদি হয় কোন মেয়েলী রোগ, তখন তোমরা কেন একজন নারী ডাক্তার খোঁজ ? যাতে তোমাদের মা বোনদের পর্দার খেলাপ না হয় ? কেন পাঠিয়ে দেওনা একজন পুরুষের কাছে, যে কিনা তাঁদেরকে উলঙ্গ করে লজ্জা স্থানের চিকিৎসা করে দিবে ? তোমাদের থিওরিতেই আসি, নারীদেরকে তৃতীয়/চতূর্থ শ্রেনী পর্যন্ত লেখা পড়া করিয়ে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে দিলাম, পৃথিবীর সব দেশেই এটা করা হল, কি দাড়াল ??? পৃথিবীর কোথাও একটা নারী ডাক্তার , কোন নারী শিক্ষিকা অথবা কোন বিষয়ে একজন নারী বিশেষজ্ঞ খুঁজে পাওয়ার কথা নয়, তাইনা ? এখন বলুন একজন পুরুষের কাছে পাঠিয়ে পর্দার সহিত আপনার মা বোনদের চিকিৎসা কিভাবে সম্ভব ? একজন অশিক্ষিত মায়ের দ্বারা সঠিকভাবে সন্তান লালন পালন কিভাবে সম্ভব? তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষা কে দেবে আপনার মেয়েকে ? মক্তবের হুজুর ? সেওতো একজন পুরুষ, জীবনের শুরুতেই আপনি আপনার মেয়েকে পাঠালেন একজন পুরুষের সংস্পর্ষে। এই আপনাদের পর্দা থিওরী ? যা পর্দার নুন্যতম মান বা শর্তটুকু বজায় রাখতে সক্ষম নয়।
যে ইসলামের হেফাজত আপনি করতে চাচ্ছেন, আপনার বক্তব্য সেই ইসলামী বিধানের সাথেই সাংঘর্ষিক। আপনি হয়ত বলতে পারতেন, মেয়েদেরকে পর্দার সাথে নারী শিক্ষীকা দ্বারা আলাদা শিক্ষার ব্যবস্থা চালু করার কথা। যার মাধ্যমে নারীরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীদের কল্যানে অবদান রাখতে পারে এবং তৈরি হতে পারে নারীদের জন্য নারীদের পরিচালনায় আলাদা একটি সেক্টর। যা সাহায্য করবে নারীদের স্বাবলম্বী হতে ও পর্দা রক্ষায়। তখন গার্মেন্টস বলেন আর যাই বলেন চাকুরীর ক্ষেত্রে নারীরা পর্দা মেনেই কাজ করতে পারবে। শিক্ষার ফলে যখন নারীরা যোগ্যতা অর্জন করবে, তখন নারীরা হবে গার্মেন্টসের মালিক, নারীদের স্বার্থে সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী হিসেবে সে নিয়োগ দেবে নারীদেরকে, ব্যস হয়ে গেল। এতে পর্দার কি সমস্যা? কেন আপনারা নারীদেরকে শিক্ষিত হতে দিতে চান না ?
আসি তেতুল প্রসঙ্গে, আপনি মেয়েদেরকে তেতুলের সঙ্গে তুলনা করলেন। সত্যিই তেতুল এমন একটি ফল, যার নাম শুনলেও সংক্রিয় ভাবে জিহ্বায় পানি(লালা) চলে আসে। সততার সাথে বলছি এই তেতুল শব্দটি লেখার মুহুর্তেও আমার মুখে পানি চলে এসেছে। বিষয়টি আমার মাঝে ঘটেছে। সে খবর তেতুল বা তেতুল গাছ জানেও না। কারন ফ্রান্সে তেতুল গাছতো দূরের কথা কিনতে পাওয়টাই দুরহ ব্যাপার। যাইহোক এখানে তেতুলের কি দোষ ? বরং আমি মনে করি এটা তেতুলের গুন। আপনি নারীদেরকে তেতুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন, এবং তাদের দেখলে পুরুষেরএ তেমনি হয়। আমি আপনার সাথে সম্পূর্ন একমত। কারন নারী দেখলে বা নারীদের সংস্পর্শে এলে পুরুষের ঠিক লালা না ঝড়লেও মানসিক একটা পরিবর্তন বা চাহিদার মাধ্যমে একটা আকর্ষনের সৃষ্টি হয়। আর এটা তাদের একটা গুন। সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং তাদেরকে এ রকম আকর্ষনীয় করে সৃষ্টি করেছেন, যাতে প্রতিটি পুরুষ, রাজা বাদশাহ যাই হোক নারীর কাছে এসে নমনীয় হয়। ভালবাসায় প্রচন্ড আগ্রহে তাঁদেরকে আপন করে নেয়। তুলনামূলক দুর্বল নারী জাতির এই গুন বা আকর্ষনীয়তা দিয়ে শক্তিশালী পুরুষ জাতিকে নারীর প্রতি দুর্বল করে সমতার সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু শফি আহমেদ সাহেব নারীদেরকে তেতুলের চেয়েও খারাপ বলেছেন। আমি আপনার এই কথাটির সাথে মোটেও একমত নই। কথাটি বলা মোটেও উচিত হয়নি। কারন, এখানে খারাপ শব্দটি ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। খারাপের কি আছে ? খারাপ বল্লেন কোন অপরাধে ? তেতুল বা নারীদের প্রতি আকর্ষন, এই গুনটাতো আল্লাহ প্রদত্ত। তাদের কি দোষ? এখানে খারাপের কি দেখলেন? যদি খারাপের কিছু দেখে থাকেন, তাহলে সেটা যাদের লালা ঝড়ে তাদের কে বলুন। যেহেতু আপনি নারীদের তেতুলের মত আকর্ষনীয় বা লোভনীয় বলেছেন, সেক্ষেত্রে আপনি তেতুল দিয়েই উদাহরন দিতে পারতেন, যেমন সেই লোভনীয় তেতুলটি একটি আবরন (খোসা) দিয়ে আবৃত থাকে তেমনি এই আকর্ষনীয় নারীদেরও প্রটেকশনের জন্য ইসলামিক কোড মেনে পোশাক পড়ে চলাফেরা করার পরামর্শ দিতে পারতেন। আমি আগেই বলেছি তাঁর বক্তব্য ছিল অপূর্ন। কারন তিনি তেতুলের বর্ননা দিয়েছেন, কিন্তু ঠিক একই সময়ে তেতুল দেখে যাদের লালা ঝরে তাদের করনীয় ব্যাপারে তিনি কিছু বলে সমন্বয় করেননি। তিনি শুধু তেতুলকে ঘরে আটকে রেখে সুরক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন কিন্তু তেতুল দেখে যাদের লালা ঝরে তাদের কে যে আল্লাহ পাক কুরআনে লালা গিলে খেতে বলেছেন অর্থাৎ পুরুষদেরকে দৃষ্টি অবনত রাখতে বলেছেন, নারীদের উপড় থেকে কু-দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বলেছেন, নিজের কু বাসনাকে সংযমের মাধ্যমে সংযত রেখে নারীদের কে সম্মান করতে বলা হয়েছে সে কথা বলতে ভুলে যাওয়ার মাশুলই হচ্ছে আজকের এই সমালোচনা। আজকের ধর্ষনসহ যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনার দায় শুধু নারীদের একার নয়। আর নারীদেরকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে এর সমাধান ইসলাম দেয়নি। সূরা নুরের ৩০ নং আয়াতে পুরুষকে প্রথমে দৃষ্টি অবনত রাখতে বলা হয়েছে অতপর ৩১ নং আয়াতে নারীকে শালীনভাবে জীবনযাপন বা পর্দা করার কথা বলা হয়েছে। নারীদের পর্দার ওয়াজই কেবল শোনা যায়, কিন্তু পুরুষদের ও যে পর্দা করার শর্ত ইসলামে দেয়া আছে সে ওয়াজ খুব কমই শোনা যায়। আমি বলছিনা মেয়েরা সমাজে উলঙ্গ হয়ে চলুক, না সেটা কোন সভ্য সমাজ সমার্থন করেনা, পৃথিবীতে প্রচলিত কোন ধর্মই সেটা সমার্থন করেনা। আমি শুধু বলতে চাই, ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে ভারসাম্য বজায় রেখে সমাধান দিতে হবে। শুধু নারীকে চার দেয়ালে আটকে রেখে নয়, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী পুরুষ জাতিকে ঠিক হতে হবে, তাদের ধর্মীয় অনুশাসন মেনে সমাজে নারীদেরকে স্বাধীন ও অবাদ চলাচলের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। অন্যথায় বোরকা বা চার দেয়াল কেন কবরে গিয়েও নারীরা রক্ষা পাবেনা। যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে এই ব্যাপারে বরাবরই এবং বেশিরভাগ সময় ভারসাম্যহীন ভাবে ইসলামের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে নারীদেরকে ইসলামের দেয়া অধিকার ও মর্যাধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
আমিও শফি আহমেদ সাহেব হুজুরকে তাঁর এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার অনুরোদ জানাচ্ছি, কারন তাঁর নারী শিক্ষা বিরোধী বক্তব্য, দেশে বিদেশে যতগুলো অন্তত মহিলা মাদ্রাসা আছে নারীকে পর্দার সাথে শিক্ষাদানের জন্য, সেগুলোর উদ্যোক্তা,পরিচালকবৃন্দ ও শিক্ষক/শিক্ষীকাদেরকে অসম্মান করারও শামিল।
রাষ্ট্রে নারীদেরকে অপমান, তাদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন, যৌতুক, ইভটিজিং, ধর্ষন,খুন প্রভৃতির ব্যাপারে যে আইন আছে তাঁর যথাযথ প্রয়োগের জন্য কঠোর আন্দোলন করুন, অথবা নারীদের উপর এইসব অত্যাচারের শাস্তি হিসেবে আরো যদি কোন কঠোর আইনকে যথাযথ মনে করেন সে ব্যাপারে সরকারকে নীতিমালা দিন। এবং তা বাস্তবায়নে সরকারকে চাপ প্রয়োগে বাদ্য করুন।
পৃথিবীতে ইসলামী আন্দোলনের নামে হাজার হাজার সংগঠন রয়েছে। যার বেশিরভাগই পরিচালিত হচ্ছে চরম পন্থা অবলম্বনে এবং ইসলাম তথা রাসুল পাক (সাঃ) এর মূল আদর্শ থেকে সড়ে এসে মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে। যা যে কোন মানুষের জন্য বিপজ্জনক।
হাজার হাজার অসমাপ্ত মনগড়া কথা বলে রাত পার করে দিয়ে কোন লাভ নেই বরং সেটা শুধু মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। না জানলে বা না পারলে চুপ থাকুন। আর যদি পারেন প্রয়োজনে একটি কথা বলুন এবং তাঁর সামগ্রিক দিক তুলে ধরুন। মানুষের অকল্যানকর কোন কথা বা থিওরী দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
বিষয়: বিবিধ
১৩৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন